ঈদ এলো এবং চলেও গেলো। আমাদের নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ ঈদে ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন করেছেন, শহীদ মিনারে। ঈদ ‘উদযাপন’ বা ‘বর্জনে’র মাধ্যমে। ব্যাপারটিতে আমার ‘সামান্য’ কৌতুহল ছিলো, অন্য অনেকের মতো। কিন্তু আমি, পরিবারের সবার সাথে প্রতি বছরের মত গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। ঈদ করতে। ‘শহীদ মিনার’ আমাকে ভাল মতন টানে নাই। এদিকে গ্রামে গিয়ে এক বেহাল অবস্হার মুখোমুখি হলাম। ঈদের আগের রাত থেকে পরপর দুইদিন বিদ্যুতহীন আমাদের পাড়া। আশেপাশের কয়েকটি পাড়ারও একই অবস্হা। জানলাম, বিদ্যুত অফিসে যোগাযোগ হয়েছে, ওরা আসবে। কিন্তু ঈদের দিন বা তার পরের দিনও কোন খবর নাই। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো ষড়যন্ত্রের আভাস দিতে চোখ সরু করবেন: ঈদের দিনে এইসব কারা করে? প্রধানমন্ত্রীর এমন বিভ্রান্তিতে আমরাও হয়ত বিভ্রান্ত হবো। কিন্তু যেটি হলো, টেলিভিশনতো দূরের কথা, অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকেও দূরে থাকার ফলে দুনিয়ার তাৎক্ষনিক সংবাদপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলাম এ দুদিন। পত্রিকাতো বন্ধই। অথচ আমি শহুরে নাগরিক, গ্রামে বেড়াতে এসেছি মাত্র দুদিনের জন্য। লেখালেখির কারণে গোপনে বুদ্ধিজীবীদের সাথে শ্রেণীগত আকর্ষণও বোধ করি, সমভবত। তাই, ‘কৌতুহল’। ফলত শহরের বন্ধুদেরকে একটি ঈদ-শুভেচ্ছা-বার্তা দিয়েছিলাম মোবাইলের মাধ্যমে। বার্তাটি ছিলো, আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রথমবারের মত বাঙালি মুসলমানদের সাথে ঈদ ‘উদযাপন’ করছেন। এটুক।
আমার বন্ধুদের সবাই ‘বুদ্ধিজীবী’ নন। বা ‘লেখালেখি’র সাথেও জড়িত নন তেমন। বড়জোর হিশেবপত্র লেখেন, ‘লেখালেখি’র সাথে অনেকের এধরণের সম্পর্কও আছে। ফলত ‘বড়’ ‘বড়’ বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতা সম্পর্কে তেমন খবর রাখেন না অনেকেই। তাই আমার বার্তাটি পাওয়ার পর অনেকেই ফোন করে বা ফিরতি এসএমএস দিয়ে জানিয়েছেন, ব্যাপারটি তারা বুঝেন নাই। আবার একজন, যিনি লেখালেখি করেন, এবং অতিরিক্ত সচেতন, কবি ও বুদ্ধিজীবী, তিনি পাঠালেন: ‘বুদ্ধিজীবী সমাজ নিপাত যাক’। এদিকে গ্রামে বসে বুদ্ধিজীবী সমাজের ঈদ নিয়ে আমার ‘সামান্য কৌতুহল’ মরে না। স্হানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক- যিনি আমাকেও ছোটবেলায় পড়িয়েছেন- তাঁকে কথা প্রসঙ্গে বুদ্ধিজীবী সমাজের ঈদ-আগ্রহের ঘটনাটি বুঝিয়ে বললাম। তিনি আগ্রহভরে আমার কথা শুনলেন। তারপর অবাক হয়ে বললেন, শহীদ মিনারে আবার ঈদ হয় আমি আমার স্কুল জীবনের ওস্তাদের উপর ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক’র মত মন্তব্য করলাম, কেন হবে না, ঈদ কি শুধুই ধর্মীয় ব্যাপার, এখানে কোন সেক্যুলার প্রপঞ্চ নেই? তিনি হয়তো ভাবলেন, তার পুরাতন ছাত্রটি নাদান হয়ে উঠেছেন, ‘প্রপঞ্চ’ শিখেছেন। তাই এই ‘প্রপঞ্চটি’রে পাত্তা দিলেন না। জানতে চাইলেন, বুদ্ধিজীবীরাই কি নামাজে ইমামতি করেছেন? আমি শহরে ফোন করে বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলাম, ইমাম কে ছিলেন নামাজে। ফোন করাও সহজ ছিল না। গ্রাম, তার উপর ঈদের সময়গুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্কে কী যেন হয়। কোন মতেই পৌঁছানো যায় না। বন্ধু জানালো, ইমাম হলেন বর্ষিয়ান বুদ্ধিজীবী জনাব সৈয়দ আবুল মকছুদ। তবে নামাজ হয় নাই, অবস্হান এবং বক্তৃতা হয়েছে। মকছুদ সাহেবের ইমামতিতে। দুপুর থেকে বিকেল অবধি। শুনে আমার স্কুলবেলার শিক্ষক মহোদয় জানালেন, শুধু খোতবাতে ঈদ হয় না, নামাজও পড়তে হয়। নামাজ না পড়লে তাদের ঈদ হবে না, কচু হবে।
বন্ধুটি ফোনে জানালো, নামাজ না পড়েও এই ঈদে অংশগ্রহণকারীদের লোকজন বেশ খুশি। কেউ কেউ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় জানিয়েছেন যে, তাদের এই ঈদ-উদযাপন জীবনের খুব স্মরণীয় ঘটনা। আমি ভাবতে বসলাম। এর আগে তারা কখনো ‘ঈদ’ করেছেন- এমন সংবাদ পাই নাই। অন্তত মিডিয়ায় তাদের ঈদ-পালনের ঘটনা এর আগে কখনো আসে নাই। পহেলা বৈশাখ বা অন্যান্য অনুষ্ঠান পালনের ঘটনা আছে। পুজোতেও তারা গিয়েছেন বিভিন্ন সময়, সমভবত। কিন্তু অনেক ঘেঁটেও ঈদের খবর পাই নাই। এইবার বাধ্য হয়ে তারা ঈদ ‘উদযাপনে’ নেমেছেন। স্মরণীয় ঘটনা তো বটেই। কারণ এটি তাদের জীবনে প্রথম ‘ঈদ’। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদযাপনে এর কোন প্রভাব থাক বা না থাক।
২.
এরপরে তত্ত্ববিলাস। ‘বড়’ ‘বড়’ বুদ্ধিজীবীগণ যেভাবে ভাবেন, বা আলোড়িত হন, দেশের মানুষ, এমনকি শহুরে নাগরিকরাও তার আশেপাশের ভাবনা ভাবেন না এত সহজে। বা সেই মাত্রায় ও সেই পদ্ধতিতে আলোড়িত হন না। সুশীল মিডিয়াগুলো তার সম্মতি আদায়ের জন্য যত প্রচারণা চালাক না কেন। এটুক বুঝলাম। তারপর? গ্রামে বসে, বন্ধুদের কাছে শুভেচ্ছাবার্তাটি পাঠানোর সময় আমার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটি ঈদ-‘উদযাপনে’র প্রশ্ন নয়, বরং ‘বর্জন’ এর। তারা বরং ‘উদযাপনে’র নামে মিডিয়াতেই ঘোষণা দিয়ে সমবেতভাবে ঈদ ‘বর্জন’-এর কর্মসূচি পালন করেছেন এবার। একই সাথে ঈদের দিনে শহীদ মিনারে ‘সমাবেশ’-এর মাধ্যমে এতদিন ধরে বেহাত ধর্ম-ব্যবসায়ের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্হান তৈরি করার চেষ্টাও নিলেন, হয়তো। এজন্যই ‘বর্জনে’র নাম হয়েছে ‘উদযাপন’-এর ধুলো। মুসলমানের ঈদ তারা আগেও বর্জন করতেন, ‘ঈদ’ নামের ঘটনায় সর্বতোভাবে অদৃশ্য থেকে। তাই আমার বার্তাতে একটু ঠাট্টা ছিল। ঠাট্টার কারণ, এই গোষ্ঠী নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলখেল্লায় মুসলমানি পরিচয়-চিহ্ন ও আচারগুলোকে হীনমন্যভাবে লুকায়।
৩.
সে বর্জন বা উদযাপন যাই হোক, আমরা আবার বুদ্ধিজীবী সমাজের গল্পে ফিরে যাই। লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ঈদের কয়েকদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন, তিনি এবং তার সতীর্থ বুদ্ধিজীবী সমাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দুটি সংক্ষিপ্ত উপহার চান। দুটি অপসারণ। এক যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব সৈয়দ আবুল হোসেন। এবং দুই নৌপরিবহন মন্ত্রী জনাব শাজাহান খান। এই দুজনের অপসারণ চাওয়ার কারণ হলো, তারা দুই নাগরিক বুদ্ধিজীবী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির এর নিহত হওয়ার ঘটনায় ‘দায়ী’। যেহেতু সড়ক-দুর্ঘটনা, সরল অংক হলো দায়িত্ব সড়ক মন্ত্রীর। আবার নৌপরিবহন মন্ত্রী একই সাথে সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা হেতু ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। তাই দায়ী তিনিও। সড়কমন্ত্রী সড়ক ঠিক করেন নাই, আর নৌমন্ত্রী অশিক্ষিত ‘আন্ডার মেট্রিক’ লোকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছেন। তাই এই দুই মন্ত্রীর ‘পদত্যাগ’ নয়, ‘অপসারণে’র দাবিতে ঈদ বর্জন। অবশ্য এই দাবি শেষ পর্যন্ত প্রায় ‘এক দফা’তে এসে থেমেছে এখন, শুধু যোগাযোগ মন্ত্রীর পদত্যাগে। খবরে দেখলাম, অবশেষে, যোগাযোগ মন্ত্রীর এই অপসারণ আন্দোলনে মহান জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এর উইকিলিকসের মাধ্যমে মার্কিন সাবেক রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিও যুক্ত হলেন যোগাযোগমন্ত্রীর সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অবশ্যই যুক্ত ‘হলেন’ বললে ভুল হবে, সে অনেক আগের ঘটনা, বলতে হবে যুক্ত ‘ছিলেন’। সৈয়দ আবুল মকছুদগণ আরো পরে সেই জামাতে শরিক হলেন মাত্র। তারবার্তাটি দশ ফেব্রুয়ারি দুই হাজার দশ এর, উইকিলিকস প্রকাশ করেছে গত ত্রিশ আগস্ট। যদিও বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবরটি প্রথম বিডিনিউজের মাধ্যমেই এসেছে, গতকাল। বিরোধী দল বিএনপিও এই ব্যাপারে উৎসাহী। সরকারের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর আন্দোলন তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতায় আশার আলো দেখছে বিরোধী দল। বুদ্ধিজীবীদের ঈদ-আগ্রহ এবং উইকিলিকস তাদের জন্য আপাত আশীর্বাদ। উৎসাহী আওয়ামীলীগের সংসদীয় কমিটির ব্যাঘ্রগণও, যারা মন্ত্রী হতে পারেন নাই এইবার। উৎসাহী আমরাও। কারণ, আমাদের সুশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ ও তাদের কিছু মিডিয়ার কর্মসূচির সাথে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির ‘সখ্য’ প্রকাশ্য করেছে বিডিনিউজ। যদিও সরকার হিশেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ পুরোপুরি ব্যর্থ ও দুর্নীতিপরায়ণ, অন্যান্য সরকারগুলোর মতই বা তার চেয়েও বেশি, এ বিষয়ে আমার কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু আমরা মহান জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সাহেবের মাধ্যমে মহান জেমস এফ মরিয়ার্টির ‘আন্দোলন’ পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিই আপাতত। এবং অপেক্ষা করি।
৪.
কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের গল্পেই কি সব শেষ হয়ে যায়? গল্পের অপরাপর চরিত্র, যারা উচ্চারিত হলো না, তাদের খোঁজ কি আমরা একটু হলেও নেব না? অন্তত বুদ্ধিজীবী সমাজের গল্পের সাথে সম্পর্কিত করে হলেও, সেটি করার চেষ্টা করি এবার। তারেক-মিশুকের দুর্ঘটনায় একই সাথে আরো তিন জনের মৃত্যু ঘটেছে। তারা মিডিয়ায় এবং অপরাপর সব আলোচনায় সম্পূর্ণ অনুপস্হিত। আমরা প্রচুর খোঁজ খবরের মাধ্যমে অনেক কষ্টসাধ্যে এ তিনজনের নাম জানতে পারি। তারেকের মাইক্রোবাস চালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজ, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোতালেব হোসেন এবং প্রোডাকশন কর্মী মোহাম্মদ জামাল। কেন? সমভবত এ তিনজন তখনো নাগরিক বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন নাই বলে। আবার, এই শ্রেণীর ছায়ায় থাকার কারণে মিডিয়ায় অন্তত তাদের নামটুক এলো, হয়তো বা। এদিকে বুদ্ধিজীবী সমাজের এই ঈদ-বর্জন শোরগোলের মধ্যেই, ঈদের ঠিক আগে পুলিশী নির্যাতনে অসুস্হ হয়ে যাওয়া আইনজীবী এম ইউ আহমদ এর মৃত্যুর খবর পাই আমরা মিডিয়ায়, ছোটখাট পরিসরে। ইনি ‘বিএনপির আইনজীবী’, বিডিনিউজের মত একটি পপুলার মিডিয়ার সংবাদ-শিরোনাম ছিল এমনই। বিএনপি নামে কোন কোর্ট আদতে কি আছে, ফেসবুকে এই জনপ্রিয় মিডিয়াটির পেইজে একজন পাঠকের বিষ্ময় ছিল এটি। প্রসঙ্গত মরহুম এমইউ আহমদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু বিএনপি সমর্থক, ঘটনা হল এই। সংবাদের দলীয় চেহারা মাঝে মধ্যে এমন আজগুবি রূপ ধারণ করে যে, এমইউ আহমদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে ‘বিএনপির আইনজীবী’তে পরিণত হন।
এম ইউ আহমেদ ছাড়াও এই মাসে আরো অনেকেই মরেছেন, বা খুন হয়েছেন। পঁচিশ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জোয়ানরা বাবুল আহমদ নামে এক বাংলাদেশী যুবককে পাথর ছুড়ে খুন করে। যদিও সীমান্তে বিএসএফ এর খুনোখুনির ঘটনার এখন কোন সংবাদমূল্যই নেই মিডিয়ায় কাছে, এটি তারা ছোট করে ছাপে, অথবা ছাপে না। বরং এখন ‘বন্ধুত্বে’র সংবাদগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ‘মধুর মনমোহন সিং’, ‘মমতাময়ী মমতার অভিমান’, মহান সোনিয়া গান্ধির ‘অটিস্টিক সফর’- ‘সম্পর্কে’র বৈপ্লবিক রূপান্তরের দোরগোড়ায় বাংলাদেশ-ভারত’, ‘বহুল সম্ভাবনার ট্রানজিট হলো না’- এইসব লাল শিরোনাম। লাল- এইটার একটা কারণ এমনও হতে পারে যে, সংবাদগুলোতে বাবুল বা ফেলানীর রক্ত লেগে আছে। সীমান্ত-হত্যা, এটি পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী ভারতের বিপরীতে দেউলিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘বন্ধুত্ব’ ও বেড়ে ওঠার দৈন ইতিহাসের অংশ। ‘অধিকারে’র দেয়া তথ্যমতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর হাতে গত দশ বছরে প্রায় সাড়ে নয়শ’ বাংলাদেশী খুন হয়। এই হিশেবের ভেতরে বাবুল আহমেদ এবং নতুন বছরে খুন হয়ে যাওয়া সংখ্যারা সমভবত নেই। গেল সীমান্তপর্ব। আবার, তারেক-মিশুকদের দুর্ঘটনার আগের দিন রাষ্ট্রীয় শৃঙখলা-বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারে মারা গেছেন পাঁচজন। ক্রসফায়ার- এটিও এখন আর কোন সংবাদ-ই নয় মিডিয়ার জন্য, প্রতিদিনই ঘটে। এটিও বাদ আপাতত। জুলাই মাসেই শবে বরাতের রাতে রাজধানীতে ছয় তরুণকে প্রকাশ্য গণপিটুনির মাধ্যমে ও কুপিয়ে মারা হয়েছে। ‘অধিকার’ জানাচ্ছে, এ বছরেরই জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এমন গণপিটুনিতে মরেছে পঁচাত্তর জন। আর দুই হাজার দশ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মরেছে একশ ছাব্বিশ জন। গণপিটুনি গেল। মীরসরাইয়ের আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড বা দুর্ঘটনা কি মনে আছে আপনাদের? গত এগার জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধ-শত ছাত্র-ছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল, সড়ক দুর্ঘটনায়। শেষোক্ত ঘটনাটি মিডিয়াতে কিছুটা গুরুত্বের সাথে এসেছিলো। মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেছেন মীরসরাই- ‘শোক’ ও ‘সমবেদনা’ জানাতে। এই সব খুব কাছের ঘটনা, তাও সব ঘটনাগুলোর বরাত অনা সমভব হলো না।
আবু তোরাবের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ সেসময় কোথায় ছিলেন? সমভবত ঘুমোচ্ছিলেন। প্রতিবাদ দূরের কথা, হয়তো তাদের ‘শোক’-ধারণাও অত পোক্ত হয়ে ওঠে নাই তখন পর্যন্ত। হয়তো ছোটলোকের ছেলেদের জন্য ‘শোক’ প্রকাশ শ্রেণী-আভিজাত্যের সাথে যায় না, তাই। মরে যাওয়া শিশুগুলো কোথাকার কোন পাড়াগাঁর, শহরের হলেও কথা ছিল। অজপাড়াগাঁর মীরসরাইয়ের প্রায় অর্ধশত ছাত্রের থেকে মরহুম বুদ্ধিজীবী তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনির খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়। হবেও বা। অথবা মহান জেমস এফ মরিয়ার্টির তারবার্তা তখনো তাদের কাছে এসে পৌঁছায় নাই। অথবা উইকিলিকসে প্রকাশিত হওয়ার আগেই ওরা হয়তো পেয়েছিলেন, কিন্তু মধ্যবিত্তের আরো গভীর ‘শোক’ নির্মাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেমন তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনির। তাই অধীর হয়ে ছুটে যান নাই- বা যোগাযোগ মন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর অপসারণও চান নাই।
দৃশ্যত অজপাড়াগাঁয়ের একটি বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশত ছাত্রকে ট্রাকে করে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে’ যেতে বাধ্য করার বা তাদের হত্যার কৃতিত্ব শিক্ষামন্ত্রীর। অথবা খোদ প্রধানমন্ত্রীরই কিনা- এ বিষয়টি ভাবার ফুরসত বা সাহস তাদের হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। তবে শিক্ষা মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে মিডিয়ায় তাদের এমন কোন ভাবনা বা তৎপরতা প্রকাশ হয় নাই।
তবে লক্ষণীয়, তারেক-মিশুক এর মৃত্যুর আগে বা পরের খুন ও দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে আমাদের ‘সত্যাগ্রহী’ বুদ্ধিজীবীগণ মাসব্যাপী গান্ধীবাদী নিরবতা দেখিয়েছেন। জনাব আহমেদ ‘বিএনপির আইনজীবী’ বলে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো মৃদু প্রতিবাদ ও শোক প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধিজীবীগণ নীরব। গণপিটুনিতে ছয় তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জনগণকে আইন বিষয়ে ‘শিক্ষিত’ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবীগণের গলা ফুলে উঠে নাই প্রতিবাদে। বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখন আর নতুন কিছু বলেন না। র্যাবের মতই মুখস্হ প্রেসনোট পাঠিয়ে দেন। বুদ্ধিজীবীগণের প্রগাঢ় নীরবতা ঘন হয়।
সবশেষে বাবুল আহমদরা বিএসএফ এর গুলিতে মারা গেলে, মরার একটা প্রেসনোটও হয় না। না কোন প্রতিবাদ, না কোন ‘শোক’। না প্রধানমন্ত্রী, না বিরোধী দলীয় নেত্রী, না মহান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যারা প্রতিবাদে সত্যাগ্রহ করেছেন শহীদ মিনারে।
প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের, বন্ধুত্বের এমন প্রগাঢ় মুহূর্তে এই মরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছোট পরিসরে হলেও মিডিয়াতে আসায় সবাই সমভবত বিরক্ত হয়েছেন।
৫.
শহরে ফিরে সংবাদ-প্রবাহের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর, বিষয়গুলো নিয়ে এভাবেই ভাবলাম অনেকক্ষণ। ভেবে ভেবে মনে হলো, এই ‘বিরক্তি’র বিষয়গুলো ভুলে গিয়ে আমরা বরং আপাতত ‘শোক’ প্রকাশ করি। নাহ, বাবুলের জন্য নয়, স্রেফ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর জন্য। এটা বেশ সুবিধাজনক। সবকিছু ছাপিয়ে, মিডিয়াতে শোক প্রকাশ করে লেখালেখি করি, গলা ফুলিয়ে কথা বলি। আমাদের বিভিন্ন মৃত্যুতে ‘শোক’ হোক, শহীদ মিনারে ‘ঈদ’ হোক। নিখাদ হত্যাকাণ্ডগুলো আমরা ভুলে যেতে চাই। কারণ আমরা বুদ্ধিজীবী হই, বা হবো।