Interviews, Speeches

রিফাত হাসান

আমার ইসলাম প্রশ্ন

September 25, 2023   0 comments   12:17 am
Rifat Hasan is giving speech
ভাববৈঠকি-৪ এ ইসলাম প্রশ্ন নিয়া প্যানেল বক্তৃতা দিচ্ছেন রিফাত হাসান।

তো, ফরহাদ ভাই যখন বলেন, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অপরাপর লক্ষ্যগুলোর একটা রবীন্দ্রনাথকে অর্জনও। তার বিপরীতে, আমি, প্রায় প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথ ও বিএসএফ এর খুনোখুনি পড়ি, সীমান্তে। মানে, ফরহাদ ভাইয়ের এই রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠটির সাথে আমার সীমান্তে আমাকে প্রায়ই রক্ত দিয়ে লড়তে হয়। মানে, মুক্তিযোদ্ধারা যে মুক্তিযুদ্ধ কইরা রবীন্দ্রনাথকে অর্জন করেছেন, ফরহাদের মতে, সেই রবীন্দ্রনাথই আমারে রাষ্ট্রে আর সীমান্তে এই মুহূর্তে লাঠিয়াল হয়ে জমিদারি করেন। নিশ্চয়ই, ফরহাদ ভাইয়ের সেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ক্রিটিক আছে, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠেই। সেই ক্রিটিকের সাথে আমার এই আলাপটাও তোলা জরুরি মনে হল। আমার এই আলাপে বেশ প্রশ্ন থাকবে। বা প্রশ্নগুলোই আলাপ। আলাপ ইটসেলফ সুরাহা না।

Share

[ভাববৈঠকি-৪ এ ইসলাম প্রশ্ন নিয়া রিফাত হাসানের প্যানেল বক্তৃতার অনুলিপি এই লেখা। ৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখে, রিদয়পুর, টাঙ্গাইলে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয় । মানস চৌধুরী, তুহিন খান, মোহাম্মদ আজম এবং মনোওয়ার শামসি সাখাওয়াত এই আলোচনায় সহ-প্যানেল আলোচক ছিলেন। আর সভাপতি ছিলেন ফরহাদ মজহার। রিফাত হাসানের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল Thoughts With Rifat Hasan এ পুরো বক্তৃতার ভিডিও দেখা যাবে।]

আসসালামুআলাইকুম। এখানে, আমার দুই পাশে অধ্যাপকবৃন্দ বসে আছেন, এই ঘটনাকে সামনে নিয়েই আমি কথা বলা শুরু করতেছি। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক ব্যাপারটা নিয়ে একটা ভয় আছে আমার। সেটা হচ্ছে, পথে দেখা হল আপনার, সাথে সাথে আপনারে দাঁড় করিয়ে ট্রান্সলেশন এলেম যাছাই করে নিলেন। যখন আপনি তার উত্তর দিতে পারলেন না, ভয়ে থাকলেন। তো, এইসব ভয় আর সংকোচ নিয়াই শুরু করছি আর কি।

আমার ঘটনা হচ্ছে, ঠিক অধ্যাপকবৃন্দের মত করে ক্লাস পারফর্মেন্সের অভিজ্ঞতা আমার নেই, বা এই ধরনের অনুষ্ঠানে আলাপের অভিজ্ঞতাও। সেজন্য অনেক সময় আমি দেখে দেখে কথা বলবো। সরাসরি কথাও বলার চেষ্টা করবো। আমি আসলে, তুহিন খানের যেইটা নোট, তা লিখিত ফর্মে চাইতেছিলাম, যাতে এইটা নিয়ে আমার আলাপগুলো ভাইবা নিতে পারি। শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ রোমেল এইটা আমাকে দিতে পারলেন না। যার কারণে আমি এখানে আসার ঠিক আগে কিছু কুইক নোট করেছি, সেই নোটগুলোই আমি পড়ার চেষ্টা করবো। এই ঘটনা যদি আপনাদের কোন বিব্রতবোধ তৈরী করে, আমাকে ক্ষমা করবেন। পরে, প্রশ্নোত্তর থাকলে আরো কথা বলা যাবে।

একটা কথা শুরুতে বলে নিই। আমরা আসলে এখানে এসেছি, কারণ আমাদের মূলত কিছু তর্ক আছে। এবং আমি একটা কথা বলি প্রায়ই, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ভেতরে কোন তর্ক থাকে, ততক্ষণ আমাদের ভেতরে একটা প্রেম সম্ভাবনা থাকে। তর্ক শেষ হওয়ার পরে আমাদের কোন প্রেম থাকে না। তাই, আমি তোমার লগে তর্ক খুঁজি। এহ মোর দৈন্য। মানে, তর্ক যখন শেষ, তখন প্রেমেরও পরিসমাপ্তি। অর্থাৎ, আপনার ব্যাপারে আমার কোন আকর্ষণই আর থাকে না। সুতরাং আমি তর্কটা জারি রাখতে চাই। এবং এখানে যারা আছেন, আমার খুবই শ্রদ্ধেয়জন ফরহাদ ভাই আছেন, যার সামনে আমি কথা বলতে খুবই সংকোচ বোধ করি। ফরহাদ ভাই এমন একজন বড় মাপের মানুষ, যার সামনে আমরা আসলে একজন ছাত্রের মতো, সব সময়।

আমি তারপরও শুরু করছি। আমার আলাপগুলোকে আমি কয়েকটা ছোট ছোট পর্বে সাজিয়েছি।

প্রথম যে নোক্তা দিয়ে শুরু করছি, তা হল, আজকে আমাদের আলাপের শিরোনাম হল ইসলাম প্রশ্ন। আমরা যে এখানে আজকে ইসলাম প্রশ্ন নিয়া আলাপ করছি, করতে পারছি, এইটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে খুবই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। মনে হয় প্রথম ফরহাদ ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনেছি। বাংলাদেশে সেকুলার মহলে ‘ইসলাম প্রশ্ন’ শব্দটি পরিচিত করিয়েছেন ফরহাদ মজহার। এর আগে কেউ ইসলাম নিয়া কোন আলাপরে ‘ইসলাম প্রশ্ন’ আকারে হাজির করে নাই আমাদের সামনে। আমরা এর বাইরে মওলানাদের ওয়াজ শুনেছি, পীর সাহেবদের কথাবার্তা শুনেছি, নানান রকম একাডেমিশিয়ানদের বয়ান শুনেছি, কিন্তু এইটারে যে আমাদের এখানে একটা প্রশ্ন আকারে হাজির করার ঘটনা, এইটা ফরহাদ ভাই আমাদেরকে প্রথম শুনিয়েছেন। আর ইসলামী মহলে কোন ‘ইসলাম প্রশ্ন’ ছিল না। ফলে, এই আলাপটি মূলত সেকুলার মহলের আলাপ। তেমন কইরা ইসলামী মহলের না। আর, যেহেতু ফরহাদ ভাইয়ের ইন্ট্রোডাকশন, আমাদের এই আলাপে ফরহাদ ভাইয়ের নাম অনেকটাই ঘুরে ফিরে আসবে। এইটা আপনাদেরকে, এমন কি ফরহাদ ভাইকেও মেনে নিতে হবে আর কি।

১.

ফরহাদ ভাই নিজের পরিচয় দেন মার্কসের ছাত্র বইলা। আমি মার্কসের ছাত্র না। কিন্তু, আমি, কোন এক সময় তরুণ মার্কসের ‘ইহুদি প্রশ্ন’ যখন পড়তেছিলাম, তখন ইহুদি প্রশ্ন নিয়া জার্মান ভাবুক ব্রুনো বাওয়েরের আলাপগুলোরে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সাজিয়ে নিয়ে পড়তেছিলাম। যেমন, বাওয়ের যখন বলেন, খ্রিশ্চিয়ান রাষ্ট্রে ‘পলিটিক্যাল ইমানসিপেশনে’র জন্য ইহুদিদেরে নিজের ধর্ম ছাইড়া আসতে হবে। তখন, আমি এই ‘ইহুদি’র জাগায় ‘মুসলমান’ পড়ি, আর ‘খ্রিশ্চিয়ান স্টেইটে’র জাগায় পড়ি, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র’। পুরো বাক্যটা হয়, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ‘পলিটিক্যাল ইমানসিপেশনে’র জন্য মুসলমানদেরে নিজের ধর্ম ছাইড়া আসতে হবে’। মানে, আমার কখনোই মনে হয় নাই যে, বাংলাদেশ নামের একটা রাষ্ট্র আর তার একটা ‘রাষ্ট্রধর্ম’ আছে, যার নাম ‘ইসলাম’। বাওয়ের বা মার্কস যত সহজে জার্মানিরে খ্রিশ্চিয়ান স্টেইট হিশেবে বলতে পারতেছিলেন। পত্রিকায় প্রকাশের সময়ে যখন পড়ি, তখন সেভাবে খেয়াল করি নাই, পরে, যখন ফরহাদ ভাইয়ের মোকাবেলা পড়তে যাই দ্বিতীয়বার, ফরহাদ ভাইয়ের মোকাবেলা, একটা বিখ্যাত বই আছে, দেখি কি, ফরহাদ ভাইও আমার মতন কইরাই রূপকল্প সাজিয়ে নিয়ে পড়ার একটা মহড়া দিয়েছেন। কিন্তু অন্যরকম। আমি ইহুদির জাগায় মুসলমান বসিয়েছি। ফরহাদ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান।

স্বভাবত তাই তো হওয়ার কথা। মানে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টানের আলাপই আসার কথা ছিল।

ইউরোপে, বা অন্ততপক্ষে তখনকার জার্মানের আলাপেই যদি আসি, তখন ইহুদিরা সংখ্যালঘু ছিল। তারে লইয়াই মার্কসের আলাপ। আর বাংলাদেশে তো আসলে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। এবং সেই সময়ে, জার্মানে ইহুদি একটা সমস্যা আকারে হাজির ছিল, যার সমাধান খুঁজতে জার্মান রাজনীতি থিকা শুরু কইরা ভাবুককুল নানানরকম আলোচনায় মরিয়া ছিল। সবশেষে, নাজি-রা হলোকাস্ট দিয়া তার একটা সমাধান করে। আর ভাবুকরা? বাওয়েরের আলাপটা তার থিকাই শুরু। পড়তে গিয়ে আমার মনে হইতেছিল, বাওয়েরের আলাপও নাজিদের কাছাকাছি। যে, ইহুদিরা তাদের ধর্ম যদি না ছাড়ে, তাহলে তাদের মুক্তি, মানে যে রাজনৈতিক মুক্তির কথা হইতেছে, তা সম্ভব না। বাওয়ের অবশ্যই আরো অনেক গভীর আলাপ করেছেন। এই ছোট পরিসরে তার সবটা আলাপ আনতে গেলে বেশ বড় হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার কেন মনে হইল, এই আলাপটাতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান না এসে ‘ইসলাম’ বা ‘মুসলমানরে’ নিয়া আসতে হবে? ইহুদিরা তো জার্মানিতে সংখ্যালঘু, কিন্তু এইখানে তো মুসলমানেরা সংখ্যালঘু নয়। এইখানে তো মুসলমানেরা রীতিমত ‘সংখ্যাগুরু’।

২.

তো, এই যে আমার ভেতরে একটা ‘মুসলমান’ নিয়ে আসার, বা ‘ইসলাম’ নিয়ে আসার আকুতি তৈরী হল, বা ভেতর থেকে আসল, এই আলাপটা যে তৈরী হল, এইটাই মুলত আসলে, আমার আজকের আলাপের বিষয় হইতে পারে আর কি!

যেমন, আমি দেখলাম, আমাদের এখানে, যেমন তুহিনের আলাপ শুনতেছিলাম, তুহিন একটা অপরায়নের সমস্যার কথা বলতেছিলেন, ইসলাম প্রশ্ন নিয়া তিনি যা ভাবেন, তা বোঝাতে গিয়ে। মানে হচ্ছে, আমরা যখন ইসলাম প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করি, এর পপুলার অর্থটি এখানে এভাবে হয় যে, এখানে মুসলমান ও ইসলাম ব্যাপারটার একটা অপরায়ন হইতেছে, এই ধরনের একটা পাঠ, এবং সেই অপরায়নের মোকাবেলার আলাপ। মানে, ‘ইসলাম প্রশ্ন’ শব্দটা নিয়া আমাদের পপুলার ভাবনাটা এই জায়গা থিকাই। তার উদাহরণ তুহিন থেকে দিলাম।

এই ঘটনা কেন ঘটল?

তাহলে কি আমাদের একটা মুসলমান প্রশ্ন তৈরী হয়েই ছিল?

‘ইসলাম প্রশ্ন’ না, মনে রাইখেন, ‘মুসলমান প্রশ্নে’র কথা বলছি।

নাকি আমার মনের ভূত! হা হা, আমার মনের ভূত যদি হয়ও, তার জন্য ফরহাদ ভাইদেরেও কিছুটা দায়ী করার, অন্তত উসকে দেওয়ার লোভ বোধ হয় এখন আইসা আর সম্বরণ করা উচিৎ হবে না আমাদের।

উনিশ শ একাত্তর সালে, আমি এইটারে বলি, নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের বাংলাদেশ বিপ্লব। এই বাংলাদেশ বিপ্লবের পরে ফরহাদ ভাইরে আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর একটি বইলা সম্বোধন করি। সেজন্য ফরহাদ মজহার নিয়ে আমাদের আলাপগুলো করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর কি। ফরহাদ মজহারের আলাপগুলো, ফরহাদ মজহার কীভাবে কোন প্রশ্ন তোলেন, তারে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করবো, সেই ধরনের একটা ব্যাপার আমাদের দিক থেকে তো আছেই।

তো, আমার উসকানি হইল, ফরহাদ ভাইয়েরা ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশ তৈরী করেছেন, তাতে ‘মুসলমান’ হিশেবে আমার অবস্থানরে ‘অপর’ আর সংখ্যালঘুর মত কইরা রাখা হইছে। মানে, সংখ্যালঘু ব্যাপারটা স্রেফ সংখ্যার ব্যাপার আর রইল না আর কি। আদতেই কখনো ছিল না। লঘু মানে তো আধিপত্যের অধীনে আপনারে লঘু করে রাখা হইছে, সেই ঘটনা। এইটা কোন সংখ্যায় লঘুত্বের ঘটনা।

১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক অভিজ্ঞান হিসেবে। তারো আগে আক্ষরিক অর্থে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ঘটে ১৯৪৭ সালে। এসবই ইতিহাস। নজর দিলে দেখা যায়, এইসব ইতিহাসেরই গভীর গোপনে একটি আধিপত্যবাদি ও বর্ণবাদী কুশীলব হাজির ছিল। উপনিবেশের আদলে ও সুবিধাভোগী হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর স্রেফ অনুকরণে এই ভূখণ্ডে হঠাৎ যে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ, ইতিহাসের এই বর্ণবাদী কুশীলবের বীজ সেখান থেকেই। যারা দৃশ্যত এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে সবসময় সুবিধাবাদি ও আপোষকামি। ফলে বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ–হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভিতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়েন ও শক্তির জায়গাগুলোকে অস্বীকার ও ঘৃণা করে পুরোপুরি এলিয়েন হয়ে।

ফলে, উনারা যে রাষ্ট্র তৈরী করেছেন, তাতে, আমি বলি যে, রাষ্ট্র নেই। আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই রবীন্দ্রসংগীতটি কেমন? তা বোঝার জন্য আমি দুইটি ঘটনার উল্লেখ করেছি সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি বইয়ের ভূমিকাতে। প্রথম ঘটনা, ১৮ জুলাই ২০০৮। সেই সময় বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর গুলিতে খুন হন কয়েকজন বিজিবি সদস্য। তখন, এই খুনোখুনিরে লইয়া একটি কুইক নোট লিখেছিলাম: রবীন্দ্রনাথ ও বিএসএফ এর খুনোখুনি। সেই লেখাটির সময় আমাকে আন্দোলিত করেছে দুটি তাৎপর্যময় ছবি। একটি হল, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হান্নান সরকার আর কৃষ্ণপদ দাস এর লাশ। প্রথম আলো পত্রিকায় তার বিবরণে লেখা ছিল: ‘হান্নানের চাকরীর বয়স ছিল আর চার বছর। অবসরের পর হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার’। অন্য ছবিটি হল, বাংলাদেশের সেই সময়কার আলোচিত সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের একটি ছবি, তাঁর স্ত্রী নাজনীন মঈনের সাথে কমলাটে শান্তিনিকেতনী উত্তরীয় পরে শান্তিনিকেতনের গেইটে সাংবাদিকদের সামনে পোজ দিচ্ছেন। চোখে কালো সানগ্লাস। প্রথম আলো পত্রিকায় তারও একটি ক্যাপশন দেওয়া হয়েছিল: ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল শান্তিনিকেতন দেখার।  আমার শৈশবের সেই স্বপ্ন পুরণ হলো আজ’। আপনি চমকে উঠবেন পড়তে পড়তে।  কারণ দুই প্রান্তে দুজনের স্বপ্ন। পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে, একজনের আশৈশব স্বপ্ন পুরণ হলো অন্যজনের রক্তের দাগের উপরে দাঁড়িয়ে। আর হান্নান সরকারদেরকে স্বপ্ন দেখার মূল্যই দিতে হয় কয়েকশতবার করে। একবার সীমান্তে বিএসএফর কাছে জীবন দিয়ে, আর বহুবার দেশীয় শাসক শ্রেণীর কাছে আসামি হয়ে।  কথাটি আমার মনে পড়ে প্রায়ই।

দ্বিতীয় ঘটনা, জেলখানায় জামাত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রবীন্দ্রসংগীত গাইতেছেন। এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সেই সময়কার আওয়ামীলীগ নেতা গোলাম মওলা রণি, তার কারাগারের দিনলিপিতে। তিনি সেখানে জামাতের শীর্ষ নেতা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার গলায় মধুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিবরণ দিয়েছেন, যা অবাক হবার মত। রণির বয়ানিতে মোল্লা সাহেবের গলার স্বর কতটা মধুর, তার গান কোন জাদুতে কারাগারে মানুষদের টেনেছে, সে ব্যাপারটি আমার আগ্রহের জায়গা ছিল না। বোধ হয় তার গানের কণ্ঠ ভালই ছিল, রনির জবানি তাই বলে। আমার আগ্রহ অন্য, যে কারণে এই বিবরণীটির কথা এখানে কওয়ার লোভ সামলানো গেল না। সেটি হল, এই ঘটনায় আমাদের পূর্বধারণাই প্রবল হয়েছে। জামায়াত শিবির যদি রবীন্দ্রবিরোধী হয়েই থাকে, তা রাজনৈতিক নহে। সাম্প্রদায়িকও নয়। সাংস্কৃতিক অনভ্যস্ততা মাত্র, যা রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্রবলয়ের ফাঁসির কারাগারে বসেও তাকে মধুর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বাঁধা দেয় না।

মানে, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ইসলাম সব যে রবীন্দ্রসংগীতে মজেছে, তা রবির যে মহাভারত, তার রাজনৈতিক পাঠ নিতে অক্ষম। সীমান্তের লাঠিয়াল আর রাষ্ট্রের যে জমিদারবাবু, তারে পরখ করতে অক্ষম। স্রেফ ভাবালুতা, যা ফাঁসির মঞ্চে রবিবাবুর গান শুনতে বাধা দেয় না।

আমি এইটারে বলি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ।

তো, প্রশ্ন হল, এই রবীন্দ্রনাথ কে, যিনি নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এমন প্রাতঃস্মরণীয় হলেন?

রবীন্দ্রপাঠ শিরোনামে আমার একটা কবিতা আছে। সেটি হল, সন্ধ্যা হচ্ছে। আমরা পরস্পর মুখোমুখি বইসা আছি। আমি ও আমার প্রেমিকা। আমি, আমার প্রেমিকাকে বোঝাচ্ছি, গীতাঞ্জলীর কোন একটা স্বরলিপির কথা। তো, সব কথা শেষ হবার পর, প্রেমিকা আমার কাছ থেকে জিগেশ করছে, কে রবীন্দ্রনাথ?

তো, এই রবীন্দ্রনাথটা কে, তা বোধ হয় ফরহাদ ভাই থেকেই শুনতে পারি আমরা। আসেন, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ থিকা পড়ি:

‘স্বাধীনতা অর্জন করার লক্ষ্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও একটা প্রচ্ছন্ন লক্ষ্য হিশেবে হাজির ছিলেন। তাঁকে রাজনৈতিকভাবে অর্জন করতে হইছে আবার। তার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা যখন রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তখন প্রতিটি অক্ষরের গা থেকে রক্তের দাগ মুছে মুছে পড়ি।’

এই যে রক্তের দাগ, এইটা কোন রক্ত? একাত্তরে যারা শহীদ হইছেন, তাদের রক্ত। ফরহাদের মতে, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠে মোটামুটি এই কথাটিই বলেছেন ফরহাদ, রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্রনাথকে শিল্প সংস্কৃতি থেকে মুছে দেওয়ার পাঁয়তারার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথকে অর্জন ও পুনপ্রতিষ্ঠার লড়াই করতে হয়েছে এদেশের জনগনকে। ফলে, এই লড়াইয়ের অংশ হিশেবেই নতুন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হল রবীন্দ্রনাথের একটি কম গুরুত্বপূর্ণ গান। আর এই রক্ত হল সেই লড়াই সংগ্রাম ও ত্যাগের রক্ত।

তো, ফরহাদ ভাই যখন বলেন, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অপরাপর লক্ষ্যগুলোর একটা রবীন্দ্রনাথকে অর্জনও। তার বিপরীতে, আমি, প্রায় প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথ ও বিএসএফ এর খুনোখুনি পড়ি, সীমান্তে। মানে, ফরহাদ ভাইয়ের এই রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠটির সাথে আমার সীমান্তে আমাকে প্রায়ই রক্ত দিয়ে লড়তে হয়। মানে, মুক্তিযোদ্ধারা যে মুক্তিযুদ্ধ কইরা রবীন্দ্রনাথকে অর্জন করেছেন, ফরহাদের মতে, সেই রবীন্দ্রনাথই আমারে রাষ্ট্রে আর সীমান্তে এই মুহূর্তে লাঠিয়াল হয়ে জমিদারি করেন। নিশ্চয়ই, ফরহাদ ভাইয়ের সেই জমিদার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ক্রিটিক আছে, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠেই। সেই ক্রিটিকের সাথে আমার এই আলাপটাও তোলা জরুরি মনে হল। আমার এই আলাপে বেশ প্রশ্ন থাকবে। বা প্রশ্নগুলোই আলাপ। আলাপ ইটসেলফ সুরাহা না।

যেমন, প্রশ্ন করি, এই যে রবীন্দ্রনাথরে অর্জনের লড়াই, এই লড়াইটা কারা করল? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত? বাংলাদেশের চাষা ভুষো মুক্তিযোদ্ধারা কি রবীন্দ্রনাথরে চিনত? মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে? বুদ্ধিজীবীরা? পাকিস্তানি শাসকদের রবীন্দ্রবিদ্বেষের, সাম্প্রদায়িকতার ভার নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নেবে কেন?

৩.

এই হল বাংলাদেশ রাষ্ট্রে মুসলমান ও মুসলমানি চিহ্ণের অপরায়ন নিয়ে আমাদের যে আলাপ শুরু করছিলাম, তা। আপাতত এই নিয়া আলাপ এর চেয়ে বিস্তার না করি এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে, কারণ আমাকে অলরেডি মোহাম্মদ আজম ইশারা দিচ্ছেন সময় সংক্ষিপ্ততার। আমাকে মাত্র পনের মিনিট সময় দেওয়া হয়েছে, যদিও আমি বলেছিলাম, আমার চল্লিশ মিনিটেও শেষ না হয় যদি, থামাতে পারবেন না। তাও, আমি সংক্ষিপ্তে শেষ করার চেষ্টা করছি।

এই অপরায়নের পর, যার কারণে ২০১৩ সালে ঢাকার বুকে মাদ্রাসার ছাত্রদের যে উচ্ছাস, তার গুরুত্ব অপরিসীম। এই উচ্ছাস ছিল এই অপরায়নের বিরুদ্ধে। যেইটারে আপনারা ‘হেফাজতের উচ্ছাস’ বলেন, ফরহাদ ভাই বলছিলেন বোধ হয়। স্মৃতি থেকে বলছি। ভুল হতে পারে।

কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, ফরহাদ কোন মুসলমান প্রশ্ন তোলেন না। তোলেন ‘ইসলাম প্রশ্ন’।

তাহলে, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, ইসলাম প্রশ্ন ব্যাপারটা কেমন?

ফরহাদের কোট: ‘আমার কাছে ধর্ম, বিশেষভাবে বর্তমান বাংলাদেশ ও বিশ্বের বাস্তবতায়, ‘ইসলাম’ ডাকনাম নিয়ে যা কিছু হাজির, তার সঙ্গে মোকাবেলা খুবই বড়ো এবং জরুরি একটি কাজ।’/ মোকাবেলা প্রথম সংস্করণ বোধ হয়। ‘সব সময়ই আমার আগ্রহ রাজৈতিকভাবে সক্রিয় ভাব ও দর্শনের প্রতি’। এই জায়গা থিকা ফরহাদ ভাই নদীয়ার ভাব আন্দোলনের কথাও বইলা থাকেন। এখন একটু বেশিই বলেন।

কিন্তু ফরহাদ পরে, আবার অন্য প্রশ্ন করছেন, মাদ্রাসা শিক্ষিত তরুণদের, যারা ‘ইসলাম প্রশ্ন’ শব্দ ব্যবহার কইরা আলাপ করতে চান, তারা ‘ইসলাম প্রশ্ন বোঝেন না’। ‘ইসলাম প্রশ্ন’ কেন করেন তারা?

‘লক্ষ্য করেছি মাদ্রাসার তরুণদের মধ্যে একটা নতুন স্তরের জন্ম হয়েছে যারা সেকুলারদের ভাব, ভাষা জিজ্ঞাসা অনুকরণের চেষ্টা করে। ‘ইসলাম প্রশ্ন’! যেমন। কার্ল মার্কস ব্রুনো বাউয়েরের সঙ্গে ধর্ম ও আধুনিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার করতে গিয়ে ‘ইহুদি প্রশ্ন’ (On the ‘Jewish’ Question) লিখেছিলেন। সেই দিক থেকে বাংলাদেশে রানা দাশ গুপ্তদের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদের দাবির আলোকে ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’ বা ‘খ্রিস্টান’ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। হওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ইসলাম প্রশ্ন’ কি?’/ ফরহাদ মজহারের ফেসবুক আলাপ থেকে এই কোটটা নিয়েছি।

আচ্ছা। আমারও এই প্রশ্ন তো রইলই, তাহলে, ফরহাদ মজহারের যে ‘ইসলাম প্রশ্ন’, সেটি উপরে তুহিন বা পরে আমি ইসলাম ও মুসলমানদের অপরায়নের যে আলাপ করেছি, তা তো না। তাহলে ফরহাদ মজহারের ‘ইসলাম প্রশ্ন’টা কী? যা একাট্টা নিজে করতে চান?

এইটা কি ধর্ম হিশেবে ইসলামকে মোকাবেলার প্রশ্ন, উপরে ফরহাদ ভাই যেভাবে কইলেন, ‘ইসলাম’ ডাকনাম নিয়ে যা কিছু হাজির, তার সঙ্গে মোকাবেলা খুবই বড়ো এবং জরুরি একটি কাজ।’? মানে, মার্কসের জায়গা থিকা ধর্মের পর্যালোচনা হাজিরের প্রশ্ন? যেইটারে ফরহাদ ভাই ‘বিপ্লবী রাজনীতির’ জায়গা থিকা আলাপ তোলার কথা বলেন। এই ‘বিপ্লবী রাজনীতি’র সঠিক চেহারাটা কী? এইসব ছোট ছোট প্রশ্ন তো করাই যায়। এইটা কি ধর্মের সাথে মৈত্রি সম্ভাবনা?

যেমন, ইসলামের ট্রেডিশনের ভেতর থিকা, একজন মাদ্রাসার ছাত্র বা ট্রেডিশনাল আলেম, যারা ইসলামের ট্রেডিশনের ভেতরে অথরিটি হইয়া বিরাজেন, তাদের কোন ‘ইসলাম প্রশ্ন’ থাকে না। তাদের ইসলাম বোঝাপড়ার চেষ্টা আছে, তা হইল নিজের ধর্ম নিয়া নিজের বোঝাপড়ার প্রশ্ন। এইটারে ঠিক ইসলাম প্রশ্ন কওয়া যায় না। তার কাছে হিন্দু প্রশ্ন থাকিত পারে। বা মার্কস প্রশ্ন থাকিত পারে। আমি এইখানে ইসলাম প্রশ্ন নিয়া যে আলাপটি হাজির, তারে স্পষ্ট কইরা পড়তে চাইছি। মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কিত বোঝাপড়া কী হবে, ঠিক সেই কর্তব্যের আলাপ না আর কি! দেখবেন, তারা ইসলাম নিয়ে আলাপ করেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রের বা ভেল্যুর কথা বলেন, বা রাজনীতির কথা, এরকম নানান চেহারার আলাপ। কিন্তু ধরেন, আজকে ইসলাম প্রশ্ন নিয়া আমরা আলাপ করছি, এই আলাপে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ঘটনা হল, এইখানে আমার পাশে সহবক্তা হিশেবে যিনি বসেছেন, মানস চৌধুরী। তিনিও কথা বলেছেন। তো, মানসের নিশ্চয় ধর্ম হিশেবে ইসলাম যাপনের কোয়াশ্চেন নেই, যেহেতু তিনি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান নন। কিন্তু তার ইসলাম প্রশ্ন থাকা সম্ভব। সোশাল ফেনোমেনন হিশেবে ইসলাম তার কাছে যে গুরুত্ব নিয়া হাজির, তার ঐতিহাসিক সামাজিক দার্শনিক তাৎপর্য নিয়া আলাপ। এই ইসলাম কোন মুসলমানের ইসলাম না, স্রেফ হিন্দুরও ইসলাম না, যে ইসলাম সবার হয়ে উঠতে পারছে, সেই ইসলামই মূলত মানসের ইসলাম। আমার কাছে তার ইসলাম প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ, যার কাছে স্রেফ পৈত্রিক উত্তরাধিকার হিশেবে ইসলামের ভেতরে বসবাসের বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন মানস।

আসলে আমি এই আলাপগুলো পরিস্কার করার কথা বলছি। এমন না যে, অভিযোগ আকারে পেশ করছি। না ফরহাদ ভাইয়ের প্রতি, না অন্য কারো প্রতি। বরং, আমরা কিছু আলাপকে স্কিপ করে যাই, ফরহাদ ভাই আমাদের ভেতরে জনপরিসরে সবচেয়ে ডিটেইল আলাপ করতে পছন্দ করেন এবং ভয় পান না। তো, ফরহাদ ভাই যে ভয় পান না, এই ঘটনারে এই আলাপের সুযোগে আরো কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে উসকে দিতে চাই। তো, ফরহাদ ভাই প্রশ্নটা এমনভাবে করেন, যেন ফরহাদ ভাইয়ের একটা ইসলাম প্রজেক্ট আছে। অনেকের যেমন, ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রজেক্ট’, যেমন, বাংলাদেশে যারা পলিটিকাল ইসলাম করেন, জামায়াত, বা আর আর কোট আনকোট ইসলামী সংগঠনগুলো। যারা মনে করেন যে, দুনিয়ার সবকিছু বাদ দিয়ে আসলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এখানে রাষ্ট্রের সবাইকে বাধ্য করতে হবে, আপনি মদ খেতে পারবেন না, আপনি নামাজ না পড়লে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে একটি আরব দেশের শরয়ি পুলিশের মত কইরা শাস্তি দেওয়া হবে, মানে একটা আইনি চেহারা দিয়ে বাধ্যবাধকতা তৈরীর ব্যাপারটারে তারা ইসলাম মনে করে, এবং এই ভাবটাই পপুলার। তো, ফরহাদ ভাই যখন ‘ইসলাম প্রশ্ন’ নিয়া আলাপ তোলেন, বাংলাদেশে ইসলামবাদিদের নানান গ্রুপ নিজেদের মত কইরাই এর অর্থ করেন ও শরয়ি মাসআলা মাসায়েল নিয়া আলাপ পাড়েন। যেমন, ফরহাদ যা বলেন, তা ইসলামসিদ্ধ কিনা, জায়েজ বা নাজায়েজ, এইসব। তারা ধইরা নেন, ইসলাম প্রশ্ন মানে, ইসলামের ট্রেডিশনের ভেতর থিকা ইসলামরে যেভাবে মওলানারা ঐতিহাসিকভাবে বুঝেছেন ও মেনে চলার কথা বলেছেন, তার অনুযায়ী চলার মেনে চলার প্রশ্ন। যেমন, তখন, এইমতে, উনাদের ইসলাম প্রশ্ন হল ‘ইসলামী রাষ্ট্র’। বা ইসলামী শরিয়া। বা কাদিয়ানিরা মুসলমান কিনা। বা ফরহাদের ঈমান আছে কিনা। শিয়ারা বেহেশতে যাবে কিনা। এইসব। বা কোন ইসলামপন্থা সহিহ, এইসব।

তো, এই অবস্থার উত্তরে, এই তর্কের মধ্যে ফরহাদ কখনোই তাদেরে স্পষ্ট কইরা এই কথা বলেন না যে, আমি মার্কসের জায়গা থিকা ইসলামের বোঝাপড়ার কথা কইতেছি। বা ‘বিপ্লবী রাজনীতির’ জায়গা থিকা ইসলামরে কীভাবে মোকাবেলা, মানে ক্রিটিক করব, তার আলাপ করতেছি। ইসলামের শরয়ি বিচারের আলাপ না, যা মওলানারাই কইরা থাকেন হরদম। বরং, আমি খেয়াল করেছি, ফরহাদ ভাই বলেন, মওলানারা যা বলেন, তা ‘আসল ইসলাম না’। ফলে, ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে তকফির হয়, মওলানারা যেমন একে অপরের বিরুদ্ধে তকফির করেন।

ফরহাদের এই যে না বইলা থাকা, এইটা আমি ফরহাদের ইসলাম প্রশ্নের সমস্যা মনে করি।

তো, ফরহাদ যখন ইসলাম প্রশ্ন নিয়া আলাপ শুরু করলেন, তা কেন তাকে শুরু করতে হল?

কারণ, বাংলাদেশে ইউরোপের যে রেনেসা, তা তার মুগ্ধতাসহই, কোনরকম ক্রিটিক ছাড়া অনুপ্রবেশ করেছে, উপনিবেশ ও আধুনিকতার সাথে। অনেকটা আরবের ইসলাম আরবি জাতীয়তাবাদ ও স্থানীয় সংস্কৃতিচিহ্ণের উপাদানসহই যেমন আমাদের বাংলায় মওলানারা রিপ্লেইস করতে চাইলেন। এইটারে অবিকল রিপ্লেস করতে গিয়ে ইউরোপের ইতিহাসে যে চার্চ ও সামন্ত্র শ্রেণীর বিরুদ্ধে ইউরোপের ব্যক্তির, মানে আধুনিকতার রক্তক্ষয়ি সংঘাত, সেই সংঘাতটুকুই ধর্মঘৃণার আকারে, যেইটা আমাদের এখানে ইসলাম ছিল, সেই ইসলামঘৃণা আকারে ঢুকেছে। আর এইখানকার কমিউনিস্টরাও সেই ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্টের প্রশ্নহীন ছাত্রই ছিল শেষমেষ।

আর, হাহা, ফরহাদ স্নেহের স্বরে কইতেছেন, সিঁদুর দেখলে মেঘের ভয় হয়। এইখানে মেঘ হইল পাকিস্তানের ‘উগ্র জাতীয়তাবাদি ইসলাম’, যা এই ঘৃণা তৈরীতে ভূমিকা রেখেছে। আর সিঁদুর হইল ইসলাম। যেমন, আল মাহমুদ আর শামসুর রহমান সম্পর্কে কইতে গিয়ে বলতেছেন, ‘একজন ধর্ম থেকে দূরে, ধর্মের বিপরীতে চলে গিয়েছেন, যা কাব্যের বিপরীতে দাঁড়ানোরই শামিল। কাজে কাজেই নিরাপদে দাঁড়িয়ে থাকবার কারণে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী’ ইসলাম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতার রসদ হয়েছে। অন্যজন ইসলাম কী সেই প্রশ্ন না তুলে ‘ইসলামী’ হয়ে গিয়েছেন, যে ‘ইসলাম’ সম্পর্কে বাংলাদেশে ঘোরতর সন্দেহ আছে। এই সেই ‘ইসলাম’ যার নামে আমরা মানুষ হত্যা ও ধর্ষণ এবং আমাদের ভাব, ভাষা ও বাংলায় ইসলামের লোকায়তিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রূপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হত্যাযজ্ঞ দেখেছি।’

তো, এই প্রেক্ষিতেই, প্রগতিশীলদের মধ্যে এমনও আলাপ আছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মূলত ইসলামকে ‘পরাজিত করেছে’। সম্ভবত দুই হাজার আট সালেই হবে, বিমানবন্দরে লালনভাস্কর্য ভাঙার ঘটনার পরে , এইটা মানসরা ভাল জানবেন, সেই সময় আমরা বেশ কথা বলেছিলাম এইটারে লইয়া, গায়ক মাহমুদুজ্জামান বাবু প্রমুখদের এরকম একটি শ্লোগান ছিল, যে, আমরা ইসলামকে পরাজিত করেছি।

তো, ফরহাদ ভাই জানাচ্ছেন, ‘আধুনিকতার তৈরি মাল হিশাবে এই বিকৃতিগুলো যখন আমাদের দেশে চালান হয়ে এল তখন তার কলিজায় বর্ণবাদের মোহর মারা। ফলে নির্বিচার আধুনিকতার পোশাক যাঁরা গায়ে চাপালেন তাঁরা এই দেশের মানুষের সকল বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার বিচার—সবকিছুকেই মাপলেন একটা নিক্তি দিয়ে : প্রিমিটিভ, বাজে জিনিস।’

এই হল ইতিবৃত্ত।

৪.

তো, আমি দুই হাজার ১৩ সালে যে শাহবাগের যে গণজাগরণমঞ্চ তৈরী হইছিল, তারে প্রগতিশীলদের এই ধর্ম প্রশ্ন মীমাংশার ব্যর্থতা হিশেবে পড়ি। নোক্তা দেওয়া দরকার, এইটারে আমি কন্সপিরেসি থিওরি, মানে আওয়ামি প্রজেক্ট হিশেবে পড়ি না। এখানে আমার পাশে মোহাম্মদ আজম আছেন, এইটারে লইয়া আজমরা এক ধরনের একটা গ্রে এরিয়ার আলাপ পাড়েন, আমি খেয়াল করেছি। যারে নিয়া আমার স্পেসিফিক দ্বিমত আছে। আওয়ামীলীগ এই ঘটনারে ব্যবহার করতে সমর্থ হইছিল, প্রগতিশীল বা বামপন্থার আর আর সব প্রজেক্টও যেমন আওয়ামীলীগ সহজেই নিজেদের রাজনীততে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। আর, ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট তো আমাদের এখানে যে চেহারা নিয়ে হাজির আছে, তা হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। নমঃ শূদ্র ও বাঙালি মুসলমান, মানে ছোটলোক মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার ঐতিহাসিক শত্রুতার ইতিহাসের সাথে সাথে যা হাড়ে মজ্জায় সাম্প্রদায়িকও। হিন্দু জমিদারতন্ত্র থিকা শুরু করে বাবু সম্প্রদায়ের ইতিহাস পড়লে বুঝবেন। ওরা এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতিয়ার হয়েছিল।

তো, এইখানকার পপুলার মার্কসবাদি, বামপন্থি বা প্রগতিশীল রাজনীতি যারা করতেন, তারাও, শেষমেষ এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নহীন গ্রাহক ছিল। ফলত, তাদের কাছে মোকাবেলা মানে নির্মূল। ক্রিটিক না। কাজেই ধর্ম বা বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ইসলাম, এই ক্ষেত্রে জামাত রাজনীতি, তার মোকাবেলা তারা যুদ্ধাপরাধ টুল দিয়ে সারতে চাইতেছিল। যেহেতু নির্মূলই সমাধান। যেভাবে বাওয়ের কইতেছিলেন, আপনাদেরে নিজেদের ধর্ম ছাইড়া দিয়ে আসতে হবে। তাই, শাহবাগের আগে, জামাত রাজনীতি নিয়ে বাহাস ও তৎপরতা মূলত ধর্মীয় রাজনীতি বা আদর্শিক মোকাবেলার প্রশ্ন ছিল সব সময়। কিন্তু যেহেতু ধর্মীয় রাজনীতি ফিরে আসল, যার হাত ধরেই হোক, সে তো আসবেই, উনারা তখন যুদ্ধাপরাধরে টুল হিশেবে বাইছা নিলেন। ফলত, শাহবাগ প্রপোজিশন মূলত বাংলাদেশে এই ‘প্রগতিশীল’দের ইসলাম মোকাবেলার প্রশ্ন ছিল, আমি সব সময়ই বলতে চেয়েছি। এ কারণেই হেফাজতের মুভ ভুল ছিল না। তারা কোট আনকোট ইসলাম বাঁচাতে নামল। হেফাজতের মুভ ছিল তখন পলিটিক্যাল। যেমন তুহিন উল্লেখ করেছেন, ইসলাম নাম অলা সংগঠনের সাথে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার পর্যন্ত শেয়ার করতে রাজি না বামেরা।

৫.

তো, তারও বহু আগে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান নিয়া লিখছিলেন। বাঙালি মুসলমান ব্যাপারটি কেমন? ফরহাদ ভাই তো বলেন, বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন না, আমাদেকে ইসলাম প্রশ্ন করতে হবে। তো, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছফার কি কোন ইসলাম প্রশ্ন ছিল?

হয়তো ছিল, কিন্তু আমরা সেভাবে পাই নাই। তার ‘ইসলাম প্রশ্ন’ না। ছিল ‘মুসলমান প্রশ্ন’। আমার কাছে ছফার মুসলমান প্রশ্ন ইন্টারেস্টিং। তিনি ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মুসলমানের মন পড়তে চাইতেছিলে, হামদরদি দিয়ে। যদিও তার পদ্ধতিগত ও ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ঠা নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, কিন্তু তার হামদরদিতা নিয়ে আমিও হামদরদি।

এই বিষয়ে আমি একটা কোট দিতে চাই, স্যার যদুনাথ সরকারের একটা কোট, সলিমুল্লাহ খান থিকা ধার করে। ফলে, সাধু ভাষায় লেখা এই কোট। তিনি বলতেছেন:

‘পূর্ববঙ্গ হইতেছে এয়াহুদি বিবর্জিত ফিলিস্তিনের তুলনা। আর আমরা পশ্চিমবঙ্গকে এয়াহুদি শাসনাধীন ফিলিস্তিনের মতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে বাধ্য—ইহা হইবে তমিস্রার মধ্যে আলোকবর্তিকাস্বরূপ, মধ্যযুগীয় অজ্ঞানভাব আর অচলিত ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের অন্ধসংস্কারে ডোবা মরুভূমির মধ্যে একখণ্ড মরুদ্যান বিশেষ।’ (যদুনাথ সরকার ২০১৪ : ১০৩ । যদুনাথ সরকারের Brothers from over the River লেখার কোন হদিস দিতে পারেন? India after Independence: Writings of Jadunath Sarkar, editor: Raj Narayan Pal এই বইটাতে আছে। এইটা পাওয়া গেলেও হবে।]

মানে, হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণীর কাছে মুসলমান প্রশ্ন যেভাবে হাজির ছিল আর কি এইখানে, ইতিহাসে! অখন্ড, বৃহত্তর ভারত বলিয়া যে ইউটোপিয়া, তার থিকা যে বঙ্গ বইলা আলাদা একটা ঘটনার কথা কইতেছিলেন দীনেশ চন্দ্র সেনরা (দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ (‘পূর্ববঙ্গীয় বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক’ ছিলেন দীনেশ, ছফা উল্লেখ করেছেন), যা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার, নিরদ সি প্রমুখ ‘সমগ্র ভারত এক, অখণ্ড ও অচ্ছেদ্য’-বাদীদের মনঃক্ষুন্নের কারণ হইছিল), আবার তার মধ্যেই বঙ্গের মুসলমান যে আরো অন্য চরিত্রের ঘটনা (ননমাইগ্রেটেড, কনভার্টেড নিম্নবর্ণের হিন্দুরও বাইরের, অহিন্দু, অনার্য, ভাটি বাংলার সন্তান বাঙালি মুসলমান), এই আলাপের, মানে ফরহাদ ভাই যেইটা ফুকোয়ামার অর্থে আত্মপরিচয় নির্মাণের রাজনীতির বিরোধিতা করছেন, তার বাইরেই আরো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে, সেটি হল, ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান ধারণার গুরুত্ব হল, ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান কখনোই একা হাজির থাকে নাই। বাঙালি মুসলমান ব্যাপারটা এমন, এখানে ইতিহাসের নমঃশূদ্র, চণ্ডাল, দলিত, কৃষিজীবী, কাঠুরে, জেলে ও আর আর বর্ণহীন, অনার্য স্বাধীন নৃগোষ্ঠি স্বমহিমায় বিরাজ করে, বাঙালি মুসলমানের সাথে। এই থাকারে বাদ দিয়া কোন বাঙালি মুসলমান থাকে না, বাঙালি মুসলমান হয়ই না। বাঙালি মুসলমান শব্দের গুরুত্ব এখানেই।

ফলে বাঙালি মুসলমানরে সাম্প্রদায়িক প্রত্যয় হিশেবে পাঠ, নাকচ ও মুসলমানি চিহ্ণের প্রতি ঘৃণাবাদি রাজনীতির যে মহড়া বর্ণবাদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের তরফে (যার সাথে উপমহাদেশে বর্ণহিন্দু ও জাতপাতভেদের যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক এজেন্সি, মুসলমান ও মুসলমানি চিহ্ণরে আদার কইরা রাখা, ভারতীয় বাংলাভাষি মুসলমানদেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার বর্ণবাদী হুঙ্কারের যে এজেন্সি, তার ঐতিহাসিক সখ্য আছে), আবার জাতীয়তাবাদী প্রত্যয় হিশেবে পাঠের যে ধরণ মৌলবাদী ইসলামের সম্প্রদায়গত ও নিছক ধর্মীয় বয়ানের তরফেও, উভয়রে ক্রিটিক ও নাকচ করতে পারাটা সর্বাগ্রে জরুরি।

৬.

পণ্ডিত ব্রুনো বাওয়ের এবং তার সময়ের জর্মন ভাবুকদের আলাপগুলোর কথা কইতেছিলাম শুরুতে। তো, এই আলাপে কেউ কেউ এমন কথাও কইতেছিলেন যে, প্রেস, শিক্ষা, কালচার, স্টেইট ডি-‘জিউফাই’ করার জন্য, যাতে ইহুদি আর নন ইহুদিদের মধ্যে ইন্টার মেরিজ না হইতে পারে ও তারা বংশ বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম না হয়। যাতে ইহুদিরা ক্রমেই যে সোশালি ডোমিনেন্ট পজিশনে যাচ্ছিল, তারে থামানো যায়।

অধুনা বিজেপির লাভ জেহাদ মোকাবেলা ও আন্তধর্মিয় বিয়ে নিয়ে প্রশ্নর সাথে মিল খুঁজে পান? শেষমেষ তো হলোকাস্টে শেষহল জার্মানদের সমাধান। ভারতবর্ষের সমাধান কী?

আর বাওয়েরের সেই ঐতিহাসিক আলাপ তো আছেই, যারে কেন্দ্র কইরা মার্কস ইহুদি প্রশ্ন লইয়া আলাপ করলেন। যে, ইহুদিদেরকে যদি রাজনৈতিক মুক্তি পেতে হয়, তাহলে তাদেরে তাদের ধর্ম ছাইড়া আসতে হবে। যেহেতু রাজনৈতিক মুক্তির জন্য দরকার সেকুলার স্টেইট। আর এই ধরনের রাষ্ট্রে ধর্ম ধরনের কোন সোশাল আইডেন্টিটির জায়গা রাখে না। আর সত্যিকারের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য দরকার ধর্মের নির্মূল, মানে বিলয়।

তো, মার্কসের উত্তরটা সেই সময় আমার পছন্দ হইছিল। মার্কস বলতেছেন, সেকুলার রাষ্ট্র মানে নাগরিকদের ধর্মের বিলয় প্রশ্ন নয়, মূলত রাষ্ট্রের ধর্মীয় চরিত্রের বিলয়। মানে, একটা সেকুলার রাষ্ট্রে নাগরিকরা কোন ধর্মের, তার ভিত্তিতে অধিকার ফয়সালা করবে না। মানুষের ধর্ম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে না। বরং রাষ্ট্রর নিজের সেকুলার হয়ে ওঠার দায় আছে। নাগরিকদের ধর্ম নিয়ে মাথা ব্যথা সেকুলার রাষ্ট্রের কাজ নয়। সেকুলার রাষ্ট্রে ধর্ম বহাল থাকতেছে, বা ধমীয় পরিচয় অনধিকারের কারণ হচ্ছে, যে লোক মুসলমান, হিন্দু বা ইহুদি, সেই পরিচয়ের কারণে সে অধিকার না পায় যদি, এইটা সেকুলার রাষ্ট্রের ভেতরকার সমস্যা। ধর্মের বা ঐ ধার্মিক মানুষের সমস্যা না। এই হল মার্কসের সেকুলার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ধর্ম বোঝাপড়া, বিপরীতে, আমরা দেখি, আমাদের কমিউনিস্টরা ধর্ম নিয়া এই বেসিক বোঝাপড়ার জায়গায়ও পৌঁছাতে পারে নাই, ফরহাদ ভাইয়েরাও বলেন।

কিন্তু, সেকুলার রাষ্ট্র তো নিজেই একটা ছদ্ম ধর্মপ্রকল্প। আমরা দেখি।

তালাল আসাদ বলতেছেন, সেকুলার রাষ্ট্র সম্ভব নয়, কারণ ধর্ম ঘুরে ফিরে আসে। (the state is not that separate. Paradoxically, modern politics cannot really be separated from religion as the vulgar version of secularism argues it should be)। ‘রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বিশুদ্ধ ধর্মব্যবস্থার ‘অন্য’ আরেকটি রূপ, তাই এটি ধর্মের বেড়ে ওঠার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়। ধর্ম রাষ্ট্র থেকে আলাদা থাকবে—সেটি করতে গিয়ে কোন কোন বিষয়গুলি মূলত ধর্মীয় বা ধর্মসম্পর্কিত—রাষ্ট্র কর্তা হয়ে সেইসব ধর্মীয় চিহ্ন নির্ধারণ ও সংজ্ঞায়ন করতে যায় এবং ধর্মে বুদ হয়ে যায়’ (Secularism as a political doctrine I see as being very closely connected to the formation of religion itself, as the “other” of a religious order. It is precisely in a secular state—which is supposed to be totally separated from religion—that it is essential for state law to define, again and again, what genuine religion is, and where its boundaries should properly be.

মানে, ধর্মের চিহ্নায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর হইতে থাকে সেকুলার রাষ্ট্র।

যেমন বোরকা, দাঁড়ি টুপি, কোরান শরীফ, জেহাদি বই ইত্যাদি।

৭.
আমি দুইভাবে ইসলামকে দেখি। ইসলামের ট্রেডিশন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ইসলামরে দেখি। আবার, ট্রেডিশনের ভেতরে দাঁড়িয়ে, দূরকে, বাহিরকে দেখি। আমার এই উভয় দেখাই গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যান্য ধর্মীয় ভাবধারাগুলোর মধ্যে ইসলামের গুরুত্ব হচ্ছে, এটি ইহজাগতিক প্রশ্নগুলোর অমিমাংসা রেখে দেয় না, মোকাবেলা করতে বলে। রাজনীতি, রাজনৈতিকতা, আইডিয়া, আইডিওলজি- এইসব শব্দের সাথে ইসলামের যে ক্লাসিক্যাল আক্বিদা-চিন্তা, উম্মাহ ও খেলাফত ভাবনা, তার সম্পর্ক ও ব্যবধান এখনতক পদ্ধতিগত আলোচনায় খুব একটা হাজির নেই। আধুনিক রাষ্ট্র ভাবনার অন্দরমহল থেকে ইসলাম প্রশ্ন তোলার জন্য আলাপ দরকার। এটি পরিস্কার না করে কথা বললে ধোঁয়াশা তৈরী হয়। আমি মনে করি, ইসলামের ভিতর থেকে কোন ইসলাম প্রশ্ন উদয় হয় না। ইসলাম প্রশ্ন হলো যখন আপনি ইসলামের বাহির থেকে ইসলামকে মোকাবেলা করতে চাহেন, সে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বা আপনার বিপ্লবী চিন্তায় বা আপনার পুঁজিবাদি আগ্রহে ইসলামরে কীভাবে জায়গা দেবেন, সেই প্রশ্ন।

মানুষের সত্যের আগ্রহ একটা জার্নি। প্রতি মুহূর্তের লড়াই ও সংগ্রামের পথ। জাস্টিসও প্রতি মুহূর্তের রেসপন্সের নাম। এইটা কখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হয় না, নিয়ত সংগ্রাম কইরা যেতে হয়। ফলত ইসলামী রাষ্ট্র, প্রলেটারিয়েটের ক্ষমতা ও একনায়কতন্ত্র ও আর আর চুড়ান্ত আদর্শবাদী হইতে চাওয়া টার্মসমূহ ইউটোপিয়ান ও অলিক। বরং প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে একটা পৌত্তলিক মূর্তি দাঁড়ায়, যা ডিকটেটর হিশেবে আবির্ভূত হয়। ফলত যে কোন পৌত্তলিক মূর্তি তৈরীর বিরুদ্ধে লড়াই জরুরি হয়। রসুলুল্লাহর দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের খোতবার সময়ে এক ব্যক্তি হঠাৎ উঠে তরবারী উত্তোলন করে ওমরকে তার দামী, অতিরিক্ত পরিচ্ছদের জন্য জবাবদিহী চান। উমর খোতবা বন্ধ রেখে তার পরিচ্ছদের হিশাব দিতে থাকেন। এটাই জাস্টিসের সংগ্রাম, মানুষের জায়গা থেকে। এইটা নিরন্তর কইরা যেতে হয়; নইলে ডিকটেটর ও ফ্যাসিবাদ দাঁড়ায়। দেখা যাচ্ছে, ইসলামিস্টরা এই লড়াই মূলতবি রেখে খেলাফত নামে একটা মূর্তির পৌত্তলিকতা শুরু করে। ফলত এতে মানুষের মানুষ সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। অপরাপর আদর্শবাদীরাও তাই। একটা মূর্তি বানিয়ে তার পক্ষে লড়াই করে। আমি বলি কি, দরকার এই মূর্তি ভাঙার লড়াই। সে ইসলাম হোক আর কমিউনিজম। বা খেলাফত। বা জাস্টিস। বা আইন। প্রতি মুহূর্তেই মানুষের সজীব লড়াই জারি রাখার ব্যাপার। আগের মূর্তি ভেঙে প্রতি মুহূর্তেই নতুন সত্য ও জাস্টিসের মুহূর্ত তৈরী করা।

ফলে, মুসলমানরা যখন মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন আমি দেখি, তারা মূর্তি চেনে না। আমার কাছে যা শিরক, তা উনারা বোঝেন না। যেমন, আমি বলি, শিরক হচ্ছে ক্ষমতার ক্রিটিক, যে ক্ষমতা খোদা, ঈশ্বর হয়ে উঠতে চায়। হযরত মুহাম্মদ সল্লল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম মক্কায় পূর্বপুরুষদের এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, যারা নারীকে জন্মমাত্রই জীবন্তু পুঁতে ফেলত আর মানুষকে দাস বানিয়ে রাখত ও তার বিরুদ্ধে কাউরে কথা কইতে দিত না। কোন প্রাণহীন মূর্তির বিরুদ্ধে মুহাম্মদের এই লড়াই ছিল না। মূর্তি একটা সিম্বল মাত্র। এখন যেমন বাংলাদেশে বর্তমান রেজিমের অনৈতিক ক্ষমতার সিম্বল একটি মূর্তি। এই ক্ষমতার ক্রিটিক ছাড়াই স্রেফ মাটির মূর্তির বিরোধিতা, এই ব্যাপারটির বোঝাপড়া ছাড়াই ট্রেডিশনাল মওলভিরা ধর্ম ও শিরকের আর একটি মূর্তি বানিয়ে তার আরাধনা করে। তাদের ইসলাম একটি মূর্তি বিশেষ। তাদের বিবেক, কোরান, কাবা, সবই মূর্তি। স্রেফ প্রাণহীন মূর্তির মতই টেক্সট এর রিপিটেশন ও মুখস্ত করে। যেন তার কোন হিস্ট্রি নেই। মানুষ কেবল বিবেকহীন অবিবেচক অনৈতিহাসিক ঘটনা। স্রেফ মুখস্ত করা ও বলাই তার নিয়তি। আমি এইটারে মূর্তিপূজাই বলি।

এই জাগায় আমি মানুষের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার কথা বলি, ছদ্মসার্বভৌমের বিপরীতে। ধর্মভাবের কথা বলি, ধর্ম হয়ে ওঠার বিপরীতে। এই ধর্মভাব ও সার্বভৌম অবস্থাটি কেমন?

ইসলামে মানুষের একটা আধ্যাত্মিক জার্নি আছে। এর প্রাথমিক অবস্হা হল মানুষ যখন নিজের অস্তিত্ব, জীবসত্তা ও অপর সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, তার কাছে নিজেকে ব্যক্ত করতে প্রস্তুত হয়, তখন।  এ পর্যায়ে সে ব্যক্তি, ইনডিভিজুয়াল বা পারসন। অন্য অনেকের মধ্যে আলাদা একজন। এই স্তরটি হল মূলত ইন্দ্রিয়সর্বস্ব ও আত্মমগ্ন জীবসত্তা, সেলফ। ইসলামের গ্রন্হ কোরআন শরীফ নফসের এমন স্তরের কথা জানাচ্ছে আমাদের: যার নাম নফস-ই আম্মারা, যে স্তরে নফস-ই আদেশদাতা, নিয়ন্ত্রক। এই পর্যায়ে তার নৈতিকতা, নন্দন ও রাজনৈতিকতা দাঁড়ায় না, কারণ এই জীবসত্তায় ‘বিবেক’ থাকে না। মানে কোন ধর্মভাব থাকে না।  যখন ব্যক্তি নিজের এই জীবসত্তা এবং তার সামনে হাজির ‘অপর’- উভয়ের সম্পর্ককে বিচার-ও-বিবেকবুদ্ধি দিয়ে ঝালাই করতে সচেতন হয়, অপরের মধ্যে নিজেকে দেখতে ও একাত্ম হতে শেখে, তখন ব্যক্তির রাজনৈতিকতার শুরু। একই সাথে ধর্মভাবেরও শুরু। এটি আত্মমগ্ন জীবসত্তার সেলফ ও আত্মতা থেকে উত্তরণ-মুহূর্ত। কোরআন শরীফ নফসের এমন স্তরকে বলছে নাফস-ই লাওয়ামাহ, বিবেকের জাগরণ-মুহূর্ত। এই বিবেক হলো ফিতরত, মানুষের প্রকৃত স্বভাব, যা একই সাথে সার্বভৌম ও দায়বদ্ধ।  মূলত এই দায়বদ্ধতা ছাড়া মানুষের কোন ধরণের সার্বভৌমত্ব হয় না।  কোরআন শরীফে এই সার্বভৈৗমর নাম দেয়া হয়েছে খেলাফত, মানে সেই যোগ্যতা ও ক্ষমতা, যা দিয়ে ‘স্বাধীনভাবে’ ভাল-মন্দের ফারাক বিচার করতে সক্ষম মানুষ।  মূলত বিবেকের এই জাগরণমুহূর্ত ও দায়বদ্ধতা হল ইন্দ্রিয়সর্বস্ব ও আত্মমগ্ন জীবসত্তা থেকে মানুষের প্রস্হানমুহূর্ত।  এই মুহূর্তে এসে আত্মর দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটে মানুষের।  ফলত বিবেক দিয়ে বিচার করতে স্বাধীন ও সার্বভৌম হয় মানুষ।  এই বিশেষ সার্বভৌম সম্পর্কে সচেতন হয়ে সম্পর্কে সক্রিয় থাকাটাই মুআমিলাত।  এই অবস্হায় ধর্মভাবসম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে ওঠে ‘রাজনৈতিক’ ব্যক্তি।  তখন তার নৈতিকতা, নন্দন ও রাজনৈতিকতার যে ধরণটি দাঁড়ায়, তাই হলো বন্ধুত্ব।  মূলত বন্ধুত্বের এই ধর্মভাবটির উপরেই দাঁড়ায় শিল্প ও নন্দন।  যে শিল্পে বন্ধের, সেলফের, আত্মতার অবমুক্তি ঘটে।  মানে বন্ধুত্ব ঘটে।

‘বন্ধুত্ব’ একটি জরুরি ভাব।  অন্তত ধর্মভাবসম্পন্ন মানুষের জন্য।

আমি এই জায়গা থেকেই, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি, মানে একটা মানুষ সম্পর্কের পুনরুত্থানের কথা কই।

যেমন, আমার ইসলাম ভাবনা হচ্ছে, যে ইসলাম দলিত, শুদ্র, মুড়ং, মুসলমান সবার লড়াইয়ের ভাষা হয়ে ওঠে। কেবল সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা কইতে ও দাঁড়াতে কাতর যে ‘ইসলাম’, তা হীনমন্য, আত্মকেন্দ্রিক, বিহ্বল। তার সাথে ভারতের বজরঙ্গি দলের হিন্দুত্ববাদের তেমন মৌলিক পার্থক্য কোথায়?

Leave the first comment