সম্প্রতি প্রকাশিত ‘টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা’ পড়তেছিলাম। লেখক ও বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসানের মলাটবদ্ধ লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা আমার এটাই প্রথম।
পড়তে পড়তে খেয়াল করলাম তার টেক্সটের ভাষা ও রাজনীতি, হলাহলের ভিতর দিয়ে সিলা তৈরির তরিকা, এবং অবশ্যই বন্ধুত্ব, সম্পর্ক ও রাজনীতির বেসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং; এবং মনে হইলো এই জার্নির সাথে-পলিটিক্যাল ইনসান হিসাবে আপনার পরিচয় ঘটা জরুরী।
বইটা কয়েকটা ভাগে ভাগ করা আছে। যদিও আমার পড়ার অভিজ্ঞতায় এই অংশগুলোকে আলাদা করার মানে হইলো ‘জাস্ট ওছিলা’। অর্থাৎ রিফাত হাসান যেই সম্মিলিত জার্নির দিকে আগান, সেই জার্নিতে আপনি কীভাবে ইন্টার্ভেন করবেন তারই পথ। এই পথে প্রবেশ করতে করতে আপনি টের পাবেন লেখক খুব স্লোলি আপনার ভিতরে প্রবেশ করতেছেন। এই প্রবেশরে আমি স্বাগত জানাই।
কেনো স্বাগত জানাই? আমরা যেই দলীয়/মতাদর্শের গণ্ডির ভিতরে একটা ইউটোপিয়ায় বাস করি সেখানকার আবেগ, সুবিধা ও আকাঙ্ক্ষারে রিফাত হাসান যেইভাবে প্রশ্ন করে করে আগাচ্ছেন, তা আমাদের ভেঙেচুরে নতুন করে ভাবতে উস্কে দেয়। লেখাগুলো ‘বৈঠকি আলাপ’ ঢঙে, এমনতর নতুন রাজনীতি ও সম্পর্কের সাথে মোলাকাত করার দ্বার উন্মুক্ত করে যে, পুরো বইটা পড়তে ক্লান্তি আসে না।
শুরুতে বড় একটা ইন্টারভিউ আছে। ওটার সূত্র ধরে আমার পাঠাভিজ্ঞতায় যেতে চাই। ভনিতাসহই বলা দরকার মনে করতেছি। রিফাত হাসানরে তার লেখার ফর্ম/স্টাইল নিয়া প্রশ্ন করায় তার উত্তরে তিনি যা জানাইতেছেন আমাদের,— ন্যাচার হিসেবে রিফাতের রাষ্ট্র রাজনীতি ও মানুষ (মানুষের সীমানা তথা সভারেন) ধারণার প্রাইমারি ইন্ট্রোডিউসিংরেই হাজির করে তা। অবশ্য সেখানে এনার্কির প্রশ্নও তৈরি হয়। অর্থাৎ লেখক তার লেখার ফর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট স্পেস নিতে চান, কোনো বাঁধাধরা পদ্ধতির এপ্লিকেশন না।
এবং তারপরও আপাত বিচারে রিফাতের একটা টেন্ডেন্সি লক্ষ করা যায়। তা হলো, সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও রাজনীতির চলক হিসেবে আড্ডা, ও ঘটনার বিশ্লেষণ। সে কারণে, টেক্সট কন্সপিরেসি.. বইতে [আমি শিওর না, তার প্রিভিয়াস বইগুলোও এমনই কি-না] আমাদের জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির চিহ্ন ধরেই লেখকের এই টেক্সট আমাদের সামনে সামগ্রিক বিবেচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে। এবং তেমনি আলোচিত/কম আলোচিত ঘটনা-বর্ণনার মধ্য দিয়া যাওয়ার ফলে বরং পাঠক হিসেবে নিজেকেও রেলিভেন্ট পাওয়া যায়। এটা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিংই। একইসাথে এর সুবিধা হলো– ভূরি ভূরি দেশী-বিদেশী লেখক-বুদ্ধিজীবীরে মেনশন তথা তাদের বক্তব্যের রেফারেন্স দিয়া সময়রে বুঝতে হয় না। সেরকম করে বোঝানোও দোষের না বটে!
কী লেখবেন, কেনো ল্যাখেন, তার ফর্ম কী হবে এসবরেই রিফাত হাসান বর্ণনা করছেন তার ‘সম্বিত’র কারণ। সেকারণে খেয়াল করা যায়, বুদ্ধিজীবী রিফাত আর আর লেখক বুদ্ধিজীবীর মতো— লেখক ও বুদ্ধিজীবী হওয়ার তাড়নায় নয়, বরং একটা দায় ও মানুষের প্রতি মহব্বত থেকে কথা বলেন, ল্যাখেন। এই নিয়া বইটাতেও আলাপ আছে বটে। কিন্তু লেখক ও বুদ্ধিজীবী রিফাতের রাজনীতিটা কী? এই টেরটরির কথা যখন আমরা কল্পনা করি।—
‘…এই প্রতিবিপ্লবী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণীর ভাবনা-চিন্তার একটা বড় স্রোত একাত্তর থেকে এ পর্যন্ত সুবিধাবাদী।ফলত, স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে মৌলিক ভাবনা ও বুদ্ধির চর্চা অনুপস্থিত এখানে। আবার যারা এই এই সুবিধাবাদের বাইরে, তারা সিরিয়াসলি ভাবতে ইচ্ছুক নন, সরল ও অবিকশিত থেকে গেছেন।’
আমি মনে করি, রিফাত হাসানের তৎপরতা এই অবিকশিত শ্রেণীর রাজনীতি বিনির্মাণ ও সুবিধাবাদীদের হাত থেকে কওমকে, ব্যক্তি মানুষ ও তার সম্ভাবনারে নিয়া টিউনিং করা। মানুষের সম্ভাবনার যেইভাবে বিলয় ঘটছে, ঘটতেছে, সেইখান থেকে মানুষ ও প্রাণ-প্রতিবেশের সমস্ত সম্ভাবনারে উস্কে দিতেই রিফাত হাসান রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রশ্নরে পুনঃপুনঃ কোশশেইন করেন। তাই কখনও কখনও হয়ত মনে হতে পারে বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসান কি নৈ-রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেন! তা তিনি করেন কি-না তা পাঠক হয়ে আপনার খোঁজার বিষয়, তার জরুরতও। তবে কওমের ব্যাপারে তার যেই আগ্রহ— তার জরুরত অন্তত আমরা এই আধুনিক রাষ্ট্র ও নাগরিক ধারণার ভিতর বসে আন্দাজ করতে পারি।
প্রসঙ্গত, আমরা যেই ট্রানজেশনাল টাইমটায় আছি, এই সময়টা বেশ অস্থির। রাষ্ট্র ও রাজনীতির অবস্থাও যেন ‘কিছুই করার ও গড়ার নাই’ টাইপ। ফলে মোড় নেয়ার আগেই আমাদের হাতে অল্পই সময় আছে। সেই সময়টায় আপনার চিন্তা ও তৎপরতার একটা রেপিড নোট হতে পারে ‘টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা’।
লেখক হিসেবে রিফাত হাসান যেই জার্নিতে আছেন,পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক বিবেচনায়, তার ও আমাদের এই জার্নির গন্তব্য নিয়া নিশ্চিতভাবেই বোঝাপাড়া তৈরি হওয়া জরুরী।
এখন সেই বোঝাপাড়ার লাইগা চাইতেছি আমরা বন্ধুরা ধারাবাহিকভাবে বইটা নিয়া অনিয়মিত আড্ডা-আলোচনা চালিয়ে নেবো। ট্রান্সক্রাইব করে তা পাঠকদের জন্য নোট আকারে দেয়ার ইরাদা রাখি। সেই আলোচনারই একটা খসড়া নোট হিসেবে এটা ভূমিকা বিশেষ।
মনিরুল মিরাজ, লেখক।