চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরে বেশ কিছু পীর ফকিরের মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটল। মাজার ভাঙার পক্ষে কোন রাষ্ট্রীয় অবস্থান দেখা না গেলেও, এবং হামলার বিরুদ্ধে কঠিন বিবৃতি থাকলেও, যেহেতু প্রশাসন দুর্বল, সবকিছুর মতই, এই কাঠিন্য তেমন দৃশ্যমান হচ্ছে না। এইটা এলার্মিং। এই মাজার ভাঙার যে পন্থা ও আইডিওলজি, তারে কীভাবে পড়েন?
এই মাজার যারা ভাঙছে, তাদের মধ্যে প্রকাশ্য তিনটা গ্রুপ দেখি আমি।
এক. বিভিন্ন ইন্টারনেট হুজুর, যেমন তহা আদনান নামের জনৈক জনপ্রিয় বক্তা। এরা হলেন, সালাফি, মানে হুজুরদের ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ অংশ। উনাদের ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ তো বোঝেন, বাঙ্গালদের ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’র মতই ভয়াবহ। তবে, এরা মোটিভেশন দেন। সরাসরি ভাঙতে যান না।
দুই. ছোট ছোট বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের হুজুর। এরাও উপরের হুজুরদের ভক্ত, বিশ্বাসে সালাফি। এরা সরাসরি রাস্তায় নেতৃত্বে থাকতেছেন, একটা ভিডিওতে দেখলাম।
তিন. ওলামালীগের লোকেদের সালাফি অংশ। এদেরকেও দেখা গেছে বিভিন্ন জাগায়। এর বাইরে, অপ্রকাশ্য গ্রুপটি হল, জুব্বা আর টুপি পরিহিত আত্মগোপনে থাকা ও ছদ্মবেশি পুরনো রেজিমের সুবিধাভোগী অপরাধী, বা ছাত্রনেতা। মূলত এরা হলেন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অভ্যন্তরীন কর্মী, হুজুরদের ভক্ত বা কর্মী হিশেবে মিশে আছেন, খেয়াল করলে এদেরে খুঁজে পাবেন। এদের কাজ হল জনঅভ্যুত্থানকে অর্থহীন করা।
উসকানি ও হামলায় অংশগ্রহণের প্রমাণসাপেক্ষে এই তিন গ্রুপের সবাইরেই গ্রেফতার করা দরকার, প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা এখনো আমরা দেখতে পাইতেছি না।
মজার ব্যাপার হল, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ সোসাইটিতে এই ভাঙায় নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল শার্ট প্যান্ট পড়ুয়া মাস্টারদের। ওয়ালিউল্লাহর লালশালু উপন্যাসের মোটিভেশন তো সেরকমই ছিল, বহু বছর ধইরা। দেখা যাচ্ছে, এই লালশালু ‘ভণ্ড’ ও মজিদের ‘মাজার ব্যবসার’ বিরোধিতায় ব্যবহার না হয়ে ইসলাম ফোবিয়ায় ব্যবহৃত হইছে ঐতিহাসিকভাবে।
বিপরীতে, এই ওয়ালিউল্লাহর যারা ভক্ত, তারা ‘ফরমাল ইসলামে’র বিপরীতে ‘মাজার’ ধরনের বিকল্প ইসলাম ধর্মীয় চর্চা ও আইকনগুলোর ভক্ত হইলেন। এই ভক্তি, আমি মনে করি, পলিটিক্যাল। এর কারণটা হল, ওয়ালিউল্লাহর লালসালুরে আপনি ‘ইসলাম প্রশ্ন’ মোকাবেলার টুল হিশেবেই বেশি পড়তে পারবেন, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ হবার, বা তার পূর্ববর্তি পয়গম্বরদের অপেক্ষাকৃত ‘ফিলসফি’ অরিয়েন্টেড ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের চাইতে। ফলে, তার ভক্তরাও, সেই ‘ইসলাম প্রশ্ন’ মোকাবেলাই করে যাইতেছেন। এই ব্যাপারটা লইয়া তেমন আলোচনা হয় না দেখি।
এর বাইরে, আরো দুইটা নোট রাখি, যেহেতু জল এতদূর গড়াল। লজিক্যালি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে সব কাজ আইনত অবৈধ হিশেবে বিবেচিত, মাজার বা অন্য কোন ধর্মীয় স্থাপনার অভ্যন্তরেও সেসব কাজ অবৈধ হিশেবেই বিবেচিত হবার কথা।
সে হিশেবে গাঁজার আসর ও বিক্রি বাট্টার যে অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে তো অভিযান পরিচালনা করাই যায়।
দুই. ‘অধর্ম’র অভিযোগ, যেমন মাজারে সিজদা, তারে লইয়া মোহসেন আউলিয়া নামের বিখ্যাত মাজারে একবার ঘুরতে গিয়ে নিষেধবাণী দেখেছি আমি, এই নিষেধবাণী কি সব মাজারে ফলো করা হয় না? যদি ফলো করা হয়, তাহলে মাজারের ‘অধর্ম’ লইয়া মাজার বিরোধীদের আপত্তি কোন জাগায়?
তিন. মাজারে যে আয়, তা আকাশচুম্বি হবার কথা, কারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ মাজারে এসে রোগমুক্তি বা মনের ইচ্ছে পুরনের উদ্দেশ্যে উদার হস্তে ‘মানত’ করে, যা অন্য কোথাও করে না। এই অবস্থায়, এই আয়ের ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য ধীরে ধীরে প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে সরকারে পক্ষ থেকে।
মাজারের যারা ‘খাদেম’, বা ‘পীরজাদা’, তাদেরে প্রায়ই বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা বা সংসদ সদস্য হতেও দেখা যায়, যাদের আযের উৎস কেবল পীরজাদা হবার বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। উপরে যে তিনটি পয়েন্ট বললাম, মাজারগুলোরে এইসব বিষয়ে একাউন্টেবল করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা যায়, মাজার ভাঙা থামানোর পরে, ধীরে ধীরে। জল তো ঘোলা হল ঢের।
…..
পুনশ্চ: মাজার ভাঙ্গার এক্সট্রিমিজম নিয়ে এখন পর্যন্ত জামাত হেফাজতের স্পষ্ট বক্তব্য নেই। তাদের যে একটা ‘ইসলামপন্থিদের মৈত্রি-কল্পনা’ দেখা যাচ্ছে কয়েকদিন ধইরা, ওখানে, কি মাজার ভাঙার ব্যাপারে একটা কনসেনসাস আছে? যদি তাই হয়, তাহলে এইটা ভয়াবহ ঘটনা হবে। একটা সুপার এক্সট্রিমিস্ট শক্তি হিশেবে গড়ে উঠবে এরা। মানে, মডারেট ইসলামী দল থেকে এক্সট্রিমিস্ট ইসলামী দলে রূপান্তর। যদি তা না হয়, অমুসলিম ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার বিরুদ্ধে যে স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করতে পেরেছিল ওরা, এখানেও তারা তাদের অবস্থান পরিস্কার করে না কেন? জামাত এবং হেফাজত কি অবস্থান পরিস্কার করতে ভয় পায়? বা ধোঁয়াশায় রেখে দিতে চায়? বা, অনুকুল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করে?
নাকি ওরাই সেই বিজ্ঞানমনস্ক হুজুরদের মাজারের মূল মুতওয়াল্লি?
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪
পুনমুদ্রণ, ফ্রম মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে। পৃষ্ঠা ২০২। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। ফেব্রুয়ারী ২০২৫

