আমরা মোটামুটি ‘হিন্দু মহাভারতে’ থাকি। আমাদের মহাইতিহাসের অংশ। তাই, হিন্দুগন্ধে আমার ‘অস্বস্তি’ নেই। অস্বস্তি অসম্ভবও বটে, তার কারণ পরে বলছি। কিন্তু ‘মুসলমানগন্ধে’ আপনার আপত্তি, বা অস্বস্তি নেই তো? যদি থাইকা থাকে, তার মনস্তত্বের আলাপও তো করতে হবে। আসুন, পড়ি আমার এবং আপনার মনের ভেতর বাহির। যদি বাংলাদেশে ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ নামে যেটি হাজির, তারে বুঝতে চাই।
রোহিঙ্গা, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ‘সংখ্যালঘু’ মন
ডিসেম্বরের ৬ তারিখ, দুই হাজার ষোল। সকাল থেকে জামালখান ছিলোাম। প্রেসক্লাব সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে বহুবার হাঁটতে হাঁটতে গেছি। কাজে, অকাজে, চা খাইতে ও আড্ডা দিতে দিতে দেখছিলাম রাস্তা। প্রায়ই জমজমাট মিছিলে মিটিঙে। দূর থেকে দেখলাম, রোহিঙ্গা নিয়া। পরে দেখলাম, গেরুয়া কাপড়। কাছে গিয়ে দেখি, বৌদ্ধ সম্প্রদায়। আমার এক বন্ধুরে দেখলাম, দাস, সে হাত নাড়ছে। সাংবাদিক। বৌদ্ধদের ভেতরে কি দাস হয়, আমি ভাবলাম। আমিও হাত নাড়লাম। একজন মাইকে বলছেন, মিয়ানমারে যারা মুসলমানদের উপরে হামলা করছে তারা প্রকৃত বৌদ্ধ নয়। মিয়ানমারের হঠকারীদের এই হামলা বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমারকে চাপ দিতে তিনি ‘জননেত্রী’ শেখ হাসিনারে আহ্বান জানালেন। তাদেরে আশ্রয় দেবার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালেন। আমার মনটা ভরে গেল। আমরা জানলাম, বৌদ্ধ শান্তির ধর্ম, যেমনটি ইসলামও। এতদিন ইসলামরে জানান দিতে হইত, এখন তাদেরও জানান দিতে হচ্ছে। এইটা শুনতে নতুন লাগলেও, বেশ ইন্টারেস্টিং। একজন বললো, আরাকান তো চট্টগ্রামের অংশ ঐতিহাসিকভাবে, সেই হিশেবে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামেরও। ওখানে স্থানীয় আওয়ামী কালচারাল কর্মীরাও আছেন, মুসলমান। মানে, সরকারের সমর্থন আছে। একটা কেমন সাজ সাজ রাজনৈতিক রব। বহুদিন পরে, এইসব কোলাহল খারাপ লাগল না। কয়েকদিন আগে মিডিয়ায় দেখা গেছে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ও ভিক্ষুরা হেফাজতের আমির আহমদ শফির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এই দৃশ্যটা স্বস্তিকর। আমাদের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সদ্ভাব দরকার। কথা বার্তা ও সম্প্রীতির সহাবস্থান দরকার। নিজেরে অপর কইরা রাখলে অপরই থাকা হয়, সংখ্যালঘু। এই লঘুত্বের লঘুতা ভাঙতে হবে। নইলে সব কিছু ভেঙে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে কাজে চলে গেছিলাম। সন্ধ্যায় আবার ফিরছিলাম, ওইদিক দিয়েই। দেখলাম, লোক হালকা বেড়েছে। এইটা কি সারাদিন চললো? বন্ধুরে দেখা গেল। সে আবার হাত নাড়ল। হাসিখুশি যিশু। ছোটখাট পত্রিকার সাংবাদিক। এতক্ষণ নাম খেয়াল করি নাই। এইবার খেয়াল করলাম, ঐক্যবদ্ধ সনাতন সমাজ, বাংলাদেশ। ওদের পাশে রেখে বাতিঘরের দিকে ঢুকলাম। কয়েকটা বই দেখতে হবে। বাতিঘর থেকে বেরুতে বেরুতে তখন সন্ধ্যার পর। যেতে যেতে শুনলাম, এলা নতুন শ্লোগান। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। এ্যাকশন এ্যাকশন—। আমি বেরুলাম আর শুনলাম এখনকার বক্তা বলছেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা স্রোতে ভেসে আসে নাই। ইত্যাদি। ভাষা আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হচ্ছে। ছেলেপেলেরা দেখি রিকসার আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। পথিকদের দিকে উত্তপ্ত নয়নে তাকাচ্ছে। আমার অস্বস্তি হতে লাগল।
এই অস্বস্তিটা কেমন?
২.
আরো পড়ি।
বিদ্যানন্দ নামের সংগঠনের এক টাকার আহার কর্মসূচি সম্প্রতি মিডিয়া ও সাধারণ্যের আগ্রহ কুড়িয়েছে।
বিদ্যানন্দ নামটি সুন্দর। নামে অল্প হিন্দুগন্ধ, আমাদের খেয়ালে আসত না, যদি না মিডিয়াগুলো বিদ্যানন্দের ঘটনাকে হিন্দু উদ্যোক্তার মানবিক গল্প হিশেবে হাজির করত, যেখানে মুসলমানদেরে ইফতারি ও সেহেরি খাওয়ানোর বিবরণ আছে। বলা বাহুল্য, এই ধরনের মানবিক গল্পের সমস্যা আছে। কিন্তু মিডিয়ার কাজ তো সমস্যা তৈরি করাই।
আগেই বলেছি, হিন্দুগন্ধে আমার অস্বস্তি নেই। এলা বলি, আমার স্বস্তিই আছে বরং। আমার স্বস্তিটি রাজনৈতিক। কেন বুঝিয়ে বলি।
আমি বিদ্যানন্দের কাজে স্বস্তি বোধ করতাম এজন্য যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের নানান বৈচিত্র্য ও সম্ভাবনা বিদ্যানন্দের ঘটনায় পাবেন আপনি। স্রেফ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মুসলমানদেরকে আদার কইরা থাকতে চাওয়ার ঘটনাই এদের চেহারা না। যেমন হেফাজতে ইসলাম আর জামাতে ইসলামই কেবল মুসলমান না, মুসলমানের আরো চেহারা আছে বাংলাদেশে। আমরা যে প্লুরালিস্টিক সোসাইটি ও ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কথা কই, তার জন্য এই বৈচিত্রগুলোরে বুঝতে পারা ও ধারণ করতে পারা জরুরি।
কিন্তু পরে একদিন, তাদের নিজেদের ঘোষণায় দেখলাম, তারা জানাচ্ছেন, ‘বিদ্যানন্দ’ নামটি দিয়েছেন এক ‘মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্ট’। আর তাদের ৯০% মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক। ফলত ‘হিন্দু উদ্যোক্তা’ হিশেবে উদ্যোক্তা ভদ্রলোক পদত্যাগ করছেন। যদিও অভিমানের বাক্যই, পরে মিটমাট হইছে বলে ওরা জানাইছেন আমাদের, আমার আফসোসটি হল, তিনি বা ওরা হিন্দু থাকিতে পারিলেন না, বা মুসলমান যারা তার সতীর্থ, তারাও মুসলমান থাকিতে পারলেন না।
উভয়ই সাম্প্রদায়িক রহিয়া গেলেন। এই ঘটনা খারাপই হল।
‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’
অস্বস্তিটারে মোটাভাবে ‘হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ আকারে দেখা হয়। আমার মতে, এই সমস্যাটা প্রজেক্টেড, ন্যাচারাল না। সম্প্রদায়গত আবেগ দিয়ে এইটারে বিচারের ঝামেলা অনেকেই করেন। আবার, ‘বিচার’ না, সম্প্রদায়গত আবেগরে ব্যাবহার কইরা এই সমস্যা জিইয়ে রাখে রাজনৈতিক দলগুলো, যেমন আওয়ামীলীগ।
যেমন, পনেরতে দুর্গা পূজার সময়ে এক আওয়ামী মন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে অসুর বধ করার ‘জঙ্গি’ আহ্বান জানাইতেছিলেন, বিরোধী দলকে ইশারা করে। ‘সাম্প্রদায়িক মুসলমানরা’ এতে গোস্বা হইছিলেন, কিন্তু আমি চমৎকৃত হইছিলাম।
রাষ্ট্র একটি ‘জঙ্গি’ ব্যাপার, আমি সব সময়ই বইলা থাকি। জঙ্গ, জিহাদ আমার বেশ পছন্দেরও বিষয়। হিন্দু পুরাণ পড়তে আমার ভাল লাগে, কারণ এখানে ‘জঙ্গি’ ও বধের (কেতাল?) ব্যাপারে কোন আধুনিক নাপাকি ভাব নেই, বরং অনেকেই হয়তো জানেন না, গীতারে সন্ত্রাসবাদী কেতাব বইলা অভিহিত কইরা গুরুতর আলাপ আছে। কাউন্টার ন্যারেটিভগুলোকে পাত্তা না দিলে, হিন্দু পুরাণ মতে, অসুর হল কায়েমি শক্তি, তারে বধ কইরা নবশক্তির উত্থান আনার জন্য দেবীর আগমন। বলেছিলাম, যদি মন্ত্রী এমন আহ্বান করেন, আপনারা যারা মুসলমান এতে সাম্প্রদায়িকভাবে আহত হন ক্যান? দেশে এখন কায়েমি শক্তি কে? বরং, আমি বলেছিলাম, আসেন, সব পূজোতেই মন্ত্রী মশাইয়ের অসুর বধের আহ্বানরে স্মরণ করি।
অসুর মানে তো কায়েমি শক্তি। ক্ষমতা।
মানে, এই ক্ষমতারে তো পাঠ করতে পারতে হবে, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা বোঝার আগে।
মূলত, হিন্দু-মুসলমান সমস্যারে আপনি কীভাবে পাঠ করবেন, এইটা আপনি সভ্যতা, ইতিহাস ও ক্ষমতাকাঠামোরে কীভাবে পাঠ করতে অভ্যস্ত, একই সাথে তার ফয়সালাও।
দরদ দরকার, কিন্তু স্রেফ ‘সম্প্রদায়গত আবেগ’ কোন পাঠ না। আবেগ একটা ছোট প্রপঞ্চ হইতে পারে মাত্র।
সাম্প্রদায়িকতা, লঘু ও গুরু প্রশ্ন
সাম্প্রদায়িকতার সাথে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুত্বের সম্পর্ক, বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে হিন্দু বা অন্য ধর্মের হওয়াটারে স্রেফ একটা সংখ্যালঘু ও অমুসলিম বা আদার হওয়ার ব্যাপারে পর্যবসিত করার আলাপটি কেমন? এ ধরনের একটা তত্ত্ব আওয়ামী-ঘরানা ও তাদের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী হাজিরের মতলবে থাকেন, যেমন শাহবাগের সময়ে প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান। এই ধরনের আলাপগুলোর কারণে হিন্দু হওয়াটা অন্যায়, অপরাধ ও ‘গালি বিশেষ’ হিশেবে প্রতিষ্ঠা পাইছে ধীরে, আপনার অবচেতনে, আপনি খেয়াল করবেন। ফলে যখন আপনি হিন্দু হয়ে জনপ্রিয়-সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও আওয়ামী ধারার বাইরে নিজের ক্রিটিক্যাল অবস্থান জাহির করেন, তখন আপনাকে এলিয়েন ও অপরাধী আকারে দেখা হয় এবং অপদস্থ করা হয়। লেখক পিনাকীকে এজন্য ‘অমুসলিম চর’ গালি শুনতে হইছে, আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে, আপনাদের মনে থাকিত পারে।
এই যে বাংলাদেশে হিন্দু বা আর আর ধর্মাবলম্বীদেরে নাগরিকের বাইরে, স্রেফ ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘অমুসলিম’ বানিয়ে হাজির রাখা, এর রাজনীতি হল এদেরে আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা মেশিনের হাতিয়ার বা ভোক্তা হিশেবেই জিইয়ে রাখা। এই চেহারাতেই উনাদেরে দেখতে পছন্দ করেন এই সংখ্যালঘুবাদীরা, আর যে কোন সম্ভাবনায় হকচকিয়ে ওঠেন। এদের চিন্তা-চেতনায় নাগরিকতার কোন স্থান নেই। অবশ্যই, ‘নাগরিক অধিকার’ ধারণাটা শহীদও হইছে এদের দ্বারা, গত বছরগুলোতে, বা আরো আগে, ঐতিহাসিকভাবে।
বরং আমাদের ইতিহাসঅভিজ্ঞতা বলে, সংখ্যাগুরু যেমন, সংখ্যালঘুর ভেতরেও সাম্প্রদায়িক চিন্তা, তৎপরতা জিইয়ে থাকতে পারে। এইটার সমাধান সম্প্রদায়ের চিহ্ন মুছে দেওয়া নয়। কেন, কোন অবস্থার কারণে কোন সম্প্রদায় নিজেদের কম নাগরিক মনে করেন, তা যদি কেবল সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু প্রশ্নে সমাধান করতে চান, তাইলে সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলেই ঘুরপাক খাবেন আপনি। কারণ, যে কারণে কোন সম্প্রদায় কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে সংখ্যাগুরু, তাদেরকে কোনভাবে সংখ্যালঘু বা অন্তত সমানসংখ্যা বানিয়ে ফেলা সম্ভব না। এটুক সাধারণ জ্ঞান। যে অবস্থার কারণে কোন সম্প্রদায় নিজেদের কম নাগরিক মনে করেন, তা মূলত নাগরিক অধিকার প্রশ্নই। এখানে সমাধান করতে চান না, বিষয়টারে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হিশেবে জারি রাখতে চান, সেজন্যেই খান এবং আওয়ামীলীগের সংখ্যালঘু প্রশ্ন।
মানে, আমাদের রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা জিইয়ে রাখার পাশাপাশি হিন্দু বা অন্যদেরে ‘সংখ্যালঘু’ কইরা রাখার ব্যাপার আছে। আবার, বিপরীতে ‘সংখ্যালঘু’ হইয়া থাকারও ব্যাপার আছে। এইটা মনস্তত্ত্বের রাজনীতি। বাংলাদেশে যে মুসলমান ছাড়া অন্যরা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবেন, এইটা কেমন? বা ভারতে মুসলমানরা? এই ব্যাপারটিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে দেখেন বা মোকাবেলা করেন? প্রথমে নোক্তা দিই, সংখ্যাগুরুতার কারণে বাংলাদেশের সব সংগঠন মুসলমানদের সংগঠন, এমন কি আওয়ামীলীগও। ভারতে যেমন, সব রাজনৈতিক দল হিন্দুদের। এই ঘটনা তো মুছে ফেলা যাবে না। এর বাইরে কী ঘটে?
৪.
‘সংখ্যালঘু’, ‘নয়া রাজনীতি’ ও হিন্দু সম্প্রদায়
নয়া রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল করতে চান এমন লোকেদের সাথে আমার প্রায়ই আলাপ হয়।
একবার উনাদেরে জিগেশ করলাম, কেন বাংলাদেশে জামাতের সাথে হিন্দু বা অপরাপর সম্প্রদায়ের লোকেদের কোন সামাজিকতা নেই, অথচ সেই একই জামাত ইন্ডিয়ায় পূজামন্ডপে সেবামূলক কাজ করে, শরবতের স্টল দেয়। বা, ধরুন, কেন আপনেরা মনে করেন, বাংলাদেশে হিন্দু বা আর আর অমুসলিমদের আওয়ামীলীগের ভোটব্যাংকের বাইরে আর কোন সম্ভাবনা নেই? এইটা কি কেবল হইয়া থাকা, নাকি কইরা রাখারও ব্যাপার। বাংলাদেশে হিন্দু বা আর আর অমুসলিমদেরে সংখ্যালঘু কইরা রাখার রাজনীতিটা আওয়ামীলীগের, ভোটব্যাংকের বাইরে আর আর সম্ভাবনাগুলো নিয়েও শঙ্কিত আওয়ামীলীগই। সেইসব সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আওয়ামীলীগের বাইরে আর আর দলগুলোর অবস্থান কেমন? আমি মনে করি, তারাও আওয়ামীলীগের সহযোগীই। এইটা ভালমতন বোঝা দরকার। এইখানে আপনি কেবল হিন্দুদের মন পড়তে চান, মুসলমান আওয়ামী লীগ বা জামাত, মানে বাঙালি মুসলমানের মন কি পড়েন? পড়তে পারেন?
তো, আমি কইলাম, আপনারে যে হিন্দু জনগোষ্ঠী সাপোর্ট দেবে, কোন কারণে? আপনি তো তাদের নামরে ব্যবহার কইরা একটি উদার ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতির ‘বিজ্ঞাপন’ করবেন মাত্র, এর বাইরে কিছু করবেন কি? আওয়ামীলীগ, বিএনপি, বা জামাত যা সাধারণত কইরা থাকে। এইসব বুইঝাও, আওয়ামীলীগ শত লুটপাট ও সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ করা সত্ত্বেও, এরা আওয়ামীলীগরে ভোট দেবে আদর্শগত কারণে। কারণ আপনারা সবাই একই চরিত্র ধারণ করেন। কিন্তু আদর্শগতভাবে একজন ইসলামিস্ট, একজন ইসলামিস্ট জাতীয়তাবাদী, আর আওয়ামীলীগ সেকুলার।
তো, ভারতে মুসলমানরা যেমন পপুলারলি হিন্দুত্ববাদী বিজেপিরে ভোট না দিয়ে অপেক্ষাকৃত সেকুলার শ্লোগানের কংগ্রেসরে ভোট দিয়া থাকেন বইলা বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশেও হিন্দুরা আওয়ামীলীগরেই পছন্দ কইরা থাকেন ইসলামপন্থী জামাত ঘেঁষা বিএনপির পরিবর্তে। এইটা আদর্শ ও সাইকোলজিগত কারণে। ভারতের মুসলমানরা যেমন হিন্দুত্ববাদ চায় না, বাংলাদেশের হিন্দুরা ইসলামিজম চাইবেন না, এই ঘটনা বুঝতে মহাভারত পড়তে হয় না।
কিন্তু যারা মনে করেন, এই না-মুসলমান জনগোষ্ঠীরে বাইরে রাইখা বাংলাদেশ হবে না, তাদেরে সাথে নিয়েও, আওয়ামীলীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে আরো ইফেক্টিভ জরুরি রাষ্ট্রগঠনের কাজ করতে হবে, আপনারা যারা নয়া রাজনীতি করতে চান, তারা এই বরফ কীভাবে ভাঙবেন? আর আর দলগুলোর মত স্রেফ একটা উইং করে দিয়া বইসা থাকবেন?
তো, হিন্দু সম্প্রদায় কেন আপনাদের সাথে থাকবে? উনারা তো কেবল হিন্দু শাখারে রিপ্রেজেন্ট করবেন। আপনার দল না। রাজনীতি হল প্রতিধিত্বকারী গ্রুপগুলোর স্বার্থ নিয়া নেগোসিয়েশন। আপনি যখন শ্রমিক সংগঠন করেন, তখন শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়া ভাবেন ও কর্মসূচি দেন। আর যখন হিন্দু সংগঠনের বেলা, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সম্প্রীতি সমুন্বত আছে’ স্রেফ এইটুকু বিবৃতির জন্য তাদেরে ব্যবহার করেন। বা জামাত ভাল, অসাম্প্রদায়িক সংগঠন, বিএনপি উদার, এই বিবৃতির বাইরে জামাত বা অন্য দলের হিন্দু সংগঠনের পলিটিক্যাল তৎপরতা আছে কি? শ্রমিকদের সমস্যা ও সমাধানগুলো নিয়ে যেমন, তাদেরে আন্দোলনের স্বার্থে হলেও ভাবতে হয়, হিন্দু সংগঠনগুলো নিয়া কি তেমন কইরা ভাবেন ও একটিভ থাকেন?
একটা হিন্দু উইং কইরা রাখা— ফায়দা লুটার এই আওয়ামী জামাত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে আইসা, কেবল মুসলমানদের দল হইয়া থাকার যে ঘটনা, তারে ভাঙতে হবে। বরং আপনারা বাংলাদেশে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে নিয়মিত সংলাপ করেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাথেও করেন। অপেক্ষাকৃত সামাজিক ইসকনের সাথেও করেন। অপেক্ষাকৃত নন ডোমিনেন্ট ‘সংখ্যালঘুদে’র শাখাগুলোর সাথেও করেন। যেমন দলিত। আরো আরো নিম্নবর্ণ। অন্যান্য ধর্মও। ওদেরে বলেন, যে, বাংলাদেশ নিয়া আপনাদের ভাবনা কী? আমরা নিজেদের ভাবনা নয়, আপনাদের ভাবনাগুলো নিয়েই কাজ করতে চাই। এই আলাপ ও যাত্রায় আপনাদের মনের ভাষা যদি এরা পড়তে পারেন, বাংলাদেশে উনারা আওয়ামীলীগের উপরে যে চোখ বন্ধ কইরা আদর্শিক ভরসা, তার থেকে চোখ ফেরাতে সাহসী হবেন। গত কয়েকদিন আগে ভারতের এনআরসি ইস্যুতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি ছিলো, যদিও পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের মত র্যাডিক্যাল বক্তব্য দিতে সমর্থ হন নাই তারা, আমি মনে করি, এই ঘটনারে নিজেদের জন্য ইশারা হিশেবে নিতে পারেন নয়া রাজনীতির ভাবুকরা।
৫.
শ্যামলকান্তি ভাবনা: অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থা বনাম হিন্দু শ্যামলকান্তি
দুই হাজার ষোলর ১০ আগস্ট শ্যামলকান্তি ভক্ত নামে নারায়নগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ‘স্যরি স্যার’ হ্যাশটাগে এক অভিনব আন্দোলন শুরু হয় সে সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবীদের, যেখানে সবাই নিজেদের কানে ধরা ছবি পোস্ট করে। এই আন্দোলন নিয়া না, আলাপের এই অংশে আমাদের আগ্রহ অপরাধ ও তার বিচারের ধারণা নিয়া, একই সাথে ‘সংখ্যালঘু’ ব্যাপারটি এখানে যেভাবে ফাংশন করেছে।
অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থার অন্তর্গত দর্শন হল সংশোধন ও জনশৃঙ্খলা। শাস্তিরে যদি ডিভাইন ব্যাপারও ধইরা নিই, তাও এর উদ্দেশ্য হলো পরকালীন মুক্তি। মানে, এই শাস্তির মাধ্যমে তার অপরাধমুক্তি ঘটবে ও পরকালে বঞ্চিত হবে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদিও আমাদের ভাববার সময় অল্প, কিন্তু গভীরভাবে ভাবা দরকার। মূলত বাংলাদেশে অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থার নামে যা আছে তা হল অপমান, ঘৃণা ও প্রতিশোধ ব্যবস্থা। সেই জন্যই আমরা শাহবাগ মুভমেন্টের পরে বাংলাদেশে যে আইনের অব্যবস্থা ও প্রতিশোধ ও অপমানের সংস্কৃতি চালু হয়— তার সমালোচনা করি। কারণ বিচারের পরিবর্তে কেবলই ফাঁসি চাওয়া, অপমান ও প্রতিশোধের ভাবনা এবং তা যে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন তৈরি করছে তা আমাদেরে যে জাগায় নিয়ে যেতে চায়, আমাদের গন্তব্য সেটি নয়।
উল্লেখিত ঘটনায় শ্যামলকান্তিরে কানে ধইরা উঠবস করানোর ভেতরে সংখ্যাগুরুর বাহাদুরি আছে, গ্রাম্য মাতব্বরি বুদ্ধি আছে, প্রতিশোধস্পৃহা ও অমর্যাদা ও অপমান আছে— আর কিছু নেই। আমি অবশ্যই মনে করি, শ্যামলকান্তি যদি কোন অপরাধ কইরা থাকেন— নবী বিষয়ে কটুক্তি ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ঘৃণার প্রচার— তার আইনি সমাধান আছে— অন্তত আইনে।
সামাজিক যে বিচার ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চালু আছে— রাষ্ট্রের অব্যবস্থার বিপরীতে আমি তার প্রমোটর হলেও— কখনো কখনো এর সাথে রাষ্ট্রের মালকিনরা জড়িত হয়ে পড়লে অপমান ও অসামাজিক শাস্তি প্রথাই এর মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন গলায় জুতার মালা পরিয়ে হাঁটানো— কানে ধরে ওঠ-বস-বেত্রাঘাত— ইত্যাদি অপমান। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আদালতেও মূলত এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটে না। যেমন রাষ্ট্রের নাগরিকদের এজলাসে দাঁড় করিয়ে অপমানের ঘটনা বা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বাই চান্স এডিটর বইলা কটাক্ষ করার ঘটনা হাইকোর্টেই ঘটেছে।
এর সাথে কিছুটা তুল্য দৃশ্য হলো— ৫ মে ঢাকা দখলমুক্ত করার সময়ে হেফাজত কর্মীদের কান ধইরা বসায়া রাখা— এমন নাগরিক অপমান সম্ভবত বাংলাদেশ এর আগে কখনোই দেখে নাই। এইসবই হলো সেই ফেনা, যার তলায় দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগ। অপমান, ঘৃণা ও প্রতিশোধ ব্যবস্থা ছড়িয়ে যার শুরু। এই অবস্থার বিরুদ্ধে মানবিক মর্যাদার জন্য লড়াইটা তাই আমাদের শাহবাগ ও তার স্পন্সর রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই লড়তে হবে— একটি মানবিক রাষ্ট্রের জন্য।
শ্যামলকান্তি নিয়া আরো কথা বলা সম্ভব। যেমন শ্যামলকান্তি ভক্ত একজন হিন্দু না হইলে এই ঘটনা সম্ভব হতো কি? বলা মুশকিল। বাংলাদেশে ঘেন্নাবাদীদের হত্যা করা হইছে, সেত অন্যদেরও হরদম হয়। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেলিম ওসমান সাহেব শাহবাগের ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারকারী কাউরে এইরকম কানে ধইরা উঠবস করানোর বা অপমানের সাহস ও সুযোগ পাইতেন না। যতই প্রধানমন্ত্রী ঘেন্নাবাদীদের বিরুদ্ধে বলুন না কেন, আদতে তিনি তাদের আশ্রয় ও অন্নদাতা।
তার মানে এইটা কি সংখ্যালঘু সমস্যা? কিছুটা তো বটেই। কিন্তু এই শব্দটি সমস্যারে লঘু কইরা ভাবতে শেখায়, গুরু ব্যাপারটিরে পাশ কাটিয়ে। তাতে সমাধান আসে না।
বরং বাংলাদেশে জামাত শিবির ও বিএনপির নেতাকর্মীরা অপমান, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, জেল-জুলুম-হুলিয়া ও খুনের দিক থেকে সংখ্যালঘুতর, আপনি খেয়াল করলে দেখবেন। এইদিক বিবেচনায় বাংলাদেশে অমুসলিম নাগরিকরা আওয়াজ তুললে বাংলাদেশের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত বিএনপি জামাতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের নিয়া তুর্কি সালতানাতের বাইরের বিশ্ব-সমাজও একটু চোখ তুলে দেখবার তাকত পেতো। কারণ হাড়ে মজ্জায় সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী এই গোষ্ঠীর হাতে ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদী’ কেউই নিরাপদ নয়। কিন্তু মুসলমান যেহেতু সেকুলার প্রপঞ্চ নয়, তাতে বাকী বিশ্ব কার কী-ইবা যায় আসে। অমুসলিমরা সমন্বিতভাবে আওয়াজ তুললে এই অপমান, অমর্যাদার সাথে সাথে তারও একটা সেকুলার সুরাহার উপায় হয়।
কিন্তু আপনারা তো আওয়াজ তুলেন না। স্রেফ ন্যাকামো ও ফাজলামোতে ভরা ভারচ্যুয়াল সম্প্রদায়ের কানমলা বিপ্লব দিয়া কী হবে?
‘হিন্দু নিগ্রহ, হিন্দু পুড়িয়ে মারা’র প্রশ্ন বা আমি তো বিএনপি জামায়াত করি না
: আমি তো বিএনপি জামায়াত করি না। আপনার এপিএস আমার বিরুদ্ধে কেন মিথ্যে মামলা দিলো? ~ প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তির মামলায় গ্রেফতার ও জেলের ভেতরেই আগুনে পুড়িয়ে মারার শিকার পলাশ কুমার রায়, গ্রেফতারের আগে~
: ইতিহাসে এরকম নজরবিহীন ঘটনা আর একটিও নেই, জেল যেখানে সব থেকে নিরাপদ জায়গা সেখানে যদি হিন্দুদের পুড়িয়ে মারা হয় তবে হিন্দুরা কোথায় যাবে? এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের দাবি জানান। ~ হিন্দু মহাজোট নেতা পলাশ কুমার রায়কে কারাগারে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সভাপতির বক্তব্যে সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মিলন ভট্টাচার্য~
উপরের এই কোট দুটিতে ওঠা অভিযোগ ও প্রশ্নগুলো করুণ। কিন্তু আপনি যে পদ্ধতিতে একটি খুনের প্রশ্নের সুরাহা চাইতেছেন, যে প্রশ্ন তুলে, প্রশ্নের এই ধরণটি কেমন?
‘হিন্দু পুড়িয়ে মারা’র প্রশ্ন বা ‘বিএনপি জামাত ছাড়া কাউরে মিথ্যা মামলা কেন দিল’, এই চরিত্রের প্রশ্ন ও আলাপটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম ২০১২ সালে। সেই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে আপনাদের অনুমোদিত ডেমন মূর্তি ‘শিবির সন্দেহে’ খুন হন দর্জি বিশ্বজিত কুমার দাশ। বিশ্বজিতরে পিটিয়ে মেরে ফেলার সময়েও তার আকুল আবেদন ছিলো, ‘আমি তো বিএনপি জামাত বা শিবির নই, আমারে কেন মেরে ফেলা হচ্ছে’।
রেহাই পাওয়া যায় নাই।
রেহাই যে এখানে নেই, অন্য কোথা, কবে বুঝবে ফ্যাসিবাদীরা।
আপনি নিজের জন্য যে মুক্তি চান, তা যতক্ষণ বিএনপি জামাত শিবির বা হিন্দু বা মুসলমানের জন্যও একইভাবে না চাইবেন, আপনি এইভাবে খুন হতে থাকবেন। কোন সময় এর নাম হবে ‘হিন্দু পুড়িয়ে মারা’, কোন সময় এইটুক বলার সুযোগও পাবেন না।
কারণ সে হিন্দু নয়। মুসলমান। বা জামাত শিবির। বা বিএনপি। আপনার মুক্তি পাওয়া হবে না। কারণ আপনি কেবল নিজের, বা নিজের সম্প্রদায়ের মুক্তি চান।
৬.
তাইলে, হিন্দু-নিগ্রহ বইলা পরিচিত প্রশ্নগুলোরে আপনি কীভাবে দেখবেন?
আমার আগ্রহ প্রথমত নাগরিক অধিকারের জাগায়। দেখবেন, এই নিগ্রহগুলো ও এর কারিগররা কোন না কোনভাবে প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামোর অংশ, যার ব্যাপারে আপনি ননক্রিটিক্যাল থাকতে চান ও প্রশ্ন করতে ভয় পান। বা সেই কাঠামোরে ভক্তি ও সমীহ করেন।
দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের ‘সংবেদনশীল’ অংশ এইটারে কীভাবে ক্রিটিক করে। বা আদৌ ক্রিটিক করতে সক্ষম কিনা। মুসলমানিত্বের জায়গা থেকেও। এবং তাদের পরিচয়ের রাজনীতি ও ইন্টারেস্টের জায়গা থেকেও, যদি তার ছিটেফোটা থাইকা থাকে। যেমন হেফাজত ও জামাত।
তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদী মিডিয়া ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকুল এইটারে কোন জাগায় নিয়ে যেতে চায়। কারণ এইটা আমাদের, নাগরিকদের লড়াইয়ের পদ্ধতি ও পথ ঠিক করে দেয়।
চতুর্থত, বাংলাদেশের আর আর রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘটনা নিয়া কীভাবে, কোন জাগা থেকে ডিল করতে চায়। কারণ এইটা তাদের রাজনীতির মেচিউরিটি ও সক্ষমতার প্রশ্ন। যেমন বিএনপি ও অন্যান্য উদার দলগুলো।
সবশেষে, একই সাথে, গুরুত্বের জায়গা হল, স্বয়ং হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো এই ঘটনারে কীভাবে রিড ও ডিল করতে সক্ষম। যেমন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, ইসকন, হিন্দু মহাজোট ইত্যাদি। যদিও, খেয়াল রাখা জরুরি, বাংলাদেশে জামাত বা হেফাজত বলিতেই যেমন মুসলমান মাত্রের প্রতিনিধি না, এই দলগুলোও হিন্দু সাধারণের একমেবাদ্বিতীয়ম প্রতিনিধি না।
বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’ পলিটিকসের বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ও তার বিপরীতে সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উইঠা নাগরিক নিগ্রহরে নাগরিক নিগ্রহ হিশেবেই পাঠ করতে পারা, তার প্রতিকার চাইতে পারা, এইটা গুরুত্বপূর্ণ।
বন্ধু ও শত্রুর ভেদজ্ঞান কার কীরকম, এইখান থেকে স্পষ্ট হয়।
৭.
আদর্শ হিন্দু ও মুসলমান ভাড়াটিয়া
কেবল হিন্দু বা মুসলমান ভাড়াটিয়া চেয়ে বিজ্ঞাপন ব্যাপারটি কেমন? আমার মতে, এইটা খুব বেশিভাবে না ঘটলে, এইটারে অস্বাভাবিক হিশেবে চিহ্ণায়ন সমস্যাজনক।
কোন একটা মিডিয়া ‘হিন্দু ও ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হবে না’ বইলা একটা সাইনবোর্ড খুঁজে পেয়েছে, এইটা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার গালাগালি সম্বলিত গম্ভীর কথাবার্তা চোখে পড়ছে, তাই এই আলাপ তোলা। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা শিরোনামের আলাপে এই আলাপরেও আনা যায়, যেহেতু সোশাল এক্সক্লুশনের আলাপ তোলা হচ্ছে এইটারে কেন্দ্র কইরা। এই কথাবার্তার মূর্খামি ও প্রিজাম্পশনগুলোরে প্রশ্ন করা দরকার মনে হল। এই ঘটনারে সোশ্যাল এক্সক্লুশন ধরনের উদাহরণ হিশেবে উপস্থাপন এখানে ধর্মগুলোর সমাজকাঠামো না বোঝার ফল।
হিন্দু বা মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা, বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা ব্যাপক হারে নেই। তাই সোশ্যাল এক্সক্লুশনের ধারণা কিছুটা কেতাবি, অন্তত শহরে তো নয়ই। গ্রামে হিন্দুপাড়া মুসলিম পাড়া বইলা ব্যাপার দেখা যায়, হিন্দু-মুসলমান একই পাড়ায় থাকে মিশ্রভাবে, এই ধরনের ঘটনা বিরল। কিন্তু শহরে দেখবেন মুসলিম পাড়া বইলা কিছু নেই, কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল আছে প্রায়ই।
গ্রামে সমাজ গঠনের যে রূপ, এই যে হিন্দুপাড়া, মুসলিম পাড়া, তা নিয়া কোন এক একাডেমিকের কাজের কথা পড়েছিলাম, যিনি মনে করেন, এইটাই প্রাকৃতিক।
প্লুরালিজম তো আরবান ব্যাপার, কিছুটা রাষ্ট্রের ধারণার সাথেও মিলে, কিন্তু সমাজ হয় ধর্মের ভিত্তিতে। কারণ এর সাথে আচার-অনুষ্ঠান, ভ্যালু-সিস্টেম ও সহজতার সাথে জীবনযাপনের সম্পর্ক আছে। মুসলমান বা হিন্দু এক সম্প্রদায়ের আজান বা পূজা অর্চনার ধ্বনি আর সম্প্রদায়রে বিব্রত না করা উভয়ের পক্ষ থিকাই ভব্যতা ও উদারতা বটে, কিন্তু এই উদারতা ও সহনশীলতার লিমিট যে আছে, তা স্রেফ কেতাবের প্রশ্ন না। এর সাথে সহজতার সাথে জীবন যাপনের ধারণার সম্পর্ক আছে, আপনি যত আর্বান বা মডার্নই হোন না কেন।
তবে, এই ঘটনা শহরে খুব একটা আছর করে না। শহর ধারণা প্লুরারিস্টিক। অন্তত আমার চোখে হিন্দুদের ভাড়া দেওয়া হবে না, এই ঘটনার চেয়ে কেবল আদর্শ হিন্দু ভাড়াটিয়া চেয়ে বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে বেশি, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায়। এইটা যদি ব্যাপক হারে না হয়, এইটারে আমার স্বাভাবিক মনে হয়।
পরস্পরের পরস্পরের জন্য পরস্পরের সাথে কথা কইতে পারা
বাংলাদেশে ‘ইসলামি মব’ নিয়া আলাপ হয় প্রচুর, যেহেতু মুসলমান সংখ্যাগুরু। আমরাও এই আলাপ করতেছিলাম বেশ কিছুদিন ধইরা। ‘মব’, আবার ইসলামি, মানে সংখ্যাগুরু, এইটা ভয়ংকর ব্যাপার। কয়েকদিন আগে এরকম ইসলামী মব একজনকে পুড়িয়ে মেরেছে, ‘কোরান’ অবমাননার অভিযোগে। অনেকটা পশ্চিমের খারাপ আত্মা, ডায়নি পুড়িয়ে মারার মত করে। বাংলাদেশে ‘ইসলামী’ দলগুলো এই ঘটনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট মেসেজ দিতে ও ঠিকঠাক প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমরা তো বটেই, সর্বসম্প্রতি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদও এই ‘ইসলামি মব’ নিয়া প্রতিবাদ করেছে। তো, আসেন, এই ঘটনা ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদকে পাঠ করি।
বেশ কিছুদিন আগে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কর্তৃক ভারতের এনআরসি নিয়া প্রতিক্রিয়া আমি রিড করেছিলাম। কৌশলী এবং কৌতুহলউদ্দীপক। তাদের উদ্বেগটি ছিলো, ‘ভারতে এই নয়া আইন চালু হওয়ার ফলে, অধিকতর নিরাপত্তার আশায় বাংলাদেশ বসবাসকারী সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে উৎসাহিত হতে পারেন এবং একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে অসম্প্রদায়িক আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণ কমতে পারে’।
মানে, বাংলাদেশে ‘হিন্দু কমে যাওয়ার’ ভয়।
খেয়াল করবেন, এই আলাপে বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার ঘটনায় উদ্বেগ নেই, কিন্তু তাদের আপত্তির কৌশলগত দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। নামে ও আচরণে এটি পাঁড় সাম্প্রদায়িক সংগঠনই, যেখানে সম্প্রদায় হিশেবে মুসলমানের অস্তিত্বরে নেই করে দেয়া হইছে, তারপরে মুসলমানদের বিপরীতে বাকিদের নিয়া ‘অসাম্প্রদায়িক’ দল করা হইছে।
নামে ও চরিত্রে প্রবল সাম্প্রদায়িক, তাদেরে নিয়া আমার এই আপত্তি এখনো বহাল থাকলেও, তারে উপেক্ষা কইরাই কিছু আলাপ করা সম্ভব। যেমন, মিডিয়ার খবরমতে চট্টগ্রামে এই দলের সাম্প্রতিক এক কর্মসূচিতে, পরিষদ নেতা রানা দাশগুপ্ত হেফাজত নেতা কাসেমিরে ধন্যবাদ জানাইছেন, হিন্দুদের বাড়িতে হামলা ও লালমনিরহাটের ঘটনার নিন্দা জানানোর কারণে। এইটা দারুন। বাবুনগরির হাসিনাবন্দনার ঘটনার চেয়ে এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক, আমি মনে করি।
আবার, খেয়াল করুন, একই কর্মসূচিতে তাদের একদল কর্মী কর্তৃক ভারতে মুসলমানদের উপরে হিন্দুত্ববাদীদের নির্যাতনে ব্যবহৃত ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান ও হেফাজত নেতাদের নিয়া ‘জবাই জবাই জবাই হবে’ শ্লোগান সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যার প্রেক্ষিতে, ওরা আজকে প্রেস রিলিজ দিয়ে জয় শ্রীরাম ও হেফাজত নেতাদের প্রতি এই বিদ্বেষমূলক শ্লোগানের নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন বইলা একটি নিউজ খেয়াল করলাম। যদি সত্যি হয়, এইটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই শ্লোগান নিয়া ভয়সহই আমি পরিষদের এই প্রেস রিলিজ বা ধন্যবাদের ঘটনাগুলোরে, একসাথে, শুভবোধের চিহ্ন হিশেবেই পাঠ করতে চাই।
হিন্দু আমার কাছে ‘আদার’ কোন ঘটনা না, আমার সহনাগরিক, আমার পাশের বাড়ি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ যদি কখনো স্রেফ সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে আর আর ধর্মীয় ও পলিটিক্যাল এনটিটিগুলো নিয়ে সহনশীল ও আন্তরিকতা নিয়ে আগায়, পাশে দাঁড়ায়, এই উত্তরণরে মুসলমান ধর্মীয় নেতাদের ওয়েলকাম জানানো উচিত। কেবল আওয়ামীলীগের দিকে তাকিয়ে না থেকে তাদের পরস্পরের পরস্পরের জন্য পরস্পরের সাথে কথা কইতে পারা উচিত।
ব্যবহৃত ছবি: নিউয়র্ক টাইমস, ১৭ আগস্ট ২০১৭। Riots that took place in the streets of Calcutta in 1946 between Muslims and Hindus claimed thousands of lives.
পুনমুদ্রিত। লেখকের টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা বহি থেকে। পৃষ্ঠা: ২৩৭। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। প্রথম প্রকাশ: ২৫ মার্চ, ২০২১।