Blogs

রিফাত হাসান

ভ্যাটের রাষ্ট্রবিজ্ঞান

September 14, 2015   0 comments   12:06 am
Primary Author: রিফাত হাসান

ভ্যাট নিয়া সাইফুর রহমানের আমলে লাল লাইনে নো ভ্যাট ক্রস চিহ্ণিত পোস্টার দেখতাম। সেই সময় তেমন বুঝতাম না, যখন বুঝা শুরু করলাম, তখন থেকে অবিচার মনে হইত। সেইটা ছিল বিএনপি আমল। তখন কিছু কিছু ভ্যাট নেওয়া দোকানের সাথে জঙ্গী আলাপ চালা্তাম, ভ্যাট না দেবার তরে। আমার অবশ্যই ট্যাক্সকেও অবিচারই মনে হইত, এখনো হয়। তবে ভ্যাট হল ডাকাতি। তাই, আমি সচেতন থেকে ভ্যাট নেওয়া দোকানি থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কাহাঁতক? পুরোপুরি এড়ানো অসম্ভব। এইবার এল শিক্ষায় ভ্যাট। এই ব্যাপারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটু হীনমন্যতা কাজ করছে। দুই কারণে। এক. তারা মনে করে তারা বড়লোকের পোলা না। সুতরাং এইটা তাদের বিষয় নয়। দুই. দেশের জরুরি মুহূর্তে তারা পোতায়ে গেছেন। তার অবস্থান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিয়ে নেবে, তা মন থেকে মানতে না পারা। কিন্তু ভ্যাট বিষয়টা আন্দোলনের জন্য কেমন? এইটা কি কোন মৌলিক আন্দোলন? কেউ কেউ এইটারে পোস্টমডার্ন আন্দোলন বলবার চেষ্টায় আছেন, যার মেয়াদ সীমিত। অচিরেই এর ইতি ঘটবে। তাই কি? এই আন্দোলনে এমন শ্লোগানও আসছে, নো ভ্যাট, গুলি কর। ক্ষমতাসীনদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদজনক শ্লোগান। এই কবছরে আমরা পুলিশ প্রহরায় আন্দোলন দেখেছি, বিপরীতে পুলিশের গুলিতে মরেছে কয়েক হাজার, ক্রসফায়ারে, পথে, ঘাটে, মিছিলেও অগণিত। কোথাও এমন শ্লোগান উচ্চারিত হয় নাই। এই প্রথম উচ্চারিত হল। পুলিশের, মানে সরকারের অহমে আঘাত এমন আহবান। গুলি কর। এই…

Share

ভ্যাট নিয়া সাইফুর রহমানের আমলে লাল লাইনে নো ভ্যাট ক্রস চিহ্ণিত পোস্টার দেখতাম। সেই সময় তেমন বুঝতাম না, যখন বুঝা শুরু করলাম, তখন থেকে অবিচার মনে হইত। সেইটা ছিল বিএনপি আমল। তখন কিছু কিছু ভ্যাট নেওয়া দোকানের সাথে জঙ্গী আলাপ চালা্তাম, ভ্যাট না দেবার তরে।

আমার অবশ্যই ট্যাক্সকেও অবিচারই মনে হইত, এখনো হয়। তবে ভ্যাট হল ডাকাতি। তাই, আমি সচেতন থেকে ভ্যাট নেওয়া দোকানি থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কাহাঁতক? পুরোপুরি এড়ানো অসম্ভব। এইবার এল শিক্ষায় ভ্যাট। এই ব্যাপারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটু হীনমন্যতা কাজ করছে। দুই কারণে। এক. তারা মনে করে তারা বড়লোকের পোলা না। সুতরাং এইটা তাদের বিষয় নয়। দুই. দেশের জরুরি মুহূর্তে তারা পোতায়ে গেছেন। তার অবস্থান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিয়ে নেবে, তা মন থেকে মানতে না পারা।

কিন্তু ভ্যাট বিষয়টা আন্দোলনের জন্য কেমন? এইটা কি কোন মৌলিক আন্দোলন? কেউ কেউ এইটারে পোস্টমডার্ন আন্দোলন বলবার চেষ্টায় আছেন, যার মেয়াদ সীমিত। অচিরেই এর ইতি ঘটবে। তাই কি? এই আন্দোলনে এমন শ্লোগানও আসছে, নো ভ্যাট, গুলি কর। ক্ষমতাসীনদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদজনক শ্লোগান। এই কবছরে আমরা পুলিশ প্রহরায় আন্দোলন দেখেছি, বিপরীতে পুলিশের গুলিতে মরেছে কয়েক হাজার, ক্রসফায়ারে, পথে, ঘাটে, মিছিলেও অগণিত। কোথাও এমন শ্লোগান উচ্চারিত হয় নাই। এই প্রথম উচ্চারিত হল। পুলিশের, মানে সরকারের অহমে আঘাত এমন আহবান। গুলি কর। এই জাগায় পুলিশ কর্তা হিশেবে হাজির নেই, গুলি করলেও। পুলিশ গুলি করবে ছাত্রদের আহবানে। এই অহমের জায়গাটা সরকার নিতে পারবে না। তাই গুলি করলেও, এইবার ভেবে চিনতে করবে বলেই আমার ধারণা।

এর আগে আমরা গৃহপালিত আন্দোলন দেখেছি। পুলিশ প্রহরায়, ফাঁসি চাই আন্দোলন। সেই অান্দোলনের সাথে এর তফাত কোথায়? আমরা দায়িত্ব নিয়ে শাহবাগের বিরোধিতা করেছিলাম ও তার গন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। ফাঁসি ও বিচারের প্রশ্নে প্রচুর বাহাস হয়েছে। প্রথমত, আমরা বলেছিলাম, দাবীটাই ফ্যাসিস্ট। তারপরে একটা দাবীকে গণদাবী প্রমাণ করতে যাদের পুলিশের সহায়তা লাগে, গোয়েন্দা সংস্থার খুনোখুনি লাগে, মিডিয়াকে বন্ধ করে দিতে হয়, তার ব্যাপারে এমন গুরুত্ব দিয়ে আলাপেরও কিছু নেই। তৃতীয়ত, ফাঁসি ও বিচার এক নয়। এই আন্দোলনের পরিণতিতে (এইটা কি আন্দোলন ছিল আদৌ?) বিচার মানেই ফাঁসি, এমন একটা ধারণা তৈরী করা হয়, ট্রাইবুনাল আইন পরিবর্তন করে একটি বিদ্যমান রায়ের গতি চেইঞ্জ করে দেওয়া হয়, এবং ফাঁসি, কেবলই ফাঁসি, নো ন্যায়বিচার। তাইলে ট্রাইবুনালের দরকার কী ছিল, আমরা প্রশ্ন করেছি।

ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের সম্ভাবনা ও সুবিধাবাদিতাও আমাদের নজরে আনতে পারি। প্রথমত, এই আন্দোলনের চরিত্র গণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট কোন দাবী নিয়ে তারা আসে নাই। এখানে পুলিশ প্রহরা নেই, বরং পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছে ছাত্ররা। সরকারপন্থি মিডিয়া, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এই আন্দোলন থামাতে তৎপর। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এই আন্দোলনের ছাত্রদের অহমে আঘাত দিয়ে ঠাট্টা করেছে। সুতরাং কোনমতেই এই আন্দোলনকে গৃহপালিত আন্দোলন বলা যাবে না।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটা রেডিমেইড উন্নয়নবিপ্লবী মডেলে বিশ্বাসী বইলা আমার ধারণা ছিল, কারণ আমার জানামতে এক এগারর কুশিলবরা সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে। এইবার তারা এই আন্দোলনে সেই মডেল থেকে নিজেদের বের করে এনেছে। এইটা কম বড় ঘটনা নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে দুটি শ্রেণী আছে। এরা পপুলারলি যেই শ্রেণীর, সেই শ্রেণীর জন্য গণতন্ত্র খুব একটা বড় সমস্যা নয়, যেহেতু খুব একটা আন্দোলন সংগ্রামেও তাদের থাকতে হয় না, সরকারের জননিপীড়ণ তাদের খুব একটা গায়েও লাগে না। তাদের খুব একটা জীবিকার সংগ্রামও নেই। আমি মনে করি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শ্রেণীর ছাত্রদের আন্দোলন আবশ্যিকভাবেই তাদের বাবা মা দের আন্দোলন না। তাদের বাবা মারা ভ্যাট দিয়ে এবং ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে উভয় অবস্থাতেই সুখি। এই আন্দোলনটি একান্তই তাদের। কারণ এই ঘটনাটি তাদের অহমে আঘাত হানে। এত সুন্দর স্বাভাবিকভাবে সব কিছু মাইনা নিয়েও তাাদেরে ভ্যাট দিয়ে পড়তে হবে? এই বুঝার মুহূর্তটি দারুণ। ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত না আসা পর্যন্ত অন্যের স্বার্থ বুঝাও মুশকিল, বিশেষত যে শ্রেণীর এই আঘাত পাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তাদেরকে গুলিও করা হল। এইবার তারা জগদ্দল রাষ্ট্রের মুখোমুখি হল। অনেকটা রক্তের দাগ মুছে মুছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের মত ঘটনা।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আর একটি শ্রেণী হল, অতিনিম্নমধ্যবিত্ত্ব। তাদের বাবা মারা এই অান্দোলনে হাজির শুধু না, এক জাগায় দেখলাম, শ্লোগানও দিচ্ছেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বামীও হাজির আছেন। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাইলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ভর্তি হল কেন? এক মজার প্রশ্ন বটে। এই প্রশ্নটিই আপনি করুন রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রই উত্তর দিতে পারবে, কেন নাগরিকদের একটা অংশকে জীবনের সর্বস্ব শুধু সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে ব্যয় করতে হচ্ছে। দেশে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার পরে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাওয়াটা কি অপরাধ? অথবা এমনও অনেকে আছেন, যারা নানান বিপদে পড়ে বিস্তর বিরতি দিয়ে আবার পড়ালেখা কনটিনিউ করতে উপায় খুঁজেন। তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকে না, যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ তাদের জন্য রুদ্ধ। এই শ্রেণীর জন্য ভ্যাট বিরোধী সংগ্রাম তাদের জীবন সংগ্রামেরই অংশ। তারা প্রতিক্ষণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আছেন। সর্বক্ষণ, রাষ্ট্রের মুখোমুখি।

ভ্যাট নিয়া এই আন্দোলন অরাজনৈতিক? হাঃহাঃ। অরাজনৈতিক কোন আন্দোলনই হয় না। ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, বিপদের মুখোমুখি না ফেলে কোন আন্দোলনই হয় না। এই আন্দোলন অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্বকে নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি ও সন্ত্রস্ত করেছে। ফলত এইটা একটা রাজনৈতিক আন্দোলনই। আমি এইরকম আরো আরো আন্দোলনের শুরু হোক, তাই চাই। শিক্ষকদের আন্দোলনও এরকম কর্তৃত্বময় হয়ে ওঠুক। আমি এই রাজনৈতিক আন্দোলনের সফলতা কামনা করি।

Leave the first comment