পাঠ প্রতিক্রিয়া

আরেফিন মোহাম্মদ

রিফাত হাসানের লেখালেখির কনসেনসাস, পলিটিক্স ও রূপকথা

June 8, 2021   0 comments   9:32 pm
Guest Author: আরেফিন মোহাম্মদ

আমি কেন রিফাত হাসান পড়ি – এই প্রশ্ন দিয়াই আলাপটা শুরু করা যাক। রিফাত হাসানের লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় পোস্ট-শাহবাগ বাংলাদেশে। আমরা নাগরিকরা বিশেষত অনলাইন নেটিজেনরা যখন আক্ষরিক অর্থেই দুইটা পষ্ট এবং মোটাদাগে বিভক্ত হইয়া অনলাইন এক্টিভিজম চালাইতেছি, রিফাত হাসান সেই সময়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি কিভাবে গইড়া উঠে তার আলাপ হাজির করতেছিলেন৷ রিফাত হাসান সেইখানে দেখাইতেছিলেন, মানুষের পলিটিক্যাল হইয়া উঠার সাথে কিভাবে আজাদ হওয়ার একটা সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়ায়া আছে৷ ঠিক এই জায়গাতেই বোধহয় রিফাত হাসানের সাথে আমার এবং আমাদের একটা সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, রাজনীতি হাজির হইতেছে, গইড়া উঠতেছে৷ ফলে রিফাত হাসানরে পাঠ করা তার পাঠকদের জন্য, যাদের সাথে ইতিমধ্যে রিফাতের একটা মানসিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি গইড়া উঠছে, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠতেছে। কথা বলবো রিফাত হাসানের “টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা” নিয়া। রিফাত যদিও বইটারে চারটা মোটা পয়েন্টে ভাগ করছেন- ইন্টারভিউ, কনসেনসাস, ইন্টারভেনশনস ও র‍্যাপিড নোট; তবে আমি বইটারে শুধু দুইটা ব্রডার লাইনে ভাগ করবো – ইন্টারভিউ এবং কনসেনশাস। ইন্টারভিউ অংশে রিফাত হাসানের আগের বিভিন্ন ইন্টারভিউ সন্নিবেশিত করা হইছে৷ আমরা যারা রিফাত হাসানের নিয়মিত পাঠক, তাদের অনেকেই হয়তো এই ইন্টারভিউগুলা হয়তো আগেই পইড়া থাকবো। ইন্টারভিউ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার৷ আমি নিজেও আগেই এই ইন্টারভিউগুলা পড়ছি, কোন কোনটার ভিডিও-ও দেখছি৷ কিন্তু নতুন কইরা পড়তে গিয়া মনে হইলো, মোটেই বোরিং লাগতেছে না; পুরাতন…

Share

আমি কেন রিফাত হাসান পড়ি – এই প্রশ্ন দিয়াই আলাপটা শুরু করা যাক।

রিফাত হাসানের লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় পোস্ট-শাহবাগ বাংলাদেশে। আমরা নাগরিকরা বিশেষত অনলাইন নেটিজেনরা যখন আক্ষরিক অর্থেই দুইটা পষ্ট এবং মোটাদাগে বিভক্ত হইয়া অনলাইন এক্টিভিজম চালাইতেছি, রিফাত হাসান সেই সময়ে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি কিভাবে গইড়া উঠে তার আলাপ হাজির করতেছিলেন৷ রিফাত হাসান সেইখানে দেখাইতেছিলেন, মানুষের পলিটিক্যাল হইয়া উঠার সাথে কিভাবে আজাদ হওয়ার একটা সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়ায়া আছে৷ ঠিক এই জায়গাতেই বোধহয় রিফাত হাসানের সাথে আমার এবং আমাদের একটা সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, রাজনীতি হাজির হইতেছে, গইড়া উঠতেছে৷ ফলে রিফাত হাসানরে পাঠ করা তার পাঠকদের জন্য, যাদের সাথে ইতিমধ্যে রিফাতের একটা মানসিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি গইড়া উঠছে, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠতেছে।

কথা বলবো রিফাত হাসানের “টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা” নিয়া। রিফাত যদিও বইটারে চারটা মোটা পয়েন্টে ভাগ করছেন- ইন্টারভিউ, কনসেনসাস, ইন্টারভেনশনস ও র‍্যাপিড নোট; তবে আমি বইটারে শুধু দুইটা ব্রডার লাইনে ভাগ করবো – ইন্টারভিউ এবং কনসেনশাস।

ইন্টারভিউ অংশে রিফাত হাসানের আগের বিভিন্ন ইন্টারভিউ সন্নিবেশিত করা হইছে৷ আমরা যারা রিফাত হাসানের নিয়মিত পাঠক, তাদের অনেকেই হয়তো এই ইন্টারভিউগুলা হয়তো আগেই পইড়া থাকবো।

ইন্টারভিউ একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার৷ আমি নিজেও আগেই এই ইন্টারভিউগুলা পড়ছি, কোন কোনটার ভিডিও-ও দেখছি৷ কিন্তু নতুন কইরা পড়তে গিয়া মনে হইলো, মোটেই বোরিং লাগতেছে না; পুরাতন জিনিস পড়তেছি খুব একটা ফিল হইতেছে না৷ মনে হইতেছে যেন আমি আলাপেই আছি এবং এই আলাপের নানান দিক আমার কাছে নতুন অর্থ নিয়া হাজির হইতেছে।

যেমন, রিফাত হাসান এইখানে কইতেছেন যে, আমরা কেন লিখি? সবাই তো লিখে না। আমি লিখি, আপনে লিখেন, আমরা লিখি; কিন্তু আরো আরো অনেকেই তো লিখে না৷ আমরা কেন লিখি? রিফাত হাসান এইখানে তার বিবেকের একটা বয়ান হাজির করতেছেন।

সেই বয়ান দিতে গিয়ে আসতেছে পলিটিক্স। রিফাত বলতেছেন, মানুষের নফসের পশু অবস্থা এবং দাস অবস্থা থেকে আজাদ হওয়াটাই তার পলিটিক্যাল হইয়া উঠা; এইটাই তার খেলাফত অবস্থা।

রিফাত হাসানের লেখালেখির কোন নির্দিষ্ট ফর্ম নাই কেন?

রিফাত কইতেছেন- তিনি যখন লেখেন, তিনি মূলত কথা কন৷ সো, যদিও এইটা তার লেখালেখি কিন্তু তিনি মূলত আড্ডার ঢঙে আছেন, আলাপে আছেন৷ ফলে তার নন-ফিকশন আলাপ লেখালেখির ঢঙে আইসা ঠিক প্রবন্ধ থাকতেছে না, অনেকটা ফিকশনের ঢঙে, কিছুটা কাব্যিকও হইয়া উঠতেছে কখনো কখনো। যেহেতু রিফাত তার পাঠকের লগে আসলে একটা আড্ডায় আছেন৷ ফলে তিনি এইখানে ঠিক লেখক ততটা না, যতটা আসলে তিনি ওরেটর।

এইখানে রিফাত হাসান একটা টাটকা উদাহরণ দিতেছেন শীর্ষেন্দুর৷ শীর্ষেন্দুকে যখন বাংলাদেশে বইসা সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক খুনের কথা জিজ্ঞেস করা হইতেছে, জবাবে শীর্ষেন্দু কইতেছেন, তিনি একজন লেখক, এইটা রাজরাজড়াদের ব্যাপার; মানে এই বিষয়টা তার লেখক রেস্পন্সিবিলিটির বাইরে – এইটা হইলো নির্দিষ্ট ফর্মের লেখক হিসেবে নিজেরে ভাবার একটা ক্রাইসিস৷ আবার রিফাত অরুন্ধতীর বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারে অরুন্ধতীর এক্টিভিস্ট পরিচয়রে ক্রিটিক কইরা আলাপ তুলতেছেন – ক্যান অরুন্ধতী স্পিক?

তো, এইভাবে নানান আলাপ, প্রশ্ন আর ক্রিটিকের মধ্য দিয়া বইয়ের ইন্টারভিউ অংশ আগাইতেছে।

কনসেনশাস অংশে রিফাত মূলত রাষ্ট্র প্রকল্প, আইন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, লিবারেলিজম, মডার্নিটি, হিন্দু-মুসলিম প্রশ্ন, নাগরিক যাপিত জীবনের রাজনীতি ইত্যাদি নানান দিক তার গল্প বলার ফিকশনি ঢঙে নন-ফিকশন আলাপ হাজির করতেছেন।

ফ্যাসিবাদের সময়ের যেই কালেক্টিভ কনসেনশাস সেইটা রিফাত দেখাইতেছেন যে, এক ধরনের কৌতুক, ভয়ের ব্যবস্থানা এবং খুনের কনসেনশাস তৈয়ার হইয়া আছে আমাদের মইধ্যে৷ রিফাত দেখাইতেছেন, কিভাবে ‘ফাঁসি চাই’ থেইকা ‘বিচার চাই না’-র দিকে আমাদের যাত্রা হইলো। রিফাত কইতেছেন, কিভাবে শাসক এবং আমাদের মইধ্যে ‘কৌতুকের’ একটা কনসেনশাস তৈরি হইয়া গেলো মন্ত্রীদের স্থুল চুটকির মধ্য দিয়া।

এবং মোস্ট ইমপরট্যান্টলি, শাসকদের এই চুটকি, কৌতুকের পাশাপাশি ভয়ের ব্যবস্থাপনা এবং খুনের কনসেনশাস এর মধ্য দিয়া আমাদের মইধ্যে টেক্সট কন্সপিরেসি ও নানান রূপকথা হাজির হইতেছে৷ সেই কন্সপেরিসি ও রূপকথা কখনো হোলি আর্টিজানের চীফ শেইফ-রেও জঙ্গি বানায়া দিতেছে, কখনো মাদ্রাসা বন্ধের র‍্যাডিক্যাল রাষ্ট্রীয় বয়ানের বিপরীতে এলিট ভার্সিটি বন্ধের হালকা চুটকিগুলোও কিছুটা ডিসকোর্সের মর্যাদা পাইয়া যাইতেছে, হালকা আলাপের ছলে হইলেও।

তো, রিফাত হাসানের এই যে লেখালেখি, বিশেষত তার “টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা” এই বইয়ের কনসেনশাসটা কী? কীইবা তার পলিটিক্স?

আমি মনে করি, রিফাত হাসানের এই কনসেনশাস-টা হইলো, এই ফ্যাসিবাদের সময়ে যেই ভয়ের ব্যবস্থাপনা ও খুনের কালেক্টিভ কনসেনশাস তৈয়ার হইয়া আছে ইতিমধ্যে, তারে এমনভাবে এড্রেস করা রিফাতের পাঠকরা যেন এরে সহজেই চিনতে পারে, নিজের সিচুয়েশনের লগে রিলেট করতে পারে; ফলে এই স্থুল কৌতুক,ভয়ের ব্যবস্থাপনা এবং খুনের কনসেনশাস এর মধ্যে যেই টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা হাজির হইতেছে সেই ব্যাপারে একটা সচেতন পালটা কনসেনশাসও হাজির থাকে ঠিক একই পলিটিকাল ডোমেইনে।

রিফাত হাসানের লেখালেখির পলিটিক্সও ঠিক এইখানেই – রিফাত নিজে যেইটারে কইতেছেন, ‘নফসে লাওয়ামা’ অবস্থায় দাসত্ব থেকে নিজেরে লিবারেট করা, আজাদ করা। রিফাত এইটারেই কইতেছেন পলিটিক্যাল হইয়া উঠা বা খেলাফত লাভ৷
রিফাত হাসানের কি কোন রূপকথা প্রকল্প আছে?

আমি মনে করি, আছে৷ বইয়ের ইন্টারভিউ অংশে বানানের সাথে রিফাতের রাষ্ট্র, আইন, এনার্কি প্রশ্নে যে অবস্থান, তারে রিফাত হাসানের রূপকথা বলা যায়৷ রিফাত যেখানে এনার্কিস্ট হইতেছেন না, আবার রাষ্ট্ররে আলটিমেট গোল বা আইনরেই অ্যাবসলিউট মানতেছেন না৷ যে কারণে রিফাত হইয়া উঠছেন ‘ইহাই রাষ্ট্রবিধির’ প্রতি অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল।

তো, রিফাত হাসান পাঠ বরাবরই আনন্দের৷ বিশেষত এই ফ্যাসিবাদের সময়কে বোঝার এবং রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরিতে তাই “টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা” রে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি৷ নন-ফিকশন প্রবন্ধ ধরনের কাঠখোট্টা আলাপরে আড্ডা ও গল্পের ঢঙয়ে পড়ার সুযোগ তো বাংলা ভাষায় আমাদের খুব বেশি নাই-ই বলা যায়৷ রিফাত হাসান তার লেখালেখিতে পাঠক হিসেবে আমাদের জন্য সেই অল্প প্রিভিলেজটুকুই হাজির করতেছেন।

“টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা” পাঠক হিসেবে আমাদের জন্য যুগপৎভাবে একটা হ্যাপী রিডিং এবং ইন্টারেস্টিং পলিটিক্যাল জার্নি – কোন সন্দেহ নাই।

আরেফিন মোহাম্মদ, লেখক।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.

Leave the first comment