১.
বিকেলটা রণজিৎ দাশের জন্য কেমন, বলা মুশকিল। পরে ভদ্রলোক কফি খাচ্ছিলেন। কয়েকজন স্থানীয় কবিসমেত। খুব হাশিখুশি। আমি ভাবার চেষ্টা করছিলাম।
কবির কবিতা পাঠ শেষে একজন মাদ্রাসার হুজুর বা মাদ্রাসার ছাত্র ভরা মজলিসে কবিকে প্রশ্ন করেছেন, তিনি প্রত্যহ রোজনামচা লেখেন। তার রোজনামচার ভাষা কী হবে? এইটা লেখার জন্য কি তাঁকে দাশহুজুরের মত ডিকশনারির শব্দ ব্যবহার করতে হবে? একটু পরামর্শ দয়া করে। প্রশ্নের সারাংশটি এরকমই। নিতান্তই সরল প্রশ্ন, একজন গুণীজনের প্রতি। হয়তো ভাবলেন একজন কবির পরামর্শ বেশ কামেল হবে। আগেকার দিনে তো কবিদেরকে তেমনই ভাবা হত। বিদ্যান, গুণি, সর্ববিষয়ের পণ্ডিত। কবিগণ আগেকার দিনে মসনভি লিখতেন। মানতেকুত তায়ের। মহাভারত লিখতেন। মেঘদূত লিখতেন। আমরা শুধু কাব্য হিশেবে নয়, কোন কোন মুহূর্তে আরো মহৎ মর্যাদা দিয়ে পাঠ করতাম সেইসব গ্রন্থ। কবি মাদ্রাসার হুজুরের এই প্রশ্নের কী উত্তর দিতেন, আমি জানতে পারি নি। কারণ আয়োজকরা এই প্রশ্নরে গুরুত্ব না দিয়ে পরের প্রশ্নে চলে গেলেন। আয়োজকরা বিরক্ত হইছিলেন সম্ভবত। এই রোজনামচা লেখকরে কবিসভায় কে দাওয়াত দিল? আরো ভয়াবহ কথা হল, রোজনামচার সাথে কবিতার তুলনা, এ কেমন ব্লাসফেমি!
তা না হয় হলো। কিন্তু একজন ইংরেজির হুজুরও (ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র) বললেন, তিনি রণজিৎ দাশ প্রমুখের আধুনিক কবিতাগুলো বোঝেন না। এত কঠিন সব ডিকশনারি মারা শব্দ কেন কবিগণ ব্যবহার করেন? আমার পাশের জন ও বন্ধু বলে উঠলো, গর্দভ। ভাষা ও সাহিত্যে পড়লেই কি আর কবিতা বোঝা যায়? বোঝা যায়, তিনি রণজিৎ দাশের কবিতা পড়েন এবং বোঝেন। কবির পক্ষ থেকে এই প্রশ্নেরও কোন উত্তর মিলল না।
তারপর একজন চট্টগ্রামের কবির প্রশ্নের উত্তরে, রণজিৎবাবু অনেকটা অসহিষ্ণু হয়েই জিজ্ঞাসিলেন, তিনি সর্বমোট কয়টা কবিতা লিখেছেন। শিল্প বা কবিতা কী?- এইটা নিয়ে বাহাসের মুখোমুখি যদি কোন মৃদুমন্দ কবি হন, সে এক বিপদ বটে। দাশবাবু কবি ভদ্রলোকের উত্তরে যেইটা বললেন, তার সারাংশ হলো, বাহাস দিয়ে কী হবে। আমরা কবি। দার্শনিক নই। কবিতা লিখে আনন্দ পাই। তাই লিখি। এই লেখা নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর কবি দিতে পারেন না। বা তিনি বাধ্য নন। তার শুধু অভিজ্ঞতাটুক হয়। কিন্তু তার রহস্য সে বলতে পারে না। কবিগণ তো দার্শনিক নয় যে, তাকে সব প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার করে যেতে হবে। কবিদের এই দায় নেই। তা ভাল। প্রশ্নকর্তা কবি তখন বললেন, এ নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। রণজিৎ বাবু আরো অসহিষ্ণু হয়ে কইলেন, আমি আপনার সাথে বাহাস করতে আসি নাই। আপনার দ্বিমত শুনব না। আপনার আর কোন প্রশ্ন আছে?
বুঝা যাচ্ছিল, বিকেলটা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না রণজিৎদাশের। কিন্তু বাবু খুব হাশিখুশি মানুষ। তার কবিতার মত ঝরঝরে। কফি খাচ্ছেন। কিন্তু কবিতা কী?
২.
তো, রণজিৎ দাশ, মানে এই শুধু প্রশ্নবাবুর কথাই শুনছিলাম। যিনি বাহাসে জড়াতে চান না। এইটা কবিতা পাঠের আগে, তার বক্তৃতার সময়।
কবিতা কী- এইটা নিয়ে কথা বলা যে কোন কবিরই অনুচিত, দাশের মতে। বরং চুপ থাকা ভাল।
এই বলেই রণজিৎ বাবু শিল্প কী, কবিতা কী, তা নিয়ে বেশ অনেক্ষণ কথা কইলেন। লিখিত কথা। যার মাথা মুণ্ডুর হদিস পাওয়া গেল না। যেমন ধরুন, শুরু এবং শেষ হল মোটামুটি এই দিয়ে:
..কবিতা কী? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। যুগ যুগ ধরে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার নিস্ফল চেষ্টার পর, মোটামুটি এমনই সার্বিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে, এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। যেখানে হাতি-ঘোড়া গেল তল সেখানে মশা বলে কত জল।.. কবিতা যদি হৃদয়ের কথা হয়, তাহলে হৃদয় কী? কাকে বলে মানবহৃদয়?.. হৃদয় হলো প্রেমের শক্তি এবং স্বয়ং প্রেম।.. তাহলে এবারে আমরা ভাবব যে, কবিতা হল হৃদয়ের কথা, হৃদয় হল প্রেমানুভূতি, আর কবিতা হল সেই প্রেমানুভূতির শিল্প। প্রেমের বেদনা, মনুষ্যত্বের বেদনা, আমরা সারাজীবন কবিতায় বেদনারই গান গাই।../ রণজিৎ দাশ। বাতিঘর, ২৭ জুন ২০১৪
মোদ্দা কথা, প্রথমত অনিশ্চয়তা, তারপরে কিছু একটা খড়খুটো যেমন প্রেমে এসে থামলো। প্রেমই কবিতা। বা প্রেমের বেদনাই কবিতা। এই ধরণের কিছু। বা নিশ্চিত নয়। মানে,কবি নিজে। বা নিশ্চিত হতে চানও না তিনি। এক দার্শনিকের বক্তব্য কোট করলেন কবিতা সম্পর্কে। পরে আমরা তার কথায় জেনেছি, যা শুরুতে বললাম, কবিরা দার্শনিক নন, সব কিছু বোঝার দায় কবিদের নেই। তার মানে, কবিরা দার্শনিক নন, কিন্তু দার্শনিকগণ হয় তো কিছুটা কবিও। কেননা, দার্শনিক কবিতা বোঝেন বা কবিকে বোঝেন। কিন্তু কবি দর্শন বোঝেন না। তা হবে হয়তো। তবে বোঝা গেল, কবিরা হবেন ঘরকুনো, কোলাহলমুক্ত। কবির কাজ দর্শন, বাহাস বা রাজনীতি করা নয়, দাশবাবু যেভাবে বললেন।
ভাল কথা। আচ্ছা, কবি কী করেন তাইলে? নিজের সাথে নিজের জীবনের মধু? রণজিৎ দাসের সাথে বাহাস চলবে না বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেরা বাহাস করতে পারি।
৩.
কামিনী ফুলের গন্ধে সত্য আছে, ছলনাও আছে।/ কামিনীফুলের গন্ধে: রণজিৎ দাশ
রণজিৎ দাশের এই লাইনটা আমার ভাল লাগে। কামিনীফুলের গন্ধে সত্যও আছে, ছলনাও আছে। মানে, সত্য এবং ছলনাতে কবি সচেতন। যদিও এইটা বেশ ডিলেমা নির্দেশ করে। তারপরও তিনি সত্য যাচেন। ছলনাও বুঝিতে চাহেন। অন্তত তাঁর কবিতা যে বক্তব্য দেয়, তাতে। এইটা দার্শনিক অবস্থান। কিন্তু দাশবাবু তাঁর বক্তব্যে বলতেছেন, তার এই দার্শনিক বোঝাপড়ার দায় নেই। তাহলে কী আছে?
রণজিৎ দাশের কথা শুনে মনে হল, তিনি সত্য ও ছলনা থেকে নিজেরে বহু দূরবর্তী এক কবি হিশেবে রাইখা দিতে চান। আমোরাল। মানে, যেখানে সত্যও নেই। ছলনাও নেই। এইটা ভদ্রলোকের এই লাইনের সাথে কনফ্লিক্টিং। রণজিৎ দাশের কবিতাগুলো শুনে খারাপ লাগল না। কোন কোন কবিতা বেশ ভাল। যেমন ঈশ্বরের দান। শুনতে শুনতে মনে হল, এগুলো তো শিশুর আনমনে খেলা নয়। বরং সচেতন বাহাস তোলার চেষ্টা। তাইলে কবি কেন বললেন, কবিরে প্রশ্ন করা যায় না। তিনি বাহাস করেন না?
কবির কি নিজের প্রশ্ন বা বাহাস সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস থাকে না? বা তিনি ভাবধারায় শিশু, অস্পষ্ট, তাই কবিতা লেখেন?
৪.
কবিতা পাঠ যখন করছিলেন জনাব দাশ। আমার সম্মুখবর্তিনী তখন রেসিপির বই পড়ছিলেন। শুদ্ধ বাংলায়, রন্ধনশৈলীর বই, আমার বন্ধু বললেন। আমি ঠাহর করে দেখলাম, পদার্থটির নাম রাঙ্গালুর পেটিস। অদ্ভুত কাণ্ড, একবন্ধু আমাকে ডেকে পেছনে দেখালো। পেছনের জন (এইবার তিনি জনৈক, জনৈকা নহেন) ও রন্ধনশৈলীর বহি নিয়ে ব্যস্ত। বইগুলো খুব সুন্দর। দেখলেই উল্টাতে ইচ্ছে করে। ছবিগুলোও সুন্দর। তরতাজা রান্নার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।
অবশ্যই, আমার হাতেও একটি বহি। বহিটাতে ‘মজহারীয় আদর্শ’ শিরোনামের লেখা দেইখা উল্টাচ্ছিলাম। আর একটা ক্যানন ইওএস এম ক্যামেরা। হুটহাট ছবি তুলছি। আমার বন্ধুরাও তুলছে। এর। ওর। পাশের। হাজিরানে মজলিশের। সবই বইসা বইসা। আর কবিতাও শুনছি। বা কবির প্রতিক্রিয়া শুনছি। আর ভাবছি, রোজনামচার সাথে কবিতার পার্থক্য কী? রণজিৎদাশবাবু কিছু কইতে পারবেন এ নিয়ে? আচ্ছা, রণজিৎ দাশবাবুরে আমরা কবি কই ক্যান? কবি কী পদার্থ?
৫.
এইসব ভাবতে ভাবতে একটা ফোন এলো। এক অপরিচিত কুরিয়ার সার্ভিস থেকে। ঢাকার এক বন্ধু রাজশাহীর আম পাঠিয়েছেন। আমার সাথে লেখালেখির সূত্রে পরিচয়। উনার ভাষায়, চট্টগ্রামে ভাল আম পাওয়া যায় না। আপনার জন্য বিষমুক্ত আম পাঠাব। আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন আগেই। আম আনবার জন্য রিকসা নিয়ে দ্রুত এই অনর্থ কবিতার প্রান্তর (যার অর্থ সম্পর্কে খোদ কবি সন্দিহান, কিন্তু আমরা মহৎচিন্তা করতে চেষ্টা করি) ত্যাগ করলাম। এবং ওখানে গিয়ে তাজ্জব হলাম। ভেবেছিলাম, অল্প কিছু আম হবে হয়তো। উপহার তো উপহারই। কিন্তু দেখি রীতিমত বিরাট একঝাঁকি আম। বোধ হয় কেজি বিশ-পঁচিশেক বা আরো বেশি হবে। নীচের ছবিটি দেখুন।
শেষ পর্যন্ত বিকেলটা ভালই কাটল। আমি এই আম্রসমুদয় বরণ করলাম। রণজিৎ দাশের কবিতা পাঠ উপভোগ করেছি। তারঁ বক্তব্য যদিও নয়। কিন্তু কবিতা ও রাঙ্গালুর পেটিস পাঠ থেকেও এক ঝাঁকি আম আমার জন্য প্রবল অর্থ নিয়ে এল। কবিতা ও আম নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি অবশেষে রিকসা থেকে নামলাম। বন্ধু, যাহারা আম্র পছন্দ করেন, তাহাদের জন্য আগামী কয়েকদিন আমের আমন্ত্রণ।..