Articles, Blogs

রিফাত হাসান

আরজ আলী মাতুব্বরের দোকান, হলি বেকারি ও ইন্ডিয়া

December 1, 2023   0 comments   12:15 pm
Saturdayafternoon 2020

‘জঙ্গি’ গল্পে বাংলা সিনেমা কীভাবে, কোন বয়ানে নিজেরে হাজির করে, তার আগ্রহ আছে আমার। ফারুকি তো এখন সিনেমা নিয়া বিশ্বময় ঘোরেন। জঙ্গি নিয়া আন্তির্জাতিক যে বয়ান, তার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে জঙ্গি বয়ান, একই সাথে একটি জঙ্গি ব্যবস্থা হিশেবে যে রাষ্ট্র জগদ্দল হাজির, তারে ফারুকি কীভাবে হাজির করতে চান, তার আগ্রহ।

Share

হলি আর্টিজান নিয়ে সিনেমা হবে, তাই বেশ আগ্রহ ছিল। এই সিনেমার কথা যখন শুনলাম, তখন বোধ হয় ‘হলি বেকারি’ নাম প্রচারিত হইছিল। তখনই সিনেমাটা নিয়া আগ্রহ জানাইছিলাম, সোশাল মিডিয়ায়। ফারুকির প্রতি আগ্রহ, এই সাধারণ কারণের চাইতে, হলি আর্টিজানের ঘটনারে কেন্দ্রে রাইখা সিনেমা, এই কারণটাই মূখ্য ছিল। সেই সময়ে, টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা নামের লেখায়, যেটি পরে একই নামের বহিতে মুদ্রিত হইছিল, আমি কইতেছিলাম, ‘গুলশান ঘটনার পরের বাংলাদেশের সাথে তার আগের বাংলাদেশের ব্যাপক তফাত থাকবে। নাইন ইলেভেনের পরের দুনিয়া যেমন আলাদা দেখা যায়, ঠিক তেমনই।’[1] আলাদা, কারণ, এর পরে পশ্চিমের ফিকশন ও গল্পগুজবের বয়ানগুলোর চাইতে তাদের বয়ানে একটা ‘জঙ্গি রাষ্ট্রে’র ভেতর থেকে বাকি দুনিয়ার রাজনীতিরে আমরা কীভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষমত, তার আলাপের জরুরত হবে। এর চিহ্ণ ও ইশারা বহুত দিন ধইরা আকেলমন্দরা দিয়াও আসছিলেন, এই ঘটনায় ইশারাটা জগদ্দল হাজির নাজের হইয়া বিদ্যমান হল মাত্র। ফলে, আমরা হঠাৎ জম্পেশ জঙ্গি গল্পে ঢুকে পড়েছিলাম। তাই, এইসব নিয়া সিনেমা, সাহিত্য হবে, এইটাই স্বাভাবিক।

P24146622 i h10 aa

সমস্যা হল, বাংলাদেশে পলিটিক্যাল ইভেন্টগুলোকে ডিল করতে পারার মত মেচিওরিটি, প্রজ্ঞা ও সাহস কোনটাই সাহিত্য ও শিল্পজগতের নেই। তাদের চিন্তা ভাবনা ও ভাষা কৈশোর না পেরুনো বালকদের মত। এইটা আমি উপন্যাস নিয়ে বলেছিলাম কখনো। আরো অনেক ক্ষেত্রে এইটা কওয়া চলে। রেহনুমা আহমদের একটা সম্পাদনা, বেশ আগের, ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন, পইড়া আমি একই অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম। আমি কইতেছিলাম, একাডেমিক লোকজন, বা একাডেমিক একটিভিস্টদেরও লিমিট হইল নিজের সময় ও স্থানকে ডিল করতে, মুখোমুখি ও পর্যালোচনা করতে সক্ষম না হওয়া, এড়িয়ে যাওয়া। এই বহিতে রেহনুমা ইসলাম নিয়া সিলেকটেড সমকালীন চিন্তাগুলোর সংকলনের চেষ্টা করছিলেন, অনুবাদ। ইন্টারেস্টিং, দেখি, এইখানে রেহনুমা সারা দুনিয়ার ইসলামী চিন্তার চর্চাগুলোরে আলোচনায় এনেছেন। যেমন য়ুসুফ আল কারজাভিরেও এনেছেন, আবার আমেনা ওয়াদুদরেও এনেছেন (স্মৃতি থেকে বলছি, বইটি এই মুহূর্তে হাতের কাছে নেই)। কিন্তু বাংলাদেশে যে চিন্তাগুলোর প্রভাব, তার ঘরের দরজায়, যেমন আবুল আলা মওদূদি, সেগুলোর কোন আলাপ নেই। এই এড়িয়ে যাওয়ার মানে কী? পর্যালোচনারে ভয় পাওয়া? এইটা একই সাথে এলিটিজম, সুবিধাবাদিতা আর কুপমণ্ডুকতারে হাজির করে। একটি জান্তব সমস্যারে বহুদূরের স্রেফ একাডেমিক/সেমি একাডেমিক আলাপ হিশেবেই হাজির করে, মাটিতে নামতে ভয় পায়। তো, এই লেখালেখি ফর্মের সমস্যারও আগে কুপমণ্ডুক। সিনেমার সমস্যাও একই।

এই জাগায় ফারুকি যে হলি আর্টিজানের ঘটনারে নিয়া সিনেমা বানাতে চাইলেন, এইটা আগ্রহউদ্দীপক ঘটনা বটে। এই আগ্রহে, ফারুকির রক্ষণশীলতা কম।

ফলে, ‘জঙ্গি’ গল্পে বাংলা সিনেমা কীভাবে, কোন বয়ানে নিজেরে হাজির করে, তার আগ্রহ আছে আমার। ফারুকি তো এখন সিনেমা নিয়া বিশ্বময় ঘোরেন। জঙ্গি নিয়া আন্তির্জাতিক যে বয়ান, তার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে জঙ্গি বয়ান, একই সাথে একটি জঙ্গি ব্যবস্থা হিশেবে যে রাষ্ট্র জগদ্দল হাজির, তারে ফারুকি কীভাবে হাজির করতে চান, তার আগ্রহ। এর আগে, বঙ্গে নাইন ইলেভেনের প্রভাবে জঙ্গি বয়ান নিয়া তারেক মাসুদের সিনেমা হইছে, আমরা দেখেছি। রানওয়ে। তরল, অনেকটা মুখস্ত দেখার ভঙ্গি। আরো আগে বা পরের সিনেমা, ভারতের নকশাল আন্দোলন নিয়া বলিউডের ‘চক্রব্যুহ’ দেখছিলাম এক সময়। এই সিনেমায় রাষ্ট্রবিরোধী যে ‘জঙ্গীবাদ’— তার স্থানিক বয়ান হাজির আছে। ‘ইসলামী’ জঙ্গিবাদের সাথে অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থা নিয়া আমাদের যে রুচির তর্ক, যেমন নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি, তা সেই সিনেমায় এসে মার খায়, যখন দেখি, একজন গোপনে বিপ্লবীদের তথ্য পাচার করছে, সেজন্য প্রথমে তার কান কেটে ফেলা হল। তারপরে তাকে জবাই করে প্রকাশ্য জনসমক্ষে লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হল। এই দৃশ্যায়ন স্রেফ ইসলামে আইসা খাবি খাওয়াদের রুচিবাদরে প্রশ্নে ফেলতে সক্ষম।

Shonibar bikel

এই রুচি প্রশ্ন নিয়া আমি আলাপ করেছিলাম, টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা লেখায়। আসেন, পড়ি:

….

ফলত, এ বছরই, এক বন্ধুর সাথে আলাপের শুরু এরকম।

: কী সমস্যা?

: আইএস।

: আইএসে কী সমস্যা?

: বর্বর।

: কেমন?

: ওরা যেইভাবে জবাই করে।

: আপনার জবাইতে সমস্যা?

: হু।

: যদি অন্যভাবে মারা হয়? যেমন, গুলি করল। ধরুন, আপনার পরিচিত আধুনিক রাষ্ট্র, যেমন বাংলাদেশের পুলিশ, ওরা যখন ক্রসফায়ারে মারে?

: দুইটা এক হল?

: আপনার কীসে আপত্তি?

: জংলি ওরা।

: তলোয়ার দিয়ে মারে বলে?

: হু। এত নৃশংস কীভাবে হতে পারে, ভাইবা দেখুন?

: নৃশংস বটেই। কিন্তু আপনার বোধ হয় মারাতে আপত্তি নেই? শুধু একটু আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝামেলা!

: উহুহু। তাই কি বললাম। কিন্তু আইন তো দরকার।

: হু। আইন। আইন নিয়া আপনার ভাবনা হচ্ছে ‘দরকার’। আর কিছু?

: দরকার না?

: বটে। তাইলে দেখুন, আপনি আধুনিক রাষ্ট্রে একজন আসামীকে জল্লাদ দিয়ে দম বন্ধ কইরা ফাঁসিও দেন। আইনে।

: হু। ফাঁসি বন্ধ করা কি সম্ভব?

: হাঁ, আপনি এর সমর্থকও। আপনি তো ফাঁসি চাই বইলাই চিল্লান। এইটা কি নৃশংস বইলা ভাবেন না?

ডটডটডট।[2]

….

একই সাথে রাষ্ট্র হিশেবে ভারতের আলাপ ছিল সেই ছবিতে। ভালই। তো, বাংলাদেশও যখন জম্পেশ জঙ্গি গল্পে ঢুকে গেল, ভাবতেছিলাম, হলি আর্টিজানের পরের বাংলাদেশে ফারুকি এই আলাপ, এই রুচির তর্ক ও রাষ্ট্ররে কীভাবে সামলান? স্রেফ ‘জঙ্গী’ না, এইটা তো একই সাথে ‘ইসলামি’ জঙ্গীবাদও, যারে লইয়া আমাদের বহুত গীত গাওয়া আছে, ইতিহাসে এবং সাহিত্যে। রানওয়ে ছবিতে তারেক মাসুদের যে বয়ান তা ছিল সরাসরি আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ব্যবসার ফটোকপি। ফারুকির দেখা কীরকম— জানার আগ্রহ জানিয়ে রাখছিলাম তখন। এই আগ্রহ, ফারুকিরও নজরে পড়ছিল তখন। তিনি তার উত্তরে আমারে জানাইছিলেন, যে, তিনি ডিফরেন্ট পারসপেকটিভ নিয়া তার সিনেমায় কাজ করতে চান। ফ্যাক্ট না, ‘মাইন্ডসেটে’ আগ্রহ উনার।

২.

তো, এই ‘ফ্যাক্ট না, মাইন্ডসেটে’র সিনেমাটা যে শেষমেষ নাজেল হল, এইটা খুশির সংবাদ। যদিও, বাংলাদেশের সেন্সরবোর্ড ‘এই ছবির সাথে হলিআর্টিজানের ঘটনাপঞ্জির সম্পর্ক নেই’, এই ডিসক্লেইমার দেওয়ার শর্তে ছবিটা ছাড় দিতে রাজি হইছিল, সাংবাদিক ও সেন্সর বোর্ড সদস্য শ্যামল দত্তর বরাতে জানছিলাম। শেষমেষ, হলি বেকারি যদিও, শনিবার বিকেল নামে হাজির হল, প্রথম সুযোগেই দেখলাম। ইন্ডিয়ার ভার্সনটাই, যেখানে এরকম কোন ডিসক্লেইমার নজরে পড়ল না। আমার চোখের ভুল? দেখতে দেখতে, সেই ‘মাইন্ডসেট’ পড়ার/বোঝার চেষ্টা করলাম, যা ফারুকি হাজিরের চেষ্টা করেছেন বলে জানাইছিলেন তখন। এর বাইরে, সিনেমা, সিনেমাটোগ্রাফির একজন আম পাঠক/দর্শক মাত্র আমি, শিল্পেরও ভোক্তা বটে, কিন্তু একই সাথে রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রও যেহেতু আমি, এইটা তার আলাপ। সিনেমার শিল্পের তেমন কইরা না। এইটা নন্দনতত্ত্বের লোকজন করবেন। যেমন, ‘ওয়ানশটের সিনেমা’, ফর্ম বা ক্যামেরাগিরি ইত্যাদি। তবে, এত দ্রুত শেষ হল, ফর্ম হিশেবে এই সিনেমা ‘অস্তিত্বে’র অসহনীয় লঘুতারে স্মরণ করিয়ে দেয়।

৩.

এ পর্যায়ে কইয়া নিই, এইটা ঠিক সিনেমা হিশেবে শনিবার বিকেলের আলাপও না। হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে যে রাষ্ট্র ও সমাজ আমরা অতিক্রম করলাম, করতে চাইলাম, সিনেমা নাটক তো এইসবরেই দেখায়। তার পর্যবেক্ষণ। এই সিনেমাটাও, তারই অংশ। রাষ্ট্র, ধর্ম ও জঙ্গ নিয়া আমাদের যে মাজহাবি বাহাস, তার পরিণতি কেমন হল, এই সিনেমায় তা দেখা যায়।

আর কিছুটা, এই সিনেমায় যে ‘মাইন্ডসেট’ ফারুকি সার্কুলেট ও বিপনন করলেন, তার ভাষায়, তারে পড়ার চেষ্টা।

এর আগে, শনিবার বিকেল যখন বানানো শেষ হল, জেনেছিলাম, এটি আটকে দেওয়া হইতেছে। যেখানো পুরো রাষ্ট্রটারেই স্রেফ একটা সেন্সরযন্ত্রের বাইরে আর কোন সম্ভাবনা আকারে রাখা হয় নাই, এই সেন্সরটা স্বাভাবিক। আটকে দেওয়ার নিন্দা জানাইছিলাম তখন। কারণ, যে কোন বিষয়েই রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর ভাষা ও বয়ানের বাইরে কিছু ভাবতে, কইতে দেওয়া হবে না, এই ফ্যাসিস্ট ও গুমোট অবস্থার অবসান চেয়েছি আমি, সবসময়, নীতিগতভাবে। শনিবার বিকেলের ক্ষেত্রেও, আমি তাই চেয়েছি।

Saturday afternoon farooooki

পরে, দুই হাজার উনিশের জানুয়ারিতে শনিবার বিকেল নিয়ে নিউজ হল, সম্ভবত বিজ্ঞাপনের ঘটনা ছিল এটি। এক অভিনেতার শ্মশ্রু সম্বলিত ছবি প্রকাশিত হল, পত্রিকায়। ছবিটা যে হৈ-হল্লা তুলল, তা হল, আপত্তি। এই ছবিটাতে যে পাঠকদের ‘আপত্তি’, তাদের মতে, নর্থ সাউথের যেসব পোলাপাইনরে হামলায় দেখা গেছে, তাদের কারো দাড়ি টুপি নেই। তাহলে ফারুকির এই হলি আর্টিজানে ট্রেডিশনাল ইসলাম চিহ্ণের প্রতি ছুতমার্গসম্পন্ন ছবির মত দাড়ি টুপি কেন।

আমার উত্তর ছিল, এই আপত্তি নীতিনির্ধারনী না হয়ে ক্রিটিকাল হওয়া পর্যন্ত ভাল।

আপত্তি নিয়া আলাপ চলতে থাকুক। দাড়িতে যেমন, আপত্তিতে ‘আপত্তি’র কিছু দেখি না। তবে নোক্তা, ফারুকির কাজ দেইখা আমার কখনো মনে হয় নাই যে, ফারুকির কাজে ইসলাম বা মুসলমানি চিহ্ণ নিয়া কোন ছুতমার্গ আছে। কিন্তু মাইন্ডসেট নিয়া যে ভাবতেছিলেন ফারুকি, তা তো মুছে যাবে না। তার নানান সোশাল পলিটিক্যাল হিস্ট্রি থাকে। ফারুকিরও মাইন্ডসেট আপনি পড়তে পারবেন, ফারুকি যেমন সেই মান্ডসেটরে পড়বার কথা জানাইছিলেন।

৪.

তো, সেই দিন শনিবার বিকেল দেখতে দেখতে, এইসবই ভাবতেছিলাম।

গল্পটা দেখতে দেখতে, প্রথমত যা হল, ‘জিম্মি’ শব্দটা আমার মাথার ভেতরে মৌমাছির হল্লার মত ঢুকে গেল। গমগমে, নিঃশ্বাস আটকে থাকা হলি বেকারি, যেন আমরা সবাই, পুরো বাংলাদেশশুদ্ধ তার ভেতরে আটকা পড়লাম। আর আমরা জিম্মি হিশেবে অপেক্ষা করছি, কখন আমাদের মৃত্যু বা মুক্তি হবে। জল্লাদখানায়, জল্লাদের তরবারির নীচে বইসা। যে জল্লাদরে চিনি না, বা কম চেনা যায়। জিম্মি শব্দটা, সম্ভবত সিনেমাতে কোথাও নেই। কিন্তু এই দশাটারে আমরা তো চিনি।

মজার ব্যাপার হল, এখনকার বাংলাদেশে যখন আপনি নিজের এই জিম্মি দশার কল্পনা করেন, তাতে বন্দুকধারী হিশেবে থাকেন বর্তমান টোটালিটারিয়ান রেজিমের সিপাহি সামন্ত, শেখ হাসিনা বা তার র‍্যাব পুলিশ সেনাবাহিনী ও ভয়ের রিপাবলিকের সশস্ত্র মিডিয়া, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। কোন রাষ্ট্রবিরোধী ‘জঙ্গী’ না। এবং, বাংলাদেশেও, অনন্তকাল ধইরা, আমাদেরও এরকম জিম্মি দশাই। এই বোধ আচ্ছন্ন কইরা দিতেছিল আমাকে, যে যুদ্ধে আপনার স্রেফ দর্শক বা খুন হওয়া ছাড়া আর কোন পছন্দ নেই। আপনি, হয়ত খুন হওয়ার নানান রকম পদ্ধতি বাইছা নিতে পারেন, কখনো কখনো, যদি ভাগ্যবান হন। স্রেফ এইটুক। বেঁচে থাকার না।

এমন কি, আমার মনে আছে, ঘটনার শুক্রবারে সন্ধ্যা রাতের দিকে প্রথম যখন মিডিয়াতে এই জিম্মি ঘটনার সংবাদ ও কানাঘুষা শুরু হল, যেখানে এই ঘটনার নায়ক কারা, তা অপরিস্কার, কেউ কিছু অনুমানও বলছিল না, অন্ধকারে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখি, আমার আশেপাশের লোকজন এর অন্য অর্থ নিয়ে গুপ্ত উল্লাস প্রকাশ করছে, যার অর্থ হল, এইবার সম্ভবত শেখ হাসিনা যাবেন। হা হা।

Saturday after noon 3

মানে, মানুষ যে ‘মুক্তি’ চাইতেছিল, তাই মানুষ কল্পনা কইরা নেয়।

রাষ্ট্র ও সমাজের একটা টোটালিটারিয়ান অবস্থা থিকা মুক্তি। কারণ, মানুষ জানে না, মুক্তি কোন অন্ধকার গলি দিয়ে আসে না। মুক্তির পথটা স্পষ্ট হইতে হয়।

ফলে, দেখা গেল, মুক্তি দূর কি বাত, আমরা অন্য ল্যুপে ঢুকে পড়লাম।

৫.

তো, প্রথম এই কথাগুলো লিখলাম, টিভিতে হামলা ও জিম্মির ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে:

‘গল্পের পাশাপাশি—

গুলশানে সত্যিকার বন্দুকধারিদের সাথে পুলিশের যুদ্ধ চলছে। কয়েকজন বিদেশি নাগরিক জিম্মি। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত ও তারা পিছু হটছে পরবর্তি কৌশল ঠিক করার জন্য। কয়েকটি মিডিয়া খবর দিচ্ছে যে ওখানে ‘আল্লাহু আকবর’ শোনা গেছে। ওরা বলছে, এটি এমন দিন, যখন ঝিনাইদহে এক সংখ্যালঘুকে কুপিয়ে হত্যা করা হইছে। মিডিয়ার রুদ্ধশ্বাস বিবরণ চলছে। অর্থাৎ আজকের দিনটা আসলেই আগ্রহউদ্দীপক। চলছে গল্পের পাশাপাশি কিছু সত্যিকারের বন্দুকযুদ্ধও। এটি গল্পরে সত্যি করে তোলে ও মিথ নিয়া আমাদের আগ্রহ বাড়ায়।’..

মানে, আমরা যে কন্সপিরেসি, গল্প ও গুল ব্যবস্থায় ছিলাম, এইটা তার একটা বাস্তব দৃশ্যায়ন মাত্র মনে হবে আপনার। প্রায়ই আমরা এরকম নানান বন্দুকযুদ্ধের গল্প ও প্রেস রিলিজ পড়তাম, পুলিশ বা র‍্যাব এর তরফ থিকা। উভয়ের পার্থক্য হল, এইটা চোখে দেখা যাইতেছে, এবং লাইভ টেলিকাস্ট হইতেছে, ফলে হাতে ধরা যাইতেছে, এইটুক। কিন্তু এই ‘দেখা’ কোন সত্য উৎপাদন করে?

আমার মনে আছে, গুলশান ঘটনার পরের দিন, ভোরের বৃষ্টির ভেতর যখন তারা ভিজছিলেন, খবরে, একই সাথে জিম্মি এবং ‘জঙ্গী’, উভয়ের শাদা ও লাল হয়ে থাকা মৃতদেহই আমারে তাদের সাথে কথা কইতে টেনেছে। যখন তাদের লাশ আলাদা করা হচ্ছিল, বৃষ্টির ভেতরে ভিজতে ভিজতে, আমিও ভিজতেছিলাম। উভয়রেই আমার বাক্সবন্দী মনে হইতেছিল, মূলত ‘জিম্মি’।

অবাক হয়ে দেখলাম, আমার ভেতরের এই জিম্মি দশা, এই বৃষ্টির ফোটা, এই সিনেমায় ফারুকিকে তেমন কইরা স্পর্শ করছে না, তার গল্পে। আমি জিম্মি এবং জঙ্গী, উভয়ের হৃদয় এবং ফিসফাসই, খেয়াল করার চেষ্টা করলাম এই সিনেমায়, কান লাগিয়ে। কিন্তু, কারো আওয়াজই পেলাম না।

বরং কৌতুকের আওয়াজ পেলাম।

কৌতুক, একই সাথে দেখলাম, শনিবার বিকেলে ফারুকি আরজ আলী মাতুব্বরের দোকান খুইলা, মাজহাবি তর্ক নিয়া বসেছেন। যা শেষ হল মহাভারতের বয়ান আর ‘ভারতফোবিয়া’র বিকিকিনিতে আইসা।

এই উভয় ঘটনা আমারে ক্লান্ত করল।

৬.

কেন এই ক্লান্তি, বলছি।

‘জঙ্গী’ গল্পে তেমন আগ্রহ নেই আমার। কিন্তু বয়ানগুলো কীভাবে তৈরী হয় ও কাজ করে, তারে লইয়া আগ্রহ তো আছে। জিম্মিকারীদের সাথে জিম্মিদের আলাপ, আগ্রহ ও রক্ষণশীলতা যেসব বিষয় নিয়া, তারে পড়া যেতে পারে ফলে। পর্দা, নারী, নারীর চাকরি, কাফের, হিজাব, হিন্দু, শিয়া, ভারতীয়— এইসব শব্দ ও বিষয় লইয়া জিম্মিদের তর্ক ও চিৎকার চেঁচামেচিগুলো দেইখা, পরে আমি ছবি দেখা বন্ধ করে ভূক্তভোগি, বেঁচে আসা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণগুলো খুঁজে খুঁজে, আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। কোথাও এরকম কোন বিবরণ বা ইশারাও পেলাম না।

তাহলে এই তর্ক আসল কই থিকা?

আমার মনে হল, এইখানে ‘শহুরে মধ্যবিত্তের দার্শনিক’ হইতে চাওয়া আরজ আলী মাতুব্বর দোকান খুইলা বসছেন, নয়া শহর হইতে চাওয়া সোশাল মিডিয়ার ‘ইসলামী’ একটিভিস্টদের মধ্যে পপুলার ‘অন্যমনস্ক সাজিদে’র লগে। এজ আ সোশাল ফেনোমেনন। তর্ক করছেন। যেন একটা কৌতুকের পরিসরেই এই দোকানি ধর্ম হিশেবে ইসলাম ও অন্যান্য বাহাসের সালিশি সমাধান দেখতে আগ্রহী। দোকানি, মানে পরিচালক।

এই জাগায়, আপনি যদি শ্রেণীগতভাবে উভয়ের কোনটারই অংশ না হওয়াটারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, উভয়রে ফেনোমেনন আকারে পড়তে পারবেন।

আরো ইন্টারেস্টিং হল, শেষমেষ, এই সিনেমার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ইনডিয়া’ প্রশ্নের সেভিয়র হিশেবে আবির্ভূত হওয়া। এক শিয়া মুসলমান, কিন্তু জাতীয়তায় ইন্ডিয়ান বইলা তারে ‘জঙ্গী’রা খুন করবে। কারণ একে তো ইনডিয়ান, তার উপরে শিয়া, যে কাফেরের থিকাও খারাপ, তারে খুন করা জরুরি সবার আগে, তাদের মতে। আর বাকি সবাইরে ছেড়ে দেবে। এই জাগায় আপনি যেন বলিউডের সিনেমায় কোন ‘পাকিস্তানি ভিলেন’ দেখবেন। কিন্তু তারে চেনা যাচ্ছে না, আর সবার সাথে মিশে আছেন যেহেতু। এই ভারতবিদ্বেষ ও খুনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে জনৈক জিম্মি, বাস্তবে অভিনেতা জাহিদ হাসানের লড়াই এর গল্প হয়ে উঠল এই সিনেমা। আর এই গল্পেই শেষ হয় সিনেমা।

এইটা গল্প হিশেবে কেমন? প্রথমত, আপনি যদি ইতিহাস সম্পর্কে সত্যানুগ থাকারে গুরুত্ব দেন, এই গল্প সত্যানুগ না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণের কোথাওই হলি আর্টিজান ইস্যুতে এই ইন্ডিয়া প্রশ্ন ইশারা হিশেবেও আসে নাই। অবশ্যই, সত্যানুগ হওয়ার দরকারও নেই, পরিচালক যদি দাবী করেন, এইটা ফিকশনমাত্র, হলি আর্টিজানের ঘটনার সাথে এর প্রত্যক্ষ সত্যানুগ হওয়ার কোন সম্পর্ক না থাকলেও চলে। তাহলে, এর পরে থাকে, ফিকশন হিশেবে এই ঘটনার বিচার। ফিকশন হিশেবে এই ঘটনার যে আগমন, এইটা কেমন?

বাংলাদেশে জনগনের ভেতরে ইন্ডিয়া লইয়া ঐতিহাসিক অস্বস্তি আছে।

সীমান্তের খুনোখুনি, সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ‘গোমাংস ভক্ষণ’ ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান হত্যায় প্রশ্রয় ও রাষ্ট্রীয় উসকানি, বাংলাদেশ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য ও ঘৃণামূলক প্রচার প্রচারণা, গঙ্গা ও তিস্তার পানির হিস্যা, অসম বাণিজ্য-সম্পর্ক ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের কনসেন্টরে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না, এমন দলের প্রতি প্রশ্নহীন সমর্থন, প্রশ্রয় ও আশির্বাদের হাত, এইসব কারণে বাংলাদেশের জনগনের ভেতরে ইনডিয়া নিয়া এই অস্বস্তি তৈরী হয়ে আছে ঐতিহাসিকভাবে। অবশ্যই, শুধু বাংলাদেশ না, সব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের জনগনের মধ্যেই রাষ্ট্র ভারত নিয়া এই ধরনের অভিজ্ঞতা ও অস্বস্তি আছে। রাষ্ট্র ভারত নিয়া বাংলাদেশের জনগনের এই অস্বস্তি ও বিরোধিতারে বাংলাদেশে বিজেপির কালচারাল প্রপোজিশনের একটিভিস্ট/প্রপাগান্ডিস্টরা ‘ফোবিয়া’ ও ‘ধর্মান্ধতা’ আকারে প্রচার করে। যেমন, সম্প্রতি বাংলাদেশি অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বাংলাদেশি খেলার দর্শকদের ‘ভারতকে সমর্থন করা’ আর ‘না করা’ ইস্যুতে, এরকম ইশারা ও ঘৃণামূলক মন্তব্য করেছেন। যারে লইয়া সোশাল মিডিয়া ও মিডিয়াগুলোতে শোরগোল হল কিছুদিন আগে। এইখানে, স্পষ্ট বোঝাপড়ার ব্যাপার হল, রাষ্ট্র হিশেবে ভারতের ‘রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা’ ও ‘মৌলবাদিতা’র প্রতি বাংলাদেশের জন-অসন্তোষরে এই যে স্রেফ ‘ফোবিয়া’ এবং ‘ধর্মান্ধতা’ আকারে দেখানোর পলিটিকস, তা গোবেচারা কোন ঘটনা না। মজার ব্যাপার হল, ফারুকির এই সিনেমাও এই প্রপোজিশনরে নিরব সমর্থন জানাবে, যে, বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার বিরোধিতা একটা ‘ধর্মান্ধতার ইস্যু’। পলিটিক্যাল না।

আরো কিছু ঘটনা খেয়াল করা যায়। ভারতীয় চ্যানেল সনি লাইভ দশটা ভারতীয় ভাষায় সারা ভারতজুড়ে এই ছবি প্রথম রিলিজ দিয়েছে। ভাল কর্তব্য পালন বটে। এই সময়টা ‘রাষ্ট্র হিশেবে ইন্ডিয়াকে বাঁচানোর’, বা ‘ইনডিয়ার পক্ষে সেভিয়র হওয়ার’ যে বয়ান, তার জন্য ভাল। আমাদের, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইন্ডিয়া মরে যাচ্ছে। ক্ষমতা, প্রভাব আর ভারসাম্যের পালাবদলের লড়াই চলছে। বাংলাদেশের জনগন ভারতবিশ্বস্ত একটা গণবিরোধী রেজিমের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন ধরে। একটা অনির্বাচিত সরকারের পক্ষ নিয়া রাষ্ট্র হিশেবে ইন্ডিয়ার যে হস্তক্ষেপ ও ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর অনৈতিক ক্ষমতা চর্চাকারী রাষ্ট্র হিশেবে ইন্ডিয়ার ভেতরগত বিরোধগুলো ও নাগরিক অসন্তোষগুলোও একই সময়ে আমাদের সামনে আসছে। এই অবস্থায়, জঙ্গী গল্পের ভেতর দিয়া ইন্ডিয়ার এই মরে যাওয়ারে বাঁচিয়ে তোলার একটা পরিকল্পনা, কাল হো না হো মুভির একটা মুড পাবেন এখানে।

বাকি সবকিছু ছাপিয়ে, এই যে ইন্ডিয়ান নাগরিকরে বাঁচানোর গল্প প্রধান হয়ে উঠল, এইটার কারণে এই ছবিটা দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে, আপনি ইনডিয়ার বয়ানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখছেন।

……

তো, শেষমেষ এই নয়া মুক্তিযুদ্ধ আপনারে কই নিয়ে যেতে চায়, তারে পড়তে পড়তেই এই সিনেমাটা দেখতে পারেন। আর, আপনি এই আরজআলী মাতুব্বরের দোকানের খদ্দের হবেন, নাকি আপনার নিজের জঙ্গ কোনটি, তা খুঁজতে নৈতিক দার্শনিক তর্ক তুলবেন, এইটা আপনার সেই ভ্রমণেরও অংশ হতে পারে। পারে কি?

প্রথম প্রকাশ: ১ ডিসেম্বর ২০২৩


[1] টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা (পৃষ্ঠা ১৯২, টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। মার্চ: ২০২১)

[2] পূর্বোক্ত।

পুনমুদ্রণ, ফ্রম মধ্যবর্তি বেঞ্চটাতে। পৃষ্ঠা ২০২। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। ফেব্রুয়ারী ২০২৫

Leave the first comment