রিফাত হাসানে আমার একটা অরগানিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বেশ আগে, অরগানিক বলতে বোঝাই, ফেইসবুকের কারো শেয়ার বা অন্য কোনো লেখক-চিন্তকের রিভিউ বা কারো আলাপ আলোচনায় তার নাম শুনে না, টাইমলাইনে তাকে অনেক আগ থেকে দেখতে দেখতে তাকে চেনা হয়ে উঠতে থাকে, কীভাবে এটার শুরু সেটা এখন আর মনে পড়ে না। তবে এতটুকু নিশ্চিত কোনো রেফারেন্সের মাধ্যমে তাকে আমার চেনা হয়ে ওঠেনি, ইন্টারেস্টিং!
তরুণদের কাছে, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ‘ইন্টেলেকচুয়াল’দের মধ্যে রিফাত হাসান অন্যতম। তার এই ইনফ্লুয়েন্স অতিরিক্ত মাত্রায় ডান শিবিরে; আবার বাম শিবিরে, আমার মনে হয়, রিফাত হাসানকে নিয়ে উচ্ছ্বাস এর চেয়ে নীরবতা বেশি, হতে পারে এটাও একটা সম্পর্ক। আমার আশপাশে অনেক উঠতি তরুণকে রিফাত হাসানের মতো বলতে চেষ্টা করতে দেখি, মানে রিফাত হাসান একটা প্রবণতা হিসেবে হাজির হচ্ছেন, এটা একটা ডেঞ্জারাস (ডেঞ্জারাস মানেই খারাপ বা ভালো সে রকম না) দিক। এমনকি, তার বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তারাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই রিফাত হাসান প্রবণতায় আক্রান্ত। এ ছাড়া ফেইসবুকে এই প্রবণতা হামেশা দেখা যায়।
এই যে একটা প্রবণতা হয়ে ওঠার বিষয়, এটা মন্দ কী ভালো সে হিসেবে যাবো না (আগেই বলে রাখি, আমার কোনো গন্তব্য নেই), এটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবণতা হয়ে উঠতে প্রথম যে ধাপগুলো পেরোতে হয়, সেগুলো পেরোনো অধিকাংশের এক জীবনে হয়ে ওঠে না।
রিফাত হাসান বিষয়ক আমার এই অবতরণিকা থাকুক, এই অবতরণিকার দরকার আছে। যতই রিফাত হাসানের কথা বলি না কেন, এই লেখা শেষ পর্যন্ত পাঠকের নিজেরই রিভিউ কেন না বিশ্বাস করি পাঠ রিভিউয়ের নামে আসলে যা হয় তা নিজেরই এক ধরনের উত্থাপন।
রিফাত হাসানের বইটা আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। বহুদিন পর একটা বাঙলা বই টানা একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লাম। এটা সম্ভব হয়েছে তার ভাষার গতিময়তার চেয়ে, ভাষার চমকের কারণে। আর এই চমকের প্রধান হাতিয়ার হলো প্রশ্ন, ডিনায়াল আর প্রতিরোধ। মানে তিনি প্রাঞ্জল গতিময় ভাষা দিয়ে বলতে বলতে হঠাৎ একটা প্রশ্ন উত্থাপন করে দেবেন, যেটা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন, অন্তত সেই সময়ে। কিংবা তিনি, কথা বলতে বলতে হঠাৎ সরে যাবেন, নতুন রাস্তা ধরা শুরু করবেন, ফলে একটা চমক এসে হাজির হবে। আর নন-ফিকশনের গদ্য এ রকম লেখা যায় এবং লিখে এভাবে একটা বইতে ধরে রাখা যায়, এই মুনশিয়ানা বর্তমানে খুব কম লোকের আছে। নন-ফিকশনের প্রচলিত গম্ভীর এবং শক্ত গদ্য কাঠামোকে ভেঙেচুড়ে এ ধরনের একটা আড্ডা-মেজাজি নন-সিরিয়াস ভাষা এবং সরলতায় রূপ দেয়া যায়, কিছুকাল পূর্বেও এটা ছিল অসম্ভব। অনেকেই হয়তো চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রিফাত হাসান পেরেছেন। নোক্তা হিসেবে একটু বলে না রাখলেই নয়, রিফাত হাসানের এই আপাত ভাষা (আমি যেটাকে আসলে ভঙ্গি বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য করি) কোনো বিপ্লব না এবং নন ফিকশনের যেই প্রচলিত ফর্ম, ফর্মেট বা ভঙ্গি, তার সাবস্টিটিউটও না।
এখন এই পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলা যাক। পাঠের আসলে প্রতিক্রিয়া হয় না, পাঠ-প্রতিক্রিয়া বলে আমরা যা চালিয়ে দেই সেগুলোর সঙ্গে আসলে কনটেন্টের খুব একটা যোগ নেই, বরঞ্চ কনটেন্টের প্রতিক্রিয়ার কথা বলে আমরা আমাদের কথাই বলি। ফলে এই পাঠ প্রতিক্রিয়াকে সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই, এই পাঠ প্রতিক্রিয়া অনেকটা পাঠকের নিজের বোঝাপড়ার দাখিলা, রিফাত হাসানের এই বইকে অবলম্বন করে। কিন্তু এটাই জরুরি লেখকের জন্য, তার বই বা লেখা, অন্যকে কীভাবে নিজের বোঝাপড়ার সামনা-সামনি করে ফেলতে পারে, যদি পারে, সেটা একটা অনবদ্য বিষয় ওঠে।
একটা বস্তু বই, তার মধ্যে যে অক্ষর সেগুলো আধা-জীবন্ত ভাইরাস (ভাষাকে আমি আধা জীবন্ত ভাইরাস ভাবি, যা লেখক বা পাঠক তথা পোষকের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে) আর এর মাধ্যমে আমরা জীবন্ত (কিংবা মৃত) লেখকের কাছে গিয়ে পৌঁছাই। এই যে এক রহস্যময় জার্নি, এটা সব সময়ই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। রিফাত হাসান হয়তো বলবেন, এটা একটা ‘সম্পর্ক’, তো সে সম্পর্ক নিয়ে এগোনো যাক।
‘টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা’ এই নামটাই এই বই নিয়ে আগ্রহ জাগানোর জন্য যথেষ্ট। ব্যক্তিগতভাবে, এই নাম শুনে আমার মনে হয়েছে, বাহ, সেইরকম তো! বইয়ের ভেতরে ঢোকার আগে কিংবা বই বাজারে আসার আগে নামকরণের যেই বিষয়টা, সেখানে রিফাত হাসান বেশ একটা খেলা খেলে দিয়েছেন। বইয়ের ভেতরে তিনি‘বিসমিল্লা’তে টেক্সট ইমেজ রূপকথা ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি মেলা আকর্ষণীয় শব্দ দিয়ে একটা ভূমিকা লিখেছেন বটে, তবে, এই চমৎকার নামের জন্য আর কোনো ব্যাখ্যাই দরকার পড়ে না।
এই বইয়ের টানা প্রতিক্রিয়া লেখা একটু কষ্টকর, কারণ, লেখক নিজেই বলেন, ‘লেখালেখি, শিল্প, বন্ধুত্ব- আমার কাছে তার নির্দিষ্ট ফর্ম নেই। যে কারণে আমি ফর্মের চেয়ে যোগাযোগ খুঁজি…’
এটাকে চাইলে একটা লেখকের আত্মরক্ষা হিসেবেও দেখা যায়, মানে কেউ যদি দেখতে চায়। কারণ আসলেই, এই বইয়ের কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম নাই।
চারটি সাক্ষাৎকার, এর মধ্যে একটি অতি-দীর্ঘ, আর একটি আসলে আলাপচারিতা। এই সাক্ষাৎকারগুলোতে রিফাত হাসানকে পাওয়া যাবে। একেবারে ‘র’।
সাক্ষাৎকারগুলোর আলোচিত নানা বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দেয়াটা অসম্ভব, তবে চুম্বকের আকর্ষণটাকে তুলে আনা যায়। যেমন বানানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, তিনি অরুন্ধতি রায়কে নিয়ে ইন্টারেস্টিং একটা মন্তব্য করেছেন যে, অরুন্ধতি রায় আসলে বেসিক্যালি এলিটিস্ট। আর অভিযোগ করেছেন, ভারতের বাংলাদেশ পলিসি বিষয়ে তার যে কোন শক্ত কথাবার্তা নেই। মন্তব্য করেছেন, এগুলো নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে, প্রশ্ন তুলতে হবে।
অরুন্ধতি রায়ের বাংলাদেশি ভক্তদের বিষয়ে তার অবস্থান ইন্টারেস্টিং। তার ‘ক্যান অরুন্ধতি স্পিক?’-এ কাশ্মীর এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে অরুন্ধতির অবস্থান এবং বাংলাদেশে যাদের সঙ্গে তার মেলামেশা, মানে বন্ধুত্ব এবং সম্পর্ক আর কী, সেটা নিয়ে একটা রেডিক্যাল অবস্থান আছে।
বানানের সঙ্গে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, প্রায় ৩২ পৃষ্ঠা, বারবার ঘুরেফিরে একই জায়গায় আসা, এলোমেলো প্রশ্ন অনেক, উত্তরের মাঝখানে প্রশ্ন, টপিক থেকে টপিকে অসময়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে, মনে হতে পারে, একটু ঘষামাজা করে দিলে পাঠকের জন্য বেশি সুখপাঠ্য হতে পারতো। কিন্তু ঐ যে ফর্মহীনতার প্রতি তার যে দরদ, সেটা কনসিডার করলে, এই সাক্ষাৎকারে এসে বোঝা যায়, তিনি ফর্মহীনতাকে বেশ দুর পর্যন্ত টেনে নিতে পারেন, এটা সাহসের বটে।
রিফাত হাসানের প্রশ্ন তোলার বিষয়টা অনেকটা নির্মোহ এবং নির্মম। এ ছাড়া তিনি পার্টিজান আলোচনার বাইরে গিয়ে একটা নতুন বুদ্ধিজীবীতার ছক আঁকতে পারেন। পার্টিজান বুদ্ধিজীবীতার বাইরে গিয়ে তার যে চিন্তা, সেটাকে অনেকের কাছে বেশ একটা মুগ্ধ হবার মতো বিষয়। এটা সত্যি যে, পার্টিজান আলোচনা বা ক্রিটিক এখন আর শোনার যোগ্য না। অত্যন্ত সরল যে, পার্টিজান ক্রিটিক কিংবা বুদ্ধিজীবী শেষ পর্যন্ত কোন বন্দরে গিয়ে নোঙর ফেলবেন, সেটা আগ থেকে অনুমেয়, কত নটিক্যাল মাইলে তিনি কোন রুট দিয়ে যাবেন সেটাও অনুমেয়। ফলে বহুদিন হলো, পার্টিজান বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে মৃত, কিংবা তারা কেবল দলীয় পাণ্ডাদের তর্কের খোরাক জুগিয়ে চলছেন। এর মধ্যে নিরপেক্ষতার ভেকধারীরাও আছেন। ফলে সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রিফাত হাসানের এই যে নন-পার্টিজান ক্রিটিক অবস্থান, বা তার প্রশ্নের পতাকা, এটা দৃশ্য হিসেবে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং চমকপ্রদ! তরুণেরা সম্ভবত এ কারণেও রিফাত হাসানের ভক্ত। তার এই নন-পার্টিজান অবস্থান তাকে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা এবং ছোটলোকি থেকে মুক্ত করেছে, ফলে এক ধরনের ইনোসেন্স তার চিন্তায়, একটা সরলতা তার বলায়, সেটা আকৃষ্ট করে, এবং এটা এভেইলেবল না, এটা নতুন। আমি তার নন-পার্টিজান অবস্থান পছন্দ করি কিন্তু এর ক্রিটিকও করি, বিশেষত এই দুঃসময়ে, যখন পার্টিজান আলাপকে কখনো কখনো মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং রক্তে গোসল করতে হয়, তখন অন্তত বিশেষ কিছু জায়গায় পার্টিজান আলাপই/অবস্থানই দরকার। সে আলাপ সব সময়ে, একটু টেকনিক্যালি হলেও, এড়িয়ে যাওয়া রিফাত হাসানের মধ্যে আছে। আমি এটার ক্রিটিক করি।
শাহবাগ প্রশ্নে রিফাত হাসানের বিস্তর লেখালেখি আছে, এই বইয়েও আছে। আশ্চর্য, এই বইয়ে সাক্ষাৎকারে তাকে জামাতি বলছিল (আসলে ভেবেছিল) একজন। পড়ে আমি যারপরনাই অবাক হয়েছি। এই বই এবং অন্যান্য জায়গায় রিফাত হাসানের যে শাহবাগ অবস্থান, সেটা একেবারেই একটা লিবারেল অবস্থান শুধু নয়, আমার মনে হয়েছে বিপজ্জনকভাবে তিনি লিবারেল। তিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ন্যায়সংগত কিনা সেই প্রশ্ন তোলেন। মনে হয় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিতান্তই একটা ‘বিচারিক’ বিষয়, যদিও, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির প্রসঙ্গে বিচারিক বিষয়টি সবার শেষেই আসতে পারে, অন্তত একজন তলিয়ে দেখা চিন্তকের চিন্তায়। রিফাত হাসানের কণ্ঠেই শোনা যাক—
“বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যতোরকম নড়াচড়া ও প্রচার প্রচারণা বা আলাপের ব্যাপার হইছে, সবগুলার ভেতরে প্রকট হিশেবে সামনে আসে যা, তা হল তারা এইটারে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হইছে। তারা মানে ক্ষমতাসীন ও তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলো। তাদের কাজ ছিলো, দরকার ছিলো- তারা অনেস্ট হোক, ডিজ অনেস্ট হোক সেটা ব্যাপার না- এটাকে বিচার হিশেবে প্রতিষ্ঠা করা, জামাত রাজনীতি নয়, যুদ্ধাপরাধের। কিন্তু তারা এইটাকে বিচার হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে বরাবরই ব্যর্থ।
…যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত আমার ক্রিটিকগুলোর মধ্যে একটা ক্রিটিক হচ্ছে, এটা এমন একটা বিচার হওয়া উচিৎ যে বিচার হওয়ার পরে ছাত্রশিবিরের পোলাপাইনও মানতে বাধ্য হবে যে, আসলে আমরা ন্যায়বিচার পাইছি।”
অত্যন্ত নিষ্পাপ এবং যুক্তিযুক্ত আলোচনা। এইখানে দীর্ঘ আলোচনা না করে রিফাত হাসানের এই আপাত নিষ্পাপ ক্রিটিক নিতে সমস্যা বোধ করি এই জন্য যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেবল ‘বিচারিক বিষয়’ হিসেবে গণ্য করে, ন্যায়বিচারের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করার যে আহ্বান, সেটা আসলে না—তলিয়ে এক-চোখে দেখার একটা বিষয়। এটা ‘সেক্যুলার’ বা ‘লিবারেল’ অবস্থানের ভেতর বেসিক্যালি একটা আওয়ামী অবস্থান। কখনো কখনো ন্যায় বিচার চাওয়াও একটা পার্টিজান অবস্থান।
অন্তত এই বই পড়ে শাহবাগকে নানা জায়গা থেকে দেখার সুযোগ হতে পারে, তেমনই, নানা অদেখাও দেখার সুযোগ হয়তো মিলবে। শাহবাগ নিয়ে আলাপ শেষ হবার না, শেষ হবেও না। তবে শাহবাগ এবং পরবর্তী বিষয়-আশয় নিয়ে, অন্তত, (রিফাতের বন্ধু) মাসুদ জাকারিয়ার সঙ্গে আলোচনায়, অত্যন্ত চমৎকার চমৎকার বিষয়ের হঠাৎ হঠাৎ অবতারণা ঘটেছে। এই সাক্ষাৎকার/আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক গুরুত্বপূর্ণ না, মজার।
এই রকম দু’চারটি বিষয় ধরে ধরে আলাপ করতে গেলে বহু শব্দ অকারণে খরচা হয়ে যাবে, এবং অর্থহীন হবেও বটে। এই বইয়ের মলাটের মধ্যে বিষয় হিসেবে জাকির নায়েক থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি, জাতীয় সংগীত থেকে শুরু করে ভাস্কর্য বহুবিধ আলোচনার পসরা জমানো হয়েছে। ফলে ওভার-অল একটা ইম্প্রেশন নিয়ে লেখা একটু কঠিন।
তার পাঁচ মে নিয়ে লেখাটি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে, শাপলা অভিমুখে হেফাজতের লংমার্চকে তিনি একবাল আহমেদ এবং হান্টারের মধ্য দিয়ে দেখে মন্তব্য করেছেন—
“আজকে যে কওমী মাদ্রাসা ও তার নেসাব নিয়ে শাসক গোষ্ঠী আতঙ্কিত, তখনও হান্টার একই আতঙ্ক ব্যক্ত করেছিলেন। হান্টার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে শুধু নয়, ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসা থেকে যারা বেরুচ্ছে, তারাও এক একটা জেহাদ প্রচারকারী হুজুর।”
তার এই অবজারভেশন গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন এবং এর বিরুদ্ধ বিপ্লব সংগঠনের যে শত বছরের পুরোনো সিলসিলা, সেটা এখনো সম্পূর্ণ হয় নাই বলেই মনে হয় না? ফলে আমাদের, পেছনের দিনগুলোর লড়াই আর সামনের দিনগুলোর আসন্ন লড়াই, দুই-কে একটু সুতোয় বেঁধে দেয়ার একটা আলাপ এখানে আসল না?
হেফাজতের ভাবটি একটি ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বলেই তিনি মত দিচ্ছেন, যথেষ্ট যুক্তি সহকারে। যদিও সব সময়েই হেফাজতের একটি লুকোনো রাজনৈতিক অভিলাষ আমরা দেখেছি। যাই হোক, হেফাজত বিষয়ে তার লেখা, ‘পাঁচ মে: বন্ধুত্ব, রাষ্ট্র ও মানুষের সম্পর্কের পুনর্বিবেচনা’-তে একটা বেশ গভীর সাঁতার, তার চিন্তার পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে, অন্তত আমার মত, ‘সবকিছু-ভুলে-থেকে-ভালো থাকতে চাওয়া’ সাধারণ মানুষের জন্য। এই লেখাটিকে আমি থরে থরে সাজানো অত্যন্ত সুন্দর একটি চিন্তা-গাছ বলতে চাইছি। এটা বলেও, এটাও বলতে চাইছি, হেফাজতের আন্দোলনের পরের বাংলাদেশের জন-মানসে, ধর্ম, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র বিষয়ে একটি বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে চারদিকে যে আওয়াজ, তার গতি প্রকৃতি নিয়ে একটা আলাপ থাকলে মন্দ হতো না। অবশ্য সেটার সময় ফুরিয়ে যায়নি।
তার প্রবন্ধ (বা লেখা) বসন্তের ছাত্র আন্দোলন একটি মোটা দাগে প্রশংসা-পত্র হিসেবে হাজির হয়েছে। ‘কয়েক দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর একটি’ বলে বিবেচনা করে এই আন্দোলনের একটি ‘মৌলিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও রক্ষনশীলতামুক্ত’ চরিত্র উন্মোচন করেছেন। এই আন্দোলনকে এইভাবে দেখা যায় বটে, তবে, আরও তলিয়ে দেখলে, এর নানা চরিত্র পাওয়া যায়। চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের আন্দোলন কীভাবে একটি দশকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে হাজির হয়, সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে আমি কোনো কূল-কিনারা করতে পারিনি। ফলে তার এই আলাপ আমার কাছে ততটা আগ্রহ উদ্দীপক হয়নি। কিংবা হতে পারে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে এই আন্দোলন ঘনীভূত হয়েছে বলে আমি এর ভেতর-বাইর অনেক কিছু সরাসরি দেখেছি। যদি ভুল না করি, এক এগারোর সরকারের সময় এই আন্দোলন একটি মোড় নেয়ার দিকে যায়, তখন আমি হলের ছাত্র। স্মৃতি হাতড়ে বাহির করার চেষ্টা করি, চাকরি-প্রত্যাশী এই বিপুল মধ্যবিত্তের ভাত-কাপড়-সম্মানের এই দাবিটি যদি তখনকার মিলিটারি গভর্নমেন্ট মেনে নিত, বা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিত, তাহলে আগস্ট বিপ্লবে ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণ হতো কিনা। না হলে কী হতো! ছাত্রদের এই আন্দোলন দুটি সময়েই বেশি ঘনীভূত হয়েছে, যখন, প্রথাগত রাজনীতির সকল রাস্তা বন্ধ। এই চরিত্রটি কেমন?
আমার খটকা লাগার বিষয়গুলো বলে গেলাম, বিস্ময় কিংবা মুগ্ধতার কথা ধরে ধরে বলা সম্ভব না। ফলে স্পেসিফিক আলোচনায় আর যাচ্ছি না। আমার প্রশ্ন, না নেয়া বা ক্রিটিক, সবই আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার বিষয়।
এবার একটু অন্য আলাপে আসি, এই বইয়ের চরিত্র আসলে কী রকম? রিফাত হাসানের এই বই অনেকাংশে গল্পের বই। চিন্তার বইগুলো ‘বিষয়’ নিয়ে যেভাবে মেথডিক্যালি এগিয়ে যায়, এটা তেমন না। এখানে তিনি ঘটনার ভেতর দিয়ে তার ব্রেনকে তলোয়ারের মতো চালিয়ে দিয়েছেন। এই জন্য এই বই পড়তে গেলে অশিক্ষিতেরও কোনোরকম কষ্ট হয় না। তিনি আসলে আগে ঘটনাকে আনেন, তারপর তার ভেতরের টেক্সট। এইবার এই টেক্সটকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে কন্সপিরেসির দৈত্যকে হাজির করেন। তারপর তার রূপকথার ডালি নিয়ে বসেন। চেনাজানার মধ্যে থাকা অল্প পরিমাণ রেফারেন্স তিনি আনেন, এ ছাড়া, তার এই সমস্ত গল্পের রেফারেন্সও গল্পই, কী মজার! এ কারণে তিনি অনন্য।
এখন, এই বই পড়ে রিফাত হাসানকে আমি দেখি নাই, তা সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক স্থাপিত হলো? এই সম্পর্ক একরৈখিক, অর্থাৎ, আমি তারে ধরতে নিয়েছি, কিংবা তাকে ধরতে গিয়ে আমি নিজেকেই ধরেছি। এই ধরাধরির কনফিউশনের বাইরে যেটা বলতে পারি- শব্দে, তাচ্ছিল্যে, প্রশ্নে আর মোকাবিলায়- তিনি আমার কাছে হাজির হয়েছেন একজন নাবিক হিসেবে। সেই নাবিক খুঁজতে তৎপর, কিছু জিনিস খুঁজে পান বটে, কিন্তু, কী কী খুঁজতে তিনি ডুব দিচ্ছেন, সেগুলোও হাজির করেন। ফলে, অন্যরাও, সাইডে বসে থাকলেও, তাদের মধ্যে একটা নাবিক ভাব এসে হাজির হয়। সবচেয়ে বড় একটা বিষয়, চিন্তকের যে গৌরব আর গোঁড়ামি সেখান থেকে তিনি মুক্ত বলেই মনে হয়েছে। এইটা তার বিশেষত্ব নাকি আমার মূর্খতা, সে ব্যাপারে আমি কী-ই বা বলতে পারি। তবে এটা আমি তার বিশেষত্ব হিসেবেই দেখি।
এখন বলি, এই বই দরকারি কিনা? ‘দরকারি ভাবলে দরকারি, না ভাবলে অদরকারি’- এই ধরনের একটা উদাসীন মনোভাব আমার আছে। সেই মনোভাব নিয়েই বলতে পারি, এই বই একটা সময়ের জার্নাল। আপনি এই দুঃসময়ে যা যা দেখছেন, রিফাত হাসান তাই নিয়েই ডিল করেছেন। এবং এটা করতে গিয়ে, তিনি নানা আলাপের শুরু করছেন, কিছু শেষ করছেন, কিছু করেন নাই। ফলে আমাদের নিকট অতীত ও বর্তমানের নানা ঘটনা, যেগুলা আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে এক সময়, সেই ঘটনাগুলো তিনি নানা ভঙ্গিতে এবং ভাবে দেখার চেষ্টা করছে। এই বই একটা ঘটনা-চিন্তা-ডায়েরি’র মতো ব্যাপার হয়ে উঠছে।
আর এই বই স্মৃতিকাতরতার জন্মও দেবে। যেমন; শাহবাগ যখন হয় তখন আমি মিরপুর থেকে শাহবাগ হয়ে মতিঝিলে যাই অফিস করতে। আমি তখন ইসলামী ব্যাংকের অডিটর। জায়গায় জায়গায় ইসলামী ব্যাংকের বুথ ভাঙার খবর পাই। আমরা বাইরের লোক, ফলে আমাদের ইসলামী ব্যাংক ভিজিটর কার্ড দিয়েছে যেন ঢুকতে সমস্যা না হয়। সেই কার্ড লুকিয়ে রেখে আতঙ্ক নিয়ে শাহবাগ নেমে তারপর হেঁটে গিয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে যেখান থেকে বাস পাই উঠি। শাহবাগের রাস্তায় দেখি, ‘রাষ্ট্র মেরামতের জন্য রাস্তা বন্ধ, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’ – এই ধরনের লেখা।
সেই সাময়িক দুঃখ কীভাবে একটি পারমানেন্ট দুঃখ হয়ে উঠল, এই বই পড়লে, সেটাও তো আমাদের মনে পড়বে। ফলে, রিফাত হাসান যে বলছেন, কন্সপিরেসি ও রূপকথা, সেটা একেবারে অমূলক না। এটা একটা দুর্দান্ত ফিকশনও, যদি আপনি ধরতে পারেন। আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা, তার সঙ্গে একে মোকাবিলার বিষয়– ফলে এই বই শেলফে থাকলে, সুবিধা আছে। পুরোনো ফটো-অ্যালবামের মতো মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দেখার মতো। বইটা রাখতে পারেন। আর না রাখলেও অসুবিধা নাই- সেই ধরনের উদাসীনতার কথা তো বললাম-ই।
অনেক বকাবক করে ফেলছি, এবার রিফাত হাসানকে কীরকম পেলাম সেটা বলি। সব বিষয় মিলে, আমি এই মতে এসে পৌঁছেছি, রিফাত হাসান সম্ভবত একজন লিবারেল লোক। যদিও তিনি বলেন, তিনি রাষ্ট্র বিলোপেরও পক্ষে, কিন্তু রাষ্ট্রকে তিনি লিবারেল হইতেই বলেন, কিংবা হয়তো রাষ্ট্র একটা লিবারেল বিষয়ই। কিন্তু, এই যে বাংলাদেশ ক্রমশ পশ্চিমাদের একটা লেবার-ক্যাম্প হয়ে উঠছে, যেখানে, সবচেয়ে সস্তায় পাওয়া যায় মানুষের মাসল, সেই জনপদে লিবারেলিজমের ঝান্ডা কীভাবে উড়তে পারে সেই চিন্তায় আমার ঘুম হারাম। কোনোদিকেই কোনো রাস্তা পাই না।
শেষে আমি একটু ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তির জায়গায় আসি। এই বই আমাকে মোহিত করেছে। একজন একাউন্ট্যান্টকে মোহিত করা কঠিন। আর কমন বিষয় নিয়ে আমার কিছু কিছু চিন্তা-ভাবনাকে একটা আদালতে এনে বসিয়েছে, যে আদালতের বিচারক আর বাদী-বিবাদী, দুই-ই আমি। ফলে এই বইটি আমি মাঝে মাঝেই হয়ত খুলে দেখব।
মুরাদ কিবরিয়া, লেখক।