তখন অস্তপ্রহর। সূর্য আদধেক কমলা আভা রেখে ডুবল প্রায়। জঙ্গুলে রাস্তাগুলো ছোপ ছোপ অন্ধকারে ভরে উঠছে আস্তে আস্তে, অস্বস্তির মত। রাস্তা ধইরা দুই দিক থেকে হেঁটে আসছে দুই দরবেশ। দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে থাকায় তাদের ক্লান্তি ধরেছে। যখন ওরা পরস্পরকে অতিক্রম করতে গেল, তখন দুজনেরই হঠাৎ বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে আসল।
ওরা পরস্পরের অতিক্রমের দিকে উৎকণ্ঠার সাথে তাকাল, আর ভাবল, মানুষ শরীরের এমন গন্ধ হয়?
সব পথের গন্তব্যগুলোতে যেমন একজন মুর্শিদ থাকেন, দুই দরবেশের পথও একজন মুর্শিদের দরগাতেই শেষ হল। রাস্তাটি হল একটা বৃত্তের মত, যেখানে পথগুলো একটি মধ্যবিন্দুতে আইসা শেষ হয়। বিন্দুটি হল সেই দরগা। ভ্রমণ, ক্লান্তি, মানুষ ও গন্ধের অস্বস্তিকর স্মৃতি নিয়ে তারা দরগায় ঢুকল। ঢুকেই আবার দুজনের মুখোমুখি দেখা আর দুজনেই আঁতকে উঠে নাকে জামার আস্তিন চেপে ধরল, যাতে অভিজ্ঞতাটা তাদের কিছুক্ষণ আগের স্মৃতির মত না হয়।
মুর্শিদ বললেন, তোমাদের চোখে মুখে এত অস্বস্তি কেন?
দুজন দুজনের দিকে ইশারা দিয়ে দেখাতে চাইল।
মুর্শিদ তা দেখে হাসলেন এবং বললেন, তোমরা হাত সরাও। সহজ হও।
ওরা অস্ফুটে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল।
মুর্শিদ স্নেহে কাছে এসে হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, এইবার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নাও।
দুজনেই দেখল, এক অদ্ভূত সুরভি জুড়ে আছে সবখানে। এমন কি অপর দরবেশের গায়ের থেকেও, সুরভিগুলো দৃশ্যের মত নাচছে।
তারা মুর্শিদের দিকে তাকাল বিস্ময় নিয়ে।
২.
মুর্শিদ তাদেরে নিয়ে দরগাহ থেকে বেরুলেন আবার। যে দুটি পথে তারা এসেছিল, সেই পথগুলো দেখিয়ে বললেন, তোমরা দুজন আবার দুদিক থেকে হাঁটতে থাক। চক্ষু কর্ণ খোলা রাখবে।
ততক্ষণে রাত প্রায় দ্বিপ্রহর। দুই দরবেশ আবার হাঁটতে লাগল। রাত ফরসা করে আদধেক চাঁদ উইঠা গেছে ততক্ষণে। তাই তাদের হাঁটতে তেমন অসুবিধা হল না। হাঁটতে হাঁটতে যখন একটা রাতপাখি ডাইকা উঠল, তখন তাদের সম্বিৎ এল। তারা আবার সেই গন্ধ পেতে থাকল। তাদের অস্বস্তি শুরু হল। গন্ধটা স্পষ্ট হতে হতে তারা আবার পরস্পরের দেখা পেল এবং অস্বস্তির সাথে পরস্পরকে অতিক্রম করে দ্রুত চলে গেল।
এইবার দরগার দরজা দিয়ে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করতে গিয়ে দুজনেই ধাক্কা খাবার জোগাড়। কিন্তু মুর্শিদের কাছে যখন পৌঁছাল, আবার পুরো ঘর এবং দুই দরবেশ সুরভিতে ভইরা উঠল।
মুর্শিদ এইবার তাদেরে দস্তরখান থেকে রুটি ও পানি খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বললেন এবং খুব ভোরে ওঠার জন্য বললেন।
৩.
শ্রান্তিহরণ ঘুম হল দুজনের। ঘুম ভাঙার পরে তারা আবার মুর্শিদের কাছে এল।
তখনো প্রায়ান্ধকার। প্রত্যুষ তখনো ফুটবে ফুটবে। মুরশিদ তাদেরে নিয়ে আবার বেরুলেন। এইবার একটা তৃতীয় পথ দেখালেন। বললেন, তোমরা এই পথ দিয়েই হাঁটবে।
পথটা নতুন, কিছুটা অন্যরকমও। দরগায় ঘুমের মত, এই পথের পরিপার্শ্ব , মাটি ও ঘাসও কেমন শ্রান্তিহারক মনে হল ওদের। ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারা এই পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে তারা কিছু মানুষের ঘর বসতি আর গাছপালা অতিক্রম করল। কিছু তারার জটলা দেখে দাঁড়াল পথে। তারাগুলোকে নিয়ে ভাবল। প্রায়ান্ধকার থেকে আলো ফুটছে আস্তে আস্তে। ক্রমে, আরো কিছুক্ষণ পর, ভোর ফুটল। ভোরের পাখির কিচির মিচিরও শুনতে পেল তারা। আগের পথের তাড়াহুড়োগুলো নেই। তাদের মনে প্রশান্তি এল। গল্প, পরিচয় ও সম্পর্ক হল। তাদের মধ্যে আরো কিছু আলাপ হল। যেমন, তারা তাদের আগের রহস্যময় যাত্রা এবং গন্ধের স্মৃতির কথা বলল, যা এখন মনে হচ্ছে অলীক, হাস্যকর। তারা তাদের রাস্তাগুলোর এই অদ্ভূত চরিত্রের আলাপও করল, যেখানে সব পথ মুর্শিদের দরগায় আইসা শেষ হয়। সব কিছুর পরে তাদের মনে হল, মুরশিদ এমন অনেক কিছু জানেন, যা তারা জানে না। তাই তারা নীরব ও নৈঃশব্দরেই শ্রেয় ঠিক করল। পরে, এক সময় আর সব পথগুলোর মতই এই পথ ধরেও ওরা মুর্শিদের দরগায় ফিরে আসল।
মুর্শিদ এবার তাদেরে তাদের ভ্রমণের বর্ণনা দিতে বললেন।
দুজনই তাদের আনন্দময় ভ্রমণের বর্ণনা দিল।
বর্ণনা শুনে খুশি হলেন মুর্শিদ। এবার একটু বিশ্রাম নিয়ে তাদেরে আবার আগের পথটিতে হাঁটতে বললেন। বললেন, চক্ষু কর্ণ খোলা রাখবে।
৪.
তারা অবাক এবং ত্রস্ত হল। মুর্শিদকে তারা অস্ফুটে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু থামল। গতকাল যখন এই পথ দিয়ে আসছিল, তখন তাদের সেই পথের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। নতুন যে পথ ভোরে মুর্শিদ চিনিয়েছিলেন, সেই পথ কত সহজ। তাদের পরিচয়ও হয়ে গেল। কিন্তু মুর্শিদের দেখানো পথই তাদের পথ। তারা প্রশ্ন না করারেই শ্রেয় মনে করল আর হাঁটতে শুরু করল, দুইজন দুই পথে, কিছুটা মনোভঙ্গ নিয়ে।
হাঁটতে হাটতে এবার সূর্য দ্বিপ্রহর। খরতাপ। গাছের ছায়া এবং তার ফাঁকে রোদ আর বাতাসও যেন গরম হলকার মতো। সময়টা গ্রীষ্মকাল। একটা ঘুঘুর ডাক শোনা গেল। ক্লান্ত হতে হতে তারা হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে সামনে তাকিয়ে আবার একজন আর একজনকে দেখতে পেল এবং সেই পুরনো গন্ধ এবং অস্বস্তিকর স্মৃতি তাদেরে জেঁকে বসতে চাইল। কিন্তু যেহেতু তাদের পরিচয় ও আলাপ হইছিল পূর্বে, তারা দাঁড়াল। এইবার তারা পরস্পরকে দ্রুত অতিক্রম করতে গেল না। থামল।
চারপাশে জড়ো হচ্ছে অস্বস্তির নর্তকি। গন্ধ হামলে পড়ছে। কিন্তু তারা পালাল না।
তখন, হঠাৎ দেখে, মুর্শিদও তাদের সামনে হাজির।
মুরশিদ তাদের দিকে তাকালেন আর হাসলেন। সম্ভবত অস্বস্তি টের পেলেন। বললেন, এইবার তোমরা আমার পেছন পেছন আস।
দুই দরবেশ অবাক হলেও চুপ থাকল। তারা অদূরে রাস্তার প্রান্তে হাজির হল মুর্শিদের পিছু পিছু। দেখা যাচ্ছে, যত প্রান্তে যাচ্ছে, তত তাদের অস্বস্তি প্রবল হচ্ছে।
পরিশেষে একটা নর্দমা দেখা গেল।
তখন মুর্শিদ বলল, তোমাদের যে অস্বস্তি, তার উৎস বুঝতে পারলে?
দুজনেই লজ্জিত হয়ে মুখ নিচু করে ফেলল।
৫.
মুর্শিদ একটি বহুশাখাপ্রসারিত গাছের ছায়ার নীচে বুনোঘাসের উপর তাদেরে বসতে বললেন এবং নিজে বসলেন, মুখোমুখি। দূরে, সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে তখন। মুর্শিদ বলে চললেন, মানুষের একটা স্বভাব হল, গুবরে পোকা বা শুয়োরের মত। যখন আত্মমগ্ন থাকে।
দুই দরবেশ মাথা নুইয়ে চুপ থাকল।
: এই পথটা তো তোমাদের প্রিয় ছিল। তোমরা এই পথেই হাঁটতে সব সময়।
দুই দরবেশ মাথা আরো নুইয়ে নিল।
: এই পথের একটা চরিত্র হল, এর নানান বিভঙ্গ আছে। যে বিভঙ্গগুলোর অন্তে আছে নর্দমা। আর নর্দমার স্বভাব হল গন্ধ, অস্বস্তি। এতক্ষণ তোমাদের সেই অস্বস্তিই হতেছিল। যেহেতু সহজ চেনা নেই তোমাদের, এই অস্বস্তির পথগুলোই তোমরা কেবল চিনতে। এর কারণ হল শুয়োর বা গুবরে পোকার মত অন্তর্গত অনীহা। ফলে, তোমরা এই গন্ধের উৎস বুঝতে পার নাই, যেভাবে গুবরে পোকা বা শুয়োর কাদা ও গোবরের গন্ধ পায় না।
মুর্শিদ কথা বলছেন আর একটা বুনো শুয়োরের জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে গোঁতগোঁত কইরা সরে যাওয়ার আওয়াজ শুনল দুই দরবেশ।
: যেহেতু তোমরা কেবল এই জটিল বিভঙ্গের পথটিরেই চিনেছ, পরের বার আমি তোমাদের সহজ ও তৃতীয় পথটি দেখালাম। ফলে তোমাদের পরিচয় হতে পারল।
দুই দরবেশ পরস্পরের দিকে তাকাল আবার।
: প্রথম দুবার তোমরা চঞ্চল ও কেবল আত্মমগ্ন গুবরে পোকার মত ছিলে। তাই তোমাদের কাছে পথ আর পথের সত্যরূপ ধরা দেয় নাই।
দুই দরবেশ মাথা নুইয়ে চুপ থাকল।
: আর পথ মানে তো এর নানান বিভঙ্গ থাকবে। নর্দমা, জঞ্জাল থাকবে। তোমাদেরকে চক্ষু, কর্ণ খোলা রাখার কথা বলেছি প্রত্যেকবার, যাতে পথের জঞ্জাল সম্পর্কে সম্বিত তোমাদের থাকে আর তা এড়িয়ে চলতে পার।
দুই দরবেশ আবার সম্মতিতে মাথা নাড়ল।
: কিন্তু প্রত্যেকবারই পরস্পরকে অতিক্রমের সময় বুনো শুয়োর তোমাদেরকে এমনভাবে জেঁকে ধরেছে, তোমাদের যে চক্ষু-কর্ণ ও বাছবিচারের জ্ঞান ও সম্বিৎ দিয়েছেন প্রভু, তা ব্যবহারের কর্তব্য ভুলেছ।
৬.
মুর্শিদ কথা বলছেন আর অনেকগুলো বুনো পাখির মিষ্টি শিস উড়ে এল দূর থেকে।
: এই হল অহম। সেই বুনো শুয়োর, কাদায় গড়াগড়ি দেয়া ছাড়া যার মোক্ষ হয় না। তোমাদের অন্তরের সীলমোহর। যেহেতু চোখ বন্ধ করে এই পথরেই বেছে নিয়েছিলে, তোমরা সুরভিরে চিনতে পার নাই। কেবল পাশে পইড়া থাকা পথের বিভঙ্গগুলোরেই পরস্পরের রিয়েলিটি ভেবেছ।
একটা দমবন্ধ বাতাস একটা বড় শকুনের পাখা ঝাপটানির ক্লান্তির মতো দূরে সরে গেল।
: কিন্তু, দেখ, সত্য হল তাই, যা তোমরা ভুলে থাক এবং অতিক্রম করে যাও। এই নর্দমা হল তোমাদেরই আয়না। মূলত তোমরা নিজেদের আত্মকেই দেখ। এইখানে তোমরা সেই আত্মমগ্ন শুয়োর বা গুবরে পোকা। ফলে তোমাদের সত্যাগ্রহি হৃদয় বন্ধ ছিল। তোমরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময়টি নাও নাই।
একটা হলুদ পাখি অস্ফূট স্বরে ডাইকা দূরের একটা গাছের ঢালে বসল।
: আগেরবার যখন সহজ পথে বেরুলে, তখন তোমাদের বন্ধের মুক্তি ঘটল। তোমাদের অন্তরের মোহর খুলল। তাই তোমরা এইবার তাড়াহুড়ো কইরা অতিক্রমের চেয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে চাইলে। ফলে, তোমরা পথরে চিনতে পারার জন্য প্রস্তুত হলে। এতদিন তোমরা পথের বিভঙ্গগুলোরেই সত্য ও পথ ভাইবা বসেছিলে, আর তার আয়নাতেই তোমরা অপরকে দেখতে ও বিচার করতে। তোমাদের পরস্পরের পরিচয় ঘটত না। তোমাদের ইন্দ্রিয়, চক্ষু ও হৃদয় তখন কালো অবগুণ্ঠনে ঢাকা ছিল, যা মাত্র খুলতে শুরু করল।
৭.
মুর্শিদ কথা বলছেন, আর অস্বস্তি মুছে আস্তে আস্তে বুনো জুঁই ফুলের বাগান হয়ে উঠতে লাগল পরিপার্শ্ব। হলুদ সূর্যের আলো নরম আর কমলা হয়ে উঠতে লাগল, আর চারপাশের গাছগুলো শ্রান্তিহারক ছায়া হয়ে উঠতে উঠতে ঝিরঝিরে বাতাস দিতে লাগল।
দুই দরবেশের সামনে সুরভি নেচে ওঠল আবার।