Blogs

রিফাত হাসান

অসময়ের গান: আখ্যান ও পর্যালোচনা

August 20, 2013   0 comments   8:53 am
Primary Author: রিফাত হাসান

ছবি সূত্র: Demotix: The Network for Freelance Photojournalists/ http://bit.ly/18L0bAL গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের ঢল এসে একদিন শহর দখল করে নেবে, এই কবিতা দিয়ে যারা একদিন সাহিত্য গান করেছিলেন, সেই তারাই হেফাজতের গেঁয়ো মানুষদের গণহত্যাযজ্ঞ ও শহর ছাড়া করায় যৌথ বাহিনীকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। আমরা মনে রেখেছি আপনাদের বিপ্লব ও সাহিত্যকলা। কওমি মাদ্রাসা: আমার শৈশবের জবানবন্দী- শিরোনামের গদ্যের দ্বিতীয় পর্ব লেখার কথা ছিল। বন্ধু, শুভাকাক্ষি এবং আগ্রহীদের প্রচুর অনুরোধ এসেছে, এই লেখাটা যাতে অন্তত আর এক পর্ব লিখি। কিন্তু সেই পর্ব আর লেখা হল না কোনভাবেই। স্মৃতিকথা না হয় নাই লিখলাম, হেফাজত যে আন্দোলনের সূচনা করেছে, সেই আন্দোলনের একটা আলাপ/পর্যালোচনা লিখবো বলেছিলাম। সেটিও লিখে উঠতে পারি নাই। অথচ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন, আমরা যেইটাকে মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেছি, শহুরে মধ্যবিত্ত্বের, রাষ্ট্র ও রাজধানীর দুশ্চিন্তার বিষয় এখনো পর্যন্ত। হেফাজত, কওমি মাদ্রাসা, তাদের ১৩ দফা, এইসব এখন ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। সেই ইতিহাস জয়ের হোক অথবা পরাজয়েরই হোক। হেফাজত, ১৩ দফা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ইসলাম এইসবের একটা একত্র রাজনৈতিক পর্যালোচনা হাজির করা প্রয়োজন। বর্তমান লেখাটি সেটি হাজির করতে না পারার নোক্তা। বন্ধুরা ক্ষমা করবেন। এদিকে, হেফাজত কর্মীদের উপর গণহত্যাযজ্ঞ চাপা দেওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠী ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা যারপরনাই মরিয়া। শাসক শ্রেণী, বুদ্ধিজীবীমহল ও মিডিয়া এখনো পর্যন্ত এই হেফাজত ও মাদ্রাসা ছাত্রদের অমানবিক মূর্তি বানিয়ে…

Share

ছবি সূত্র: Demotix: The Network for Freelance Photojournalists/ http://bit.ly/18L0bAL

গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের ঢল এসে একদিন শহর দখল করে নেবে, এই কবিতা দিয়ে যারা একদিন সাহিত্য গান করেছিলেন, সেই তারাই হেফাজতের গেঁয়ো মানুষদের গণহত্যাযজ্ঞ ও শহর ছাড়া করায় যৌথ বাহিনীকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। আমরা মনে রেখেছি আপনাদের বিপ্লব ও সাহিত্যকলা। কওমি মাদ্রাসা: আমার শৈশবের জবানবন্দী- শিরোনামের গদ্যের দ্বিতীয় পর্ব লেখার কথা ছিল। বন্ধু, শুভাকাক্ষি এবং আগ্রহীদের প্রচুর অনুরোধ এসেছে, এই লেখাটা যাতে অন্তত আর এক পর্ব লিখি। কিন্তু সেই পর্ব আর লেখা হল না কোনভাবেই। স্মৃতিকথা না হয় নাই লিখলাম, হেফাজত যে আন্দোলনের সূচনা করেছে, সেই আন্দোলনের একটা আলাপ/পর্যালোচনা লিখবো বলেছিলাম। সেটিও লিখে উঠতে পারি নাই। অথচ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন, আমরা যেইটাকে মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলেছি, শহুরে মধ্যবিত্ত্বের, রাষ্ট্র ও রাজধানীর দুশ্চিন্তার বিষয় এখনো পর্যন্ত। হেফাজত, কওমি মাদ্রাসা, তাদের ১৩ দফা, এইসব এখন ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। সেই ইতিহাস জয়ের হোক অথবা পরাজয়েরই হোক। হেফাজত, ১৩ দফা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ইসলাম এইসবের একটা একত্র রাজনৈতিক পর্যালোচনা হাজির করা প্রয়োজন। বর্তমান লেখাটি সেটি হাজির করতে না পারার নোক্তা। বন্ধুরা ক্ষমা করবেন।

এদিকে, হেফাজত কর্মীদের উপর গণহত্যাযজ্ঞ চাপা দেওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠী ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা যারপরনাই মরিয়া। শাসক শ্রেণী, বুদ্ধিজীবীমহল ও মিডিয়া এখনো পর্যন্ত এই হেফাজত ও মাদ্রাসা ছাত্রদের অমানবিক মূর্তি বানিয়ে তার উপর জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের নায্যতা দিচ্ছে, হত্যাকারীদের আড়াল করছে। এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে রিপোর্ট করার অপরাধে অধিকার নামক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানকে গ্রেফতার করেছে সরকার, যদিও হেফাজত নেতৃত্ব বলছেন, ৫ তারিখ যে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, অধিকারের রিপোর্টে তার সামান্যই এসেছে। সরকার হতাহতদের তালিকা তৈরিতে বাধা দিচ্ছে, তাদের অভিযোগ। নোটের শুরুতে এইসব ঘটনা টুকে নিলাম, হেফাজতের আন্দোলন বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে যেন ভুলে না যাই, জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দায়টি। এলাহি ভরসা।

 

গণহত্যা ও মুক্তির তত্ত্ব

আমরা একটি মুক্তির গল্পের সাথে পরিচিত।  এইটাকে ওরা আলোকায়ন বলে।  এর বিবিধ প্রকাশ আছে।  যেমন, নারী-মুক্তি, গণতন্ত্র, সভ্যতা, মুক্তসমাজ।  এইসব আদতে খারাপ জিনিশ না।  অন্ধজনে আলো দেওয়া খারাপ তো নয়, জরুরি কাজও বটে।  তো, নাইন ইলেভেনের পর আমরা ড্রোন বিমানে চড়ে মুক্তি আসতে দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায়।  মুক্তির জন্য গণহত্যা।  এ এক অদ্ভুত মুক্তি ও আলো।  দাস, দাসত্ব খুব চটকদার শব্দ।  আপনি দাসত্ব থেকে মুক্তি চান।  সমস্যা এখানে নয়।  সমস্যা হলো, আপনি নিজের দাসত্ব থেকে মুক্তি চান না।  মুক্ত করতে চান এমন একটি গোষ্ঠীকে, যারা মনে করেন না তারা দাসত্বে আছেন।  অসভ্যকে সভ্যতা ও ভব্যতা শিক্ষা দেওয়া।  যেমন, ‘অসভ্য’ মুসলিম দেশসমূহকে ‘আলোকায়নে’র জন্য সেনা অভিযান।  এটাই জর্জ ডব্লিউ বুশ এর ঘোষিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।  ‘যা কিছু পশ্চিম, ইজরায়েল, ইহুদি এবং খ্রিশ্চিয়ান ট্রেডিশন বা সভ্যতা এবং শুভর সঙ্গে শত্রু-ভাবাপন্ন তাই সন্ত্রাসবাদ’।  এই মর্মে স্মরণে রাখা যেতে পারে।

বুশের সেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানের ভাষা, আমরা যেন না ভুলি।  এই ভাষা সব সময়েই এক।  দালাল মিডিয়াও সবসময়ই তৎপর ছিল।  ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ২রা আগস্ট ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামক পত্রিকায় তিতুমির ও হাজী শরিয়তের দল সম্পর্কে এই মিডিয়ারই বয়ান খেয়াল করুন: ‘ন্যায়পরায়ণ, স্বার্থশূন্য মহাত্মা ইংরেজ বাহাদূরের প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এই গোষ্ঠীকে যদি আমাদের বুকের উপর শক্তি সঞ্চয় করতে দেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রের সমূহ বিপদ হতে পারে।  এজন্যে সরকারের উচিত হচ্ছে ফরাজি ও ওহাবীদের সম্বন্ধে এবং আরো যেসব সম্প্রদায় ভারতের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক উচ্চাশ পোষণ করে, সেসবের তন্ন তন্ন করে তদন্ত করা। ’ (ওহাবী আন্দোলন: আব্দুল মওদূদ)।  মিডিয়া এখনও তৎপর, আমাদের দাসত্ব ও মুক্তির গল্প শোনায়।  দাসত্ব।

তাহলে শুনুন।  ৫ তারিখে মতিঝিলের গণহত্যার পরে, এই দাসত্বের বয়ান নিয়ে হাজির হল বাংলাদেশের একটি পপুলার মিডিয়া।  তাদের অপিনিয়ন, কওমি মাদ্রাসায় দাসত্ব চলছে।  তাদের সুপারিশ, এই দাসত্বের অবসান হোক।  তো, এরা একটি আলাপের আয়োজন করল এই দাস সমাজকে নিয়ে।  এই আলাপটা পড়লে আপনার এই শ্রেণীর মনঃতত্ত্ব বুঝতে সহজ হবে।  এই আলাপটি প্রয়োজন ছিল, সাম্রাজ্যের নতুন চাকরদের চরিত্র বোঝার জন্য।  ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাকর (সিভিল সার্ভেন্ট) ডব্লিউ হান্টারের জবানিতে দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস-এর যেই পাঠ, তার সাথে এই আলাপের পার্থক্য হলো, হান্টার সাম্রাজ্যের প্রতি তার বিশ্বস্ততা রক্ষা করেছেন, আবার এই শিক্ষা ব্যবস্হা নিয়ে আপাত গভীর একটা পাঠ করা চেষ্টা করেছেন, ব্রিটিশ সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেয়ার জন্য।  কিন্তু এই নতুন চাকরদের কেউই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্হা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও রাখার প্রয়োজন মনে করেন নাই।  কিন্তু মাদ্রাসায় মার্কস হেগেল লাকা পড়ানোর জন্য সংস্কার প্রস্তাব করে বসেছেন।  আলোচক ভদ্রলোক বলেছেন, আপনাদের ওখানে কী পড়ানো হয় আমি জানি না, কিন্তু হেনতেন পড়ানো উচিত।  (পড়ুন :: হেফাজতে ইসলাম: কওমি শিক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা :: / বিডিনিউজ/২০১৩-০৬-২৪)

তো, গণহত্যার পরে বা আগে, এইসব মুক্তির তত্ত্ব আসবে।  এটাই এই নতুন মুক্তির গল্প।

এই শিক্ষাব্যবস্হাকে নিয়ে, যেটাকে ওরা দাসব্যবস্হা বলছে ও মুক্তির গল্প শোনাচ্ছে, আলাপ বা পর্যালোচনা দাঁড় করাবার ন্যূনতম ক্ষমতা নেই আমাদের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের।  এই গোষ্ঠীর ব্যাপারে জানা শোনার মতো সম্পৃক্তিও দরকার মনে করে নাই এরা কখনো।  যতক্ষণ না মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোয় নিজেদের অবস্হান জাহির করতে পারল।  সেই ঘটনার সম্মুখীন হয়ে, এরা মাদ্রাসার ছাত্রদের বিরুদ্ধে দাস ও মুক্তির গল্পকেই অস্ত্র হিশেবে বেছে নিল।  বিদ্বজ্জন এইটারে এমবেডেড জার্নালিজম বলেন।  মানে, জর্জ ডব্লিউ বুশের বেডে শুয়ে যে জার্নালিজম, ইরাকযুদ্ধের সময়ে তৈরি হয়েছিল।  ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়ে এমন কিছু সাংবাদিকের জন্ম ঘটে, যারা মার্কিন বাহিনীর হয়ে কাজ করবে, গল্প বানাবে।  মার্কিন বাহিনীর গোপন তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেবে এবং সাথে থাকবে।  পরে কোন এক সময়ে এই ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন মার্কিন সেনা বাহিনীর একজন অফিসার এভাবে, ‘স্পষ্টভাবে, আমাদের কাজ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।  যুদ্ধের অংশ হল তথ্যযুদ্ধ।  তাই, আমরা চেয়েছি তথ্যপ্রবাহে আমাদের আধিপত্য বজায় রাখতে। ’ বলা বাহুল্য, বিশ্বজুড়ে এই গৃহপালিত সাংবাদিকতা সমালোচিত হয়েছে এবং একই সাথে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়েছে তথ্যপ্রবাহে আধিপত্য কায়েমের উসিলা হিশেবে।  আমাদের দেশে এখন সাংবাদিকতার এই নির্দিষ্ট ধারাটির পশার।  কোন নির্দিষ্ট ঘটনার বিবরণে মিডিয়াগুলোর ভাষা এবং গল্প দেইখা আপনি এই ধারাটি সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন।

যে মিডিয়াটি এই দাস হওয়ার গল্প বলে, আসুন দেখে নিই, সেই দাসদের গণহত্যার ব্যাপারে মিডিয়াটির কী অবস্হান।  গণহত্যা ও মুক্তির রাজনীতি, নাইন ইলেভেনের পর, আপনাকে খেয়ালে রাখতেই হবে।  তার আগেও চলেছে, কিন্তু নাইন ইলেভেনের পর এটি আরো স্পষ্ট হয়েছে।  কেউ যদি আপনারে বলেন, মুক্তি, তার মধ্যে গণহত্যার বাসনা লুকিয়ে আছে।  জর্জ ডব্লিউ বুশের বাসনা এখন আমাদের বাংলাদেশি মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।  দেখা যাচ্ছে, এটি সেইসব মিডিয়াগুলোর একটি, যারা কদিন আগে এই মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর গণহত্যার খবরকে গুম করে দিয়ে ছাপিয়েছে পবিত্র কোরআন ও কেতাব পোড়ার কাহিনী।  নয় ঘণ্টা ধরে ব্লাকআউট ও গণহত্যার পর মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করার জন্য আইন শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভিন্ন মহলের অভিনন্দনের গল্প।  কিন্তু কে কার দাস?

 

কিন্তু কে কার দাস?

মডার্ন এডুকেশনের প্রতি প্রশ্নহীন কলোনিয়াল মনোভঙ্গি ও সমর্পণ, রাষ্ট্রের নিজের আধিপত্যকামী সংস্কৃতির বাইরে সমাজে সজীব, চলমান অথচ মূলধারায় উপেক্ষিত সংস্কৃতিগুলোকে পাঠ ও তাদের সাথে সহাবস্হানের ভাষা তাদের আছে? তারা তো এই সব আধিপত্যকামী সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্হার প্রশ্নহীন দাস।  সর্বোপরি পুঁজির দাস।  যে সমাজে পুঁজিই ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরের প্রশ্নহীন দাস সকল প্রশ্ন করছে, দাস।  আধুনিক মানুষের এই মুক্তি চাওয়ার গল্প আর এক দাসত্বের অহঙ্কার থেকে উদ্ভূত।  আমরা ইতিহাসে আক্ষরিকভাবে দাসযুগ অতিক্রম করেছি, এইটারে অস্বীকারও করতে ভালবাসি।  কিন্তু পুঁজি-কাম আধুনিকতার দাস হওয়ারে গ্লোরিফাই করি।  সভ্যতা, আধুনিকতা, আলোকায়ন, এইসব।  নিজের এই দাস ব্যবস্হা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থেকে, যারা অনাধুনিক, পুঁজির প্রশ্নহীন দাস নহেন, তাদের মুক্তি প্রকল্প প্রস্তাব করি।  নচেত সামরিক অভিযান চালাও।  ঢাকা ছাড়া করো।  এইটা হলো, আধুনিক ও বর্ণবাদী মন, পুঁজির সেবাদাস শ্রেণী।  এদের এই সামরিক অভিযানেই আনন্দ।  এই মুক্তি চাওয়ার সাথে গণহত্যার বাসনা জড়িত।

এই দাসতাত্ত্বিকদের পূর্বানুমাণ হলো, আধুকিতা জগতের শেষ ও চূড়ান্ত পরিণতি।  তাই আধুনিকতার পূর্বানুমাণগুলোর ভিত্তিতে এরা অনাধুনিক বিষয়গুলোরে বিচার এবং শাস্তি দিতে ইচ্ছুক।  আধুনিকতার বাইরে কি কোন কিছুরই অস্তিত্ব সমভব নয়? এটি শুধু প্রশ্ন নয়, এই রকম সম্ভাবনা যদি আমি না ভাবতে পারি, তাহলে মানুষ হিশেবে আমার অস্তিত্ব অর্থহীন।  আমি মনে করি, এই মুহূর্তে আধুনিকতার বাইরে যারা চিন্তা করতে সক্ষম, তার মধ্যেই কেবল সম্ভাবনা জিইয়ে আছে।  সমভব হলে, ননসেন্স কিছু কথা কওয়া দরকার।  আমরাও কই, কবিতায়, তবে আধুনিক আধিপত্যবাদী ভাষায়।  আমাদের রেশনাল মন এই ভাষাটিরেও রেশনালিটির অঙ্গ হিশেবে তৈরি করে নিয়েছে।  তাই, এমন কি এই ভাষাটিরেও ভাঙা দরকার।

 

হেফাজত এর আন্দোলন

হেফাজতকে নিয়ে আমাদের বর্ণ ও সন্ত্রাসবাদী বুদ্ধিজীবীতা এবং রাজনীতির আখ্যান জানলাম।  কিন্তু হেফাজত কী বলছে।  হেফাজত বলছে, আমাদের আন্দোলন রাজনৈতিক নয়।  অনেকের সবিস্ময় প্রশ্ন: তাহলে কী ছিল আপনাদের আন্দোলন।  আমরা ইতোপূর্বে বলেছি, হেফাজত, ১৩ দফা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ইসলাম এইসবের একটা একত্র রাজনৈতিক পর্যালোচনা হাজির করা প্রয়োজন।  তো, দেখা যাচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে আমাদের যে বোঝাপড়া, হেফাজত সচেতনে বা অচেতনে তার অংশ নয়।  বা আদতেই হেফাজতের আন্দোলনটির স্বরূপ কী?

হেফাজত কোন নয়া রাজনীতির বয়ান প্রস্তাব করে নাই।  সে চেষ্টাও তাদের ছিল না।  ধর্মরাষ্ট্র বা ইসলামি রাজনীতির যে পপুলার বয়ান, যেমন উপমহাদেশে জামায়াত বা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্রাদারহুডের রাজনীতি, তার মধ্যেও ওরা যায় নাই।  বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো দলীয় রাজনীতিতেও ওদের আগ্রহ নেই।  আপনি বরং এর একটা সেক্যুলার চরিত্র পাবেন পপুলার ধর্মনিরপেক্ষ বয়ান মতে, যখন ওরা বলে যে, আমাদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, কিছু ন্যূনতম দাবি-দাওয়া আছে শুধু।  যা আপনারা যে কোন দলই সমাধান করতে পারেন।  নাগরিক অধিকারের জায়গায়, তাদের নিজেদের ভাষায়, কিছু দাবি-দাওয়া পেশ করেছে মাত্র ওরা।

এখন, ধরেন আপনি বা আমি যে আধুনিক ভাষাতে কম্যুনিকেট করি, তার মাধ্যমেই আমরা ওদেরকে বোঝাপড়া করার চেষ্টা করেছি সবসময়, এখনো।  তাই ব্যর্থ হয়েছি।  কারণ, আপনি যখন গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রর কথা বলবেন, সেই রাষ্ট্র বা গণতন্ত্র ওদের কাছে কী হিশেবে এবং কোন ভাষায় হাজির আছে তা দেখা জরুরি।  এখন আমরা যে ভাষায় ওদের বিষয়ে কথা বলি, তা অনেকটা ক্লাসিক্যাল এন্হ্রপলজিস্টদের গবেষণা পদ্ধতির কথা মনে করিয়ে দেয়।  যারা এইসবে কোন ধর্মীয় রাষ্ট্রের গন্ধ খুঁজে পান, তাদের বোঝাপড়া দুর্বল বা ফোবিয়াগ্রস্ত।  অনেকের মতে ওরা ব্লাসফেমি আইন এর দাবি করেছে।  এইটা অসত্য।  সত্য হলো ওদের তের দফায় ব্লাসফেমি আইনও নেই।  ওরা মুসলমানের নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারকারীদের বিচার ও শাস্তি দাবি করেছে।  এই দাবিকে আমি আপনাদের সম্মিলিত ঘৃণা প্রচারের বিপরীতে ওদের গণতান্ত্রিক আকাঙক্ষাা হিশেবে দেখি।  যে আকাঙক্ষাতে কোন ইনসাফকামী মানুষের দ্বিমত থাকার কথা নয়।

আপনি কারো ডিফেইম বা কুৎসা ও গালাগাল করার অধিকার রাখেন কিনা, এইটা সেক্যুলার প্রশ্ন।  ইতিহাসে ব্লাসফমি আইন নামে যা হাজির, তা মূলত একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙখলা রক্ষার প্রশ্ন, যা তার ভেতরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিবাদ এবং অস্হিরতাগুলো থেকে বাঁচিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্হাকে নিরাপদ করে।  ওদের দাবির মধ্যে ওরা কিছু কালচারাল প্রপোজিশনও রেখেছে, সেই আলাপটা আমরা নীচে করবো।  কিন্তু দেখুন, ওদের দাবি ও আন্দোলনের বিপরীতে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিউত্তর দিয়েছে বর্ণবাদী কায়দায়।  তাদেরকে অনাগরিক হিশেবে, সব মিডিয়া ও আলো থেকে বঞ্চিত করে, ব্লাকআউট ও গণহত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে।

 

২.

 

একবাল আহমেদ এর বয়ান ও হান্টারের বিবরণ

একবাল আহমেদ তাঁর Islam and Politics নামক লেখায় আলোচনা করেছেন, মুসলমান ও আলেম-ওলেমাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ কীভাবে ও কী কারণে পপুলার বয়ানে অরাজনৈতিক হয়ে উঠেছে ৬৫০ সালে উমাইয়াদের খেলাফত দখলের পর।  ট্রেডিশনাল আলেমগণ কেন মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামি চরিত্রকে অস্বীকার করে তার থেকে দূরে রাখে নিজেদেরকে, তার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ আছে বলে মনে করেন ইকবাল।  এক চার খলিফার পর থেকে হাতে গোনা কয়েকজন শাসক ব্যতীত (যেমন ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (৭১৭-২০)) বাকি কেউই ধর্মনিষ্ঠ নন (presumed impiety)।  দ্বিতীয়ত মুসলিম রাষ্ট্র কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষ (secular) আইন ও তার চর্চা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে প্রায় সর্বত্র।  তৃতীয়ত ইসলামি বিশ্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক খণ্ডাংশে বিভক্ত থাকলেও (যেমন সুলতানাত, আমিরাত, শেখ বা বর্তমানের প্রজাতন্ত্র) নীতিগতভাবে সকল ধর্মতাত্ত্বিকগণ স্বীকার করেন যে, একক মুসলিম উম্মাহ (Single Umma (Muslim Nation)) ও একজন খলিফার (Caliph (or Imam)) অস্তিত্ব ব্যতীত আর কিছুই ঐশী আইনে (Divine Laws) এবং রাসুলের উদাহরণে স্বীকৃত নয়।  একবালের মতে, উল্লিখিত তিনটি উপাদানের অনুপস্হিতিতে, আলেমগণ প্রায় এক হাজার বছর ধরে জন্ম নেওয়া মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব এবং আধুনিক কালের সরকার পদ্ধতি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনাকে অন্তত একটি শর্তে শিকার করে নিয়েছে- রাষ্ট্রক্ষমতায় ন্যূনতম ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে এবং জনসাধারণের ন্যূনতম আস্হা অর্জনে সক্ষম হতে হবে।  সূত্র: Islam and Politics, Eqbal Ahmad বাংলা অনুবাদটি মোহাম্মদ আজগর খান সম্পাদিত ও হাসান আজিজুল হক এর মুখবন্ধে অনুদিত ইসলামি রাজনীতি ও রাষ্ট্র: পাকিস্তান অভিজ্ঞতা / ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে নেওয়া, মূল টেক্সটের সাথে মিলিয়ে ইষৎ সম্পাদিত।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাকর (Civil Servant) ও উপদেষ্টাদের একজন ডব্লিউ হান্টারের বর্ণনা ইন্টারেস্টিং।  আলেমদের জিহাদি আন্দোলনে দিশাহারা ইংরেজ সরকারের জন্য একটি গবেষণা সন্দর্ভ তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলেন হান্টার সাহেব, যার ফলে তার বিখ্যাত দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস বইটি লেখা।  তার বইয়ের শুরুতে তিনি অবাক ও আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করেন, ‘মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা’ অকৃতজ্ঞ মুসলমানরা ‘প্রকাশ্যে কোন রকম রাখ ঢাক ছাড়াই শুধু একটা আলোচনাকে গুরুত্বের সাথে সামনে নিয়ে আসছে বারবার, সেটা হল, ইংরেজ বাহাদুরের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ করা ফরজ কিনা।  বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতেও শুধু এই আলোচনা।  উত্তর ভারতের আলেম সমাজ এবং বাংলার মুসলমানরা ফতোয়া ও ইশতেহার জারি করেছে জিহাদ নিয়ে।  এমনকি সংখ্যালঘু শিয়ারাও এ ব্যাপারে নিজেদের মুদ্রিত মতামত জানিয়েছে।  প্রত্যেক মুসলমানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সে ইসলামের খাঁটি পাবন্দ হয়ে চলবে, নাকি মহারানীর শান্তিপ্রিয় প্রজা হিশেবেই বাস করবে- সে সম্পর্কে। ’ তো বইয়ের শেষদিকে হান্টার সম্মুখ সমরগুলোতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বা জিহাদ মুসলমানদের উপরে ফরজ কি ফরজ নয়, এই নিয়ে আলেমদের মধ্যে যে ফতোয়াযুদ্ধ শুরু হল, তার বিবরণ দিয়েছেন।  ফতোয়ার বিষয়: দারুল হরবে, নাকি দারুল ইসলামে জিহাদ ফরজ।  মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির ফতোয়া, যেখানে পূর্বানুমান ছিল ইংরেজ অধ্যুষিত বাংলা হল দারুল ইসলাম।  সুতরাং এখানে জিহাদ ফরজ নয়।  আবার আর এক গ্রুপের ফতোয়া, যেখানে পূর্বানুমান ছিল ইংরেজ অধ্যুষিত বাংলা হল দারুল হরব, এবং এই দারুল হরব যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ ফরজ নয়।  পরের বক্তব্যটিকেই ইংরেজ সরকারকে প্রমোট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন হান্টার তার সন্দর্ভে।  এর ফলে এইটা একটা দারুল হরব হিশেবে প্রতিষ্ঠা পায়, আবার অন্যদিকে বেপরোয়া নেটিভদের জিহাদি আন্দোলন থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।  আজকে যে কওমি মাদ্রাসা ও তার নেসাব নিয়ে শাসক গোষ্ঠী আতঙ্কিত, তখনও হান্টার একই আতঙ্ক ব্যক্ত করেছিলেন।  হান্টার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে শুধু নয়, ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসা থেকে যারা বেরুচ্ছে, তারাও এক-একটা জেহাদ প্রচারকারী হুজুর।  এর কারণ হিশেবে তিনি মাদ্রাসার পাঠ্যে জেহাদের চাপ্টারকে দুষলেন।  সূত্র: দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার/ ১৮৭১/ অনুবাদ: আব্দুল মওদুদ।  আহমদ পাবলিশিং হাউজ।

একবাল আহমদের এই বয়ান বা হান্টারের এই বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ, যা হেফাজতের অরাজনৈতিক অবস্হানগুলোর ব্যাপারে আমাদের বোঝাপড়াতে সহযোগিতা করবে।  একবালের বয়ানে যে শর্ত তার সাথে হান্টারের বিবরণে যে ফতোয়ার কথা আমরা পাই, তার কিছুটা মিল আছে।  সেটি হল, মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করা বা রাষ্ট্রক্ষমতায় ন্যূনতম ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করার শর্ত।  হেফাজতের ঘোষণায় দেখা যায়, এইরকম কিছু শর্তে ওরা আজও অরাজনৈতিক হয়ে থাকছে, তাদের আন্দোলনে, তাদের কর্মসূচিতে, নিজেদের ভাষায়।

 

৩.

 

পর্যালোচনা

হেফাজতের আন্দোলনের ভাবটি হচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যার ভেতরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া আন্দোলনটিকে একটা জাতীয় রূপ দিয়েছে।  হেফাজতের আন্দোলন আমাদের নাগরিক অধিকার ধারণাটির বর্ণবাদী অংশটিরে প্রশ্ন করতে সক্ষম হয়েছে।  ঘৃণা প্রচারের বিরুদ্ধে এদের আন্দোলনকে আমরা মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বলি।  এদের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক নয়, বড়জোড় র্যাডিক্যাল বলা যায়।  এরা আধুনিকতার প্রশ্নহীন ভোগী নয়, যা আমাদের ভোগী ধারণার জীবন-প্রশ্নের সাথে এদের সম্পৃক্ত করে না।  তাই আমরা বর্ণবাদী এদের সাথে আচরণে।  কিন্তু এর বাইরেও হেফাজতের আন্দোলনের নিস্পৃহ পর্যালোচনা করা দরকার।

অন্যান্য ধর্মীয় ভাবধারাগুলোর মধ্যে ইসলামের গুরুত্ব হচ্ছে, এটি ইহজাগতিক প্রশ্নগুলোর অমীমাংসা রেখে দেয় না, মোকাবেলা করতে বলে।  রাজনীতি, রাজনৈতিকতা, আইডিয়া, আইডিওলজি- এইসব শব্দের সাথে ইসলামের যে ক্লাসিক্যাল আকিদা, চিন্তা, উম্মাহ ও খেলাফত ভাবনা, তার সম্পর্ক ও ব্যবধান এখনতক পদ্ধতিগত দিক থেকে আলোচনায় খুব একটা হাজির নেই।  আধুনিক রাষ্ট্র ভাবনার অন্দরমহল থেকে ইসলাম প্রশ্ন তোলার জন্য আলাপ দরকার।  এটি পরিষ্কার না করে কথা বললে ধোঁয়াশা তৈরি হয়।  আমি মনে করি, ইসলামের ভেতর থেকে কোন ইসলাম প্রশ্ন উদয় হয় না।  ইসলাম প্রশ্ন হলো যখন আপনি বাইরে থেকে ইসলামকে মোকাবেলা করতে চাহেন, সে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্হায় বা আপনার বিপ্লবী চিন্তায় বা আপনার পুঁজিবাদী আগ্রহে ইসলামরে কীভাবে জায়গা দেবেন, সেই প্রশ্ন।  আবার, ইসলামের জায়গা থেকে আধুনিক রাষ্ট্রভাবনা ও রাজনীতিরে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, হেফাজতের এই বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা পলায়নপর, আমাদের রাজনৈতিক অভিপ্সা নেই দ্রষ্টব্য।

আমরা বলেছি, হেফাজতের ভাবটি হল সাংস্কৃতিক আন্দোলন।  তো, কালচারাল প্রপোজিশন রাজনৈতিক দাবি দিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় না।  এইটা তো ঐতিহাসিক অর্জনের ব্যাপার।  আবার লক্ষ্য করুন, হেফাজতের ইনসাফের ধারণাটি কেমন।  এতগুলো মানুষ মারা যাবার পরও এই হত্যাযজ্ঞের বিচার এদের কনসার্ন নয়।  এরা বলছে, এই তের দফা মেনে নিলেই এদের আর কোন অভিযাগ নেই।  রাজনৈতিক দাবি, যেমন কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার প্রশ্ন রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়াটা আরো নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করা।  আমি মনে করি, কাউকে মুসলিম বা অমুসলিম ঘোষণার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে না।  রাষ্ট্র প্রশ্নটির ফয়সালা না করে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্হা ও বিশ্বাস পুনঃস্হাপনের প্রশ্নটি রেটরিক।  কোরআন ও সুন্নাহবিরোধীসব আইন বাতিল করার প্রশ্নটি একবালের বিশ্লেষণমতে সেই রাষ্ট্র থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার শর্তসমূহের একটি।  একই সাথে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বয়ানগুলো থেকে নিজেদের পলায়নপরতা।

নারী প্রশ্নের ঐতিহাসিক মীমাংসা করতে ব্যর্থ এই আন্দোলন।  আমি মনে করি, এখানে ওভারলেপ করার সমস্যাটি বড়।  যে কোন স্হানিক ইতিহাসের বিশেষ পরিস্হিতিকে বর্তমানে যান্ত্রিকভাবে পুনরুৎপাদনের বিষয়টিকে ইসলামের ধর্মীয় বিধি বিধানের সাথে গুলিয়ে ফেললে যা হয়, তা সারা দুনিয়াব্যাপী আরবীয় ইসলাম বা আরো বহু খণ্ডিত বয়ানের জনক।  এর সাথে বাঙালি মুসলমানের (ছফা অর্থে নয়, বাঙালি মুসলমান বিষয়ে ছফার বয়ান খণ্ডিত ও হীনমণ্য।  প্রথমত মধ্যযুগীয় পুঁথির পাঠ ছফায় খুব সমতলীয়।  দ্বিতীয়ত ছফার ইতিহাস ভাবধারা ‘প্রগতি’, ‘আলোকায়ন’ ইত্যাদির সাথে একীভূত, বিশিষ্টার্থক নয়) প্রাণের সম্পর্ক রচিত হয় নাই কোনদিন, ইসলামের সম্পর্ক কদ্দুর তা তো বাহাসের বিষয়।

এর সাথে আছে নারী বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি।  সভ্যতায় নারী ও পুরুষের যোগ্যতা, অবস্হান ও অবদানকে আমি মনে করি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বিবর্তন।  নারীর বিষয়ে ইসলামের অবস্হান তাই, যা আরবে বহু বছরের নারী ধারণাকে প্রশ্ন ও বাতিল করে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।  এর উদ্দেশ্য নারীকে বাতিল করা নয়, বরং পুরুষের সহযোগী হিশেবে সমান্তরালে জায়গা দেওয়া।  রসুলুল্লাহর সময়ে মসজিদে নারীর জন্য জামায়েত হতো, যা হযরত ওমরের আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয়।  আমি মনে করি, ইতিহাসের এই ঘটনা ইসলামের সভ্যতাকে ব্যাহত করেছে ও বহু বৈষম্য এবং বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে।  এখানে ইসলাম কাজ করে নাই, কাজ করেছে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা পুরুষতন্ত্র।  ইসলাম দাসপ্রথাকে যেমন সরাসরি নিষিদ্ধ করে নাই, কিন্তু দাস বানানোর যে সভ্যতা, তার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।  নারীর ব্যাপারেও ইসলামের কথা তাই।  সভ্যতার মৌলভি প্রভুরা দাসের ব্যাপারে মুক্তকণ্ঠ হতে পারেন না, কারণ বর্তমানে আমরা আক্ষরিক অর্থে দাস প্রথাকে ইতিহাসে অতিক্রম করে এসেছি।

সভ্যতার মৌলভি পুরুষেরা নারীর ব্যাপারে মুক্তকণ্ঠ এখনো হন, কারণ ঐতিহাসিকভাবে আমরা পুরুষতন্ত্রকে এখনো অতিক্রম করতে পারিনি।  বরং জীবনে যাপনে দর্শনে বয়ানে আমাদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রই হাজির থাকে।  আপাতত এদ্দুর।

নোট:

‘Frankly, our job is to win the war. Part of that is information warfare. So we are going to attempt to dominate the information environment.’, when asked why the military decided to embed journalists with the troops, Lt. Col. Rick Long of the U.S. Marine Corps replied. Postmortem: Iraq war media coverage dazzled but it also obscured, Jeffery Kahn, NewsCenter, 18 March 2004

 

Leave the first comment