তারেক মাসুদের লড়াই ‘দেশপ্রেম’ গোছের কিছু ছিল না। তারেককে বোঝার এই প্রারম্ভমুহূর্ত আমাকে আলোড়িত করে, কারণ এই ‘দেশপ্রেম’ ব্যাপারটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে উদ্ভূত। ফলত সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের সাথে এর বিভেদ সামান্য, বরং সখ্য আছে। বাংলাদেশ বিপ্লবোত্তর জনপ্রিয় ও আর্ট উভয়ধারার বাংলা চলচ্চিত্রের স্রোত থেকে শুধু নয়, শিল্পের অন্যান্য ধারা থেকেও আলাদা করে তারেকের কাজের গুরুত্ব চিহ্নিত হয় আমার কাছে এই জায়গায় এসে। এটি বোঝার জন্য নোক্তা হল, তারেকের সিনেমা স্রেফ ‘দেশপ্রেমিক’দের প্রকল্প মুক্তিযুদ্ধব্যবসাতে নিমজ্জিত থাকে নাই। বরং তাঁর লড়াই ছিল আধিপত্যবাদী ইতিহাস দ্বারা নির্ণিত ‘অদেশপ্রেমিক’ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ‘অপর’ হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলখেল্লাধারী ‘দেশপ্রেমিক’ এবং সাংস্কৃতিক বর্ণবাদীদের কামনা-বাসনা থেকে আলাদা করে বোঝা।
এই ‘অদেশপ্রেমিক’ অপর জনগোষ্ঠী কারা, তার জন্য একটি ঘটনার বরাত নেবো, সংক্ষিপ্তভাবে। দুই হাজার আট সালে জরুরি অবস্হার কোনো একদিন লালন ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্হান নেওয়ার কারণে মাদ্রাসা ছাত্রদের বিরুদ্ধে ‘প্রগতিশীল’ সংস্কৃতিকর্মীরা চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান দেয়: ‘আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির সঙ্গে, যারা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী’। এই শ্লোগানটি, এর ভেতরে যে বিদ্বেষী বর্ণবাদ লুক্কায়িত, তা আমি বোঝার চেষ্টা করেছি তখন। এর শেকড় কোথায়?
এই ঘটনার বহু আগেই তারেক মাসুদ মাটির ময়না নির্মাণ করেছেন। আবার এসবের বহু আগেই দুই হাজার এক সালের এগার সেপ্টেম্বর দুনিয়াতে ‘নাইন-ইলেভেন’ ঘটে গিয়েছে। ফলত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুলিয়া দুনিয়াবাসীর ঘাড়ের উপর লটকে পড়েছে। তারো বহু আগে ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞান হিশেবে। তারো আগে আক্ষরিক অর্থে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ঘটে ১৯৪৭ সালে। এসবই ইতিহাস। নজর দিলে দেখা যায়, এইসব ইতিহাসেরই গভীর গোপনে একটি আধিপত্যবাদী ও বর্ণবাদী কুশীলব হাজির ছিল। যা উপরের এই শ্লোগানে হঠাৎ উৎকটভাবে জানান দিয়ে ওঠে আমাদের কাছে, মাটির ময়না নির্মিত হবার বহুদিন পরেও। উপনিবেশের আদলে ও সুবিধাভোগী হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর স্রেফ অনুকরণে এই ভূখণ্ডে হঠাৎ যে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ, ইতিহাসের এই বর্ণবাদী কুশীলবের বীজ সেখান থেকেই। যারা দৃশ্যত এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে সবসময় সুবিধাবাদী ও আপোসকামি। ফলে বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ, হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভেতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়েন ও শক্তির জায়গাগুলোকে অস্বীকার ও ঘৃণা করে পুরোপুরি এলিয়েন হয়ে। তাই, সকল লুকোছাপার পরও, এই শ্রেণীর সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা মনের গভীর গোপন কথাটি উচ্চারণ করে ফেলেছে সেদিন সেই শ্লোগানে। যে, তাদের নিয়ত লড়াই হল তাদের শ্রেণীর নিজস্ব ফুল পাখি লতা-পাতা-গান সম্পর্কে ‘মূর্খ’ অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এই শ্লোগানটি ভয়ঙ্কর হলেও, অভিনব ব্যাপার নয়। অন্তত যাদের অভিজ্ঞতায় উপনিবেশের ইতিহাস আছে, যাদের আফ্রিকান কালো মানুষের দাসত্ব এবং আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের পদানত করার ইতিহাস পড়া আছে। এবং সাথে সাথে যারা এটির রাজনৈতিক পাঠ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের কাছে। সেই সময়েও এমন কথাটিই শোনা গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদীদের মুখে। ওরা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী। ওরা অসভ্য, তাই ওদের নির্মূল কর, পদানত কর, দাস কর এবং হত্যা কর।
দেখা যাচ্ছে, এই ভয়াবহ ‘অপর’-এর ধারণা যাদেরকে ঘিরে, সেই মাদ্রাসার ছাত্ররা, এবং সাহিত্যে লালসালু-পীড়িত ও নির্মিত বাঙালি মুসলমানই ঘুরে ফিরে বিভিন্ন সময় তারেকের ছবিতে নায়ক হিশেবে উঠে আসে। তারেক সচেতনভাবে তাদের জন্যই ছবি নির্মাণ করেছেন, এই কথাটি বিভিন্নভাবে জানানোরও চেষ্টা করেছেন নিজে। যারা ‘কান মে বিড়ি মুহ মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান তুলে একই সাথে ইংরেজ উপনিবেশ ও হিন্দু জমিদার শ্রেণীর নিপীড়ন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলো মাটির ময়নার সেই কাজী সাহেবরা। যারা তারো আগে ইংরেজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হাজী শরীয়তের ফারায়েজি আন্দোলন ও দুদু মিয়ার কৃষক আন্দোলনের গর্বিত ইতিহাসের অংশ, কিন্তু বাংলাদেশ বিপ্লবের পরও চলচ্চিত্রে তানভীর মোকাম্মেল-মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ হয়ে মাটির ময়নার আগ পর্যন্ত যারা ভিলেন চরিত্রে রূপায়িত। আবার, একাত্তরের বাস্তবতায় ও বাংলাদেশ বিপ্লবের প্রাক্কালে যারা স্বপ্ন-ভঙ্গের বেদনায় দ্বিধান্বিত, ফলত ‘বিহ্বল’, তারাই। এই কারণেই, রানওয়ে ছবিটি রিলিজ হওয়ার পর এটি হলে না দেখিয়ে, এমনকি ঢাকাতেও না দেখিয়ে, প্রথমে সারাদেশে দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তারেক। কেন? কারণ, ‘যাদের জন্য ছবিটা বানানো হল, তারা যদি দেখতে না পেলো তো কাজটাই অসম্পূর্ণ’ থেকে যাবে।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউট চিটাগাং-এ রানওয়ের প্রথম প্রদর্শনী হয়, তারপর দেশের অপরাপর অঞ্চলে। মাটির ময়না নিয়েও তারেক মাসুদ এমন চষে বেড়িয়েছিলেন সারা দেশ। কিন্তু আমার মনে ছোট প্রশ্ন নাড়া দেয়, তারেক কেন রানওয়ে ছবিটি চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আলমাস সিনেমা হল বা মফস্বল যেখানে বিখ্যাত পটিয়া বা হাটহাজারী মাদ্রাসা আছে, সেখানকার কাছাকাছি কোথাও প্রদর্শন করার চেষ্টা করেন নাই? অথবা তারেকের ছবির নাম রানওয়ে কেন, যেটি কোনো হলিউডি ছবির নাম হিশেবে মানানসই, যেসব ছবির ব্যাপারে তারেকের এই মাদ্রাসার ছাত্রদের কোনো আগ্রহ তৈরি হওয়ার ইতিহাস নেই, যেখানে আদতে তারা ছবির দর্শকই নয়। মনে হল, তারেক বারবার প্রগতিশীলতার বিবিধ ফাঁদে পড়েছেন। রানওয়ে ছবিটি তিনি যাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তারা কখনোই এই ছবিটি দেখতে আসবে না। এর অনেকগুলো কারণের একটি হলো: ছবিটির নাম বা প্রদর্শনের স্হান কোনোটাই ছবিটিকে তাদের আপন করবে না। হলে সিনেমা না দেখিয়ে সারাদেশ চষে বেড়িয়ে, তিনি এ ছবিটি কোথায় দেখিয়েছেন? ধরা যাক, চিটাগাং থিয়েটার ইনস্টিটিউট হল, যেটা ‘গম্ভীর’ প্রগতিশীলদের বিকেল বেলার বিনোদনপার্ক। এখানে ঐ শ্রেণী কোন দুঃখে এবং আকর্ষণে আসবেন?
আগেই বলেছি, মাটির ময়না নিয়েও তারেক মাসুদ এমন চষে বেড়িয়েছিলেন সারা দেশ। এমনি এক সময়ে তারেক এসেছিলেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চাপীঠের এক ঘরোয়া আলাপে, মাটির ময়না প্রসঙ্গ নিয়ে। সেদিন ছিল ১৬ জানুয়ারি, ২০০৪, শুক্রবার। সেই আলাপের শেষের দিকে হাজির হয়েছিলেন লেখক রেহনুমা আহমেদ এবং তারেকের সহধর্মীনী ক্যাথরিন মাসুদও। ছিলেন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র অন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট তরুণ ও প্রবীণ অনেকেই। আয়োকজকদের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্বহেতু আমিও ছিলাম। রেহনুমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জমানায় মাটির ময়নার নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, অনুষ্ঠানের আয়োজকরা মাটির ময়নাকে একটি ‘সত্য-চলচ্চিত্র’ অভিধা দিলেন। কিন্তু তারেক বর্ণনা করলেন, আমার মনে আছে, এই ছবি নির্মাণের পর প্রগতিশীলদের দ্বারা তিনি কীভাবে নিন্দিত ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার গল্প। ছবিটি দেখার পর কথাসাহিত্যিক ফয়েজ আহ্মদ তারেককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তারেক তুমি তোমার ছবিতে ঐ রাজাকার কাজীসাহেবরে তো বাঁচাই দিলা। এইটা তুমি কেন করলা। সে তো এখান থেকে গিয়ে রাজাকারে নাম লেখাবে। ’ স্মৃতি থেকে বলছি, অবিকল ভাষা-ভঙ্গি মনে নেই। যারা মাটির ময়না দেখেছেন, তাদের মনে থাকার কথা, এই ছবির বিখ্যাত কাজী চরিত্রটির কথা। হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, কঠোর ধর্মাচারী, চোখে গাঢ় চশমা, হানাদারদের ফেলে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের ভাঙা ঘরে বসে জীর্ণ আধপোড়া কিতাবে হাত বুলাচ্ছেন, হতবিহ্বল, দারুণ অবিশ্বাসে। কাজীর বাড়ি পুড়ে ছাই, কাজী তবু বিশ্বাস করতে পারেন না, মুসলমান মুসলমানের বাড়িতে আগুন দেবে। তারেক এই ছবিতে কাজী সাহেব বা রোকন কারো নিয়তি রাজাকার ও ‘অপর’-এ পর্যবসিত করেন নাই, অসীম সম্ভাবনায় ছেড়ে দিয়েছেন। মূলত এই ছবিতে কোনো রাজাকার চরিত্রই ছিল না। এই ব্যাপারটিতেই ফয়েজ আহ্মদের আপত্তি, সমভবত। আরো দুজনের নাম মনে আছে, যাদের কথা তারেক বলেছিলেন, কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই এবং লেখক গোলাম মুরশিদ। যারা এই ‘রাজাকার’টাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তারেক আরো তথ্য প্রকাশ করেছেন, যে, সেই সুনির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে আসার সময় কিছু ‘প্রগতিশীল’ সাংস্কৃতিক কর্মী তাকে মৌলবাদের ভয় দেখিয়েছিলেন, এই বলে যে, ‘যেখানে যাচ্ছেন সেটি মৌলবাদীদের আখড়া। ওরা আপনাকে মেরে টেরেও ফেলতে পারে, না যেতে পারলে বরং ভাল হয়। ’ প্রসঙ্গত, কারো অজানা থাকার কথা নয়, যারা ‘ইসলাম’ নিয়ে ন্যূনতম বোঝাপোড়া করতে প্রস্তুত, তাদের জন্য এই শব্দের ব্যবহার প্রগতিশীলদের মধ্যে বেশ মশহুর। আর, ততোদিনে পৃথিবীতে নাইন-ইলেভেন ঘটে গিয়েছে। যদিও মাটির ময়না ছবিটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল নাইন-ইলেভেনের আগেই, কিন্তু পড়ে গেছে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে। তাই মৌলবাদ-ব্যবসার একটা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত দাঁড়িয়েছে। যা সুযোগ পেলেই আত্মঘাতী খুনের ভয় দেখাত এবং ভয় পেত। তারেক কিন্তু মৌলবাদের আক্রমণ হতে পাওে এমন হুমকিকেও পাত্তা দেন নাই, চর্চাপীঠে এসেছিলেন, কারণ তাদের নাড়ির ভাষা পড়ার সাধনাই তার সাধনা।
২.
‘আমি খুশি হতাম যদি ছেলেটা জঙ্গি হামলায় মারা যেতো’, রানওয়ে ছবির নায়ক রুহুল সম্পর্কে জাহেদ সরওয়ারের কাঙক্ষা, আর্টসে ছাপা হওয়া ‘তারেক মাসুদের সঙ্গে একটি শেষ না হওয়া তর্ক’ লেখাতে তিনি উল্লেখ করছেন। আমি জাহেদের এই বাসনা সম্পর্কে ভাবছিলাম। কেন রুহুলের মৃত্যুই কামনা করছিলেন তিনি? হলিউডি সিনেমায় ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’ ব্যবসার একটা টাইপড ধরন আছে, বেশির ভাগ সময়েই নায়ক আত্মঘাতী হামলায় মারা যায় বা এরকম কিছু পরিণতি ঘটে। ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’ কী ভয়াবহ জিনিশ তা বোঝানোর জন্য নাইন-ইলেভেনের পর এই ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটে সারা দুনিয়ায়। তারেক মাসুদের রানওয়েতে দুনিয়ার এইসব ঘটনা-ঘটনের প্রভাব থাকবে না, তা অসমভব। বরং সচেতন ছিলেন বাংলাদেশে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুপ্রবেশ নিয়ে। তাই তার গল্পে উর্দু ভাইয়ের ঘন-ঘটা আছে সত্যি, কিন্তু রুহুলের আত্মঘাতী মৃত্যু ঘটান নাই তিনি। এইটা স্রেফ কাকতাল নয়, আমার মনে হয়। কিন্তু জাহেদের বাসনাটি? দুই হাজার চার সালে তারেক বললেন, চর্চাপীঠে আসার পথে প্রগতিশীলদের একটি অংশ তাকে ‘মৌলবাদীরা মেরে টেরে ফেলতে পারে’এমন ভয় দেখিয়েছিল। সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর, চট্টগ্রামের একটি পত্রিকায় এজাজ ইউসুফী নামে একজন চর্চাপীঠের সেই অনুষ্ঠানে মৌলবাদীদের হাত থেকে তারেক-ক্যাথারিন দম্পতিকে বাঁচানোর খাতিরে হাজির ছিলেন এমন দাবি জানিয়ে লিখেছেন, ‘আজ মাসুদ ভাই চলে গেলেন। কেউ তো তার নিরাপত্তা দিতে পারলো না। মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতি ভয় ছিল, কিন্তু তাকে প্রাণ দিতে হলো ঘাতক বাসের আঘাতে। ’ সত্যি, বাসটা ‘মৌলবাদী’ হলেই বুঝি মৌলবাদের প্রতি এজাজ-এর প্রত্যাশা মিটতো। তারেক মাসুদের জন্য আরো কঠিন অপঘাত আশা করছিলেন হয় তো তিনি। যেন তারেক খুন বা খুনী হয়ে যাক। আরো একটি আগ্রহ-উদ্দীপক ঘটনা। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী ৩৮ অনুচ্ছেদে ‘জঙ্গি’ শব্দের ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে এবার: ‘কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সঙঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়’। আমি ভাবছিলাম, ‘জঙ্গি’ কেন, সশস্ত্র নয় কেন? দুনিয়াতে নাইন-ইলেভেন ঘটে যাওয়ার পর বাংলাদেশে ‘জঙ্গি’ কথাটা কী অর্থ বহন করে? সব ধরনের ইসলাম এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের ‘জঙ্গি’ বানিয়ে এই অপর হিশেবে চিহ্নিত করা, খুন করে ফেলার বাসনা, সাংবিধানিকভাবেও, এর মর্ম কোথায়? এমন দূরত্ব, এমন অপর, সবাই শুধু খুনের নানান রকম বিবরণ ও পরিকল্পনা দেয়, হয় মৌলবাদীদেরকে, নয় তারেককে তাদের টার্গেট বানিয়ে। কেন?
এদিকে, বহু বছর ধরে চেপে রাখা আনু, রোকন, রুহুল, আরিফ এবং কাজী সাহেবরা কথা বলা শুরু করেছেন, কথা বলতে বলতে তারা যেন হরবোলা হয়ে ওঠেন। বন্ধ জানালার পাকিস্তান থেকে ক্রমশই ‘বাংলাদেশ’। ফলে হুমায়ুন আহমেদের শ্যামল ছায়াতে এসে মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে কুশীলব হয়ে পাক-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভাষা পায় তারা। মাটির ময়নাতে যারা ছিল বিহ্বল এবং হতচকিত, কিন্তু উন্মুখ। তৌকিরের জয়যাত্রাতে এসে মৌলভী সাহেব চরিত্রে বাংলাদেশ বিপ্লবের ত্রাতা ও পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদও হয় তারা। এইভাবে আনু, রোকন, রুহুল, আরিফ, কাজী সাহেব, এবং মৌলভীদের মুখে যে ভাষা এবং বাংলাদেশ বিপ্লবে দ্বিধায় ও সংগ্রামে, বেড়ে ওঠার ইতিহাসে তাদের যে অংশ, তার সাহস তুলে ধরে তারেক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপর তাদের নৈতিক অধিকার তৈরি করেন। এই ভাষা, এই অধিকার, অনুচ্চারিত কথা প্রগতিশীলদের পরিচিত না, শুধু তাই নয়, তারা পরিচিত হতে চায়ও না, বরং এক বর্ণবাদী আক্রোশে তাদের লড়াই চলে এই অধিকারের বিরুদ্ধে ফুল পাখি লতা পাতার নামে। এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধেই তারেক মাসুদের লড়াই। তারেকের এই লড়াই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বা সংকীর্ণ ‘দেশপ্রেম’-এর লড়াই নয়, যেভাবে অনেকেই তারেককে নির্মাণ করার চেষ্টা করেন। তারেকের ভাষায়, এটি হল ‘বাঙালি মুসলমান’-এর লড়াই। তারেকের দিক থেকে এই লড়াই শুরু হয় যখন তিনি ছাত্র, ফরিদপুরের ভাঙা ঈদগা মাদ্রাসায়, তখন থেকে। মাটির ময়নার সকালে মিসওয়াক হাতে আনু বা রোকন বা ইব্রাহিম হুজুরের ভোরগুলোর কুয়াশার মতন এই জার্নি, যেটি শেষ পর্যন্ত রানওয়েতে রুহুলকেও গ্রাস করে, কিন্তু তিনি কুয়াশাগুলোকে বুঝতে চান, তাই ভাষা দেয়ার চেষ্টা করেন, কখনো লোক-গান, কখনো জার্মান হোমিওপ্যাথি, কখনো তরুণ কমিউনিজম, কখনো সুফি ইসলাম, কখনো ‘গণতান্ত্রিক ইসলাম’, কখনো গোঁড়া কাজী সাহেব, কিন্তু কর্তা হয়ে সংজ্ঞায়িত করে দেয়ার চেষ্টা করেন না কাউকে।
২৩ আগস্ট ২০১১