গ্রন্থটি আজ পাঠকদের হাতে আসবে। আমাকে প্রকাশকের পক্ষ থেকে জানানো হইছে। একটু আগে আমিও পেলাম এক কপি।
ততক্ষণ আর একটু ভাবতে পারি, গ্রন্থটি পাঠকের হাতে আসতে আসতে।
যেমন অনেক বন্ধু পরামর্শ দিছিলেন, যেন শাহবাগ ও হেফাজত কেন্দ্রিক লেখাগুলো এক জায়গায় এনে একটি বই হয়। তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে, কেন শাহবাগকে কেন্দ্রে রেখে আমি বই করলাম না, অথচ শাহবাগকেন্দ্রিক আমার সব লেখালেখিগুলোই এখানে আছে, তার কারণ সম্পর্কে আলাপ আসতে পারে, শেষ মুহূর্তের জন্য।
এর একটা কারণ হতে পারে, শাহবাগমুগ্ধ ও প্রভাবিত যে পপুলার বয়ান, আমি তারে বিভ্রম বলি ও প্রশ্ন করি। শাহবাগের আজান নামের আমার একটা লেখা আছে, যা এই বইয়েও আছে। ওখানে আমি এই বিভ্রমটা কীভাবে আমাদের তরুণদের একটা অংশকে প্রভাবিত করেছে তার বিবরণ দিয়েছিলাম, সেই বিভ্রমের সময়েই। আমি একজন বুদ্ধিজীবী হিশেবে এর বাইরে থাকাটারে নিজের কর্তব্য জ্ঞান করেছি। আর একটি কথা হলো, আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মিষ্টি শাহবাগ বয়ান। এটি একটি ব্যর্থতা ও হীনমণ্যতার বয়ান মনে করি আমি। এর মধ্যে একটি বর্ণবাদী মনও লুকায়িত আছে। সে সম্পর্কে আমরা আমাদের লেখাগুলোতে বলেছি। আমি শাহবাগকে একটা বুদবুদ মনে করি। যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদেরকে আরো অনেকদিন শাহবাগের গান গেয়ে যেতে হবে, কারণ এটাই তাদের শ্রেণী ও অক্ষমতা। এর বাইরে যাওয়ার জন্য যে উদারতা ও সংস্কৃতি, তা তাদেরর মধ্যে অনুপস্থিত। তাই মিষ্টি শাহবাগ আলাপে একটা সাংস্কৃতিক গাম্ভির্য্য ধরে রাখার চেষ্টা আছে, আত্মাভিমানে। আমি অত্যন্ত সচেতনভাবে এই আত্মাভিমানের অংশ না। শাহবাগে তারুণ্যের যে ফ্যাসিস্ট উত্থান ঘটেছে, শাহবাগকে দ্বিতীয় মুক্তযুদ্ধ বইলা যে বুদ্ধিজীবীতা, আমি তার ঘোরতর সমালোচক। এবং অত্যন্ত সচেতনভাবে বলতে চাই, আমি হেফাজতেরও অংশ না। আমি ইতিহাসকে শাহবাগ বা হেফাজত থেকে শুরু মনে করি না। শাহবাগ একটা বিভ্রম তৈয়ার করেছে, আমি এই বিভ্রমে থিতু হওয়াটারে আমার কর্তব্য জ্ঞান করি নাই। শাহবাগ ও হেফাজত বিষয়ে আমার সব লেখাগুলোই এখানে থাকা সত্বেও, শাহবাগ বা হেফাজত ব্যবসায়ের বাইরে থেকে এই বইকে দেখা প্রয়োজন বইলা আমি মনে করি।
বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে বলা কথাগুলো
বই সম্পর্কে এক কথায় বলা মুশকিল। আমার বিভিন্ন সময়ের লেখালেখিগুলোর নির্বাচিত সংকলন বলা যায়। ভূমিকায় বলেছি, এই বইয়ের লেখাগুলো ইতিহাসের ভেতরে বসে, ইতিহাসের নামতা গুণতে গুণতে, সেই ভ্রমণের অংশ হিশেবেই লিখিত হইছে। ফলত এইসব লেখা ইতিহাসের সাথে লেখকের ডায়লগ ও বোঝাপড়ার অংশ। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিকতার দিক থেকে বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে বিকার ও সংকট উপস্থিত, তার একটা বাছ-বিচার করার চেষ্টা করেছি বইটির ভূমিকা ও অন্যান্য লেখালেখিতে। কর্তব্য, নীতি, দর্শন ও সমাজতত্ত্বের দিক থেকেও আলাপ তোলার চেষ্টা আছে। কোন পাঁড় একাডেমিক আলাপ নয়। ডায়লগ ও সম্পৃক্ততার জায়গায়, নিরন্তর বোঝাপড়া তৈরির জার্নি বলতে পারেন। আমার কয়েকটি গল্প ধরণের লেখাও এ বইয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফির মত কিছু আলাপও এ বইয়ে এনেছি। বন্ধুদের সাথে কথোপকথনও আছে। আবার, শাহবাগ ও হেফাজত বিষয়ে আমার সব লেখাগুলোই এখানে আছে। কারণ ফর্ম নিয়ে আমি ভাবি নাই। আমি সম্পর্কসূত্র ভেবেছি। নাম প্রবন্ধটি এ ক্ষেত্রে সূত্র হিশেবে ভাবা যেতে পারে- সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি।
ফ্ল্যাপের লেখা
সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি একটা জরুরি ভাব। আলাপে অগ্রসর হবার জন্য এই ভাবটি গ্রহণ করেছি আমরা। মানুষ হিশেবে প্রথমত নিজের অস্তিত্ব এবং অপর, তার বরাতে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি যার মধ্যে প্রতিদিন আমরা জারিত হই, লেখালেখি, বুদ্ধিজীবীতা ও নন্দন চর্চা করি, এইসবের একটা বিচার বিবেচনা খাড়া করার কর্তব্য পালন। আমরা বলেছি, রাজনীতি হলো সম্পর্কের জ্ঞান। এবং মুআমিলাতেই রাজনীতির প্রকাশ ঘটে। সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির এই ভাব থেকেই এই বইয়ের আলাপ ও প্রসার। এই বইয়ে আমাদের আলাপের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, আরো বিশেষভাবে বললে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকলেও, মূলত সেই সম্পর্কসূত্র বোঝাপড়ার সাধনা। আমরা যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর ভিত্তিতে নাগরিক হিশেবে আমাদের কর্তব্য নিয়ে কথা বলি, তখনও এই সম্পর্কসূত্র থেকে বলি। তার অংশ হিশেবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন, ক্ষমতা, সংবিধান, গণ-আকাঙ্ক্ষা, নাগরিকতা, ভায়োলেন্স, জাতীয় স্বার্থ এইসব বিষয় আলাপের প্রয়োজনে ঘুরে ফিরে হাজির থেকেছে। (সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা থেকে)
বইয়ের ভূমিকা থেকে আরো এক প্যারা..
ভূমিকা অথবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ ও অন্যান্য
..বলছিলাম, রাষ্ট্র নেই। আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। যেমন ‘আমার সোনার বাংলা’। মানে রাষ্ট্র-কল্পনা। কমিউনিস্টদেরও একটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় কল্পনা আছে, রাষ্ট্র নেই, ‘রাষ্ট্র শোষক শ্রেণীর বল প্রয়োগের হাতিয়ার’ ইত্যাদি। কল্পনা বলছি, কারণ এই রাষ্ট্র থাকা না থাকার শর্তগুলো, তার ‘বলপ্রয়োগ’ ইত্যাদি বচনে অভিমান আছে, রাষ্ট্র নিয়ে বোঝাপড়া নেই। এই রাষ্ট্র কখন থাকে, তার ভিত্তিও কল্পনা। যেমন ধরুন, জাসদের নেতা কর্মী মরেছে একাত্তর পরবর্তীতে, সেজন্য রাষ্ট্র নেই। রাষ্ট্র খারাপ। রাষ্ট্র নিপীড়ক। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবু রাষ্ট্র নেই। মূলত, এইসবও বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মতই কল্পনা বিলাস। এই রাষ্ট্র নেই তত্ত্ব কম্যুনিস্টদের মনোজগত একটি রোমান্টিক ভাবালুতায় ভরে রাখে। এই কল্পনা কতটা ভাবালু তা টের পাওয়া যায় দুটি ঘটনায়। এক. বাংলাদেশ বিপ্লবের পরে শেখ মুজিবুর রহমানের গণবিরোধী বাকশাল গঠনের ঘটনায় কম্যুনিস্টদের একটি গোষ্ঠীর সরাসরি অংশগ্রহণ এবং মুজিবুরের সব রকম রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের সহায়ক ভূমিকা পালন করা। আবার, বর্তমান সময়ে এসে শেখ মুজিবুর রহমান কন্যা শেখ হাসিনার সরকারে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন বিপর্যয় মুহূর্ত তৈরিতে সেই সময়কার নির্যাতিত কম্যুনিস্টদের বর্তমান ভূমিকা। মানে, জাসদের নেতা কর্মী মরেছে, সেজন্য রাষ্ট্র খারাপ। প্রগতিশীল মরলে রাষ্ট্র খারাপ। আর মৌলবাদী মরলে? তাদের কোন কোন বুদ্ধিজীবী বলছেন, প্রয়োজনে লাখ লাখ লোক মেরে ফেলতে হবে, দেশ মৌলবাদমুক্ত করার জন্য। এইজন্য দেখা যায়, সাতক্ষিরায় বুলডোজার দিয়ে, বাড়ি-ঘর ভেঙে আসামি ধরতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। মতিঝিলে প্রকাশ্য জনসমাবেশের উপর সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তার জবাব দিতে হয় না। রাষ্ট্র ঠিক থাকে, কম্যুনিস্টদের কল্পনায়। মূলত রাষ্ট্র কোন কালেই ছিল না। তখনও না, এখনও নয়।..
অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা
লেখক যখন লেখেন এবং তার জনসমক্ষে ‘প্রচার’-এর আস্পর্ধা ঘটান, তখন একটা দায় নিয়েই লেখেন। এইটা রাজনীতি সম্পর্কে লেখকের নিজের সম্বিৎ-জ্ঞান, একে ঠাহর ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা উদ্ভূত। এই কাজের জায়গা থেকে লেখক হিশেবে আমার একটা অপেক্ষা ও আহুতি আছে। আপাত এটাই অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা।
সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি
দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৪
প্রচ্ছদ: শফিক শাহীন
পৃষ্ঠা: ২২৪
মূল্য: ৫০০ টাকা
পরিবেশক: বাঙলায়ন
বইমেলায় স্টল নং: ২৩৫-২৩৬
উৎসর্গ: শহীদ দর্জি বিশ্বজিত কুমার দাস। ঋষিকেশ দাস লেন (ডিসেম্বর ২০১২)
হরতালকারী সন্দেহে রড-চাপাতিতে উপর্যুপরি আঘাত ও কুপিয়ে বিশ্বজিত দাসকে খুন করা হয়, পুরান ঢাকার রাস্তায়।
আবার মৃত্যুর পরে হিন্দু বা ‘সংখ্যালঘু’পরিচয়ে বিশ্বজিতের মানবিক পুনরুত্থান ঘটে হত্যাকারীদের কাছে।
এই উৎসর্গ যুদ্ধাপরাধ বিচারে জামায়াতেরশহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা বা ফাঁসি চাই আন্দোলনে শাহবাগের শহীদ রাজিব বা শাপলা চত্বরে হেফাজতের শত শত, মতান্তরে ৫৯ বা সরকারি হিশাব মতে ৪ শহীদ বা এইসব ঘটনা প্রবাহে আর আর সব শহীদ সাধারণ- তাদের কাউকে না কাউকে দেয়া যেত। কেন বিশ্বজিতকেই দিলাম, তার কারণ আরআর শহীদদের ব্যাপারে কথা কওয়ার যে দায় ও ঝুঁকি, বিশ্বজিত নামের মধ্যে তা অনুপস্থিত।বিশ্বজিতকে শহীদ বলা এবং এ খুনের অনায্যতা ও বিচার চাওয়ার ব্যাপারে তার খুনিপক্ষ আওয়ামী-ছাত্রলীগসহকুটনৈতিক বিশ্ব, সুশীল সমাজ, কমিউনিস্ট, জামায়াত-বিএনপি-হেফাজত সবাই খোলা দিল। এই খোলাদিল ও কখনো বেহুঁশ থাকার যে রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবীতা, তারে চিহ্নিত করার সহি মুহূর্তবিশ্বজিত কুমার দাসের হত্যাকাণ্ড।