কোর্ট কাছারির বিষয়-আশয় ও ইতিহাস তর্কের কাইজ্যা
এটি বেশ পুরনো বিতর্ক, সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল, যারা রাষ্ট্র এবং আইন তৈরি হবার পর ঐটার উপরেই সব বিচারের ভরসা দিয়ে বসে থাকাটারে সুবিধাবাদিতা এবং মূর্খতা মনে করেন, তারা বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়টিরে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ইতিহাস বিতর্কের মীমাংসা এবং কোর্টকাছারির মীমাংসার বিষয়-আসয়ের মধ্যে স্পষ্ট একটি পার্থক্য বোঝার খাতিরে। বিষয়টি শুরু করার আগে, আমার ১০ জুন ২০০৯ তারিখের একটি লেখার বরাত নিতে চাই, সেই লেখাটিতে ক্ষুদ্র পরিপ্রেক্ষিতেই, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ইতিহাস-সত্য নির্ধারণ করবার সুযোগ বা এখতিয়ার একটি বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ আদৌ রাখে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছিলাম। একটি বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের একটি মন্তব্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমার কথাগুলো ছিল এরকম: সামাজিক, রাজনৈতিক ও ইতিহাস-সত্য নির্ধারণ করবার সুযোগ বা এখতিয়ার কোন নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক অথরিটি রাখতে পারে না। এমন কি, ইতিহাস বিকৃতি বলতে যা বুঝাতে চান কেউ, মোটা দলীয় অর্থে, আওয়ামীলীগ আর বিএনপির কৌতুককর ইতিহাস-বিতর্কের সাথে তা মিলে যায়। প্রসঙ্গত দুই দলের প্রতিষ্ঠাতাকেই তারা নিজেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক মনে করে। এই মোটা দলীয় মাপের ইতিহাস চর্চা এবং তা সবার উপর চাপিয়ে দেওয়া কোন কাজের কাজ হতে পারে না। এবং যদি তারা এরকম কাজ করেও, তা প্রকৃত অর্থে অসার হাস্যকর কর্মকাণ্ডে পরিগণিত হবে, এবং এর কোনকিছুই ইতিহাস-সত্য এবং সামাজিক রাজনৈতিক বিতর্কের মীমাংসার জন্য ন্যূনতম কাজে লাগবে না। বরং ভবিষ্যৎ ইতিহাস চর্চায় হেজিমনি তৈরি করবে।
তারও আগে, বিভিন্ন লেখালেখিতে জামায়াত রাজনীতির বিচার প্রশ্নে, আইন ও কোর্ট কাছারির শরণ নেওয়ার বিষয়েও আমরা এ বিতর্কটাকে উসকে দিতে চেয়েছি যে, এটি আইন-কোর্ট কাছারির মাধ্যমে সমাধা হবার বিষয়, নাকি রাজনৈতিকভাবে সমাধার বিষয়। একটা রাজনীতির মোকাবেলা কি আমরা রাজনীতি দিয়ে করবো, নাকি কোর্টকাছারির হাইকোর্ট দেখিয়ে। অর্থাৎ এই চলমান বিতর্কটি খুবই জরুরি প্রপঞ্চ হিশেবে হাজির হয়েছে সবসময় আমাদের কাছে, রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী-আইন ব্যবসায়ী সবার মূর্খতা এবং অথবা সুবিধাবাদিতা ও ফ্যাসিবাদী মনোবিকারের কারণে। এই মনোবিকার কখনো কখনো ‘মাননীয়’ হাইকোর্ট পর্যন্ত স্পর্শ করেছে।
এবার, গত ২১ জুন ২০০৯ তারিখে কোন ক্ষুদ্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নয়, নতুন করে পুরো বাংলাদেশের সামনেই এই বিতর্কের নতুন প্রেক্ষিত তৈরি হলো, হাইকার্টের একটি বিতর্কিত রায়ের পটভূমিতে। এই তারিখে, হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ আমাদের কথিত সেইরূপ সামাজিক ও ইতিহাস বিতর্কের মীমাংসার দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দেন। আদালতের রায় ছিল এরকম: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোপরি বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ভূখণ্ডের উপর জমিদারি করার ইচ্ছে আওয়ামীলীগের বেশ পুরনো। বঙ্গবন্ধু এবং একই সাথে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বড় ঠাট্টা সারল আওয়ামীলীগ, তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর জন্য জনগণকে ‘হাইকোর্ট’ দেখিয়ে। অনেকেই এটিরে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আওয়ামীলীগ-বিএনপির ফালতু ক্যাঁচালিতে হাইকোর্টের যোগদান হিশেবে অভিহিত করবে, এবং হাইকোর্টের মানও ক্ষুণ্ন হবে নিঃসন্দেহে, যেই মান সম্মান সম্পর্কে ইদানীং আওয়ামীলীগের লোকজন এবং স্বয়ং হাইকোর্টের অনুভূতিও টনটনে। কথায় কথায় আদালত অবমাননার মামলা করেন এবং সমন জারি করেন।
যাই হোক, শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ সেই সময় কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা, অথবা জিয়াউর রহমান নামের একজন সৈনিকের অবদান ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কতটুকু, এইসব মোটা দাগের তর্ক ইতিহাসবিদরা করুন, এই তর্কের মীমাংসা এই নোটের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, আইন এবং কোর্ট কাচারির বিষয়-আশয় আর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ইতিহাস বিতর্কের বিষয় আশয়ের মধ্যে যে পার্থক্য, তা একটু টুকে নেওয়াটাই এই নোটের উদ্দেশ্য। অমাদের মাননীয় হাইকোর্টের বিচারকগণ যদি এই বিষয়টিই খেয়ালে না রাখেন, অর্থাৎ আদালতের এখতিয়ারের চৌহদ্দিটুক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকেন, কোনটা রাজনৈতিকভাবে অথবা একাডেমিশিয়ানদের বিতর্কের মাধ্যমে সমাধা হবার বিষয়, আর কোনটা কোর্টকাছারির মাধ্যমে সমাধা হবার বিষয়, তাহলে তারা এই মোটা দলীয় মাপের ইতিহাস রচনার কাজেই ব্যবহূত হবেন, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছেকৃতভাবে। স্বেচ্ছায় হবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট আছে, মাননীয় হাইকোর্টের যাবতীয় ভাবমূর্তির প্রতি নাগরিক হিশেবে ’উচিত শ্রদ্ধা’ অক্ষুণ্ন রেখেই এই সন্দেহ। কারণ, দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগের ঘটনা বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে কলুষিত করেছে বেশ আগেই, এমনকি কয়েকদিন আগে হাইকোর্টে যে নিয়োগ ঘটেছে, তাও মূলত আওয়ামী-ছাত্রলীগের হাইকোর্ট এক্সপানশন মনে হয়েছে সচেতন মহলের।
অথঃ আদালত অবমাননা সমাচার: ‘বিকৃত মস্তিষ্ক’ আর ‘অপদার্থ’র ধারণা ও ‘মাননীয়’ হাইকোর্ট
‘আদালত অবমাননা’ নামে একটা বিষয় বেশ আলোচিত হচ্ছে হাই কোর্টের এই বিতর্কিত রায়ের পর থেকেই। উপরেই বলেছি, আওয়ামীলীগের লোকজন এবং স্বয়ং হাইকোর্টের অনুভূতিও এখন এই বিষয়ে বেশ টনটনে। বিষয়টি শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কমেন্টারির পর থেকে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল: ‘বিচারপতিদের কাজ কি বিচারপতিসুলভ হয়েছে?’। আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি হল। এমাজউদ্দীন সাহেবের এই লেখাটি পড়ে আমার এই অমায়িক বর্ষীয়ান ভাল-ভদ্রলোকের বুড়ো বয়সের সুবিধাবাদিতা এবং আদালতের প্রতি তাঁর অভিমানের কারণে করুণা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যখন তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে সমন জারি হল, বড়ো চমকে ওঠার পালা। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, এই মামলার বাদি আদালতের কাছে এই বলে নালিশ করেছেন যে, ‘বিড়ালের গলায় প্রথম রাত্রেই ঘণ্টা বাঁধতে হবে’। ভাল রসিক বটেন ভদ্রলোক। এবং আদালতও, তৎক্ষণাৎ এই উঁচুমাত্রার রসিকতা অথবা ফ্যাসিবাদী মনের সমঝদার এবং সহযোগী হয়ে সমন জারি করলেন যাতে এই ‘বেচারা সাবেক উপাচার্যরূপী বেড়ালের গলা’য় ঘণ্টা প্রথম রাতেই বাঁধা যায়। আজব নয় বৈকি কারণ এতে আজব হলে ‘মাননীয়’ আদালতের এর পরের আচরণে আজব হবার ক্ষমতা আপনি হারাবেন। পরবর্তীতে বিএনপি নেতা ‘ব্যারিস্টার’ নাজমুল হুদা ও জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান এর বিরুদ্ধে একই ধরণের ‘আদালত অবমাননা’র মামলা হলো। পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ‘মাননীয়’ আদালত এই মামলা গ্রহণ না করে যা বলেছেন, রাষ্ট্রের নাগরিক সম্পর্কে সেই ঠাট্টার ভাষা একটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুনতে পারা একটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বটে। হাইকোর্টের দায়িত্ব হল সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং নিশ্চিত করা, তা ক্ষুণ করা মানে হল সংবিধানের জোরে হাইকোর্ট যে নৈতিক কর্তৃত্ব পায় আদেশ দেবার, সেটি নষ্ট হওয়া। পত্রিকায় প্রকাশ, আদালত এই মামলাটি না নেওয়ার কারণ হিশেবে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাঁরা বিকৃত মস্তিষ্ক এবং অপদার্থ। তাঁরা বহির্বিশ্বের একটি মামলার রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বিকৃত মস্তিষ্ক এবং অপদার্থর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা চলে না, যার আদালত অবমাননা বিষয়েই কোন ধারণা নেই। আল্লাহ তাদের হেদায়াত করুন। আমার একটু সন্দেহ ছিল, এমন ভালগার মন্তব্যের হুবহু পুরোটা কি সত্যিই ‘মাননীয়’ আদালত করেছেন, নাকি কোর্টের স্পোকসম্যান হিশেবে যেই ভদ্রলোক সেদিন মিডিয়ার সামনে কথা বলেছেন, সেই বাদির আইনজীবীর অতিকথন। যাই হোক, কোর্ট তাদের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়াত চেয়েছেন। আমরাও দোয়া করতে পারি, আল্লাহ, জগতের সকল অজ্ঞানকে হেদায়াত করুন আর হাইকোর্টকে মুক্তি দিন তাদের বিচারিক কাজকর্ম থেকে, তাঁরা তো আপনারই কাছে হেদায়াত চেয়েছেন, বিচারের মত জটিল কাজ তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে তুমি বড় অন্যায় করেছো। আমেন। (নাজমুল হুদা একজন সিনিয়র আইনজীবী এবং কামারুজ্জামান দীর্ঘদিন রাজনীতি করা ঘাঘু লোক- ‘মাননীয়’ আদালত তাদেরকে ‘নাদান’ এবং ‘মূর্খ’ বলে মামলা বাতিল যদি করে দেন, তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ যারা ‘আইন’ সম্পর্কে অকাটমূর্খ, তাদের বিরুদ্ধে সকল মামলাও, মাননীয় হাইকোর্ট, স্রেফ আল্লাহর দরবারে হেদায়াত চেয়ে, অবিলম্বে বাতিল করে দিন। আমেন। সংবিধানের প্রশ্ন তুলবো না। এটিতো আরো জটিল জিনিশ। এটিও আল্লাই রক্ষা করবেন। )
সর্বশেষ: কূটনৈতিক শিষ্টাচার
আমাদের মন্ত্রীবর্গ কূটনৈতিক শিষ্টাচার একদমই জানেন না। বিশেষ করে, ডা দীপুমণি। তিনি কোন আক্কেলে বললেন: পিনাবাবু ‘হ-য়-তো’ সেদিন কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই জ্ঞান মারাত্মক। তিনি এ বিষয়টিরেই নাকচ করে দিয়ে বলেছেন যে, বিদেশের কূটনীতিকরা সবসময়ই আমাদের ব্যাপারে ‘খোলামেলা’ আলোচনা করে থাকেন আন্তরিকতাভরে। আল্লাহ দীপুমণিকেও হেদায়েত করুন। আমেন। আল্লাহ আমাদের সর্বময় দায়িত্ব নিয়ে নিন।
০৪ জুলাই ২০০৯