জীবপ্রেম ভালই। দরকারিও।
এই ধরণের মানবিক গুণগুলোর বোঝাপড়ার সহিত বিকাশ দরকার।
জীব ও জীবন নিয়া আপনার বোঝাপড়া ও দার্শনিক অবস্থান কী? পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র নিয়া আপনি বোঝাপড়া ও দরদ নিয়া ভাবেন কি? কীটনাশক দিয়া পোকামাকড় খুন করে বিষযুক্ত সবজি ও ফলমুলের বাজার তৈরী, বীজের আদিরূপ নষ্ট কইরা জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড বীজ নিয়া আপনার অবস্থান কী? আপনি কেন চিড়িয়াখানা ও ইকোপার্ক ভালবাসেন আর বন উজাড় কইরা দালানকোঠা বানান, ভাবেন কি?
এইসব বোঝাপড়া বাদ দিয়া আপনার জীবপ্রেমটি কেমন?
খণ্ডিত। সাম্প্রদায়িক। দেখা যাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে আপনার জীবপ্রেমের ভাবের মধ্যে গুজরাটের জল্লাদ মোদির গো-রক্ষা আন্দোলনে নিজের কন্ট্রিবিউশনচিন্তার বাইরে কিছু নেই। ফলত গণহত্যাকাঙ্ক্ষায় ভরপুর। কেবল মুসলমান ও দলিতের অধিকারহরণকারী। যে আন্দোলন নিজেই জীব হত্যার আন্দোলন, জীবপ্রেম বহুত দূরের বাত।
মূলত, গরু নিয়া বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী সমাজের যে অতিরিক্ত সেনসিটিভিটি, তার সাথে নিখিল ভারত গো-রক্ষা আন্দোলন ও ভারতে মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়ারে ডেমনাইজ করে মেরে ফেলার, রাষ্ট্রহীন করার যে বর্ণহিন্দুত্ববাদী প্রকল্প ও আক্রোশ, তার সম্পর্ক আছে।
এই সম্পর্করে পইড়েন, পশুপ্রেম পড়ার আগে।
গরু জবাইর অধিকার সংক্রান্ত লড়াই এই অঞ্চলের মানুষের বহু পুরনো।
সেই শ্রীহট্টের দিন থেকে আধুনিক মহাভারতসপর্যন্ত।
দুই.
উপমহাদেশে গরুরাই যে একচেটিয়া রাজনীতি, সংস্কৃতি, আর্ট, সাহিত্য ও খাদ্যরুচি নিয়ন্ত্রণ করছে, শরৎচন্দ্রের গফুর থিকা আজকের চারুকলা, এইটা কীভাবে ঘটে গেল?
বা, শরৎবাবুর মহেশ কেন গফুরই লালন করে, কেন মহেশচন্দ্র নন, এইটা ভাইবা দেখেছেন? কেন তিনি অন্য সব ছাইড়া গরুরেই বাইছা নিলেন গল্পের তরে? অন্য গৃহপালিতরে ছাইড়া এই যে গরুরে বেছে নেওয়া, এইটা ধর্মীয়। আর ছাগল, বা পাঁঠা তো বিসর্জনযোগ্য, হিন্দু ধর্মে। তাই তারে নিয়া গল্প নেই। গল্প হবে দেবতারে নিয়া, যারে মুসলমান সমাজ কোরবানি দেয় ও খাদ্য হিশেবে গ্রহণ করে।
দেখবেন, এই মানবিক মর্মই পরে আইসা ভারতে গরু খাওয়ারে ডেমনাইজ করে, এবং তারে পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার স্পিরিট তৈরী করে।
তিন.
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ আর মওলানা আরশাদ মাদানীরা গরু কোরবানিরে নিরুৎসাহিত কইরা ফতওয়া দিছেন। সম্ভবত দেওবন্দ মাদ্রাসারও দুই হাজার একুশ সালে এইরকম নির্দেশনা ছিল। উপমহাদেশে মুসলমান জনমানসে সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশের এই ফতওয়া কিছুটা হৈচৈ তৈরী করতেছে এই বঙ্গের সংখ্যাগুরু মুসলমান মানসে।
আমার মতে, এই ফতওয়া এবং হৈচৈ ভাল।
আমি, সব সময়, ক্ষমতার বাইরে থাকা ধর্মীয় জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে উপদেশ ও উদার ধর্মীয় চিন্তা, তারে গুরুত্বের সাথে নেই। বাকি, যখন আপনি সংখ্যাগুরু ও বিজয়ী হিশেবে ধর্মীয় মতামত ও ফতওয়া দেন, অইখানে ধর্মের সাথে সাথে পাওয়ারের মতামতও থাকে। এই পাওয়ার, মানে ক্ষমতাসম্পর্কের বাইরেই ধর্মীয় মতামতরে বিবেচনা ও পড়তে পারা দরকার।
ব্যক্তিগতভাবে গরুর মাংস আমার, বা অনেকেরই মোটামুটি পছন্দের খাবার বটে। অন্তত মুসলমানদের তো বটেই। ভারতের বিশ কোটি মুসলমানের বড় অংশ, আরশাদ মাদানি বা আর আর দেওবন্দ আলেমদেরও, অন্তত অভ্যাসবশত, তাই হবার কথা। আরশাদ মাদানিদের এই ফতওয়া তাদের এই পছন্দের কোরবানি বটে। কোরবানি হিশেবে নিতান্ত ছোট নয়।
এটুকুর বাইরে গরুর গোশত নিয়া অবসেশন, বা গরুই চলবে, এরকম ধর্মীয় তর্ক বা অবস্থান বোধ হয় আমাদের, বা কারুরই নেই। আরশাদ মাদানিদের তো নেই-ই, ফতোয়াতেই দেখা গেল।
এলা কই, এটুকুতেই তর্ক শেষ হতে পারতো। আদতে তা হবার নয়। কেননা, তর্কটা মোটেই এই জাগার না।
চার.
তর্কটা কোন জাগার?
জিহাদ যখন ফতওয়া, মানে ডিসকোর্সের বিষয় হল, তখন ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের উপর ‘জিহাদ ফরজ হল কিনা’, তাই নিয়া প্রচুর ফতওয়া চালাচালি হইত। এর বহু আগে, যখন ডিসকোর্স তেমন কইরা দাঁড়াইতে পারে নাই, তখন শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের কোন এক অত্যাচারী রাজা গোবিন্দর কথা আমরা জানি, গরুর মাংশ খাওয়ার খবর চাওড় হওয়ার পরে বোরহান উদ্দীন নামের এক মুসলমানের পুত্র হত্যা করে গোবিন্দ, এর প্রতিকারার্থে বুরহানুদ্দীনের অনুরোধে এইখানে হজরত শাহজালালের আগমন ঘটে ও সেই রাজা গোবিন্দের প্রলয়ঙ্করি জাদুবান ও প্রবল সৈন্যদলের বিরুদ্ধে তার অলৌকিক শক্তি দিয়ে জিহাদ কইরা পরাজিত করেন।
আমরা এই কাহিনী ছোটবেলায় অনেকেই পইড়া থাকব।
এই ঘটনায় মুসলমানদের ডিসকোর্স বা ফতওয়ার দরকার পড়ে নাই। আবার, এখন অন্যদিন, সেই ফতওয়া ও ডিসকোর্সের কালও শেষ। স্রেফ রাখঢাকহীন ক্ষমতা, ট্রাম্পের উত্থানের কালে কইছিলাম।
তো এইকালে আপনি ভারতে ফ্রীজে গোমাংশ রাখার অপরাধে পিটিয়ে হত্যা, জয় শ্রীরাম বা হনুমান কইতে বাধ্য করা ও কথায় কথায় নানান ছুতোয় মুসলমানদের অত্যাচার ও হত্যারে কোন তরিকায় মোকাবেলা করবেন?
দেখা যাচ্ছে, ঠিক আগের কোন তরিকা এখানে কাজ করছে না আর। নতুন তরিকা লাগবে।
বড় বড় মুফতিরাও আর ফতওয়া বা জিহাদ ফরজ কিনা, এই ধরণের আলাপে অনিচ্ছুক, আইএসের মত বহুজাতিক সংগঠনগুলো এখন ‘জিহাদ’ বইলা একটা ব্যাপারের দায় নিছে। উপরে যে, ভারতের মুসলমানদের প্রাচীন ও প্রভাবশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ ও তার মুফতিরা আলাপ করছেন যে, ভারতের মুসলমানেরা গরুর মাংশ না খাওয়া সহিষ্ণুতা ও মহানুভবতার পরিচয় হবে বরং, এইটা এই অনিচ্ছারই অংশ, খানিকটা। ফলত, দেখা যাচ্ছে, বিজেপি-আরএসএস এর এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও নিখিল ভারত গো-রক্ষার মোকাবেলারে মুসলমান ধর্মবেত্তাদের প্রভাবশালী অংশ খাদ্যরুচির কোরবানি বা হালাল হারাম দিয়া সুরাহা করছেন। এই সুরাহা উপমহাদেশে উদার মুসলমানি চিন্তার ধারা তৈরীতে ভূমিকা রাখবে, নিঃসন্দেহে। গরুর মাংস, মানে খাদ্যাভ্যাসেরও এমন একটা সমাধান করা গেল না হয়, মুসলমানরা সেক্রিফাইস করবেন ও মহানুভব হবেন। কিন্তু উদার হিন্দু ও হিন্দু মানস তৈরী করতে হেল্প করবে কি, যে কখনো অন্যের খাদ্যরুচি ও ব্যবস্থার উপরে খবরদারি করতে তৎপর হবে না?
জয় শ্রীরাম বা জয় হনুমানের যে অত্যাচার ও খুন খারাবি, তারে এই নয়া ডিসকোর্সহীন সময়ে ভারতের মুসলমানরা বা মুসলমান ধর্মবেত্তারা আর কোন কোনভাবে মোকাবেলা করবে?
পাঁচ.
মোদির গো-রক্ষা আন্দোলনের সাথে যে মিল বা এলাই, তার কথা বাদই দিন। খোদ বাংলাদেশে এই নতুন প্রজাতির জীবপ্রেমিদের পলিটিক্যাল আইডিওলজি কেমন? দেখা গেছে, বিচারালয়ে তারা ‘ফাঁসি, কেবল ফাঁসিই হবে বিচার’ ধরণের আন্দোলন শাহবাগের উগ্র সমর্থক। গুম, খুন ও জননিপীড়ণ প্রশ্নে তাদের সিংহভাগকে প্রায়ই সংসারবিরাগি ভাবলেশহীন সন্যাসী ভাব বা রুদ্রাক্ষমালা পরিহিত সশস্ত্র কাপালিকের ভাব ধইরা বইসা থাকতে দেখা যায়, যেন কচি খাইয়া ফেলাই উচিত।
ছয়.
আপনি কী খাইতে পারবেন বা পারবেন না, এইটা নির্ধারণের আবদার ক্ষমতার ব্যাপার। নিরীহ সংখ্যালঘু প্রশ্ন না। আরএসএস মোদির নিখিল ভারত গো-রক্ষা প্রকল্পের আদলে ইস্টবেঙ্গলেও গরুর মাংস খাওয়া ও সংরক্ষণ প্রশ্নে সেন্সর-ঘেন্নার আলাপ সামনে আসছে। ভারতের ঘটনা থেকে এইটারে আলাদা কইরা পাঠ করবেন কীভাবে?