Blogs

রিফাত হাসান

শাহবাগ: আমি ও আমার পরিপার্শ্বের অভিজ্ঞান

April 17, 2017   0 comments   9:02 pm
রিফাত হাসান ও ব্রাত্য রাইসু
ব্রাত্য রাইসুর সাথে। এপ্রিল ৭, ২০১৮। শিল্পকলা একাডেমি গেইট, চট্টগ্রাম।

শাহবাগের ফ্যাসিজম বহু মানুষের মোলায়েম পোশাকটি খুলে ভেতরের ফ্যাসিস্ট পশুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। আবার বহু সাহসী মানুষকে মেনি বেড়াল হিশেবে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বহু মৌসুমি বন্ধুত্ব ও বুদ্ধিজীবীতার পতন ঘটেছে। পরিস্কার করে দিয়েছে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি।

Share

একটা ব্যক্তিগত আড্ডার বিবরণ, কিন্তু মনে হল, এইটারে একটা সময়ের ব্যক্তিগত ডকুমেন্টারি হিশেবে পাঠ করা যেতে পারে। কারণ,  এই লেখা শাহবাগের সময়ে বন্ধুত্ব ও দ্বিমতগুলোর সাথে আমার সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি নিয়েও। তখন, এক নতুন বন্ধুর সাথে আলাপ হইতেছিল। কারো ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ভাল হওয়া আর তার ভিত্তিতে অবস্থান নিয়া। আমি কইতেছিলাম, এই দুইটা ভিন্ন জিনিশ।

ইমরুল হাসান, আমাদের বন্ধু, উনার সাথে সম্প্রতি আড্ডার ছবি দেইখা বন্ধুটি বিস্ময় প্রকাশ করলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন, তার সাথে শাহবাগের সময়ে আমার ব্যাপক তর্ক তৈরী হইছিল ও এই তর্কগুলোর কিছু কিছু আমার বহিগুলোতেও আছে। কারণ, ইমরুল গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ করতেন তখন। বন্ধুটি নতুন, তার সাথে প্রথম আলাপ এইটা। একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধুনা নৃতত্ত্ব পড়ান। উত্তরে বললাম, আমি দ্বিমতগুলোর সাথে থাকারেই পছন্দ করি। কারণ, দ্বিমত না হলে তর্ক, এমন কি প্রেমও জমে না। আর, আন্ডারস্টেন্ডিং এর চেয়েও শাহবাগ ও তার পরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীতায় যে নড়াচড়া হইছিল, তা পলিটিক্যাল অবস্থান নেওয়ার ব্যাপার ছিল, শুধু কারো আন্ডারস্টেন্ডিং ভাল খারাপের প্রশ্ন না।

অনেকের বোঝাপড়ারে আমি যথেষ্ট মূল্য দিতাম, তার মধ্যে প্রফেসর সলিমুল্লাহ খানও আছেন। সলিম ভাইয়ের ভাষার আমি ভক্তও, পড়ে আনন্দ পেতাম। কিন্তু শাহবাগের সময়ে তার পলিটিক্যাল অবস্থানরে আমার ভালগার দালালি মনে হইছিল। এই লেখা যখন লিখছি, দুই হাজার সতের সাল, তখনও এই মনে হওয়ার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। আমি সলিমুল্লাহর জবানিতেই (গ্রামশির ট্রেডিশনালের অনুবাদ সম্ভবত উনি করেছিলেন ভাড়াটে) গ্রামশিরে ধার কইরা উনারে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী কইছিলাম, তের সালে। পরে, শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প ও অসহিষ্ণুতার অংশ হিশেবে উনি আমারে সোশাল মিডিয়ায় ব্লক করছিলেন। পরে অবশ্যই সলিম খানকে সোশাল মিডিয়ায় তেমন দেখা যায় নাই। তখন শাহবাগ, তার জবানিতে যেটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, এই মঞ্চ থেকে নতুন নতুন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ চলতেছিল। আমি বলতাম, নতুন বুদ্ধিজীবী নিধনের রূপরেখা। এইটা আমার পাঠ ছিল।

সলিমুল্লাহ খান, চট্টগ্রাম। ফটো: রিফাত হাসান। জানুয়ারি ১৮, ২০১৩

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে শাহবাগ শুরু হওয়ার পরপর আমরা যখন শাহবাগের আজান ও অন্যান্য লেখাগুলো লিখতেছিলাম, তখন বাংলাদেশের আর এক বড় বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ইন্ডিয়ায় অবস্থান করছলেন। সম্ভবত, সেখানে বইসা ঘটনা ও স্রোতের গতি বুঝবার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। সময় নেওয়া, এই সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও মনে হইত আমার, কারণ শাহবাগের সময়টা ছিল আনপ্রেডিকটেবল। ভায়োলেন্ট। গণজাগরণমঞ্চ থেকে নতুন নতুন খুনের মব উসকে দেওয়া হচ্ছিল। আমি, ব্যক্তিগতভাবে, ফরহাদ মজহারের মতামত জানার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। সেই প্রথম দিকে, ফরহাদের চিন্তা গ্রুপেরও অনেকরেই দেখেছি, দুই এক দিন শাহবাগে হাজিরা দিয়ে ফেসবুকে তার ঘোষণা দিতে। অত্যাশ্চর্যম লাগছিল। পরে, ফরহাদ মজহার ইন্ডিয়া থিকা ফিরার পর, সম্ভবত ফেব্রুয়ারির একুশ বাইশ তারিখের দিকে শাহবাগরে নির্মূলের রাজনীতি আখ্যা দিয়া অবস্থান নিলেন।

তার আগে পরে পিয়াস করিমরে পাইলাম আমরা। উনি জনপ্রিয়় আন্দোলনের সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্কের কথা বললেন। ফরহাদ এবং পিয়াস করিম উভয়ই রাজাকার হইলেন গণজাগরণ মঞ্চের তালিকায়। এই তালিকায় আরো অনেকেই ছিলেন। লেখালেখি করেন, এমন অনেক তরুণ বন্ধু আমাকে তখন শাহবাগের আশে পাশে গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অনেকেই আমারও খবর নিতেন, সতর্ক করতেন।

পিয়াস করিম। জনপ্রিয় আন্দোলনের সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্কের কথা বললেন।

ফেসবুকে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই বোঝাপড়া অপেক্ষাকৃত পরিস্কার মনে হইছে আমার তখন। এদের বড় অংশ কবি সাহিত্যিক, এইটা অবাক কাণ্ড! অল্প একাডেমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যাদেরে চোখে পড়ত, তাদের বড় অংশের লেখা বা অপিনিয়ন পইড়া গবেট মনে হইত। শিশু এবং দ্বিধান্বিত মনে হইত। বা ফ্যাসিস্ট। অথচ, এর উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। বাকি বন্ধুদের প্রায় সবাই শাহবাগের ক্রিটিকে শরিক হলেন।

ব্রাত্য রাইসুর কথা উল্লেখ করা যায়। ব্রাত্য রাইসুর সাথে আমার প্রথম পরিচয়, যখন রাইসু সামহোয়ারইন ব্লগে এক আজব যুদ্ধ করছিলেন। জামাত নেতা কামরুজ্জামানের ছেলের সাথে ফেসবক বন্ধুত্বের অধিকার লইয়া তর্ক। ডেইঞ্জারাস, আবার বেশ কৌতুহলউদ্দীপক সাবজেক্ট বটে। এর আগে রাইসুরে অল্প কবি হিশেবে চিনতাম। ঢাকাই কবি, প্রথম আলোর সাহিত্য দেখতেন একদা। তেমন গুরুত্বের ছিল না এই চেনা। গৌণ, মফস্বলিয় ব্যাপার মনে হইত সাহিত্য সম্পাদকদের। কিন্তু, কবি, একই সাথে চিন্তা করতে সক্ষম, এই রকম কোন ঘটনা বাংলা ভাষায় প্রায় অসম্ভব মনে হইত, ফলে বিরল ঘটনা হিশেবে রাইসুরে খেয়াল করতে শুরু করলাম। রাইসুতে মুগ্ধ হলাম এই খেয়াল করার সময়টিতে, এবং, দেখলাম, গণজাগরণমঞ্চেও ফানা হলেন না রাইসু, আর সবার মত।

ইমরুল হাসানের সাথে আমার দেখা সম্ভবত দুই হাজার বারতে। ছবির হাটের দিকে ব্রাত্য রাইসুর সাথে দেখা হওয়ার প্রোগ্রাম হইছিল, ঢাকায়। দেখি, সেই সময়ে আরো অনেকেই হাজির হলেন। তার মধ্যে ইমরুল হাসানকে বিশেষ চেনা। ইমরুল হাসান জানালেন, আমার আসার খবর পেয়ে উনি এসেছেন। এই যে ইমরুলের চলে আসা, এই ঘটনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। শাহবাগের টাইমে ইমরুল হাসানের অবস্থানকে আমার মনে হইছিল শাহবাগের প্রতি রক্ষণশীল। মানে রাজনৈতিক অবস্থান। উনার সাথে আমার কয়েকটি আলাপে, যার ব্যাপারে একটু আগে বন্ধুটি বলতেছিলেন, উনি সংবেদি থাকতে চাইলেন। আন্ডারস্টেন্ডিং এর চেয়েও শাহবাগের পক্ষে এইটা উনার পলিটিক্যাল অবস্থান মনে হইছিল আমার। উনি শাহবাগরে কেন্দ্রে রাইখা ভবিষ্যত আন্দোলনের রূপরেখা নিয়াও আলাপ করতেন তখন, একটু অবাকই হইছিলাম। সাধারণত মোলায়েম, দূরবর্তি, যেমন কবিতার আলাপ করতেন তখন তিনি।

সেই সময় ইমরুল হাসানের সাথে আমার কিছু কিছু বাহাছ হইছিল, এইসব নিয়ে আমার ছোট ছোট নোট ছিল সেই সময়। যেমন, ধরে ধরে জবাই কর শ্লোগান নিয়া আমি আপত্তি লিখি। ইমরুল তখন কইলেন, এইটা রেথরিক। এইটা শাহবাগের আসল চাওয়া বা চেহারা না। কারণ, ওরা জবাই কর শ্লোগান দিলেও মূলত প্রথম খুনটা করে মৌলবাদীরা, থাবা বাবাকে। আমার উত্তর ছিল, খুনের আহ্বানকে রেথরিক কইয়া শেষ করা যায় না। আহ্বান তো পাল্টা আহ্বানের অনুঘটক। ফ্যাসিবাদের চর্চা পাল্টা ফ্যাসিবাদ তৈরী করে। যখন পাল্টা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে, তখন এই উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা কারো না কারো পক্ষ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে। রাজীব, মানে থাবা বাবা এই যুদ্ধের অসংখ্য অতীত ও ভবিষ্যৎ কোরবানীর একটি উদাহরণ মাত্র। কারণ, ফ্যাসিবাদের কাজই হল, সবাইরে তার ভিক্টিম করে তোলা। আপনি জবাইর আওয়াজ তুললেন, আপনি নিজে তার ভিকটিম হবেন না, তা কী করে হয়?

‘বুদ্ধিজীবীর কাজ এক্টিভিজম করা না, চিন্তা করা’, ইমরুলের এরকম কাছাকাছি একটা বাহাছের উত্তরে আমার কমেন্ট ছিল, কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন বুদ্ধিজীবীতা আর এক্টিভিজমের আইল ওভারলেপ করে। পরে, আঠারর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় থেকে হঠাৎ খেয়াল করি, ইমরুল ছাত্রদের মিছিল কোন পথে যাওয়া উচিত, তা নিয়ে কনশাস হইতেছেন ও নির্দেশনা দিতেছেন। মানে একটিভিজম নিয়াও ভাবতেছেন ও পাশ ফিরতেছেন। এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় থেকে বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের যে নতুন পাশ ফেরা শুরু হল, এইটারে আমি শাহবাগ থিকা পাশ ফেরা বলি। এই ঘটনা এবং এর পরের ইমরুল হাসানের প্রতি আমি আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকি। পরে, দুই হাজার চব্বিশে সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও রাজনীতি নিয়ে একটা আলাপ করেন ইমরুল, যেখানে এই বইরে ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ের চিন্তা ভাবনার দলিল বলেন, কিন্তু ইন্টারেস্টিং হল, শাহবাগ নিয়া তার অবস্থানও পরিস্কার করেন এই আলোচনায়, যেই আলাপ ইমরুলে শাহবাগ পরবর্তি সময়ে কোথাও খেয়াল করি নাই আমি। ইমরুল শাহবাগরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন কইলেন এখানে, যারে, উনার মতে, ভুলভাবে পলিটিক্যালি ট্রিট করা হইছে। ইমরুলের পার্টটা বড় হইল এই আলাপে, কারণ উনার সাথে একটা ছবির উসিলা দিয়াই এই আলাপের শুরু হইছিল আমার নতুন বন্ধুটির সাথে। ইমরুলই আড্ডার শুরুর বিষয় ছিল।

মাহবুব মোর্শেদরে প্রথম খেয়াল করি ব্লগ ও সিপি গ্যাং এর জমানায়। সম্ভবত তখন প্রথম আলো পত্রিকাতে চাকরি করতেন, বা প্রথম আলো ব্লগের এডমিন। তখন যাদের হিউমার ও আলাপের ধরন আমার আগ্রহ তৈরী করেছিল, মাহবুব তাদের একজন। মাহবুবও শাহবাগের বিরোধিতা করতে পারছিলেন। তাদের বন্ধু সালাহ উদ্দিন শুভ্ররেও, সম্ভবত, প্রথম আলো ব্লগের এডমিন হিশেবেই খেয়াল করি প্রথম। কিন্তু, তার লেখালেখি তেমন খেয়াল করা হইত না। শুধু, মনে আছে, শুভ্রও ক্রিটিকাল থাকতে পারছিলেন তখন, শাহবাগের প্রতি। শুভ্র সেই সময় আমার লেখা শাহবাগের আজান ছাপান তার সম্পাদিত বামপন্থা.কমে। পরে আটপৌরে নামে আর একটা সাইট শুরু করেন। অইখানে শুভ্র সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি বই নিয়া একটা লেখা লেখেন, যার শিরোনাম হল, রিফাত হাসান পইড়া কী হবে। লেখাটা আমার পছন্দ হইছিল।

বন্ধু লিস্টের রেজাউল করিম মনু ছিলেন, অধুনা রক মনু নামে লেখেন, ব্লগের জমানার পরে ফেসবুকে এসে উনারে খেয়াল করি হঠাৎ। মনু, সম্ভবত তখন বিডি আর্টস দেখতেন, রাইসুর সাথে। রাইসু আর্টসের সম্পাদক ছিলেন সেই সময়। আর্টসের সূত্রেই পরিচয় হইছিল। মনুও, শাহবাগ নিয়া ক্রিটিকাল থাকার অবস্থান নিছিলেন। তবে, মনুর এখন যে ভাষার এক্সপেরিমেন্ট, তখনও তা শুরু হয় নাই।

আর যাদেরে খেয়াল করতাম তাদের মধ্যে ছিলেন সুমন রহমান। ব্লগের জমানায় পরিচয় সুমনের সাথে। সুমন বোধ হয় তখন সিঙ্গাপুরের কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন, আর বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ লেখেন ও গল্প। সুমনের কিছু পাঠকপ্রিয় গল্প আছে, যেমন, গরিবি অমরতা। শাহবাগের সময়ে, দেখা গেল, শাহবাগ বিষয়ে পুরোপুরি চুপ ছিলেন সুমন। পরে, চব্বিশের মার্চে সোশাল মিডিয়ায় সুমনকে বলতে দেখা যায়, ‘বাংলার ফেসবুক বুদ্ধিজীবীদের অতীব প্রিয় দুইটা বিষয়ে আমি কখনোই কথা না-বলবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এক, শাহবাগ আন্দোলন, এবং দুই, আহমদ ছফা। এমন গুরুত্বপূর্ণ দুইটা বিষয়ে কোনো আলাপন ছাড়াই জীবন পার করে দিতে পারতেছি, ভাবতেই আনন্দ হয়।’ এই মন্তব্য সুমনকে বোঝার জন্য ভাল নোক্তা হতে পারে। অথবা না বোঝার জন্যও। সুমন ভাল আড্ডা জমাতে পারেন ও বন্ধুবৎসল। তার বন্ধু শফিক শাহীনের সাথে বন্ধুত্ব হেতু, তার সাথেও বন্ধুত্ব তৈরী হয়।

মুনেম ওয়াসিফ, তাকে খেয়াল করার ব্যাপার ছিল না, উনি বুদ্ধিজীবী না। কিন্তু, শাহবাগের সমর্থনে প্রতিদিন একটি ছবি দেওয়ার ঘোষণা দিলেন বইলা তার নাম মনে আসল। চট্টগ্রামে বহু বছর আগে আমার বাসায় একদিন আড্ডা হইছিল ওয়াসিফের সাথে, ফলে তাকে চিনতাম। হয়তো এই কারণেও ওয়াসিফের নাম মনে আছে। তার শাদা কালো ছবিগুলো নজরে আসত, আমি ব্যবহারও করেছি শাহবাগের আজান লেখাতে। উনি চিন্তা পত্রিকার একটি কনটেন্টের কো-রাইটার হিশেবে আমার নজরে আসেন প্রথমে। ফটোগ্রাফার।

জিয়া হাসান, বখতিয়ার আহমদ, উনাদের নাম হঠাৎ খেয়াল করলাম তখন। বখতিয়ার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সম্ভবত নৃততত্বের। বখতিয়ার আহমেদের একটা লেখা মনে পড়ছে, শাহবাগ কি বিপ্লব বা এইরকম কিছু। শাহবাগের বিপ্লব হয়ে ওঠার সম্ভাবনা, এবং অসমাপ্ত বিপ্লব দেখছিলেন অই লেখায় বখতিয়ার। আর, স্রেফ এইটুক মনে পড়ে, সেই সময়ের শাহবাগের জনপ্রিয় শ্লোগান, ‘গোলাম আজম সাইদী বাংলার ইহুদী’র সাথে ইহুদী বিদ্বেষের কোন সম্পর্ক যে নেই, এরকম কিছু বোঝাচ্ছিলেন তিনি। বা জবাই কর শ্লোগানের সাথে মানুষ জবাই করবার মতন মনস্তত্ত্বও নেই, তার মতে। এই মতামত ইমরুলেরও ছিল, সেই সময়।

পরে, উনি আমার সাথে যোগাযোগ করে চট্টগ্রামে আসছিলেন ও জামালখানে দেখা ও আড্ডা হইছিল। বখতিয়ার আমারে জানাইছিলেন, হেফাজতের লংমার্চ নিয়ে আমার একটি অটোবায়োগ্রাফি টাইপ লেখা, এইটারে মাদ্রাসার ছাত্রদের বোঝার জন্য উনাদের অভিজ্ঞতায় প্রথম এথনোগ্রাফি টাইপ লেখা ছিল। বখতিয়ারের সাথে আড্ডা দিয়ে বন্ধু হিশেবে পছন্দ হইছিল। কিন্তু তার রাজনৈতিক দার্শনিক অবস্থান অস্পষ্ট মনে হইছে আমার। শাহবাগরে ঔন করতে চাইতেন, কিন্তু ঔন করতে পারতেন না, এরকম। তাদের বন্ধু সেলিম রেজা নিউটন, শাহবাগকে ঔন করতেন। কিন্তু, ‘হেফাজতের লংমার্চ: আমার একটি সেকু্লার ভ্রমণ কাহিনী’ শিরোনামে আমার লেখাটি লইয়া একটি ক্রিটিক লেখেন, তার সাইটে। এবং আমার এই লেখা তার সম্পাদিত মানুষ নেটওয়ার্ক গ্রন্থমালায় ছাপানোর অনুমতি চান। ফলে, তার সাথে একটা যোগাযোগ তৈরী হল।

জিয়া হাসানের সাথে হঠাৎ পরিচয় হল তখন। জিয়ার আলাদা কইরা কোন লেখা মনে নেই, শুধু মনে আছে, ফরহাদ মজহারের প্রতি সলিমুল্লাহ খানের হেফাজতের তাত্ত্বিক গালাগালটা উনি উনার বইয়ের ভূমিকাতে নিজের কইরা নিছিলেন। জিয়ার বইটা আমারে, সম্ভবত আরো অনেক বন্ধুকেও, পাণ্ডুলিপি অবস্থায় পাঠিয়েছিলেন, কমেন্টের জন্য। বইটা পড়ি নাই, কিন্তু ভূমিকাতে আমার এই লাইনটাই চোখে পড়ছিল। তখন জিয়াকে এই অবজার্ভেশনটাই বলছিলাম।

পিনাকী ভট্টাচার্য। ২০১৬। ছবি: রিফাত হাসান।

চট্টগ্রামে একদিন জিয়া হাসান একটা প্রোগ্রামের দাওয়াত দিলেন, এইটা ছিল জনৈক মাসুদ রানা ও পিনাকী ভট্টাচার্যর বাঙালি মর্যাদা আন্দোলন। এই সূত্রেই প্রথম পিনাকী ভট্টাচার্যের নাম শুনি। আমার সেই অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় নাই সম্ভবত, বা অনুল্লেখ্য ছিল। পরে পিনাকীকে ফেসবুকে পাই ও আমরা বন্ধু হই। দেখলাম, তিনি গণজাগরণমঞ্চে যুক্ত ছিলেন, আর অধুনা গণজারণমঞ্চের সমালোচনা করছেন। তার কিছুদিন পরেই, হঠাৎ একদিন পিনাকী জানান, তিনি চিটাগাং আসছেন এবং আমার সাথে দেখা করতে চান। আমাদের বাতিঘরে দেখা হল। আমি পিনাকীরে কইলাম, আপনার মত সাজানো গোছানো ও স্মার্ট ‘লেখক’ খুবই কম দেখেছি। উত্তরে জানলাম, পিনাকী তখন একটি কর্পোরেট কোম্পানির সিইও। জিগেশ করলাম, গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বেরুলেন কেন? কইলেন, পাঁচ মে যৌথ বাহিনীর ব্রুটাল অভিযান উনারে বদলে দিয়েছে। আমি পিনাকীর এই ধরনের বক্তব্য এখানে আসার আগে তার প্রফাইল থেকেও দেখেছি। এক পর্যায়ে আমি কইলাম, ধরুন, আপনি যদি এখন গণজাগরণমঞ্চের নেতৃত্বে থাকতেন, মানে, ইমরান এইচ সরকার হইতে পারতেন, তখনও কি আপনার অবস্থান একই হইত? পিনাকী রহস্যময় হাসলেন।

এরপরে পিনাকীর সাথে আরো অনেকবার দেখা হয়েছে। তার ও তখনকার লন্ডন প্রবাসী মাসুদ রানার সেই বাঙালি মর্যাদা আন্দোলন নামের মধ্যে ফ্যাসিস্ট উপকরণ ছিল বইলা মনে করতাম আমি। এইটা উনারে দেখা হলেই বলতাম, উনি যখন এই আন্দোলন নিয়া উচ্ছাস প্রকাশ করতেন, তখন। সেই সময়ে পিনাকীর সাথে অনেক ছোট ছোট বাহাছ হত, যার কিছু কিছু সেই সময়ে সোশাল মিডিয়াতেও এসেছে। যেমন, একবার, খালেদা জিয়া যখন ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যারে সন্দেহ কইরা বক্তৃতা দিলেন, পিনাকী এইটারে খালেদার দুঃসাহস ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধরে অস্বীকারের চেষ্টা কইতে চাইলেন। আমি কইলাম, আপনি যদি হাসিনার গুম খুন নিয়া কথা কইতে চান, সবার আগে আওয়ামীলীগের এই ইতিহাস প্রকল্প গুড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, এরা, আপনারে জবাই করার সময়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের কলেমাটাই আগে পড়ে এবং এখানেই লেজিটিমেসি খোঁজে। পরে, এই তর্ক নিয়া আমি সংখ্যা এজ আইডিওলজি নামে একটা লেখা লিখেছি। মুজিবের নাম উচ্চারণ করা নিয়াও পিনাকির রক্ষণশীলতা ছিল, ‘বঙ্গবন্ধু’ ছাড়া মুজিব কইয়া আলাপ করলে পিনাকী তার প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু, ধীরে ধীরে খেয়াল করে দেখি কি, উনার পলিটিক্যাল অবস্থান ঠিক স্থবির না, ইন্টারেকটিভলি, আমাদের সাথে তর্ক করতে করতেও উনার অবস্থান পরিবর্তন হতেছে। এইটা আমারে আগ্রহী কইরা তুলল পিনাকীর ব্যাপারে। এই যে পিনাকী ভট্টাচার্যদের অবস্থানে বড় পরিবর্তন, বিশেষ করে শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যার পরে, তার অর্থ এইটা না যে, পিনাকীর এই আন্ডারস্টেন্ডিং আগে ছিল না। আগে যেইটা ছিল, এবং পরে যেইটা হল, আমি এইটারে বলি, রাজনৈতিক অবস্থান। কুয়ার থেকে বেরুতে না চাওয়া। পিনাকীর এই কুয়া ভাঙল তার বাঙালি মর্যাদা আন্দোলনের ভাঙনের মাধ্যমে।

মাহবুব মোর্শেদরেও, আমার ইন্টারেস্টিং মনে হইছে, শাহবাগের সময়ে। ছবি: জানুয়ারি ২৩, ২০২২ । সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র।

বাংলাদেশে পোস্ট শাহবাগ লেখালেখি ও একটিভিজমের মধ্যে পিনাকী ও আরো অনেকের এই জার্নি ও পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই পলিটিক্যাল অবস্থানের পরিবর্তনের জার্নিকে যা প্রভাবিত করতে পারে, তার মধ্যে আন্ডারস্টেন্ডিং যেমন ছিল, তার থিকাও বড় ঘটনা, হাসিনার ক্ষমতার হেজিমনি ও তার থিকা তৈরী হওয়া হতাশা বা আশা। মানে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গণহিস্ট্রিয়ারে ক্ষমতায় থাকার টুল হিশেবে ব্যবহারের কারণে আওয়ামীলীগের ব্যাপারে একটা গণ-হতাশা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

রক মনু। মার্চ ১০, ২০১৫। ছবি: মোহাম্মদ রোমেল।

ফলে শাহবাগ যেহেতু আওয়ামীলীগের স্পন্সরড ব্যাপার, বুঝদার ও দায়িত্বশীল মহলে তেমন সাড়া জাগাতে পারে নাই। সুবিধাবাদি মহলে ভয়, সাড়া ও ফ্যাসিবাদ সব জাগাইছে, যেহেতু জাতীয়তাবাদি আবেগরে ব্যবহার করা হইছে। বিপরীতে হেফাজত তার একটা পাল্টা জবাব ও ক্ষমতা হিশেবে হাজির হতে পারছিল। তার একটা মূল্যায়ন হাজির করাও বুদ্ধিজীবীতার দায় ছিল, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পরে, পিনাকী ইউটিউবে আসার পর, বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সবচাইতে জনপ্রিয়, ফলে প্রভাবশালী মোটিভেশনাল পাবলিক স্পিকার হিশেবে সাঈদি, আজহারি ও সলিমুল্লাহ খানের পরে, পিনাকীকে চিহ্ণিত করি আমি।

দুই হাজার সতেরর আগস্টে হঠাৎ কোন একটা চ্যানেলে সলিমুল্লাহ খানের একটা বক্তব্য শুনলাম, যেখানে তিনি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার ভুয়শি প্রশংসা করছেন এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদের উদাহরণ দিয়ে তাদের সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা তর্কে পারবেন না বলে মতামত দিচ্ছেন। মনে হইছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কওমিদের বৈঠক ও কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা পরবর্তী নতুন পরবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিলেন। খানের সামাজিক যোগাযোগের ধারাটি এলিট, তারপরও এইটা একদা ফরহাদ মজহারের প্রতি উনার হেফাজতের তাত্ত্বিক সংক্রান্ত গালাগালের ঘটনারে পাল্টে দেবে বইলা মনে হয়। আমি কয়েকদিন আগে এইরকম একটা কিছু ইশারা করছিলাম, আজকে এই বক্তব্য দেইখা মনে পড়ল।

খানের সব সময় একটা শূন্য স্থানের দরকার ছিল, বুদ্ধিজীবী হিশেবে ফরহাদ মজহার উনার দেওয়াল আকারে দাঁড়িয়েছিলেন সব সময়। উনারে দেখা যাইত না। এখন যেহেতু হেফাজত নেতারা প্রধানমন্ত্রী ভবনে গেলেন, এই জায়গায় অল্প সময়ের জন্য একটা শূন্যতা দাঁড়াল। খেয়াল করলাম, ফরহাদ মজহার এইটাতে বেশ কিছুদিন চুপ থাইকা পরে একটি সতর্ক ক্রিটিক্যাল অবস্থান নিয়েছেন ও কওমিদেরে এর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করলেন। ফলে, কওমি মাদ্রাসা নিয়া খানের এই আলাপ এই শূন্যতা পুরনের চেষ্টা, যেখানে কোন দেওয়াল নেই। উনারে দেখা যাবে এই জায়গা থিকা। কওমিরা এখন খানেরও সাবস্ক্রাইবার হয়ে উঠবেন। অথচ খান হেফাজত কর্মীদের উপর পাঁচ মের মতিঝিল অভিযান ও যৌথ বাহিনীর হত্যাকাণ্ডকে ওয়েলাম জানাইছিলেন। দুই হাজার তেরর জুনে বিডি নিউজের একটা গোল টেবিল বৈঠকে গোঁয়াড়ের মত কইরা বলতেছিলেন, আপনাদের ওখানে কী পড়ানো হয় আমি জানি না, কিন্তু মাদ্রাসায় মার্কস হেগেল পড়ানো উচিত। তখন আমরা এইটা নিয়ে হাস্য রসিকতা করছিলাম।

যাই হোক, খানের এই অবস্থান আবার আমার আগ্রহ তৈরী করেছে। আমি আগ্রহ নিয়া দেখছি ও পড়ছি। দুই হাজার সতের সালে।

ইমরুল হাসান। এপ্রিল ১৩, ২০১৭। অভয়মিত্র ঘাট, চট্টগ্রাম।

শাহবাগের ফ্যাসিজম বহু মানুষের মোলায়েম পোশাকটি খুলে ভেতরের ফ্যাসিস্ট পশুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। আবার বহু সাহসী মানুষকে মেনি বেড়াল হিশেবে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বহু মৌসুমি বন্ধুত্ব ও বুদ্ধিজীবীতার পতন ঘটেছে। পরিস্কার করে দিয়েছে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি।

আমরা ব্যক্তিগত আড্ডাতে এই সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি নিয়া আলাপগুলো প্রচুর করি। কিন্তু পাবলিকলি করাটা একটু অনিরাপদই, যেহেতু ব্যক্তির নাম ধরে ধরে আলাপ, সম্পর্কের ব্যাপারও জড়িত। তবে, মনে হল সেদিনের এই আড্ডাটি এইটুক শেয়ার করা যায়, এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতি হার্মফুল কোন ব্যাপার নেই। এমন কি সব তথ্যই, সোশাল মিডিয়া ও জনপরিসরে প্রকাশিত হওয়া ঘটনার থেকে নেওয়া। তেমন কোন ব্যক্তিগত তথ্য নেই।

এপ্রিল ১৭, ২০১৭ । আপডেট:  এপ্রিল, ২০২৪। মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে বইতে মুদ্রিত।

Leave the first comment