হিমু বৃষ্টিতে ভিজছে। হিমুর হাতে ছাতা নেই। ছাতা পড়ে গেছে। দৃশ্যটি ভাবুন।
অপমান একটি ‘পাতি বুর্জোয়া’ ভাব। অপমানে বৃষ্টিতে ভেজাও যেমন। এইটার খারাপ-ভালর ব্যাপার না, সুবিধাবাদী দিকটি ধরিয়ে দেওয়া। ছোটলোকের তো অপমান থাকে না। তাই চড়ের বিপরীতে থাপ্পড় দিতে দাঁড়িয়ে যায়। যেইটারে আপনি অপমান বইলা মহৎ করেন, তারে সে জবাব দিতে তৈরি থাকে। বৃষ্টিতে ভেজে না।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘শিক্ষক সমাজের অপমান’ নিতে না পারাও তেমনি। যেন ছোটলোকের পৃথিবীতে আপনি মহৎ হিশেবে দাঁড়িয়ে আছেন। সে এমন ভান, যা সামান্য টানাহেঁচড়ায় ঝুর ঝুর কইরা ভেঙে পড়ে।
কিন্তু ধরুন, এইটা যখন শিক্ষক সমাজের ব্যাপারও না হয়ে স্রেফ পরিবারের অপমান প্রশ্ন। যখন আরো ছোট থেকে ছোটতর আপনার পৃথিবী। সেই আলাপ কি করা লাগবে? পরিবারও গুরুতর বটে, কিন্তু আপনি তো জড়-বিশেষ ছিলেন, যখন পুরো বটগাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছিল, সবখানে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও, যদিও, জড়ই। বৃষ্টিতে ভেজেন, জড়ের মতো। যেন আর কোনো অনুভূতি সচল নেই। স্রেফ বৃষ্টিতে ভেজা।
শিক্ষকদের অপমান তো কত হইছে, তখন তো এই হিমুগিরি হয় নাই।
অপমানের এই ধরন জয় বাংলার নামে এতদিন চর্চা হয় নাই, বা ওইখানে অপমানই করা হইছে, এই ভানটা আপনার শ্রেণীগত আত্মসম্মান সঙ্গীত। ভণ্ডামি বিশেষ।
আসলে আপনাদের, মানে শিক্ষকদের পিটানো হইছে বা টানাহেঁচড়া করা হইছে, তারে আপনি অপমান নাম দিছেন। তারপরে সবকিছু ঝেড়ে পুছে উঠে যাওয়া, যেন কিছু হয় নাই, শুধু একটু অপমান, এমন। অপমান ও পিটুনি তো দেদারছে হয়। আরো কত কিছুই হয়। জয় বাংলা বইলাই হয়। সব জাগাতেই হয়ে আসতেছে। আপনি তাদেরে বাহবা দিছেন, এইবার আপনার ছাতা পইড়া গেল, এই যা। ছাত্রলীগ, জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এইসব তো আপনার ছাতাই, পইড়া এবার ধুয়ে মুয়ে গেল।
তা যাক। এইসব ধুয়ে মুয়ে আপনিসহ যদি একবার সত্যিকার বৃষ্টিতে ভিজতে পারলেন, অপমান তো ছোটা বাত হ্যায়।
২.
ছাতা পাশে রাইখা আপনি ভিজতেছেন। এই দৃশ্য মহাকাব্যিক বটে। আপনারে তো ছাতা ছাড়া কখনো দেখা যায় নাই। এই দৃশ্য দেইখা আমাদের ছাতার কবি-সাহিত্যক ও বিপ্লবী বন্ধুরা আবেগী হয়ে পড়ছেন। তাদের অনেকেই ছাতা মাথায় লইয়া আপনারে দেখতে আসছেন।
এটি দারুণ অর্থ উদ্রেকী দৃশ্য বটে।
যার নিচে বা যে ছাতা আপনি এতদিন মাথায় কইরা হাঁটতেন, ছাত্রলীগ, বা জয় বাংলা, তারে আপনি মুড়ে রাখলেন। যেন আপনার সার্বভৌম ইচ্ছের প্রতিফলন। আপনিই ছাতা বন্ধ করছেন।
আসলে ছাতা তো আপনারেই বন্ধ করছে। আপনি না।
আপনারেই ছাইড়া গেছে ছাতা। আপনি ছাতার অবিবেকী দাস মাত্র, আর কিছু না। আগেও যেমন ছিলেন, এখনো।
যেমনি ছাতাটা পইড়া গেল, তখনই আপনার ‘রশিতে ঝুইলা মরতে’ ইচ্ছে হল। আর আপনি ছাতাটা মুড়ে পাশেই রাখলেন, যেন হারিয়ে না যায়। কাল সকালে যখন রোদ হবে, বা বৃষ্টি, আবার জমবে মেলা, ছাতার সাথে।
এই মরণেচ্ছাও ক্ষণিকের। তাই আপনার বন্ধুরাও ছাতা ছাড়েন নাই।
৩.
আপনি ছাতা নিয়া বৃষ্টিতে ভিজলেন।
যেহেতু আপনার অপমান হয়েছে। পত্রিকা বলছে, লজ্জায়, অপমানে। ‘গলায় দড়ি’ দেওয়ার কথা বললেন।
হুমায়ুনশাস্ত্রমতে, হিমুদের অপমান থাকে না। তারা অপমানে ভিজে না, এমনি এমনি ভিজে।
যেমন, গলায় দড়ি দেওয়া একটা হীনমন্য ব্যাপার, হিমুদের তো নিষিদ্ধই।
প্রতিবাদে দাঁড়াবেন, কিন্তু পিটালে গলায় দড়ি দিতে চাইবেন, এইটা হিমুশাস্ত্রে অভব্যতা।
বা, অভিমানরে জিহাদ বইলা চালাইতে চান কেন?
ছাত্রলীগের সাথে ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলা দরকার মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আপনার। ছাতা একটি মহীরুহ ব্যাপার। গতকাল যেমন বুঝতেন, এখন যেমন বোঝেন, আগামীকাল সকালেও তা বুঝতেই থাকবেন। ছাতা তো ছাতাই। ছাতার সাথে ঝামেলা পাকানোর কী মহিমা? ছাতাটা খুলে, আবার মাথায় নিয়ে, হাসবেন তো জাফর ইকবাল?
৩.
অথবা, আমরা আপনার, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিরে উদযাপন করতে পারি।
রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ বা লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের যে সংকট, তা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সংকট বলা যাইতে পারে। আমাদের তরুণদেরে এই কল্পকাহিনী উৎরাতে বলছি আমি বহুদিন ধইরা।
খবরে প্রকাশ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক জাফর ইকবাল এখন একজন ‘নাস্তিক ব্লগার’ও বটেন, সিলেট শহর আওয়ামীলীগের মতে। ‘সিলেটে জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের মিছিল, ‘ব্লগার’ অভিহিত করে অবাঞ্ছিত ঘোষণার হুমকি (ভিডিওসহ)’— একটি অনলাইন পোর্টালের এমন শিরোনাম দেইখা সম্ভবত জাফর ইকবাল তার যাবতীয় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ভুইলা গিয়া ভিমড়ি খাবেন।
হাহা, জাফর ইকবাল এন্ড তাঁর অনুগামী মিডিয়া শাহবাগের সময় বলেছিল, ব্লগ কী বস্তু তা হেফাজতের শিশুরা জানে না, তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, জাফর ইকবালের প্রিয় আওয়ামীলীগের কিশোররাও জানে না। নাকি জানে? কে ভুল বোঝাল?
সে যাই হোক, আমরা জাফর ইকবালের এই আপাত/ক্ষণিক মুক্তিরে উদযাপন করতে পারি। এবং এই ‘ব্লগার’ জাফর ইকবালের জন্য, তার পক্ষে দাঁড়ানোর জরুরি কাজটিও করতে পারি। আপাত সময়ে। সামনের বৃষ্টিতে জাফর ইকবালের ছাতা না দাঁড়ানো পর্যন্ত।