Blogs, গল্প

রিফাত হাসান

পাখি

July 28, 2014   0 comments   1:56 am
Primary Author: রিফাত হাসান

আম্মার রুম থেকে হঠাৎ মেধার খুশি শোনা গেল। পাখি! পাখি!! দেখ না! কোন ফাঁকে মেধা ঘুম থেকে ওঠে ওই দিকে চলে গেছে। আমার দু বছর বয়সি কন্যা। আমিও ওই রুমে গেলাম। পাখিটা নির্জীব। ততক্ষণে একটা চিকন দড়িতে পা বাঁধা হয়ে গেছে। পাখিটা ছটফট করছে না। কী হলো কে জানে। দড়িটা জানালার গ্রিলে বাঁধা। পাখিটারে খাবার দেওয়া হয়েছে। বাটিতে করে চাল। মেধা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। চোখে খুশির তারা। পাখির কোন আগ্রহ নেই। পাখিটা নির্জীব বসে।

Share

১.

আচমকা একটা শহুরে পাখি ঢুইকা পড়ছিল আমাদের বাসায়। কাল। পাখিটা কবুতর গোত্রিয়। এমন কখনো হয় না। তখন সকাল। সূর্য ওঠার পর। আম্মা ফজর নামাজ পড়ে কোরান শরীফ শেষ করেছেন। পাখিটারে দেইখা চুপি চুপি আমাদের ঘরে আসলেন। আমাদের ডাইকা দেখালেন। তারপরে, সবাই মিলে দরজা জানালা বন্ধ করলেন। পাখিটা সব কিছু বাদ দিয়ে খাটের নীচে ঢুইকা বসে আছে। সাধারণত পাখি ঢুকলে সিলিঙের দিকে ওড়াওড়ি করে। এইটার সিলিঙে মন নেই। ছটফটানি নেই। কেন?

পাখি ধরার আয়োজনগুলো অনেক সতর্কভাবে করতে হয়। একটা বড় কাপড় বা জাল জাতীয় কিছু। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আম্মা সেই সবের আয়োজন করছেন। আমরা যখন গ্রামে থাকতাম, বাবাসহ, তখন প্রায়ই ঘরে চড়ুই ঢুকে যেত। ছোট বেলায়। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা ভাই বোনেরা ওগুলো ধরার জন্য ছুটোছুটি করতাম। মাঝে মধ্যে আম্মাও থাকত আমাদের সাথে। ওগুলো ধরা যেত না। অনেক কসরত করে, সতর্কতার সাথে, বেড়ালের পায়ের মত আস্তে পাখিটার কাছাকাছি পৌঁছুলে, ফুরুত কইরা ওড়ে যেত পাখি। আমাদের মন খারাপ হত। আজ, এই নতুন পাখিটারে দেইখা সেই সব মনে পড়ছে। কিন্তু আমার পাখি ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই আমি হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি।

আম্মার রুম থেকে হঠাৎ মেধার খুশি শোনা গেল। পাখি! পাখি!! দেখ না! কোন ফাঁকে মেধা ঘুম থেকে ওঠে ওই দিকে চলে গেছে। আমার দু বছর বয়সি কন্যা। আমিও ওই রুমে গেলাম। পাখিটা নির্জীব। ততক্ষণে একটা চিকন দড়িতে পা বাঁধা হয়ে গেছে। পাখিটা ছটফট করছে না। কী হলো কে জানে। দড়িটা জানালার গ্রিলে বাঁধা। পাখিটারে খাবার দেওয়া হয়েছে। বাটিতে করে চাল। মেধা আগ্রহ নিয়ে দেখছে। চোখে খুশির তারা। পাখির কোন আগ্রহ নেই। পাখিটা নির্জীব বসে।

 

২.

আমি আম্মাকে বললাম, পাখিটারে ছাইড়া দেন। আম্মা বলল, বাচ্চারা খেলছে, খেলুক কিছুক্ষণ। আমি বললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছাইড়া দেন। গুনাহ হবে। আম্মা বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু পাখি তো কিছু খায় না। সত্যি, দেখলাম, চালের বাটিতে কোন পরিবর্তন নেই। পাখিটারও খাওয়ার ব্যাপারে কোন মনোযোগই নেই। আমি বললাম, তাইলে এক্ষুণি ছাইড়া দেওয়া দরকার। মেধার তীব্র আপত্তির মুখে আম্মা রশি খুইলা দিলেন। দেখা গেল, পাখিটার মধ্যে যাওয়ার কোন চঞ্চলতা নেই। যেখানে ছিল, সেখা্নেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক নিরীহ ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে। পাখির চোখ পাঠ করার চেষ্টা করলাম, ভীষণ কঠিন কাজ। মানুষের মত পরিচিত কোন ভাব নেই চোখে। তাছাড়া এত ছোট চোখ, ভাব থাকলেই আমি ক্যামনে পড়তে পারি! শুধু বুঝলাম, পাখিটার কোন সমস্যা হয়েছে। ভাবলাম, আমরা আপাতত বারান্দায় পাখিটারে ছাইড়া চলে যাই। হয়তো সময় গেলে পাখি ওড়ে যাবে। নিজের মত কইরা।

 

৩.

অফিস থেকে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। এসেই প্রথমে আম্মার বারান্দায় গেলাম। আম্মা হাসল। বলল, পাখি যায় না। দেখলাম। পাখি শুধু দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। বারান্দায় একটা ফুলের টব, মেহেদী চারা লাগানো। টবের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে পাখি। আম্মা বললেন, বাটিতে ভাত দিয়ে দেখেছে। খায় না। চাল তো না-ই। এখন কী হবে। আম্মা একটা অদ্ভূত কথা বললেন। আমাদের বাসার সামনে কদ্দুর গেলে কিছু গরিব মানুষের ঘর। এক কাজ করা যায় না, পাখিটা ওদের কাছে দিয়ে আসলে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন! আম্মা বললেন, এইভাবে এখানে না খেয়ে থাকলে পাখিটা বাঁচবে না। কবুতরের মাংস খুব স্বাদ। গরিব মানুষগুলোর কাউকে দিয়ে আসলে ওরা জবে করে খেতে পারবে। ছওয়াব হবে। আমি রেগে গেলাম। পাখিটা মরে যাক। যতদিন বেঁচে আছে, আমাদের বারান্দায় থাকুক।

 

৪.

রাতে আম্মা চালের খুদ এবং ভাত মেখে কবুতরটাকে খাওয়ালেন। নিজে নিজে কিছুই খাচ্ছে না ওটা। রাতে ঘুমিয়ে গেছিলাম তারপর। আজকে সকালে ওঠে আবার আম্মার বারান্দা দেখতে এলাম। পাখিটা সেই গতকাল প্রথম সকালের মত। দাঁড়িয়ে। চুপচাপ। নিস্তরঙ্গ। আমার মন কেমন করছে পাখিটারে দেইখা। ভাল লাগছে না। হঠাৎ কোথাকার কোন একটা পাখির জীবনের সাথে আমাদের জীবনটার কথা মনে হল। মনে হল মেধার কথা, আমার মেয়ে। মনে হল হঠাৎ কোন বিধুর জগত থেকে এই পাখিটার মতই আমরা বাপ মেয়েও এইভাবে চলে এসেছি। অচিনপুরে। যদি আমি বা ওর মা না থাকতাম, আজ এই পাখিটার মত বড্ড একা থাকত মেধা। না জানি কোন মা পাখির বাচ্চা ওটা। মন পাখিটার জন্য বিষন্ন হয়ে আছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই একটা কাক এল বারান্দার গ্রীলে। এসে পাখিটারে ঠাওরে দেখল। তারপর আমি একটু বারান্দা ছাইড়া চলে আসার উদ্যোগ করতেই কাকটা উড়ে এল নীচে, টবের কাছে, পাখিটার কাছে। এসেই ঠোকরাতে গেল। আমি দাঁড়িয়ে কাকটাকে তাড়াতে গেলাম। দেখলাম, আমি কাকটাকে তাড়ানোর আগেই পাখিটা বহু কষ্টে ওড়ার চেষ্টা করল। অবসাদের সাথে। সফল হল। জানালার গ্রীল দিয়ে ওড়ে গেল পাখিটা। আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম। মেধাও এসে দাঁড়িয়েছে আমার সাথে।

 

৫.

একটু পর, মেধা এসে আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল আবার। নীচে ছাদ। ওদিকে হাত দেখিয়ে বলল, পাখি! পাখি!! দেখ! দেখলাম, ছাদে কয়েকটি শিশু ও তাদের মা, আর সেই কবুতর পাখি। ধরে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে ওরা চলে যাচ্ছে। কোন বিধুর গন্তব্যে কে জানে!

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave the first comment