সকাল থেকে, চট্টগ্রামে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। হয়ত, ঢাকাতেও। নাকি রোদ? বাংলাদেশের মানুষ ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মাথায় ও মুখে লাল ফিতে বেঁধে প্রতিবাদ করছে এই সময়টাতে। এর মধ্যেই আমি এই আলাপগুলো শুরু করা জরুরত বোধ করলাম।
লেজিটিমেসি কই থাকে?
একটা সিঙ্গেল অনায্য খুনও যদি হয়, এবং তা প্রমাণিত হয়, ক্ষমতাসীন সরকারকে তার দায় নিতে হয় এবং নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী এই একটিমাত্র খুনের কারণেই যে কোন রেজিম নায্যতা হারায়। সভ্য দুনিয়ায় তাকে পদত্যাগ ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। এ বছর জুলাই এর এই ছাত্র আন্দোলনে একটি নয়, নির্বিচারে শত শত খুন হয়েছে, যারে গণহত্যাই বলা হচ্ছে। পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্রদের উপরে টার্গেটেড গুলি চালিয়েছে, এমন কি বাড়িতে অবস্থানরতদেরও গুলি চালিয়ে ছাত্র ও শিশুদের হত্যা করেছে। এবং এই খুনগুলো লেজিটিমেইট করতে ও আরো খুন চালিয়ে যেতে নানান অনৈতিক ছলনা করেছে সরকার, যেমন ‘শোক’।
এই হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী আমরা আমাদের অবস্থান নিতে পারছি?
অবসেসড পার্টিজান বুড়া হাবড়া, যেমন জনৈক বিচারপতি, তার সামনে যদি বেঁচে থাকা সব ছেলে বুড়োরেও ব্রশ ফায়ার কইরা মারা হয়, তাও, উনারা ফ্যাসিস্ট থাকবেন ও গণহত্যার পক্ষে থাকবেন। ফলে, আমরা নাগরিক সমাজের কথা বলছি, যারা হয়ে উঠতে পেরেছেন বইলা অন্তত ভ্রম হয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এখনতক ছাত্র এবং প্রতিবাদরত নাগরিকরা স্রেফ ক্ষমা চাইতে বলেছে ও মন্ত্রী আর পুলিশ অফিসারদের পদত্যাগ চেয়েছে।
মানে, রেজিমকে ইলেজিটিমেইট ঘোষণা করে নাই। অথচ, এই হত্যাযজ্ঞের পর স্রেফ অফিসার ও মন্ত্রীদের পদত্যাগ না, ইলেজিটিমেইট রেজিমের পদত্যাগ চাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এইটা যে হতে পারল না, এইটা এই আন্দোলন এবং আমাদের নাগরিক সমাজ, মানে আমাদের লিমিট।
এই সময়ে আইসা, আমি আরো দুটি বিষয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করতে চাই। এক. মুসলমান সেলিব্রেটি আলেম এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ধর্মীয় পুরোহিত সম্প্রদায় ও তাদের কমিউনিটি সংগঠনগুলোরে লইয়া। ইসলাম বা ধর্মরক্ষা ও কমিউনিটি সমস্যার বাইরে তারা কি আর কোন দায় বোধ করেন না? জুলুম নিয়া ধর্ম কী বলে?
প্রসঙ্গত, আপনাদের মনে থাকিত পারে, দুই হাজার তেরতে শাহবাগের বিপরীতে রসুল অবমাননার প্রতিবাদেই হেফাজত দাঁড়িয়েছিল, যেটিরে আমরা মানবিক মর্যাদার আন্দোলন হিশেবে পড়েছিলাম, সেই সময়। তো, এই জুলাইয়ে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হবার পরে এখনো পর্যন্ত তাদের কোন বিবৃতি পর্যন্ত নেই, যা তারা হরহামেশাই দিয়ে থাকেন, তাদের কমিউনিটি ইস্যুগুলোতে। বরং শুরুর কিছুদিন পর, যখন ছাত্রদের তরফে পাল্টা প্রতিরোধও শুরু হল, এক ইয়াং এবং তরুণদের মধ্যে পপুলার হেফাজত নেতার বিবৃতি বা সোশাল মিডিয়া পোস্ট আমার নজরে পড়েছিল, যেখানে ভদ্রলোক বলছেন, আপনাদের ‘সেক্যুলার’ আন্দোলনে আমরা কেন আসব?
পাশাপাশি, আর একটা নিউজে দেখলাম, হেফাজত নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ আর মওলানা মামুনুলহক সহ আলেমদের একটা গ্রুপ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সাথে বসেছেন, কীভাবে ছাত্রদের আন্দোলন ডিলেজিটিমাইজ করা যায়, ধর্মীয় জায়গা থেকে। এবং তারা ‘সহিংসতা’র নিন্দা জানিয়ে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ করতে মাঠপর্যায়ে ‘কাজ’ করবেন বলে মন্ত্রীকে জানিয়েছেন। এইটা ২২ জুলাই রাতের ঘটনা।
খেয়াল করবেন, উনারা মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন না, যারা এক ধরনের চাকুরিতে, বিশেষত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত হন বইলা অনেক সরকারী নির্দেশনায় বাধ্য থাকেন। বরং উনারা হলেন বড় বড় আলেম ও ইসলামী রাজনীতিবিদ, তাদের পছন্দের ইস্যুগুলোতে সিংহের হুঙ্কার ছাড়েন।
তারপরে, বাংলাদেশে হিন্দু কমিউনিটির অধুনা পপুলার সংগঠন হিন্দু মহাজোট, বা মুসলমান বাদ দিয়ে বাকি সম্প্রদায়গুলোর যে সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদ, বা আর আর সংগঠনগুলোরও একই অবস্থা। আওয়ামী রেজিমের এই ছাত্রহত্যার দিনে এরা সকলেই চুপ। ন্যুনতম প্রতিবাদ, অন্তত সমাজে একসাথে বসবাসের কারণে যে দায় তৈরী হয়, তারও কোন চিহ্ন নেই।
দুই. মুসলমান, হিন্দু বা যে ধর্মেরই হোন, যারা আদতে সংগঠন হিশেবে আওয়ামীলীগ করেন, তাদের নিয়া আমার আগ্রহ কম। এইটা বাংলাদেশে পার্টিজান ভেল্যুব্যবস্থাগুলো যে পৌত্তলিক ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সমস্যা, যে, তারা গণহত্যার দিনেও পার্টিজান ভেল্যু ব্যবস্থার বাইরে আইসা, মজলুমের পক্ষে দাঁড়াতে সক্ষম না। ছাত্রদের আন্দোলন এই জালিমের ভেল্যু ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই। আমার পুরনো আলাপ আছে এই নিয়া।
এই পার্টি করা লোকেদের বাইরেই, বাংলাদেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব হিন্দু বা বৌদ্ধ এস্টাবলিশমেন্ট (খ্রীস্টানের সংখ্যা কম হিশেবে, তাদেরে নজরে পড়ে না), যারা নানা ক্ষেত্রে রাজনীতি করা ছাড়াই অন্য পরিচয়ে এস্টাবলিশড পেশাজীবী, যেমন একাডেমিক, অধ্যাপক, লেখক, বা নানান ফর্ম ও ফ্রাকশনের কোন কোন বাম রাজনীতিগুলোতেও একটিভ, দেখবেন, প্রকৃতার্থে ধর্মপ্রাণ, প্রগতিশীল বা বৈচিত্র ধারণ ও মুক্তচিন্তায় সক্ষমদের ছোট অংশ ছাড়া তারা বহুলাংশেই ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী বয়ানের বাইরে থাকারে ‘নিরাপদ’ মনে করেন না। বা চুপ থাকেন।
এথিকস ও পলিটিকস তো মানুষের নেসেসারি ভেল্যু, ফলে, তাদেরও, যারা চুপ থাকেন, তাদের নৈতিকতাটারে লোকেইট করা যায় অন্যভাবে। যেমন, কমিউনিটির জন্য কাজও তো এক ধরনের ন্যায্যতার জন্য কাজই। কিন্তু, এই কমিউনাল নায্যতার লিমিট হল, অন্য নায্যতাগুলোরে ঠাহর করতে সক্ষম না হওয়া। এইটারে আমি চিন্তার নিরাপত্তাজনিত দূরবস্থা বলি। যার কারণে, স্রেফ সাম্প্রদায়িক, মানে কমিউনিটি ইস্যুগুলোতেই উনারা কথা বলেন ও একটিভ হন।
এইটা অনেকটা তাদের পুরোহিত সম্প্রদায়, বা এই মুসলমান আলেম সম্প্রদায়ের মত। এর উদাহরণ হল, ধরুন, কোথাও মন্দিরে হামলা হল, বা কোন হিন্দুর ভূমি বেদখল হল, বা ‘অবমাননা’ হল— ইত্যাদি। সম্প্রদায়ের বাইরের নায্যতার আলাপগুলোতে কেন থাকেন না, বা কেন তাদেরে ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী অবস্থানের বাইরে দেখা যায় না, তারে লইয়া ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শিরোনামে আমার পৃথক পাঠ ও লেখা আছে।
সেই পাঠ অন্য কোথাও পইড়েন। কিন্তু, ছাত্র আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক সময়েও, যখন আড়াই শতাধিক ছাত্র খুন হল স্রেফ রাস্তায় নেমে নিজের অধিকারের কথা কওয়ার জন্য, যাদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান সব সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষের সন্তান আছে, এই অংশের আপাত দৃশ্যমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্বের প্রোএকটিভ অংশকে (উপরে কওয়া ব্যতিক্রমগুলো ছাড়া) দেখা যায়, বাছবিচারহীনভাবে রেজিমের বাহিনী ও ক্ষমতার সাফাইয়ের পক্ষেই সোচ্চার।
মানে, উপরে যে কইতেছিলাম, সেই আওয়ামী বয়ানরেই আঁকড়ে ধরে বইসা থাকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন এরা, গণহত্যার সময়েও। আমার এই অবজার্ভেশনের জন্য সহায়ক কোন পরিসংখ্যান নেই, ফলে, আপাতত এইটারে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও আমার পরিচিতমণ্ডলের অভিজ্ঞতা হিশেবেই পড়া ভাল। যেমন, কয়েকদিন আগে, যেদিন এই ছাত্র বিক্ষোভে দেড়শ জন ছাত্র খুনের সংখ্যা পূর্ণ হল, সেদিনই এরকম একজন, যিনি টেক্সটাইল শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত বইলা তার ‘এবাউট’ থেকে জানলাম, নাম কোন এক চক্রবর্তি বা মুখার্জি, বলছেন, সোশাল মিডিয়া থেকে পড়ছি, ‘আওয়ামীলীগ দুধে ধোয়া তুলসীপাতা নয়, কিন্তু এই দেশে সরকার চালানোর মত বিকল্প শক্তি কি আছে যারা সাম্যাবস্থার মাধ্যমে দেশ চালাবে? আওয়ামী লীগের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে গেলে সেটা যাবে জামাত বিম্পির হাতে। তখন কী হবে ভেবেছেন কি?’ খেয়াল করেন, ‘সাম্যাবস্থা’ও চান উনি, যেহেতু এটাই তার শ্রমিক রাজনীতির পরিভাষা। কিন্তু, ভাবুন, তা হতে হবে কেবল শেখ হাসিনার অধীনে। এবং, তা বহাল রাখতে, এবং রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষায়, প্রয়োজনে আরো প্রচুর গণহত্যাও জায়েজ শুধু নয়, প্রয়োজনও। এরকম আরো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যেমন, কবি, ফিকশন রাইটার, অধ্যাপক, চাকরিজীবী। কিন্তু, উদাহরণগুলো ভার তৈরী করবে।
পাশাপাশি, নোক্তা রাইখেন, উপরে যাদেরে লইয়া হতাশা, ইতিহাসের বিভিন্ন ইভেন্টে তাদের ঐতিহাসিক অংশগ্রহণের উদাহরণগুলোরে ছোট না কইরাই এই আলাপ। ফলে, একটা সতর্কবার্তা দিই। এই আলাপের উদ্দেশ্য, আমাদের সোশাল ডাইনামিকস যে জায়গাটিতে আইসা থমকে গেছে, সেই পার্টিজান ভেল্যু ব্যবস্থা আর তার সাম্প্রদায়িক চেহারার প্রবলেম এরিয়াটারে লোকেইট করা। ‘সাম্প্রদায়িক’ মাছ ধরতে যাবেন না, তার বিপদ নিয়াই আমার আলাপ।
যে বিষয়ে হতাশ, তা তো কইলাম। এলা যে বিষয়ে আমি চমৎকৃত, তারে নিয়া বলি।
এই মুসলমান ও হিন্দু আলেম ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের পরবর্তি জেনারেশন, যাদেরে আপনারা জেনজি কইয়া ঠাট্টা করেন, তাদেরে লইয়া। এই মুসলমান ও হিন্দু আলেম ও পুরোহিত সম্প্রদায় বা ঐক্যপরিষদ, নানান পেশা ও এস্টাবলিশমেন্টের যারা নতুন প্রজন্ম, বা ছাত্র, বা তালেবে এলেম, তারা, লক্ষ্য করলাম, বেশ সচেতনভাবে এই ডগমার বাইরের ঘটনাই। এই অংশ ছাত্রদের সাথে সহমর্মি শুধু নয়, মাঠেও আছেন এবং আহত ও শহীদও হয়েছেন অনেক জায়গায়। গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেলেকচুয়াল তর্কও তৈরী করছেন। দেখবেন, নেতা ও শায়খ বা মওলভিদের ঐতিহ্যবাহি সংগঠনগুলো এইটারে সেকুলার আন্দোলন বইলা নাক সিঁটকালেও, এই আন্দোলনে মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রাণও জড়িয়ে আছে। তারাও একটিভ। আবার, আমি দেখি, আমার প্রতিবেশি যে ননপার্টিজান হিন্দু সিনিয়র, এই গণহত্যার দিনে বুড়া বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মত কইরাই কোথায় আওয়ামীলীগের কর্মী আহত, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হল, আর চেতনা ইত্যাদি নিয়া হাহাকারে থাকেন, ঠিক তার বিপরীতেই, তার মেয়েরা, ছেলেরা, যারা এখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মানে জেনজি জেনারেশন, তারা এই ডগমার বিরুদ্ধে ভাবতে, কথা কইতে ও দাঁড়াতে দ্বিধা করে না।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই দ্বিধাহীনতা স্রেফ ‘সাহস’ না, বুঝ। এইটা দারুন। তাদের সাথে কথা বললে বরং আপনি আলোকিত হবেন। আমি বলি কি, ইতিহাস ও সমাজের এই ডাইনামিকসগুলোরে ধীরে ধীরে পড়েন। তাড়াহুড়া না কইরেন।
পুনমুদ্রণ, ফ্রম মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে। পৃষ্ঠা ২০২। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। ফেব্রুয়ারি ২০২৫