হাসিনার পতনের আগের কথা। টিএসসিতে মধু দা’র দোকানে বন্ধুবান্ধব মিলে চা খেতে বসতাম আমরা। আড্ডা দিতাম। রাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলাপ হতো। আর পুরোটা সময় রাজু ভাস্কর্যের পেছনে মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা হাসিনার হাসিমুখ তাকিয়ে থাকতো আমাদের দিকে। এমনই সেই ছবির মহিমা যে, টিএসসির যে চায়ের দোকানেই বসি না কেনো, মনে হতো, হাসিনা ঠিক আমাদেরই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। আড্ডার ফাঁকে আমরা বলতাম, ‘ওই যে, Big Sister is watching you.’ মজা করেই বলতাম, কিন্তু এটা তো সত্যও। ১৫ বছর তো আমরা হাসিনার নজরদারিতেই বন্দী ছিলাম। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায়।
তখন আমাদের একটা আশা বা একটা স্বপ্ন ছিলো যে, পতন যেদিন হবে, সেইদিন তন্ত্র-মন্ত্র-শাসন-প্রশাসন-যন্ত্র-ষড়যন্ত্র সমেতই বিদায় নেবেন আমাদের ‘মাননীয়া’ বিগ সিস্টার। এর মধ্যেই অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই জুলাই আসলো। অনেক শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে মহাপরাক্রমশালী হাসিনা সরে গেলো আমাদের ঘাড় থেকে। বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অর্জনগুলোর মধ্যে জুলাই নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু, জুলাই থেকে প্রায় আট মাসের দূরত্বে দাঁড়িয়ে বাঙলাদেশের দিকে তাকালে আজ মনে হয়, হাসিনা গেলো ঠিকই, কিন্তু হাসিনার তন্ত্রমন্ত্র গেলো না। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, উত্তরোত্তর মব, মোরাল পুলিশিং, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, সেনাবাহিনীর রহস্যজনক আচরণ, সাবেকী ট্যাগিং কালচারের সমর্যাদায় ফিরে আসা, ইত্যাদি দেখতে দেখতে একটু হতাশই হয়ে গেছি বলা যায়। আরো ভালো কিছু, বেশি কিছু তো আমরা ডিজার্ভ করতাম। নাকি?
এইরকম একটা সময়েই রিফাত হাসানের ‘মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে’ বইটা একটা জার্নির মতো লাগে। এই বইয়ের বেশির ভাগ লেখাই হাসিনার আমলেই বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা (এমনকি ২০১৩/১৪ সালের কিছু লেখাও আছে এর মধ্যে), ফলে বইটা পড়ার সময় আওয়ামী জামানায় ঘুরে আসার একটা অভিজ্ঞতা হতে পারে পাঠকের। আবার কিছু লেখা বলা যায় সাম্প্রতিক সময়ের, এগুলো জুলাইয়ের আগে-পরে কিংবা জুলাইয়ে লেখা। ‘আফটারফ্যাসিস্ট পলিটিকাল ম্যানিফেস্টো’ এই ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ‘নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমান পাঠ’ কিংবা ‘আমার ইসলাম প্রশ্ন’-এর মতো জুলাইয়ের আগেই পড়েছি, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখাও দেখলাম ঢুকে গেছে এই বইয়ে। মানিয়েই গেছে বলা যায়। সব মিলিয়ে বিরাট আয়োজন। সিনেমা, স্লোগান, সংবিধান, মিডিয়া, মিডিয়ার শয়তানি, রাজনীতি, ধর্ম, ধর্মীয় রাজনীতি, ধর্মকে নির্বিশেষে গরহাজির রাখার রাজনীতি- মানে বাঙলাদেশে বাস করতে হলে নাগরিক হিসেবে ঘুরেফিরে যে প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করতে হয়, তার মোটামুটি সবই উঠে এসেছে এই বইয়ে। এরকম ক্ষেত্রে যেটা হয়, একঘেয়ে লাগার সম্ভাবনা কমে যায়। এখানেও সেটাই হয়েছে। তাছাড়া রিফাত হাসানের ভাষাও হলো বৈঠকী ভাষা। সেইখানে প্রমিত-অপ্রমিতের মিশ্রণ আছে, গুরুচণ্ডালী আছে। পাঠক হিসেবে এর বিপক্ষে অনেক কথাই বলা যায়, তবে মোটের উপর, এই গুরুচণ্ডালী রিফাত হাসানের শক্তির জায়গাই। বাঙলাদেশে চালু কলাম আর সম্পাদকীয়ের পঁচা, একঘেয়ে, বৈচিত্রহীন প্রমিতের তুলনায় এই বৈঠকী ভাষা পাঠকের পক্ষে বেশি আরামের। কিছু লেখা আকারে অনেক ছোটো, আদতে হয়তো এগুলো ফেসবুক পোস্ট ছিলো, কিন্তু কুইক অবজার্ভেশন হিসেবে এই টুকরো লেখাগুলো যথেষ্টই মূল্যবান। ‘ধর্ম ও নিধর্মের মবগুলো’ কিংবা ‘ধর্মব্যাখা ও বোঝাপড়ার অথোরিটি’ এর ভালো উদাহরণ।
যা হোক, সব লেখা নিয়ে কথা বলা তো একটা বড়ো সময়ের ব্যাপার। এইখানে বরং ‘মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে’-র প্রধান কিছু প্রবণতা নিয়েই কথা বলবো। আমার মনে হয়, লেখক হিসেবে রিফাত হাসানের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্বের জায়গা হচ্ছে হাসিনার রেজিমের জাত-ধর্ম-চরিত্রকে সঠিকভাবে ধরতে পারা। ওনার অন্যান্য বইয়ের সাথে এই বই মিলিয়ে পড়লে এই বিষয়টাই চোখে পড়ে সবার আগে। যেমন, মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে-র এক জায়গায় উনি বলছেন, বাঙলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতির দুইটা চরিত্র: ফ্যাসিস্ট ও টোটালিটারিয়ান। লেখাটা ২০১৫ সালের। আওয়ামী লীগের রাজনীতি বা আওয়ামী রেজিমকে ফ্যাসিস্ট বলতে তখন অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতেন। নামীদামী বুদ্ধিজীবীদের বইপত্রে এই শব্দের খুব বেশি প্রয়োগ আমরা দেখিনি। যদিও ২০২৫ সালে আমরা দেখছি আওয়ামী লীগেরই কর্মদোষে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটা প্রায় জাতীয় গালিতে পরিণত হয়েছে৷
‘টোটালিটারিয়ান’ শব্দটা সেইভাবে জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয় এই ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার দরকার আছে। রিফাত হাসান আওয়ামী লীগের টোটালিটারিয়ান রাজনীতির ব্যাখ্যা করেছেন সংক্ষেপে। ওনার লেখা থেকেই খানিকটা পড়া যায় এখানে, “মতাদর্শগতভাবে আওয়ামীলীগ চরমপন্থি ও মৌলবাদি। বাংলাদেশে রাজনীতিতে টোটালিটারিয়ান ভাবের জনক। এই ভাবের কালচারাল প্রপোজিশন হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা হাড়ে মজ্জায় ফ্যাসিস্ট, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ও পরমত অসহিষ্ণু। তাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রপাগাণ্ডা ও জ্ঞানীয় জায়গায় গণহত্যাকাঙ্ক্ষাকে দর্শন আকারে হাজিরের চেষ্টা থাকে সব সময়। ইতিহাসে সব সময় তারা পেশিশক্তি ও একনায়কতন্ত্রকেই তাদের পথ হিশেবে বেছে নিয়েছে…”। কথা তো সত্যিই। কিন্তু এইখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। খালি বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা সেক্যুলারিজমে ভর করেই কি আওয়ামী লীগ রাজত্ব করে? গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের কী বলে? বা, মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে-রই কিছু কিছু জায়গায় কি আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির এই আদর্শ টোটালিটারিয়ান চরিত্র থেকে কিছু কিছু বিচ্যুতির আভাস পাই না? ‘কওমী জননী’ কাণ্ডের কথাই ধরা যাক। অফিশিয়াল আইডিওলজি-র ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের খাঁটি টোটালিটারিয়ান কমিটমেন্ট যদি থাকতোই, তো হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে যে তুখোড় রাজনীতিটা আওয়ামী লীগ করেছে, সেইটা কি করা সম্ভব ছিলো? হেফাজতের সাজেশনে বাঙলা টেক্সটবুক সংশোধনের ঘটনা কি আওয়ামী লীগের ঘোষিত আদর্শের সাথে যায়? বা মন্দির ভাঙার রাজনীতিটা? এই যে, আইডিওলজিক্যাল কমিটমেন্টের তীব্র অভাব সত্ত্বেও একটা টোটালিটারিয়ান চরিত্র ধরে রাখতে পারা- এইটাকে মাইকেল ওয়ালজারের ‘Failed Totalitarianism’-এর ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ওয়ালজার দেখিয়েছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ বা অশুদ্ধ টোটালিটারিয়ানিজমও যথেষ্ট শক্তিশালী ও ঘাতসহ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। এক হিসেবে, একে স্বতন্ত্র একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবেও কল্পনা করা যেতে পারে। এইখানে শাসক এলিটগোষ্ঠী নামকাওয়াস্তে একটা আইডিওলজি ধারণ করে ঠিকই, কিন্তু সেইটা নিতান্তই একটা ধাপ্পাবাজি। এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে যথাসম্ভব টাকাপয়সা কামিয়ে নেওয়া, এবং এই উদ্দেশ্যই তাদেরকে এক ছাতার নিচে টেনে আনে। আইডিওলজিটাকে এরা ব্যবহার করে স্রেফ প্রতিপক্ষকে দমন এবং সংকটের সময় ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা চর্চার লেজিটিমেসি হিসেবে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও আমরা এইটাই দেখি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ আর সমাজতন্ত্র মিলেমিশে যে খিচুড়ি-আইডিওলজি আওয়ামী লীগ ধারণ করে, একে তো তার উপর কোনো রাজনৈতিক কমিটমেন্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেই (আওয়ামী লীগের কালচারাল উইংয়ের কারো কারো মধ্যে থাকতে পারে যদিও), তার উপর এই আইডিওলজির বিশেষ কোনো সীমারেখাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এইটা আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধার ব্যাপার, কারণ এই খিচুড়ির মধ্যে ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করা যায়, যখন-তখন যা খুশি করা যায়, এমনকি মাঝেমাঝে আইডিওলজির ঊর্ধ্বে উঠে ইচ্ছেমতো ধান্ধাবাজিও করা যায়। মদীনা সনদ দিয়ে দেশ চালানোর কথা বলা যায়। ‘আওয়ামী লীগ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে কাজ নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে’- এমন দাবিও করা যায় যখন তখন। আওয়ামী লীগের এই ভণ্ডামির ব্যাপারগুলো যে রিফাত হাসানের বইয়ে নেই, তা না। বরং বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো বইয়ে। তবু আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগের এই ‘ডানপন্থী’ চরিত্রের আলোচনা আরেকটু সিরিয়াসলি করা দরকার। বিশেষ করে যখন জুলাইয়ের পরে ‘সব দোষ বাম আর শাহবাগীদের’ কথাটা বারবার শোনা যাচ্ছে চারিদিকে, শাহবাগীদের জবাই করতে চাওয়ার পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে, তখন। শাহবাগ পরিতাজ্যই। কিন্তু শুধু শাহবাগ দিয়ে তো হাসিনার রেজিমকে ব্যাখা করা যায় না। অর্ধেকটা করা যায় সর্বোচ্চ।
শাহবাগের প্রসঙ্গ উঠতে মনে পড়লো বাঙলাদেশের ‘সিভিল সোসাইটি’ বা নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার ব্যাপারটা। এই ব্যাপারে বহু তীর্যক মন্তব্য রিফাত হাসানের বইয়েও পাওয়া যাবে। সিভিল সোসাইটি নিয়ে আমাদের হাহাকার তো প্রায় চর্বিত চর্বণের পর্যায়েই পড়ে এখন। মজার ব্যাপার হলো, আদপে সিভিল সোসাইটি বলতে যা-ই বোঝাক, বাঙলাদেশে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ বলতে সাধারণত একটা সংখ্যালঘু, এলিট গোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়৷ এই এলিটেরা বাঙলাদেশের ক্ষমতা-কেন্দ্রগুলির মধ্যেই বাস করেন, নয়তো এর কাছাকাছি থাকেন৷ এরা সরকারি চাকরি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, রাজনৈতিক দল চালান, টকশোয় যান, কলাম লেখেন, সম্পাদকীয় লেখেন, সভা-সেমিনার করেন। জ্ঞানে-গুণে যে তারাই শ্রেষ্ঠ, তারাই যে অথোরিটি, এইরকম একটা অ্যাটিটিউডও তারা হামেশাই দেখান। এরপরও দেখা যায়, এই এলিটেরা আসলে নানা ধরনের বিভ্রমে আক্রান্ত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তগুলিতে এরা প্রায়ই নির্বোধের মতো আচরণ করেন। রিফাত হাসানের বইয়ের বইয়ে এইরকম বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে। যেমন, শাহবাগ ইস্যুতে সলিমুল্লাহ খান, প্রথম আলো বন্ধের ইস্যুতে হরিশংকর জলদাস, ইত্যাদি। পার্টিজান বুদ্ধিজীবিতার আলোচনাও আছে বেশ কয়েক জায়গায়। রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে সিভিল সোসাইটি যে হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি, বরং ফ্যাসিস্ট রেজিমের পক্ষে জনসম্মতি উৎপাদনের চেষ্টাই করে গেছে মোটা দাগে, এই ব্যাপারটাকে রিফাত হাসান ফোকাসে আনার চেষ্টা করেছেন। এইটা অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা না বাঙলাদেশে। বাঙলাদেশের তথাকথিত সিভিল সোসাইটির গঠন ও বিবর্তনটাই এমনভাবে হয়েছে যে এরা পার্টিজান বুদ্ধিজীবিতার বাইরে যেতে পারেন না। মাঝেমাঝে স্বাধীনভাবে কিছু বললে বা করলেও শেষ অব্দি দেখা যায় পার্টিজান প্যাটার্নের বাইরে যেতে পারেননি। তাদের অজ্ঞাতেই দেখা গেছে তাদের একটা কথা বা কাজ পার্টিজান পলিটিক্সের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের কথা বলা যায়। কয়েকদিন আগে আহমদ শরীফের ডায়েরী পড়তে গিয়ে এক জায়গায় দেখলাম তিনি ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির প্রসঙ্গ এনেছেন। জাহানারা ইমাম, শাহরিয়ার কবির, সৈয়দ হাসান ইমাম-দের হাত ধরে ঘাদানিক যে আওয়ামী লীগেরই দাসানুদাস সংগঠন হয়ে উঠলো, এইটার সমালোচনা করছেন আহমদ শরীফ। মজার বিষয় হলো, নিজে আওয়ামী লীগার না হওয়া সত্ত্বেও আহমদ শরীফ গণ-আদালতের বিচারক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন৷ কেনো যোগ দিয়েছিলেন, সেই উত্তরও আহমদ শরীফ দিয়েছেন। তিনি গণ-আদালতে গেছিলেন ব্যক্তি গোলাম আজমকে শায়েস্তা করে দল হিসেবে জামাতকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য। যুদ্ধাপরাধের বিচার, অর্থাৎ সুষ্ঠু বিচার, তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো না। দেখবার বিষয় হলো, এইখানে আহমদ শরীফের দাবি হলো তিনি গণআদালতে গেছিলেন স্বাধীন, নন-পার্টিজান নাগরিক হিসেবে। এই দিক দিয়ে তিনি হয়তো ‘ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী’ শাহরিয়ার কবিরের থেকে আলাদা। কিন্তু তাদের উভয়ের কর্মকাণ্ডের ফসল ঘরে তুলেছে আওয়ামী লীগ (উল্লেখ্য যে, নব্বই দশকের গণআদালতই ২০১৩-র গণজাগরণ মঞ্চের আদি নমুনা)। শেষ পর্যন্ত গোলাম আজম আর জামাতকে নিয়েই জোট গঠন করে আওয়ামী লীগ, ঘাদানিক ভূমিকা নেয় নীরব দর্শকের৷ এই নীরবতা কোনো নিষ্পাপ ও নিষ্ক্রিয় জিনিস না, বরং এইটা শাহরিয়ার কবিরদের পার্টিজান সক্রিয়তারই একটা নমুনা মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা সেক্যুলার মানবতাবাদ আহমদ শরীফ আর শাহরিয়ার কবিরদের ‘সুশীল সমাজ’-কে যথার্থ অর্থে নাগরিক সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। একই কথা খাটে ধর্ম সম্পর্কে। ইসলাম সম্পর্কে। ধর্মের খুব ভালো সম্ভাবনা ছিলো বাঙলাদেশে নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চালকের ভূমিকা নেওয়ার। কিন্তু সেইটা ঘটেনি। না ঘটার কারণ অনেক। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে চালু ইসলামোফোবিয়া তো আছেই। রিফাত হাসান আরো একটা পয়েন্ট হাজির করেছেন তার বইয়ে। সেটা হলো, একটা সীমিত ও ক্ষুদ্র পণ্ডিত-ঘরানার মধ্যে ধর্মব্যাখ্যা ও বোঝাপড়ার অথোরিটি সীমাবদ্ধ থাকা। নাগরিক সমাজ তো মুখপাত্র-সর্বস্ব কোনো এনটিটি না। মুখপাত্রদের আচরণ যদি কর্তৃত্বধর্মী হয়, তো সেইখানে কর্তৃত্বটাই বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। ধর্ম বা আদর্শের প্রশ্নটা গৌণ হয়ে ওঠে।
ইসলাম ও ইসলাম-ভিত্তিক রাজনীতির প্রসঙ্গ বারবার এসেছে রিফাত হাসানের বইয়ে। এইটা ওনার লেখার একটা কেন্দ্রীয় জায়গাই বলা যায়। পাবলিক স্ফিয়ার থেকে ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার বা হীন সাব্যস্ত করার যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা, রিফাত হাসান এইটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বরাবরই। ‘আমার ইসলাম প্রশ্ন’ কিংবা ‘নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমান পাঠ’ এই ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে পড়া যেতে পারে। তবে, আমার ধারণা, জুলাই-উত্তর বাঙলাদেশে রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামী রাজনীতি যা-ই বলি না কেনো, ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভাবার আবশ্যকতা তৈরী হয়েছে৷ ধরেন, মুসলমান হিসেবে কারো মনে খিলাফত প্রতিষ্ঠার বাসনা তো থাকতে পারে। অনেকেরই আছে। তো সেই খিলাফত-বাসনার রাজনৈতিক প্রকাশ ও কর্মসূচি কেমনধারা হতে পারে? আজকাল ইসলামপন্থীদের কেউ কেউ বলছেন, গণতন্ত্রের প্রতি তাদের কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই, স্রেফ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এই বাধ্যবাধ্যকতা তো সাময়িক। রিফাত হাসান এক জায়গায় লিখছেন, যেহেতু বাঙলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি উভয়ই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে ছাপিয়ে যেতে চায়, সেহেতু এই ছাপিয়ে যাওয়ার বাসনাকে কোরবানি না দিলে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের রাজনীতি করা চূড়ান্ত প্রশ্নে অসম্ভব। কিন্তু ইসলামপন্থীরা কি সেই কোরবানিতে রাজি হবেন? যদি না হন, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে তাদের রাজনীতির ধরণটা কীরকম হবে? গণতন্ত্র কি আদৌ ধারণ করতে পারবে তাদেরকে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ ছাড়া? থিওলজির একটা প্রশ্নকে নকল করে এইখানে একটা প্রশ্ন করা যায়: গণতন্ত্র কি এমন কোনো পাথর সৃষ্টি করতে পারে, যে পাথর সে নিজেই বইতে পারে না?
নৈতিক বাধ্যবাধকতার ব্যাপারটাও বেশ গোলমেলে। ধরেন, পাঁচই আগস্টের পরে এই যে এতোগুলো মাজার ভাঙ্গার ঘটনা ঘটলো, এই ঘটনাগুলোকে বহু মানুষ সমর্থন করছে এই যুক্তিতে যে, ইসলামে মাজার-টাজার কিছু নেই; মুসলমান হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব হলো মাজার ভেঙে দেওয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় এরকম হাজার হাজার কমেন্ট পাওয়া যাবে, যার মূল কথা এইটাই: মুসলমান হিসেবে এইটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এখন যদি রাষ্ট্র এই কাজে বাঁধা দেয়, তো অনেক মুসলমানই সেইটাকে নিজের মুসলমানিত্বের প্রতি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখবেন। তাহলে মীমাংসাটা কেমন হবে? ইসলামপন্থী দলগুলো তো এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রতি নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়া উপায়ান্তর আছে? রিফাত হাসান এক জায়গায় লিখছেন ২০২৪ এর অভ্যুত্থান কোনো ধর্মীয় সংস্কারের বিপ্লব না, ফলে এর উপর সওয়ার হয়ে মাজার ভাঙতে নামার কোনো অধিকার কারো নেই। ধর্মের সংস্কার হতে হবে ভেতর থেকে। এইখানেও প্রশ্ন ওঠে, ধর্মের ভেতর-বাহির নির্ধারণ করবে কে? প্রান্তীয়দের কি সুযোগ থাকবে ভেতর-বাহির প্রশ্নে নিজ অবস্থান পরিষ্কার করার? এই প্রশ্নগুলো গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদী।
কার্ল স্মিট ‘Roman Catholicism and Political Form’ প্রবন্ধে উনিশ শতকের ক্যাথলিক রাজনীতির আলোচনা করতে গিয়ে ক্যাথলিক রাজনৈতিক দলগুলোর অবিশ্বাস্য ইলাস্টিসিটি (elasticity)-র প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ইউরোপের ক্যাথলিক রাজনৈতিক দলগুলো সেই আমলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কথা বললেও রাজনীতির প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় এমন বিভিন্ন দলের সাথে জোট বাধতো, যাদের সাথে তাদের আদর্শের কোনো মিল নেই। আবার রাজনীতির প্রয়োজনে জোটবদল করতেও দ্বিধা করতো না দলগুলো। ক্যাথলিক রাজনীতির এই দিকটাকে অনেকে সুবিধাবাদী আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন, কিন্তু স্মিট এইটাকে সুবিধাবাদ হিসেবে না দেখে দলগুলোর ইলাস্টিসিটি হিসেবে দেখেছেন। তো, বাঙলাদেশে এখন পর্যন্ত ধর্মীয় রাজনীতির যে রূপ আমরা দেখেছি, তাতে বেশির ভাগ ইসলামপন্থী দলের রাজনৈতিক আচরণ যথেষ্ট ইলাস্টিকই বলা যায়। মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে-র বিভিন্ন লেখায় জুলাইয়ের আগের ও পরের বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর যে ভূমিকার কথা উঠে এসেছে, সেখানেও এই ইলাস্টিটির প্রমাণ মেলে। এইটা তাদের রাজনীতির কৌশলগত শক্তির দিক নিশ্চয়ই, আবার গণতন্ত্রের পক্ষেও মোটের উপর এটা উপকারী একটা ব্যাপার। জুলাইয়ের পরে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের না থাকার ফলে যে ভ্যাকুয়াম তৈরী হয়েছে, সেই ভ্যাকুয়ামের কিছুটা হলেও ইসলামপন্থী দলগুলো পূরণ করবে বা করতে চাইবে, এইরকম একটা সম্ভাবনাও তৈরী হয়েছে। ফলে ইসলামপন্থী দলগুলোর যদি গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট কমিটমেন্ট না থাকে, তো সেটা এই মুহূর্তে একটা সমস্যাজনক ব্যাপারই। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন মব-কাণ্ডে ধর্মীয় দল ও ব্যাক্তিত্বদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন এই বিপদের জায়গাটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
যাই হোক, ‘মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে’ মূলতঃ পলিটিকাল ফিলোসফি-র বিভিন্ন আলাপে সমৃদ্ধ। সবচেয়ে ভালো হতো একেকটা লেখা ধরে ধরে আলোচনা করতে পারলে। পাঠকরা সেই কাজ করবেন নিশ্চয়ই। আপাতত একটা গল্প বলেই শেষ করি। কয়েক মাস আগে একটা সেমিনারে গেছিলাম। সেইখানে অন্যান্য অতিথিদের হাজির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমেদ খান। প্রধান অতিথি হিসেবেই সম্ভবত। তো কথাপ্রসঙ্গে উপাচার্য মহাশয় বললেন যে, তিনি মানুষটা হলেন একটা সাবমেরিনের মতো। সবসময় নিজের কাজেই (নিজের কাজ বলতে অধ্যাপনা ও উন্নয়ন-গবেষণা) ডুবে থাকেন, তবে মাঝেমাঝে পানির উপরে এসে উঁকিঝুকি দেন চারিদিকে কী হচ্ছে জানার জন্য। তো, তার এই বক্তব্য শুনে প্রথমে মনে হলো, এইরকম একজন সাবমেরিনকে এতো ক্রিটিকাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বানানো মনে হয় ঠিক হয়নি। পরে ভাবলাম, সাবমেরিন না কে? আমাদের দেশে ‘সুশীল সমাজ’ নামক যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীটি ক্রিয়াশীল রয়েছে, তাকেও তো একটা স্বেচ্ছা-নির্বাসিত সাবমেরিন হিসেবেই ভাবা যায়। তো, রিফাত হাসানকে এই সাবমেরিন-দশা থেকে মুক্ত মনে হয়েছে আমার কাছে। বাঙলাদেশের রাজনীতি আর সংস্কৃতির ময়দানে ঘটে চলা ছোটো-বড়ো সব ঘটনাই খুব মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করেছেন উনি। ছোটো একটা ঘটনা থেকেই দেখা গেছে খুব মূল্যবান একটা লব্ধির সন্ধান দিয়েছেন তিনি। তা-ও আবার এমন একটা সময়ে, যখন বিগ সিস্টার হাসিনার তীব্র নজরদারিতে বন্দী ছিলাম আমরা। একটা বেফাঁস মন্তব্যের কারণে জেলের ভাত খাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো প্রবল। ওইরকম একটা আবহাওয়ায় ক্রোধ আর উচ্ছাসের বুদ্ধিজীবিতার চোটে ক্রিটিক হারিয়ে গেছে প্রায়ই, চারপাশে গড়পড়তা পার্টিজান বুদ্ধিজীবিতার বাইরে তেমন কিছু দেখা যায়নি। রিফাত হাসান এদিক থেকে ব্যতিক্রম।
বাঙলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসলে হয়তো রিফাত হাসানের এই বইয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতো। কিন্তু অভ্যুত্থানোত্তর বাঙলাদেশে ফ্যাসিস্ট রেজিমের রেখে যাওয়া ব্যধিগুলি প্রায় মহামারী আকার ধারণ করায় রিফাত হাসান জরুরীই রয়ে গেছেন। বাঙলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মৌলিক দার্শনিক প্রশ্ন ও প্যারাডক্সগুলি সম্পর্কে যারা জানতে চান, ‘মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে’ তাদেরকে সাহায্য করবে। রিফাত হাসান শেষ বিচারে গণতন্ত্রেরই লোক, সবাইকেই সুযোগ দিতে চান তিনি। হাসিনার পতনের পরেও যখন গণঘৃণার রাজনীতি, মব ও মোরাল পুলিসিং সমাজকে উত্তরোত্তর ভেঙে দিচ্ছে, সমাজের একাংশকে আরেকাংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের প্রয়োজনকে তীব্র করে তুলছে, তখন সমাজের ভিতরে থেকেই সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখার একটা প্রয়াস আছে রিফাত হাসানের লেখালেখির মধ্যে। রাষ্ট্র দরকারি শত্রু, কিন্তু শত্রুই তো। রাষ্ট্রের সর্বাত্মক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াতে চান, রিফাত হাসান তাদের বন্ধু হতে পারেন।
তথ্যসূত্র:
১. Schmitt, C. (1996). Roman Catholicism and Political Form, Greenwood Press, London
২. Walzer, M. (1983). On “Failed Totalitarianism”, In Howe, I. (Ed.) 1984 Revisited, Perennial Library
৩. শরীফ, আ. (২০০৯). আহমেদ শরীফের ডায়েরি: ভাব-বুদ্বুদ, আগামী প্রকাশনী
অরিত্র আহমেদ, লেখক।