[আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। মাহবুব ভাইয়ের আলাপ শুনতেছিলাম অনেক্ষণ ধরে। ফরহাদ মজহারের আলাপটাই বেশি প্রবল ছিল মাহবুব মোর্শেদের আলাপে। আর রিফাত হাসানকে উনি ব্যখ্যা করেছেন একটু দূর থেকেই মনে হল। উনি সম্ভবত ক্লিয়ার ছিলেন না। আর আমি যেভাবে রিফাত হাসানকে দেখি, সেটা আমি আমার এই লেখায় বলছি। রিফাত হাসান একটা দার্শনিক মোকাবেলার মত করে একটা রাস্তা তৈরী করছেন, যেটা আসলে সত্যিকার অর্থেই ঈর্ষনীয়। এই অর্থেই যে, আমরা যারা বুদ্ধিজীবীতা করি, বা যাই করি, খুবই ফর্মেটিভ, খুবই ফর্মের জায়গা থেকে করি। যে একটা ফর্ম, একটা কিছু করতেছি, একটা লিগেসি আছে তার বাম বা এই সেই নানান সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সাথে এইগুলো যায়। কিন্তু রিফাত ভাই এইটা, রিফাত ভাই ইসলামকে পুঁজি করে করতে পারে কিনা জানি না, হইতে পারে, এক ধরণের, উনার যে মোকাবেলার রাস্তাটা উনি তৈরী করতেছেন, কিন্তু উনি যখন এইটা করতেছেন, উনার কাছে এইটার কোন ফর্ম, বুদ্ধিজীবীতার কোন লাইন, বিশেষ কোন ক্ষেত্র, খুব বেশি মেটার করতেছে না। এই ক্ষেত্রে উনি ইয়ে কইরা ফেলতে পরতেছেন। ফলে আমরা যারা, মানে আমি যে জায়গা থেকে আসছি, আমি আমার স্টোরিটা বলতে পারি। আমি পড়ছি ছোট বেলায় মাদ্রাসায়। এখন চোদ্দ পনের বছর বয়সে আমি সাহিত্যের লাইনে আসলাম, সাহিত্যের ফর্মটা আমাকে ভাবাল। তারপরে আমি যখন এই লাইনে আস্তে আস্তে ঢুকলাম, রাইসু ভাইদের সাথে পরিচয় হইল, কামু ভাইদের সাথে পরিচয় হইল, আমি এই জায়গাগুলোতে খেয়াল করলাম। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত দেখতেছি, যে, আমি আসলে যখন বুদ্ধিজীবীতা করি বা লেখালেখি করি, খুবই, এই জিনিশগুলা, যে কন্সট্রাকশনগুলা আছে, এই কন্সট্রাকশনের বাইরে আমি যাই না আসলে। এই আর কি। তো, এই কন্সট্রাকশনের এগেইনস্টে একটা প্যারালাল রাস্তা হিশেবে রিফাত হাসান সব সময় কথা বইলা যান তার লেখালেখিতে। যাই হোক, আমার লেখাটাই পড়ছি।]
শিল্পসাহিত্য কিংবা আর্টেরেও মানুষের মতোই রক্তমাংসের কইরা দেখতে চাওয়াটা রিফাত হাসানের প্রধান দৃষ্টি। আপাত, তখন তাই মনে হয়—ভালো আর্টের প্রয়োজন উনার চোখে না থাকলেও ভালো মানুষের প্রয়োজন সমাজে থাকাই দরকার।
আর এইটাই আমাদের শিল্পী ও অ-শিল্পী জীবনগুলোর নীতিসূত্র হওয়া উচিত।
এবং সম্ভবত সেইভাবেই শিল্পীদের আর অ-শিল্পীদের একটা গণতান্ত্রিক যোগাযোগ তৈরি করা সম্ভব!
বিপরীতে আমরা যারা ‘ভালো আর্টে’র ‘সমঝদার’ আর মৌলিক অর্থে ঘুরেফিরে উহাই ফেরি করি, তারা এইখানে রিফাত হাসানের সঙ্গে আলাদা হইতে থাকবো। আমার ধারণা, পজিশন হিসেবে এইটা উনার স্বাধীন এবং সচেতন সৃষ্টি।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যেও রিফাত হাসানের এই পজিশন, সাহস বা এমনকি বলা যায় উন্নাসিকতাটির প্রতি একধরনের ‘ঈর্ষণীয়তা’ কাজ করে।
২.
আজকে রিফাত ভাইয়ের জন্মদিন। আমার বিচারে এটা তাই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোরই একটা। যেহেতু এর মধ্য দিয়া আগাগোড়া এই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিককে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ তৈরি হয়। হবে।
আওয়ামি রেজিমেন্টের এই প্রবল ধাক্কার কালে—রিফাত হাসান যেই কালরে প্রতিদিন একবার ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দ দিয়া আমাদেরকে নির্দেশিত করতে থাকেন—ক্যানো জানি আমার মনে হয় এই জিনিস আমাদের প্রত্যেককেই যার যার জায়গায় কিছু কিছু খাটো করতেছে।
তো রিফাতকে ভাইকেও বটেই।
আদারওয়াইজ, আরো বৃহৎ, দীর্ঘ ও ‘আদর্শিক’ ফ্যাসিবাদ নিয়া রিফাত হাসান ও আমাদের আরো বেশি বেশি আলাপ করার সুযোগ-পরিবেশ তৈরি হইতো। তা না হয়ে এখন এক তুচ্ছ সন্ত্রাসবাদের সমসাময়িক চাপায় পিষ্ট আমরা হচ্ছি, আর সেটাই উনার মন ও দর্শনকে কিছু তো সংকুচিত কইরা থাকতেই পারে।
তবে যাই হোক, এইটাই বাস্তবতা। এইটারে ওভারলুক কইরা কোন স্বপ্নের দার্শনিক সাম্রাজ্য বা পরিবেশ আমরা বানাইতে পারবো না।
বরঞ্চ, আজকের সন্ত্রাসবাদী ক্ষমতার বিরুদ্ধে, ব্যক্তি হিসেবে দাঁড়াইয়া থাকার যেই স্পর্ধা, আর তার মধ্যে লুকাইয়া থাকা যেই বেদনা বা মনস্তাপ, সম্ভবত রিফাত হাসানের জন্মদিন সেটারে বুঝতে চাওয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত সময়।
আমরা তা বুঝতে পারতেছি তো?
৩.
চিন্তার জায়গার বাইরেও রিফাত হাসানের গদ্য আমারে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
ফেসবুকে আমাদের বাংলাভাষায় লেখালেখির দুনিয়ায় যেই খুবই অল্প কয়জন লেখককে আমি ‘টেস্টি’, স্বতন্ত্র ও ইফেক্টিভ গদ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকতে দেখি, উনি তাদের একজন। এরকম আমার মনে হয়।
ফলে আমার বিচারে গদ্য উনার লেখালেখি ও দার্শনিকতার বিশেষ একটা দিক বা শক্তি।
যাই হোক, রিফাত ভাই, জন্মদিনে আপনাকে নিয়ে লিখে একটু জাতে ওঠারও চেষ্টা করলাম। প্রতিনিয়ত আমাকে আর আমার নাম-না-জানা ‘বন্ধু’দেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে ‘উস্কে’ দিতে থাকায়, ভালোবাসা লইবেন।
সাদ রহমান, লেখক ও ফিল্মমেকার।