রিফাত হাসানের এতো বিস্তর পলিটিক্যাল ফিলোসোফির ডিসকোর্স হাজির করা আমার পক্ষে আপাত সম্ভব না বলে মেনে নিচ্ছি কারন সেটা করার মতো জ্ঞান ও সামর্থ্য কোনটাই আমার নাই। এর বাইরে একজন আম পাঠক হিসেবে এই বই নিয়া দুইটা কথা বলবার চাই।
প্রথমত রিফাত হাসান এখানে যে জিনিসটা ভালো করেছে সেটা হলো আমাদের কে একগাদা মহামানবদের থিওরির গ্যাঁড়াকলের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক দর্শন বুঝাইতে যান নাই, যেটা প্রায় রাজনীতি সংক্রান্ত বইপত্র পড়ার সময় আমাদের নজরে পড়ে এবং মহামানবদের মনিষীদের ভাষা ও থিওরি দিয়ে রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করতে করতে আমাদের বর্তমান সময়ের রাজনীতি আর বোঝা হয় না আর লেখক কী বলতে কী বলে ফেলতেছেন সেটাও অনেকটা ধোয়াশার মধ্যে থেকে যায়। রিফাত হাসান এখানে একিবারে বৈঠকি ভাষায় বাংলাদেশের সংবিধান, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক, সংবিধান এর সাথে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এর নানা বাঁক, নানা লুপহোল এসব নিয়ে তার ফিলসফি হাজির করেছেন, ফলত এর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের বিগত এক দশকের নানা বাঁকগুলাকে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
এই বই এর বেশীরভাগ জায়গা জুড়ে লেখক মূলত শাহবাগ আর শাপলাচত্বর এর নানা ফেনোমেনা নিয়ে আলাপ হাজির করেছেন। শাহবাগ এবং শাপলাচত্বর এই দুইটা বাঙালী জীবনে রিমার্কেবল ঘটনা, দুইটাই এক অর্থে পপুলিস্ট মানে দুইটার পক্ষে ব্যাপক জনমত আমরা দেখেছি, সুতরাং পপুলিস্ট ধারণাগুলোর ক্ষেত্রে যা হয় সেটা হলো বুদ্ধিজীবীরা এসব পপুলিস্ট ঘটনায় অধিকতর জনপ্রিয় সাইডটা নিয়ে নিজেদের সেইফজোনে নিয়ে যান (এটলিস্ট বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের বেলায় এটা কমন বিষয়) এবং তারপর আলাপ আলোচনা করেন। কিন্তু রিফাত হাসান এই ক্ষেত্রে সেইফজোনটার বাইরে গিয়ে কিছুটা ননপপুলিস্ট ধারণাটার প্রতি নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, কাজটা সেই সময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় টাফ ছিলো বাট উনি তবুও কাজটা করেছেন সো এইক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী হিসেবে উনি এককদম এগিয়ে গেছেন বলে আমার মনে হলো।।
এর বাইরে হেফাজতের শাপলা চত্বরের পুরো ঘটনাকে উনি ডিফেন্ড না করলেও মোটামুটি কয়েকটা পয়েন্ট কে করেছেন। এবং সেটা আমার কাছে অফেন্সিভ মনে হয় নি, জাতীয়তাবাদী ইম্যাচিউর প্রগতিশীলতার ব্যারাম ঝেড়ে ফেলে তার যুক্তিগুলো পাঠ করলে সেটা অনেকের বোধগম্য হওয়ার কথা। আবার আমার এইক্ষেত্রে হান্টিংটন সাহেবের একটা কথা মনে হইলো সেটা হচ্ছে মানুষ যতো যাই করুক তাকে শেষমেশ তার শেকড়ের কাছে ফিরতে হয় নাহলে তার কোন দিশা ঠিক হয় না, এইক্ষেত্রে রিফাত হাসান এর বেলায়ও সেটা খানিকটা প্রভাব বিস্তার করেছে বলে আমার মনে হয়।।
এর বাইরে রাষ্ট্র সংবিধান আইন আদালত এবং কয়েকটা কেইস নিয়ে উনি পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আইনের তেমন কিছু সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি বুঝি না তবে তার লেখা থেকে যেটা বুঝলাম সেটা হলো আমাদের সংবিধান এবং আইন আদালত এবং রাষ্ট্রের সাথে নাগরিক ও এসবের বোঝাপড়ার মধ্যে একটা বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাই যেহেতু আইন তৈরি করে তাহলে এই আইন কতটুকু সাবঅলটার্ন এর পার্পাস সার্ভ করতেছে বা এই সংবিধান কতটুকু জনগনের সেসব ব্যাপারে জনগণের তরফ থেকে আরো বিস্তর জানাশোনা এবং প্রশ্ন করার জায়গা আছে।
এছাড়া নাইন ইলাভেন পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে উনার পর্যবেক্ষণ অনেকটা ভীতিকর কিন্তু যেটা অনেকখানি সত্য হয়েছে এবং হচ্ছে বলে আমার মনে হইলো। এই জায়গাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়ছে আমার কাছে, যে ওয়ার অন টেরর এর কালে বাংলাদেশের বাস্তবতা কি হবে, এবং এটার সাথে আমাদের ডিলিংটা কেমন এবং এর আউটকাম কী এসব নিয়ে রিফাত হাসানের আলাপ বেশ প্রাসঙ্গিক।
এর বাইরে উনার কয়েকটা গল্প ও আসলো দেখলাম লেখায়। গল্পগুলো বেশ ছোট কিন্তু গভীর জীবনবোধে পরিপূর্ণ ছিলো, মনে হলো যেনো পড়তে পড়তে শেষ হয়ে গেলো যেমন তৃষ্ণার সময় কলসি মুখে নিয়ে দেখলাম প্রান জুড়ানোর আগেই পানি শেষ হয়ে গেছে।। উনার ৫ মেইর সময়কার জার্নির বিবরনে মাদ্রাসার ছেলের কবিতা লেখার ঘটনাটা কেমন জানি বুকে মোচড় দিয়েছিলো।
রিফাত হাসান মোটাদাগে হার্ডকোর গদ্য লেখেন নাই তার জন্য ধন্যবাদ। লেখায় কাব্যিকতার ছোয়া ছিলো, এটা না থাকলে এসব বই আগানো যায় না। বাট শেষের দিকের মৃদুল শাওনের সাথে বক্তব্যের ভাষাটা ঠিক বোধগম্য হয় নাই, এটা অনেক বেশী সুররিয়াল মনে হইলো যেটার সাথে সাধারনেরা রিলেট করতে পারেনা। কিছু কিছু পয়েন্ট কয়েকবার করে আসায় বইটা কিঞ্চিৎ স্থুল ও হয়েছে এটাও বলা দরকার। এটা না করলে বেটার হয়তো।।
সর্বোপরি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যে গৎবাঁধা ন্যারেটিভ যে দর্শন ও ক্ষমতার পার্পাস সার্ভ করে লেখালেখি এসবের বাইরে থেকে নিজের দর্শন হাজির করা এবং একটা গোষ্ঠীর জন্য কথা বলার স্পেইস তৈরি করা যেটা তারেক মাসুদ মাটির ময়নাতে করেছেন বলে রিফাত হাসান জানাইতেছেন, সেটাকে আমি স্বাগত জানাই।
এছাড়া এই বই এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শেকড়ের কাছে ফিরতে পারি বলে আমার মনে হলো, মানে মাদ্রাসা সংক্রান্ত যে ফ্যাালাসি এই রাষ্ট্রে প্রগতিশীলতার ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছে সেটা থেকে নাজাত পাওয়ার উছিলা হইতে পারে এই বইয়ের উত্থাপিত ডিসকোর্স।
আশা করি এই চর্চা অব্যাহত থাকবে। আপাতত এইটুকুই। ধন্যবাদ।।
১০/১০/২০১৯
বিঃদ্রঃ ২৩০ পাতা পলিটিকাল ক্রিটিকস এর বই এর সারসংক্ষেপ করা সম্ভব না এর জন্য প্রতিটা বিষয় আলাদা করে নোট করা প্রয়োজন আপাতত এতো সময় আমাদের কই,প্রবাসে কাজে কর্মে দিন যায়।তাই এটুকু নোট করলাম যাতে আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারে।