‘আমাদের এখানে রাজনীতি করার জন্য একটা লিবারাল স্পেস থাকা দরকার, যেখান থেকে আমি মুসলিম, আপনি হিন্দু আর একজন অন্য কেউ হতে পারে, অথবা একজন সেক্যুলারের জন্যও স্পেস থাকা দরকার। সবার জন্য একটা কমন স্পেস তৈরি করার ব্যাপার, এই লিবারাল স্পেস তৈরি করার জন্য আলোচনা হলো ‘সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি’ বইটির কাজ।’
‘মানুষের জন্য সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা বুদ্ধিজীবীদের কাজ। বুদ্ধিজীবী নিজে বিপ্লব করে না। সে বিপ্লবের শর্ত তৈরি করে, সময়ের ঘন্টাকে দুলিয়ে দ্যায়। ফ্যাসিবাদ একটি দেখার ভঙ্গি, রুচি ও লাইফস্টাইলও এবং এই দেখার ভঙ্গি মানুষের সম্ভাবনাকে রহিত করে। অতএব নূন্যতম গণতান্ত্রিক হউন। আপনার সাথে আমার বন্ধুত্বের প্রথম শর্ত’।
বাংলাদেশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে জ্ঞান করে এই তিনটি চেতনার অর্থাৎ সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি— রিফাত হাসানের নিজস্ব দর্শনে ও বুদ্ধিজীবীতার দৃষ্টিভঙ্গিতে বোঝার একটি মার্গ হলো— তার প্রথম পুস্তক— সংকলিত সংলাপ ও প্রকরণ ধরনের নিবন্ধসংগ্রহ ‘সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি’। পুস্তকের নবম পৃষ্ঠায় উপস্থাপনের প্রথম সংস্করণের নোটের শুরুয়াতে বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসান বলছেন— ‘রাজনীতি হলো সম্পর্কের জ্ঞান। মুআমিলাতেই রাজনীতির প্রকাশ ঘটে’। অর্থাৎ একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমেই মানুষের সাথে মানুষের রাজনীতির সাফ-সাফাই হয়ে থাকে। এই কথাগুলো আরো সহজিয়া ভাষায় বললে— একে অন্যের অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার যোগ্য মনে করলেই, সেই অবস্থান থেকে ওই ব্যক্তিদের মাঝে রাজনীতির প্রতিভাস এবং প্রকাশ ঘটে; মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে, ফিরতে, কাজে-কর্মে নিয়োজিত থেকে জীবনধারণ করতে হলে তাকে অন্যের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব স্থাপন করেই চলতে হয়; মুআমিলাত অর্থাৎ যথাযথ চুক্তি অথবা লেনদেন ভিন্ন কারো পক্ষেই নৈতিকতা পালন করা সম্ভব নয়। ইসলামে মুআমিলাতের মর্যাদা ও অবস্থান ঈমান-আকীদা-ইবাদত-বন্দেগীর পরপরই। বান্দার হকের সাথে কেউ ত্রুটি করলে সেটা আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষন না অপরাধীপক্ষ নিজেই হকদারের সাথে লেনদেন সাফ করে নেয়। ইসলামে মুআমিলাতের মর্যাদা ও অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বইয়ের মূল-আলাপ নিয়ে
‘সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি একটি জরুরি ভাব’। এই ভাব বা অনুভূতির বিচিত্র অর্থ আছে— যেমন: অভিপ্রায়, ইচ্ছে, ধারণা, বিদ্যমানতা, চেতনা, মানসিক আবেগ, চুক্তি, অবস্থা, শর্ত, চিন্তা, বিশ্বাস, মত এবং সৌন্দর্য। ভূমিকার শুরু থেকে বইটির চূড়ান্ত পাঠ পর্যন্ত এই জরুরি ভাবটি আলোচনা ও বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে ইতিহাসের পর্যায়কাল ভ্রমনের একটি চ্যারিয়ট বা সত্তয়ারি হিসেবে পুস্তকটির অধ্যেতাদের নিয়ে গেছেন এর সৃষ্টিকর্তা।
পলিটিক্যাল ফিলোসফি এবং সমকালীন রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই বইটিতে। রিফাত হাসানের দীর্ঘদিনের লেখালেখি, ব্লগ ও মুক্ত-যোগাযোগ-মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা নোটগুলোর সূত্রধর হিসেবে সংকলন করা হয়েছে এই বই, তার লেখা প্রথম পুস্তক।
বইটির প্রবন্ধঅংশে কিছু গল্প আছে— সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির অবস্থান থেকে সেই গল্পগুলোতে তিনি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে বুঝতে বা সম্পর্কিত করে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। বইটির বিভিন্ন অংশের আলাপে তিনি এই বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করেছেন— ‘মানুষের সম্পর্কের জ্ঞান হচ্ছে রাজনীতি এবং এখান থেকেই মানুষের মাঝে বন্ধুত্বের সূচনা হয়’। বইতে দেওয়া গল্পগুলোতে যে ঘটনা এবং স্মৃতি-রোমন্থন আছে— মা, বাবা, ছেলে-মেয়ে, ছোটবেলার শিক্ষকবৃন্দ, পাঠ্যজীবনের পর্যায়কাল, বন্ধু ও শিক্ষকদের সাথে অতীত ঘটনা বা অভিজ্ঞতার স্মৃতি, শহর ও গ্রামের জীবন, দেশ -বিদেশ, সংবেদ-প্রকৃতি— নিজ মনশ্চক্ষুর মাঝে সংযোগ এবং আবেগময় ঘটনা ও কল্পনার বিচিত্র পটভূমিতে ছোট ছোট গল্পাকারে রচনা করে গল্পের ছলে নিজের সাথে অন্যান্য কিছুর বোঝাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন রিফাত হাসান।
বইটির শেষভাগে এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে তিনি এই চিন্তাগুলোকেই খোলাসা করে আলাপ করছিলেন, সামান্য বিস্তারে— ‘মানুষের সম্পর্কের জ্ঞানই হচ্ছে রাজনীতি এবং এখান থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা হয়’। মানুষ যখন রাজনীতি করে, তাদের সেই রাজনীতি-ভাবনার মূলে ধর্মীয় অথবা নৈতিক একটা ভিত্তি তৈরি হয়, সেটাই হলো সম্পর্ক। এবং বন্ধুত্ব হচ্ছে কোনো আবদ্ধ অথবা বন্ধ কিংবা অখোলা অবস্থার থেকে মুক্তিলাভ। মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব হলে এই নিরুদ্ধ অবস্থানগুলোর মাঝে পরিবর্তন বা মুক্তি ঘটে এবং এই উদ্যোগ বা সূত্রপাতের মাধ্যমেই একের সাথে অন্যের রাজনীতিটা শুরু হয়। এবং এই তিনটি ব্যাপার ও করনীয় কাজ বোঝার জন্য— মানুষ এবং সমকালীন রাজনীতি, ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র-ভাবনার মাঝে সম্বন্ধস্থাপন এবং সম্পর্কযুক্ত করার একটি দার্শনিক পর্যটন হলো এই সংকলিত বহি, যেখানে বাংলাদেশের জাতীয়তাকে ঘিরে নানা প্রশ্নের উপস্থিতি, সাহিত্য থেকে বুদ্ধিজীবীতাসহ অনেক কিছুরই মোকাবিলা করার চেষ্টা আবির্ভূত করা হয়েছে। এই বইটি শুধুমাত্র সীমিত-অর্থের রাজনীতি নিয়ে লেখা হয়েছে ভাবলে বিভ্রম ঘটতে পারে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্বন্ধিত তত্ত্বানুসন্ধানে— ১৯৭১ এর ঘটনাকে ‘বাংলাদেশ বিপ্লব কিংবা গণমুক্তিযুদ্ধের’ দিক থেকে পর্যবেক্ষন করা হয়েছে। ‘গণমুক্তিযুদ্ধের দিক থেকে বাংলাদেশ বিপ্লবটাকে দেখার ব্যর্থতা’ হচ্ছে পুরো বাংলাদেশের ৭১ এর পরবর্তী ঘটনাগুলোর থেকে প্রাপ্ত নিরাশতা এবং আশাহীনতা। রিফাত হাসান বলছেন— ৭১ এর পরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, বা যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের ‘হঠকারী সিদ্ধান্তে’র কারণে বাংলাদেশে দুইটা ঘটনা ঘটেছে। একটা হচ্ছে— অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ‘বাংলাদেশে একটা প্রতিবিপ্লবী নাগরিক সমাজ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো’ এবং এই কাউন্টার রেভ্যুলুশনারি সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ তৈরি হওয়ার কারণে, ‘গণমুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী যে সম্ভাবনা ছিলো, তারুণ্যের মধ্যে যে সম্ভাবনা ছিলো’, সাহিত্যের সম্ভাবনাও বিবেচনায় রেখে এবং অপরাপর ঘটনা ও ব্যাপারগুলোর ভেতরের যে সম্ভাবনাগুলো ছিলো, ‘এইসব সম্ভাবনাগুলো থেমে গেল’। এবং এটার কারণে দেখা যাচ্ছে— আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টাকে কতগুলো বিষয়ে ভাগ করা হয়েছে, এই ঘটনাকে ‘জাতীয়তাবাদের নামে এক ধরনের গণহিস্ট্রিয়া তৈরি করা হয়েছে’। কিন্তু ‘গণমুক্তিযুদ্ধের ভাব’টা এইরকম ছিলো না, বরং পাকিস্তান রাষ্ট্রের আমাদের উপর করা সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য বিদ্রোহ-আন্দোলন-কেন্দ্রিক ঘটনা হিসেবেই ছিল। এবং ‘জনগণের দিক থেকে এই আন্দোলনটা আসলে মুক্তির জন্য গণমুক্তিযুদ্ধই’ ছিল, কিন্তু নেতৃবৃন্ধের দিক থেকে ঘটনাটা ছিল ভিন্নরকমের বরং ‘ক্ষমতার দখল’কেন্দ্রিক কিছু, পাশাপাশিভাবে বিভিন্ন বহিঃশক্তির সাথে জোট বেঁধে নানারকমের ফন্দি-ধান্দায় ডুবে থাকার ব্যাপারটাও ঠাহর করা গেছে। এই কারণেই কোনকিছুর মৌলিক রূপান্তর ঘটেনি, নেতৃত্ব অথবা অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলোর ভাগ্য নিয়েও। এমনকি বুদ্ধিজীবীতা ও বুদ্ধিজীবী-সমাজ শাসকদের প্রতিনিধি এবং প্রতিবিপ্লবী নাগরিক-সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে, এখনো এই চর্চার অবস্থান্তর ঘটেনি। ‘বুদ্ধিজীবীরা কখনোই যারা গণমুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের প্রতিনিধি ছিলো না; বরং তারা সবসময় প্রতিনিধি ছিলো তাদের, যারা প্রতিবিপ্লবী হয়ে— এই বিপ্লবের প্রতিপক্ষ হয়ে সবসময় কাজ করেছে’।
এই ধরনের বর্ণধারী অবস্থান ও সমস্যা এবং নিমিত্তকে ঘিরে উদ্ভুত প্রশ্ন এবং পর্যবেক্ষনপূর্বক বোঝাপড়ার ডিসকোর্স নিয়ে রচিত হয়েছে এই পুস্তক।
সর্বসাধারণ থেকে সচেতন নাগরিকগন, যারা রাজনীতিতে আগ্রহবোধ করেন, বা নূন্যতম সমালোচনা এবং আলাপ-আলোচনা জারি রাখতে ইচ্ছুক, তাদের এই অধিকার ও অধিকার-সংক্রান্ত ভূতাবেশ, এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলার পরিবেশ ও রাজনীতি করার অধিকার কিংবা পা রাখার জায়গাটুকু অথবা অবকাশটুকুকে কেড়ে নিয়ে, পুরো ব্যাপারটিকে তাদের জন্য কঠিন করে ফেলা হয়েছে; এইধরনের কঠোর কার্কশ্য বা অনমনীয়তা দেখানো হয়েছে। সামান্য বিস্তারে বললে— ধরা যাক, যারা ধর্মবক্তা— বিবিধ ধর্মীয় আলোচনা করেন, তারা এই ধর্মীয় আলোচনাকে স্রেফ গোষ্ঠিগত করেন, এখানে আর কাউকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য কোনো সুযোগ রাখতে চান না, তাই ‘এইসব আলোচনার ভেতরে কোনো লিবারাল স্পেস থাকে না’। যেমন— আমাদের মৌলভি-সাহেবরা বা আলেম-সমাজ যখন ইসলামের কথা বলেন, রাষ্ট্রের কথা বলেন, বা অন্যকিছুর কথা বলেন, সেখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার থাকবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো— ‘আমাদের এখানে রাজনীতি করার জন্য একটা লিবারাল স্পেস থাকা দরকার, যেখান থেকে আমি মুসলিম, আপনি হিন্দু আর একজন অন্যকেউ হতে পারে, অথবা একজন সেক্যুলারের জন্যও স্পেস থাকা দরকার। সবার জন্য একটা কমন-স্পেস তৈরি করার ব্যাপার, এই লিবারাল স্পেস তৈরি করার জন্য আলোচনা হলো এই বইটির কাজ’— বুদ্ধিজীবি রিফাত হাসান ঠাহর করেছেন।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে— ‘ভাষাকে ডিসেক্যুলারাইজ করা। একই সাথে, আবার একেবারে বদ্ধ যে ভাষা, তাকে মুক্ত করে দেওয়া’, দুটোই একসাথে প্রয়োজন।
এই বইয়ে কিছু ইন্টারেস্টিং আলাপ আছে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে কাব্যিক ঢংয়ে বর্ণনার একটা দারুন চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।
বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে রিফাত হাসানের দৃষ্টিভংগী:
এই জাতীয়তাবাদ উপমহাদেশে ‘ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক ও জাত-পাত-বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, যার সাথে ইনসাফ ও হকের প্রশ্নে বাংলা রাষ্ট্রের তথা এই ভূখন্ডের মানুষের দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের সম্পর্ক’। ‘হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ফরায়েজী ও কৃষক আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, এমন কি বাংলাদেশ আন্দোলনেও এর প্রকাশ রয়েছে’। কিন্তু অদূরদর্শী ‘শাসকদের ছত্রছায়ায়, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্দরমহলেই আবার এর উত্থান ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে’। যার ফলে স’র্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও সম্প্রসারণবাদের মাঝে গভীর সখ্য তৈরি হয়ে আছে সংস্কৃতিগতভাবেই’ এবং এই সংক্রান্ত পর্যবেক্ষন হলো— ‘এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনা তথা সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত’। এবং ‘এই সম্পর্ক ও সখ্যতার রাজনৈতিক পাঠ জরুরি।‘
‘ইতিহাসের যাবতীয় অমীমাংসা, রাষ্ট্র, নাগরিকতা এবং গণতন্ত্র প্রশ্নে পার্টিজান বুদ্ধিজীবীতা বাদ দিয়ে জরুরি রাজনৈতিক-দার্শনিক আলাপ এগিয়ে নেওয়া দরকার’। যাতে ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি লক্ষ্য এবং নৈব্যাক্তিক পর্যালোচনা দাঁড় করানো যায়’, এর সৎ সাহসের জন্য ‘দরকার বাংলাদেশ বিপ্লব অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের পূর্ণ-প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো’। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ত্রুটিপূর্ণ এবং রাহাজানিমূলক রাজনীতি, এমন কি যেকোনো প্রকারের নিপীড়ন, হয়রানি, অন্যায় বিচার-সালিশ রঙ্গের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।
‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের পূর্ণ-প্রতিষ্ঠাই একমাত্র পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনকালীন যাবতীয় অনিষ্পাদিত ঘটনা এবং অপরাধগুলোর বিচার করতে’, তা-না-হলে বিচারের নামে প্রহসনের প্রতি সমালোচনা জারি রাখতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রিয় বিষয়গুলো-জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, অভিযুক্তদের ফাঁসি, শাহবাগ, হেফাজত, বিএনপির জামায়াত সংস্রব, জামায়াত নিষিদ্ধ, জঙ্গি ইসলাম এইসব ব্যাপারে বেশ দীর্ঘ-আলোচনা আছে বইটিতে। এইসব ঘটমান জনপ্রিয় বিষয়গুলোকে ফেনোমেনন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে, কেননা ক্ষমতাসীন শাসকের এইসব প্রপঞ্চগুলোকে অবলম্বন করে পলিটিক্যাল-ফ্যাকশনালিজম জারি রেখে ক্ষমতার দখল বজায় রাখার জন্যই যেন জিইয়ে রাখা হয়েছে। মূলত ধর্মীয় ও ইসলামী রাজনীতির শক্তি ও তাকে মোকাবেলার অক্ষমতা থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতা হলো এর মূলভাব ও অভীষ্ট।
বাঙ্গালি জাতিয়তাবাদ নামে যে রেসটা গড়ে উঠেছে, তাদের সংস্কৃতি, ক্ষমতাসম্পর্কীয় অবস্থান ও অন্যান্য সব ক্ষেত্র থেকেও বিবেচনা করে এবং এই রেসের বুদ্ধিজীবীদের দিক থেকেও যে বিশাল মাত্রার কূটাগার তৈরি হয়েছে, তা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে অর্থেই ধরে নেওয়া যাক না কেন, সেই পরিমান অথবা আকৃতির মহীরুহ তার বিরোধীপক্ষেও থাকা প্রয়োজন, তাহলেই একটা ভারসাম্য অবস্থা তৈরি হবে। যখন সকলেই একটি জিনিসের পক্ষে, একটি ব্যবস্থার পক্ষে বিনা-প্রতিবাদে ও নির্বিচারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন ভিন্নমতের বা ভাবধারার অনুসারী অন্য কেউ আর সামনে এগিয়ে আসতে চাইবে না, প্রতিবাদ করতে সাহসী হবে না। কারণ প্রতিবাদ করলে অনেক-রকমের ভোগান্তিতে পড়ার ভয় আছে, এবং এমনটি যখন ঘটে, তখন সমাজে একটা অব্যবস্থা তৈরি হয়। রিফাত হাসান মনে করেন— ক্ষমতাসীনের কাজগুলো নিয়ে সমালোচনা জারি থাকা উচিত। ভিন্নমতের বা বিপক্ষদলের সেইসব সমালোচনা ও বিবিধ কর্মসূচির আয়োজন এবং অংশগ্রহণমূলক কর্মকান্ড করার অধিকার ও সুযোগ থাকা উচিত, এর মাধ্যমেই একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থা তৈরি হয়। তিনি মনে করেন— সবকিছু যে কেউ ইচ্ছে মত করে যাবে, প্রশ্নহীনভাবে, এই অবস্থাকে ভারসাম্যমূলক অবস্থা হিসেবে ধরে নেওয়া সম্ভব নয়; এবং বুদ্ধিজীবীদের কাজ হলো নিরন্তর সত্য কথা বলে যাওয়া।
কিন্তু সত্য কী? যদি এই সত্য পূর্ণভাবে প্রকাশিত না হয়ে বরং আংশিকরূপে বয়ানে হাজির হয়, তখন কিভাবে তাকে ডিল করা যাবে?
সত্যের আভিধানিক অর্থ যদি হয় ‘বাস্তব’, আর বাস্তবতা সম্পর্কিত হিসেবে সত্যকে ধরে নেওয়া যায় এবং সেইসাথে বিদ্যমানতা ও প্রকৃত কিছুকে সত্য হিসেবে ভেবে নেওয়া যায়, তাহলে আংশিক সত্য বলা ভীষন অন্যায় ও ক্ষতিকর। ‘বুদ্ধিজীবীদের যেমন নিরন্তর সত্য বলে যেতে হবে’, তেমনিভাবে দেশের সর্বসাধারণদের সত্য জানার ব্যাপারে আগ্রহী ও সতর্ক থাকতে হবে। তাদের তথ্য জানার অধিকার, যা গণতন্ত্রের মূল চর্চার একটি অন্যতম বিষয়; আংশিক সত্য বলার মাধ্যমে যদি সত্য বলা লুকানো হয়, তবে তা ক্ষতিকর বটে। তাই সর্বসাধারণকে ব্যক্তি পর্যায়েই রাজনীতি-সচেতন হতে হবে। সত্য তথ্য বা সত্য-সম্পর্কীয় ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য। একটি ঘটনার অবিকল বর্ননা শুনে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করাই জরুরি নয়; সেই ঘটনার মধ্যে ‘হাজির রাজনীতিটাকেও বুঝতে’ চেষ্টা করতে হবে এবং রাজনীতি-জ্ঞান-সচেতনতার প্রতি সকলকেই আগ্রহী হতে হবে, নিজেদের প্রয়োজনেই। একটি সাক্ষাৎকারে বুদ্ধিজীবীদের সত্যবাদিতা অনুশীলনের প্রশ্ন-উত্তরে রিফাত হাসান আলোচনা করছিলেন, যার সারকথা হলো— আমরা যারা রাজনীতি-সচেতন, রাষ্ট্রের বিচিত্র কর্মকান্ডে আমরা যেমন সমালোচনায় মুখর হই, সেভাবে রাষ্ট্র ও তার নাগরিক হিসেবে প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা রাষ্ট্রের পাশেও দাঁড়াই, পক্ষ নিয়ে সরব হই। যেমন— সীমান্তে কোনো অঘটন ঘটে যখন। কিন্তু আবার রাষ্ট্রই যখন নিপীড়ক হয়ে, তার নাগরিকদের অধিকার হরণ করে নেয়, তখন তার সমালোচনাও করছি। কেউ যেকোন দলের পক্ষ হয়ে কথা বলুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই; আসল কথা হলো— সত্যের পক্ষে তার অবস্থান আছে কি-না? সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীতাতে নৈতিকতার অনুশীলন অত্যন্ত দরকারি একটা লক্ষণ।
রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তপনার সাথে মিডিয়া ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর সিক্রেট-কোলাবরেশন এবং ম্যালপ্রাকটিস দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষণীয়। সচেতন মহল মনে করেন, ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিমন্ডলে ইনটলারেন্স এবং ফ্যাসিজম গেঁড়ে বসেছে’, এই অপকর্মের অন্যতম উস্কানিদাতা ‘এমবেডেড জার্নালিজম বা গৃহপালিত সাংবাদিকতা’, ‘মিডিয়া কিভাবে ফ্যাসিজমের বিস্তার ঘটাতে পারে, এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো— শাহবাগ ও তার প্রতিক্রিয়া’। বিবিধ সময়ের মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদগুলোর ভোক্তা হয়ে— নাগরিকদের ভেতরে যে ফ্যাসিজমের বিস্তার ঘটেছে, ‘তার বলি হয়েছেন অনেক শাহবাগের পক্ষের এবং বিপক্ষের লোক’। যেমন: ব্লগার হত্যাকান্ড দেখেছি আমরা। ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিপীড়ন, দমন এবং দলবাজিতার বৈধতা দানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এইসব’ সাংবাদিকতা। ‘ফ্যাসিবাদ চর্চা পাল্টা ফ্যাসিবাদ তৈরি করে। যখন পাল্টা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে, তখন এই উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা তারা কারো না কারো পক্ষ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পূর্বেই নেমে পড়ে। অনবরত উস্কানি ও জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে এমন একটি না ফেরার পরিস্থিতি তৈরি করে দেওয়ার ইতিহাসের আসামী হয়ে থাকবে এই গবাদি বা গৃহপালিত সাংবাদিকতা’।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বর্তমানে সংখ্যালঘু প্রশ্নের ঢাল হিসেবে এনে নাগরিক অধিকার প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। ‘মূলত রাষ্ট্রে কোনো সংখ্যালঘু থাকে না, নাগরিক থাকেন’। ‘একই সাথে পরিস্কার থাকা জরুরি— সাম্প্রদায়িকতার সাথে সংখ্যালঘুত্ব এবং সংখ্যাগুরুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। সংখ্যাগুরু যেমন, সংখ্যালঘুর ভেতরেও সাম্প্রদায়িক চিন্তা, তৎপরতা জিইয়ে থাকতে পারে। এইটার সমাধান হিসেবে সাম্প্রদায়িক নিশান মুছে ফেলা ঠিক নয়। যে কারণে কোন সম্প্রদায় কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংখ্যাগুরু, তাদের কোনভাবে সংখ্যালঘু বা অন্তত সমানসংখ্যা বানিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। এবং কেন, আর কোন অবস্থার কারণে কোন সম্প্রদায় নিজেদের কম নাগরিক মনে করেন, তা মূলত নাগরিক অধিকার প্রশ্ন দিয়েই বিচার করে, এর সমাধান করা উচিত। একে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হিসেবে জারি রেখে সমাধান সম্ভব নয়’। অন্য পরিপ্রেক্ষণে— ‘ভারত তার হিন্দুত্ব নিয়ে বাংলাদেশসহ দুর্বল ও ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের উপর যে আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী ভূমিকায় হাজির আছে, তার সাথে ভারত রাষ্ট্রের জনগণ এবং এপারবাংলা তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিন্দুদের তরফে কোন প্রানের যোগ নাই। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ নাগরিক, নাগরিকতা এবং অধিকার বিষয়ক আলাপগুলোতে পদ্ধতিগতভাবে’ অবিদ্যমান বা মৃত থেকে বিশেষ দলবাজিতা এবং বাংলাদেশীয় রাজনীতিতে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের পক্ষে অপর্চুনিস্ট বা সুযোগসন্ধানী চরিত্রে আবির্ভূত, সহযোগী এবং নির্মিত মূখপাত্রবৃন্দের ভূমিকায়ও তারা অবতীর্ণ এবং আচ্ছাদিত হয়ে আছেন যেন।
‘ইতিহাসে, আমাদের সব মুক্তি আন্দোলন এবং সর্বশেষ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে গণমুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপরাপর গন্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো এই আধিপত্যবাদ বা হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়াই করা’। ‘কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অদূরদর্শীতার কারণে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই, আমরা আবার এই আধিপত্যবাদের খাঁচায় আটকে গেছি; সীমান্তে খুনোখুনি, নদীর পানি অবরোধ, ভূমি দখল, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দাদাগিরি এইসবের মাধ্যমে আধিপত্যকামি ভারত রাষ্ট্র যেনো আমাদের পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছে। আমাদেরকে একই সাথে দুই দিকেই মোকাবিলা করে যেতে হচ্ছে, সীমান্তে এবং অভ্যন্তরে’।
বইয়ের একটি ছোট্ট-অংশে দারুন একটি গুজারেশ আছে, ‘কমিউনিস্টদের একটি জনপ্রিয় কল্পনা— রাষ্ট্র নেই, রাষ্ট্র শোষকশ্রেণীর বল প্রয়োগের হাতিয়ার’।— ইত্যাদি। এইসব কল্পনাগুলো সাধারণের মাঝে বেশ কন্টেজাস ও ইনফেকটিভ হতে পারত, কিন্তু বাস্তবিকই রোমান্টিক ভাবালুতায় আটকে থেকেছে কমিউনিস্টদের এই কল্পনারূপি জল্পনাগুলো।
ইতিহাসের দিকে তাকাই যদি বুদ্ধিজীবী রিফাত হাসানের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে
‘বাংলাদেশের উত্থান মুহূর্তে ভূমিকা পালনকারী দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী— বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী উদ্ভুত পলিটিক্যাল এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী ইন্টেলেকচুয়াল এলিট। এই উভয় শ্রেণীর পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে দৃশত অবস্থান ছিলো, তা বাংলাদেশ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক পুনর্গঠনে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই উভয় শ্রেণী এলিটবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ, হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রামগুলোর ভেতরকার নানা বাঁক, টানা-পোড়েন ও শক্তির জায়গাগুলো ধরতে ব্যর্থ হয়েছে’। এবং এই পর্যায়কালের শেষে পৌছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার রাজনীতি নিয়ে ‘একটি সুদীর্ঘ তকরার’ চালু করা যেতে পারে; প্রচুর স্মৃতিকথা হয়েছে, এর বাইরে এসে আলাপ প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের যেকোনো নন-পার্টিজান ‘সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে নেওয়া হয়েছে সব সময়ে’। ‘এই অপরাধ ঘোষনায় সবার আগে এগিয়ে এসেছে গবাদি বুদ্ধিজীবী শ্রেনী। রাষ্ট্রদ্রোহ ইত্যাদি নানা প্রত্যয় দিয়ে যেকোনো প্রশ্ন ও সমালোচনাকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখার অস্ত্র ও মুখপাত্র হয়েছে তারা। ভিন্নমতের দলন করা হয়েছে; ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম খুন এবং হত্যা করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদ। ফলত বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মতুষ্ট ও অটোক্রাটিক থেকেছে সব সময় নাগরিকদের কাছে’।
‘রাষ্ট্র ও তার কায়েমী পক্ষের জননিপীড়ন এবং বিরোধীদের উপরে প্রতিশোধের সংস্কৃতির কারণে’ জাতীয়পর্যায়ে একটি মানসিক আতংকজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ন্যাশনালিজমের নামে। ‘রাষ্ট্র-বিষয়ক যে কোনো কথা ও আলাপচারিতা খুব দ্রুতই এক প্রকারের জাতীয়তাবাদি উন্মাদনায় পরিণত হয়, এর ফলে নাগরিকতা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে কোনো গুরুতর আলাপ, পরে তার থেকে কোনো উত্তম ফলাফল লাভ অথবা পরিনতি আসেনি’ কভু। সবাই ভয়ে ও সংকোচে থেকেছে যদি রাষ্ট্রদোহিতা হয়ে যায় এবং মাস-লেভেলে এই ‘কনসিল্ড প্যানিক সাইকোলজি’ বাংলাদেশ ও এর নাগরিকদের তাড়া এবং ক্ষতি দুই-ই করেছে; আতংকের, ভয়ের ও প্রতিশোধের ভাবনায়, মৌলিক কিছুর স্ফুরণ ঘটেনি। ‘এই সাইকোলজি মানুষের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট করে দেয়। মানুষকে জড় ও পশুতে পরিণত করে। মানুষ সারাক্ষন কল্পিত শত্রু বা বাস্তব শত্রুর হামলা বা প্রতি-হামলার ভয়ে ভীত হয়ে থাকে’।
নিম্নে বইয়ের বাইরে সামান্য কিছু আলাপ রাখছি বর্তমানে দ্রুত গতিতে চলা বৈশ্বিক-সময়ঘড়িটির ভেতরের দিয়ে বৃত্তাকারে হেঁটে যেতে যেতে:
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করছেন— পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্র নামে মাত্র কার্যকর আছে। তাদের পর্যবেক্ষন আরো বলছে— বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, ওইসব দেশগুলোতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতনই আচরন করছে। এই একই দৃশ্য কি এই ভূখন্ডেও দেখছি না আমরা? পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকারব্যবস্থা সচল থাকলেও, এখানে গণতন্ত্রের অনুশীলন কতটুকু হয়ে উঠছে বা কার্যকারিতা কিভাবে বোঝা যাবে— সেটি নিয়ে নিত্য দিন অজস্র প্রশ্নের এবং জিজ্ঞাসার উদয় হচ্ছে; রিফাত হাসানের এই বইটি থেকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে আর কিছু প্রশ্নের সন্ধান মিলে গেল ও যোগ হলো ওইসব প্রশ্নের নীরব মিছিলে।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলো এবং কিছু খেয়ালি ভ্রমরের দল:
অতীত-কথায় বা উপকথায় আছে, ‘অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রান ভোমরা’। কিন্তু বাস্তবিক দেখা গেলো— যেসব দেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জবর দখল হয়-সেটিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে নারাজ ওই বেকুবশ্রেনীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দল। এরচেয়ে বরং, এইভাবে দেখা যেতে পারে, মেনে নেওয়া যায়— একনায়করাও নির্বাচন করে, কেননা তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টাটা অব্যাহত রাখে, নইলে তো মরন। আর এখনকার ‘পোস্ট মডার্ন ইলেকশন’ সময়ের মুখে তার দ্বৈত-পা গলিয়ে রেখেছে, নির্বাচন-কারচুপি শুধু জাল ভোটের মাধ্যমেই ব্যালটবাক্স ভর্তি করা হয় না, বরং আরো নানা সহজ উপায়েই জয় বাগিয়ে আনা যাচ্ছে। সমকালীন ওই বোকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একজন ব্রায়ান ক্ল্যাওসি বলেন— ‘নির্বাচনের বহু আগে এবং কাছাকাছি সময়ে ক্ষমতাসীন অধিকাংশ বেসামরিক শাসকগন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য করে দেন’। আর রাজনীতি সচেতনতা বা রাজনীতি করার অধিকার ও সক্ষমতাটুকু ক্ষমতাসীন এবং তার জুড়িদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া বিষয়ক বিবিধ ছল-চাতুরিগুলো কিরকমের ঘটেছে আমাদের সমাজে, তার লাল-টুকটুকে কিছু ঘটনার আলোকপাত রিফাত হাসানের এই বইটিতে আছে।
তো যা বলছিলাম, বেসামরিক স্বৈরশাসকগন, তথাকথিত ও বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক হয় না কভু, বরং তাদের পুনঃপুন আবির্ভাব ঘটলে জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। এরফলে জনগণ শাসকশ্রেনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ হারিয়ে ফেলে। এইসব ইন্টারেস্টিং বেসামরিক শাসক বা সিভিলিয়ান অটোক্রাটদের নিয়ে, সহজিয়া ভাষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আর কিই-বা বলতে পারে! বরং এই বলে সামনে আগাই চলুন, ফিসফিসিয়ে বলছি, অনেক সময় তাদের গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা দেখে অনেক সামরিক শাসকরাও লজ্জা পেয়ে যেতে পারেন হয়তো বা।
এইবার দুর্নীতি, তার সাথে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি নিয়ে সামান্য প্যাচাল তুলছি—
জাতিগতভাবেই আমরা সুবিধাবাদী ও স্বার্থকেন্দ্রিক স্বভাব নিয়ে এই সমাজের মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করি, জেনেটিক্যালিই বাঙ্গালি জাতি অপর্চুনিস্ট; আমাদের মুখে দেশপ্রেম বা পরপ্রেম শুধু বুলি বা ভাওতাবাজি, এইসব ব্যপারগুলো রাজনীতি ব্যবসায় উন্নয়নের নিমিত্তে বহাল রাখা আছে। আর কে-না-জানি-আমরা! যে, সেই বেসামরিক স্বৈরশাসকের এডমিনিশট্রেশনে এই দুর্নীতি ব্যাপারটি এমন সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজানো হয় যে, এবং মাত্র অল্প কিছু ব্যক্তির উপর এর ভার নির্ভর করে। স্বৈরশাসকের অনুগত সেবকবৃন্দ হবার বিনিময়ে তাদের এই অপূর্ব-আকর্ষণীয় দুর্নীতি করার সুযোগ মেলে। ফলে দেখছি, সময়ের সাথে সাথে অনেকেই ধনী থেকে মাত্রাতিরিক্ত ধনী হচ্ছেন; একেবারে সাম্প্রতিক সংবাদের অন্যতম একটি ঘটনা— সুইসব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ জমার পরিমান নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন, সেই ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ পরিমান অর্থ জমা রাখা হয়েছে বিগত মাত্র কয়েকটি সালের মধ্যেই।
কিন্তু যারা শাসকের সুনজরে নেই এবং কোথাও নেই, আর যেহেতু বিরোধীদল বলেও এইদেশে কিছু আর নেই সেভাবে, তাই যদি কোনো কারণে কেউ ক্ষমতশালী বা প্রতিবাদী অথবা ঘুম থেকে জেগে উঠে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হাই তোলা শুরু করে, এবং তাকে দেখে যদি সন্দেহ হয় যে— তিনি বা তারা যারা জেগে উঠছেন, মাথা চাড়া দিচ্ছেন তারা শাসকের অনুগত নন, বা সন্দেহভাজন তালিকায় রাখা আছে, তখন সেইসব সদ্য জাগ্রত ব্যাক্তিদেরকে তাদের এই জাগ্রত হওয়া সংক্রান্ত একান্ত পাপের জন্য বিচিত্র দুর্নীতি, চারিত্রিক ত্রুটি ও এই সংক্রান্ত জুগুপ্সা রটনাগুলো রটিয়ে দিয়ে অথবা বিচিত্র অপরাধে লিপ্ত আছেন, এইধরনের অভিযোগ এনে অভিযুক্ত করে, গোড়াতেই থামিয়ে দেওয়া হয়, অথবা আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়।
বেসামরিক স্বৈরশাসকরা অবসরের ভয়ে থাকেন, তারা হয়তো ভাবতে পারেন— ক্ষমতায় না থেকে বিরোধীদলে থাকলে, একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির তৈরি হবে এবং এর সুযোগ নিয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা প্রতিশোধ নিতে পারে।
গণতন্ত্রের একটি বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা আছে ‘That government of the people, by the people, for the people, shall not parish from the earth.’
[ The word of Abraham Lincoln to honour that sacrificed their lives in order ‘That government of the people, by the people, for the people, shall not parish from the earth’— were spoken at Gettysburg, but these words apply as well to the countless soldiers that died for the cause of democracy in the following 150 years. ]
এই সংজ্ঞার জনপ্রিয় আরেক অর্থে: ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, একটি রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা’।
‘জনগণ’ যেহেতু একটি যৌথ-সত্তা সেহেতু জনগণের অর্থ হচ্ছে বিবেচ্য জনসমষ্টির যৌথ-মালিকানা। আর এই মালিকানা প্রকাশ পায় কতিপয় অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের জনসমষ্টি তাদের সম্মিলিত অধিকারগুলো প্রয়োগের ক্ষমতা এবং সুযোগ উপভোগ কতটুকু করছেন— সেটা দিয়েই আমাদের মানতে হবে রাষ্ট্রটি তার নাগরিকদের জন্য কতটুকু মাত্রায় গণতান্ত্রিক হয়ে উঠছে।
এখন ‘জনগণের দ্বারা’ মানে কী? এর একটি মানে হয়— জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রন। কিন্তু তাদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহনের বেলায় এই জনগণের মাঝ থেকে প্রত্যেকটি নাগরিকের অংশগ্রহণমূলক আগ্রহ ও প্রয়োজনীয় নূন্যতম সাহস প্রদর্শন করার আগ্রহ এবং বোধ সমান মাত্রায় নাও থাকতে পারে।
এবং এইসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বাস্তব প্রয়োজনেই পরিণত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল পরোক্ষ গণতন্ত্রে, যেখানে শাসক এবং তার পরিচালনা-পর্ষদ ও অন্যান্য কর্মচারীবৃন্দ, সকলেই জনপ্রতিনিধি। এই পরোক্ষ গণতান্ত্রিক অবস্থায়, জনগণ ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করবে গণতন্ত্র কতটুকু মাত্রায় জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য হয়ে উঠেছে। আরেকটু বিস্তারে বলা যায়— এই সমস্যাটি শুধু এইখানেই সীমাবদ্ধ নয় যে, ভোটদানের সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় ভোটারের উপর ভোট-প্রদান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বা কোন প্রকারের শাস্তির চাপ এসে পড়ার আশংকা আছে (আমাদের দেশের কথা বললে— যেভাবে কালো আইনগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে ও অন্যান্য টুলস প্রয়োগ করে সেন্সরশীপের মাধ্যমে জনমতের প্রকাশকে স্তব্ধ এবং বিবিধ ধরনের অংশগ্রহণকে স্থবির করে দেওয়া হয়, তথ্য গোপন রাখা হয়, কায়েম করা হয় ‘ভয়ের সংস্কৃতি’, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দমন-পীড়ন, গুম খুন এবং পাশাপাশি হরণ করা হয় গনমাধ্যমের স্বাধীনতা, মৌলিক নাগরিক অধিকার ও রাজনীতি করার ইচ্ছে-স্বাধীনতা বাতিল করা হয়); আর ক্ষমতাসীন শক্তির জন্য নির্বাচন করা, এবং নির্বাচন হলে ভোটদানের ক্ষেত্রে বশ্যতা আদায় করার জন্য খুব বেশী বল প্রয়োগের ব্যাপারটা আজকাল অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। তাই দেখে গেছে, এই ভূখন্ডই শুধু নয়, পৃথিবীর বহু প্রতাপশালী বেসামরিক স্বৈরশাসকগন ও তাদের নির্বাচন-প্রক্রিয়াগুলোতে দৃষ্টিকটুভাবে বল প্রয়োগ ছাড়াই তারা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। এটা মূলত ঘটছে জনগণের মত বিনিময়ের, তথ্যের অধিকার লুন্ঠন ও দমন করার মাধ্যমে, এবং আশংকা ও উৎকন্ঠার বাতাবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে।
ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা এবং স্বৈরাচারিতা রোধে গণতন্ত্রই সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয় কিন্তু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সাধারনত অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় বলে— তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ অনুরূপ চরিত্রের হন। এর ফলে শাসনব্যবস্থা অদক্ষ, অক্ষম, অশিক্ষিতের শাসনে পরিণত হয়। স্থায়িত্ব সমস্যার কারণে— গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার চর্চা খুব বেশী দেখা যায়। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হওয়ার জন্য, সংখ্যালঘুরা অধিকাংশক্ষেত্রে আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করতে সমর্থ হয় না। আর আইনসভায় যাদের প্রতিনিধি থাকে না, তাদের অভাব অভিযোগে কেউ কর্নপাত না করায়, তাদের স্বার্থ ক্রমাগতভাবে উপক্ষিত হয়; অনেকক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকার-ও জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। এজন্যই রসিকতা করে বলা হয় যে, ‘Government of the people, by the people, against the people.’
গণতন্ত্র আসলে মানুষের মাঝে সেভাবে ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে পারেনি, এই কারণে সেভাবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কাজে নিয়োগও করতে সমর্থ হয়নি, তাই রাজনীতি ত্রুটিমূক্ত করতে এর ব্যর্থতা আছে। কিন্তু এইকথাই সত্য— অর্থনীতি ও অন্যান্য অগ্রগতির জন্য গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই, সর্বাবস্থায় আমাদের জন্য শুধু গণতন্ত্রকেই বিজয়ী হতে হবে, বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র নয় কভু।
নাসরিন জে রানি, লেখক। পলিটিক্স জিরো সিটিজেন, স্টোরিটেলার।
1 comment
ইসরাত জাহান
অর্থনীতি ও অন্যান্য অগ্রগতির জন্য গনতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই।
ভীষণ বোধ সম্পন্ন বাক্যটি এখন টাইপ কথায় সীমাবদ্ধ থাকছে বলেই পিছিয়ে আছি সকল থেকে।
ভীষণ ভালো লিখেছেন বন্ধু। ধন্যযোগ।