এক বন্ধুর সাথে আলাপ হইতেছিল। কারো আন্ডারস্টেন্ডিং ভাল হওয়া আর তার ভিত্তিতে অবস্থান নিয়া। আমার মতে দুইটা ভিন্ন জিনিশ।
ইমরুল হাসান, আমাদের বন্ধু, উনার সাথে সম্প্রতি আড্ডার ছবি দেইখা বন্ধুটি মনে করিয়ে দিলেন তার সাথে শাহবাগের সময়ে আমার ব্যাপক তর্ক তৈরী হইছিল ও এই নিয়া সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতিতে আমার লেখাও আছে। ইমরুল শাহবাগ ও গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে অবস্থান নিছিলেন। বন্ধুটি নতুন, তার সাথে প্রথম আলাপ এইটা। আমি বললাম, আন্ডারস্টেন্ডিং এর চেয়েও শাহবাগ ও তার পরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীতায় যে নড়া চড়া হইছিল, তা পলিটিক্যাল অবস্থান নেওয়ার ব্যাপার ছিল, শুধু কারো আন্ডারস্টেন্ডিং ভাল খারাপের প্রশ্ন না।
অনেকের আন্ডারস্টেন্ডিংরে আমি যথেষ্ট মূল্য দিতাম, তার মধ্যে প্রফেসর সলিমুল্লাহ খানও আছেন। সলিম ভাইয়ের ভাষার আমি ভক্তও, পড়ে আনন্দ পেতাম। কিন্তু শাহবাগের সময়ে ভদ্রলোকের পলিটিক্যাল অবস্থানরে আমার ভালগার ও দালালি মনে হইছিল। এখনো মনে হয়। আমি সলিমুল্লাহর জবানিতেই (গ্রামশির ট্রেডিশনালের অনুবাদ সম্ভবত উনি করেছিলেন ভাড়াটে) গ্রামশিরে ধার কইরা উনারে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী কইছিলাম। পরে, শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প ও অসহিষ্ণুতার অংশ হিশেবে উনি আমারে ব্লক করছিলেন। তখন শাহবাগ, তার জবানিতে যেটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, এই মঞ্চ থেকে নতুন নতুন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ চলতেছিল। আমি বলতাম, নতুন বুদ্ধিজীবী নিধনের রূপরেখা। এইটা আমার পাঠ।
শাহবাগের সময়ে, এইটা মনে আছে, আমরা যখন প্রথম দিকে শাহবাগের আজান ও অন্যান্য লেখাগুলো লিখতেছিলাম, তখন সলিমুল্লাহ খানদের আদি গুরু ও বাংলাদেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ইন্ডিয়ায় অবস্থান করছলেন। সম্ভবত, সেখানে বইসা ঘটনা ও স্রোতের গতি বুঝবার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। সময় নেওয়া, এই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও মনে হইত আমার, কারণ শাহবাগের সময়টা ছিল আনপ্রেডিকটেবল। ভায়োলেন্ট। রীতিমত নতুন বুদ্ধিজীবী নিধনের রূপরেখা চলতেছিল, উপরে বলেছি। আমি, ব্যক্তিগতভাবে, ফরহাদ মজহারের মতামত জানার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। সেই প্রথম দিকে, ফরহাদের চিন্তা গ্রুপেরও অনেকরেই দেখেছি, দুই এক দিন শাহবাগে হাজিরা দিয়ে ফেসবুকে তার ঘোষণা দিতে। অত্যাশ্চর্যম লাগছিল। পরে, ফরহাদ মজহার ইন্ডিয়া থিকা ফিরার পর সম্ভবত মার্চের শুরুতে এইটারে নির্মূলের রাজনীতি আখ্যা দিয়া বোল্ড অবস্থান নিলেন। তার আগে পরে পিয়াস করিমরে পাইলাম আমরা। উনি জনপ্রিয় আন্দোলনের সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্কের কথা বললেন। ফরহাদ এবং পিয়াস করিম উভয়ই রাজাকার হইলেন গণজাগরণ মঞ্চের তালিকায়। এই তালিকায় আরো অনেকেই ছিলেন। লেখালখি করেন, এমন অনেক তরুণ আমাকে তখন শাহবাগের আশে পাশে গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
ফেসবুকে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অনেকেরই আন্ডারস্টেন্ডিং পরিস্কার মনে হইছে আমার তখন। এরা বেশির ভাগই কবি সাহিত্যিক, এইটা অবাক কাণ্ড! এদের প্রায় সবাই শাহবাগের ক্রিটিকে শরিক হলেন। ব্রাত্য রাইসু, মাহবুব মোর্শেদ প্রমুখ যাদেরে আগে থেকেই দেখা যাইতো, উদাহরণত উল্লেখ করা যায়। ব্রাত্য রাইসু, এইসব পরিস্থিতিতে ডাইনামিক থাকতে পারেন প্রায় সময়। শাহবাগ প্রশ্নেও। মাহবুব মোর্শেদরেও, আমার ইন্টারেস্টিং মনে হইছে, শাহবাগের সময়ে। ক্রিটিক্যাল ছিলেন শাহবাগের প্রতি। বন্ধু লিস্টের রেজাউল করিম মনু ছিলেন, অধুনা রক মনু নামে লেখেন, ক্রিটিক্যাল ছিলেন শাহবাগের প্রতি। আর যাদেরে খেয়াল করতাম তাদের মধ্যে সুমন রহমানরে অবশ্যই দেখা যায় নাই তখন তেমন কইরা। সালাহ উদ্দিন শুভ্র, ক্রিটিক্যাল ও শার্প ছিলেন। মুনেম ওয়াসিফ, তাকে খেয়াল করার ব্যাপার ছিল না, উনি বুদ্ধিজীবী না। কিন্তু, শাহবাগের সমর্থনে প্রতিদিন একটি ছবি দেওয়ার ঘোষণা দিলেন বইলা তার নাম মনে আসল। তার শাদা কালো ছবিগুলো নজরে আসত, আমি ব্যবহারও করেছি শাহবাগের আহজান লেখাতে। উনি চিন্তা পত্রিকার একটি কনটেন্টের কো-রাইটার হিশেবে আমার নজরে আসেন প্রথমে। ফটোগ্রাফার। ইমরুল হাসানের অবস্থান অন্যরকম। উনার সাথে আমার কয়েকটি আলাপে, যার ব্যাপারে একটু আগে বন্ধু বলতেছিলেন, উনি সংবেদি থাকতে চাইলেন। কিন্তু আন্ডারস্টেন্ডিং এর চেয়েও শাহবাগের পক্ষে এইটা উনার পলিটিক্যাল অবস্থান মনে হইছিল। উনি শাহবাগরে কেন্দ্রে রাইখা ভবিষ্যত আন্দোলনের রূপরেখা নিয়াও আলাপ করলেন, একটু অবাকই হইছিলাম। সাধারণত মোলায়েম, দূরবর্তী আলাপ করেন তিনি। জিয়া হাসান, বখতিয়ার আহমদ, উনাদের নাম হঠাৎ খেয়াল করলাম তখন। বখতিয়ার আহমেদের একটা লেখা মনে পড়ছে, শাহবাগ কি বিপ্লব বা এইরকম কিছু। পরে, উনি আমার সাথে যোগাযোগ করে চট্টগ্রামে আসছিলেন ও বাতিঘরে দেখা ও আড্ডা হইছিল। বখতিয়ার মুগ্ধ হওয়ার মতোই বোঝেন, কিন্তু পলিটিক্যাল অবস্থান পরিস্কার করেন না। জিয়ার আলাদা কইরা কোন লেখা মনে নেই, কিন্তু একটা লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের মত কইরা আলোচনা করতেন। আমার মনে আছে, সলিমুল্লাহ খানের হেফাজতের তাত্ত্বিক গালাগালটা উনি উনার বইয়ের ভূমিকাতে নিজের কইরা নিছিলেন।
চট্টগ্রামে একদিন জিয়া হাসান একটা প্রোগ্রামের দাওয়াত দিলেন, এইটা ছিল জনৈক মাসুদ রানা ও পিনাকী ভট্টাচার্যর বাঙালি মর্যাদা আন্দোলন। এই সূত্রেই প্রথম পিনাকী ভট্টাচার্যের নাম শুনি। পরে উনারে ফেসবুকে পাই ও আমরা বন্ধু হই। বাঙালি মর্যাদা আন্দোলন নামটারে আমার ভালগার মনে হইত, তার উপরে এই ভাবের মধ্যে ফ্যাসিস্ট উপকরণ ছিল বইলা মনে করতাম। পরে খেয়াল করে দেখি কি, উনার পলিটিক্যাল অবস্থান ঠিক স্থবির না, ইন্টারেকটিভলি পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। এইটা আমারে আগ্রহী কইরা তুলল পিনাকীর ব্যাপারে। এই যে পিনাকী ভট্টাচার্যদের অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন, বিশেষ করে ৫ মের শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যার পরে, তার অর্থ এইটা না যে, পিনাকির এই আন্ডারস্টেন্ডিং আগে ছিল না। আগে যেইটা ছিল, এবং পরে যেইটা হল, আমি এইটারে বলি, রাজনৈতিক অবস্থান। ৫ মের ঘটনারে, পরে আমাকে বলার সময়েও পিনাকি সিগনিফিকেন্ট হিশেবে বলেন।
বাংলাদেশে পোস্ট শাহবাগ লেখালেখি ও একটিভিজমের মধ্যে পিনাকীর এই জার্নি ও পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। পিনাকীর তৎকালীন বন্ধু মাসুদ রানাও সেইদিন নড়ে চড়ে বসছিলেন, দেখা গেছে, যদিও পরে উনারে আর খেয়াল করি নাই। উনারে প্রায়ই ভালগার ও জঙ্গি সেকুলার অবস্থানে দেখা যেত। কিন্তু এই যে ৫ মে নিয়া বিব্রত হওয়া, বা পরিবর্তন, উনাদের এই পলিটিক্যাল অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে যা, তার মধ্যে আন্ডারস্টেন্ডিং ছাড়াও, ক্ষমতার হেজিমনি ও তৎপ্রসূত হতাশা বা আশা। বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামীলীগের ব্যাপারে একটা গণ-হতাশা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে শাহবাগ যেহেতু আওয়ামীলীগের স্পন্সরড ব্যাপার, বুঝদার ও দায়িত্বশীল মহলে তেমন সাড়া জাগাতে পারে নাই। সুবিধাবাদি মহলে ভয়, সাড়া ও ফ্যাসিবাদ সব জাগাইছে, যেহেতু জাতীয়তাবাদি আবেগরে ব্যবহার করা হইছে। বিপরীতে হেফাজত একটা পাল্টা ক্ষমতা হিশেবে হাজির হতে পারছিল। তার একটা মূল্যায়ন হাজির করাও বুদ্ধিজীবীতার দায় ছিল, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
আজকে সলিমুল্লাহ খানের একটা লেখা পড়লাম, লেখা বলা ভুল হবে, টক শোতে দেওয়া বক্তব্য। মনে হইছে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কওমিদের বৈঠক পরবর্তী পরবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিলেন। খানের সামাজিক যোগাযোগের ধারাটি এলিট, তারপরও এইটা একদা ফরহাদ মজহারের প্রতি উনার হেফাজতের তাত্ত্বিক সংক্রান্ত গালাগালের ঘটনারে পাল্টে দেবে বইলা মনে হয়। আমি কয়েকদিন আগে এইরকম একটা কিছু ইশারা করছিলাম, আজকে এই বক্তব্য দেইখা মনে পড়ল। খানের সব সময় একটা শূন্য স্থানের দরকার ছিল, বুদ্ধিজীবী হিশেবে ফরহাদ মজহার উনার দেওয়াল আকারে দাঁড়িয়েছিলেন সব সময়। উনারে দেখা যাইত না। এখন যেহেতু হেফাজত নেতারা প্রধানমন্ত্রী ভবনে গেলেন, এই জায়গায় অল্প সময়ের জন্য একটা শূন্যতা দাঁড়াল। খেয়াল করলাম, ফরহাদ মজহার এইটাতে বেশ কিছুদিন চুপ থাইকা পরে একটি সতর্ক ক্রিটিক্যাল অবস্থান নিয়েছেন ও কওমিদেরে এর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করলেন। ফলে, কওমি মাদ্রাসা নিয়া খানের এই আলাপ এই শূন্যতা পুরনের চেষ্টা, যেখানে কোন দেওয়াল নেই। উনারে দেখা যাবে এই জায়গা থিকা। কওমিরা এখন খানেরও সাবস্ক্রাইবার হয়ে উঠবেন। অথচ খান হেফাজত কর্মীদের উপর পাঁচ মের মতিঝিল অভিযান ও যৌথ বাহিনীর হত্যাকাণ্ডকে ওয়েলাম জানাইছিলেন। দুই হাজার তেরর জুনে বিডি নিউজের একটা গোল টেবিল বৈঠকে গোঁয়াড়ের মত কইরা বলতেছিলেন, আপনাদের ওখানে কী পড়ানো হয় আমি জানি না, কিন্তু মাদ্রাসায় মার্কস হেগেল পড়ানো উচিত। তখন আমরা এইটা নিয়ে হাস্য রসিকতা করছিলাম।
যাই হোক, খানের এই অবস্থান আমার আগ্রহ তৈরী করেছে। আমি আগ্রহ নিয়া দেখছি ও পড়ছি।
শাহবাগের ফ্যাসিজম বহু মানুষের মোলায়েম পোশাকটি খুলে ভেতরের ফ্যাসিস্ট পশুটি দেখিয়ে দিয়েছিল। আবার বহু সাহসী মানুষকে মেনি বেড়াল হিশেবে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বহু মৌসুমি বন্ধুত্ব ও বুদ্ধিজীবীতার পতন ঘটেছে। পরিস্কার করে দিয়েছে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি।
আমরা ব্যক্তিগত আড্ডাতে এই সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি নিয়া আলাপগুলো প্রচুর করি। কিন্তু পাবলিকলি করাটা একটু অনিরাপদই, যেহেতু ব্যক্তির নাম ধরে ধরে আলাপ, সম্পর্কের ব্যাপারও জড়িত। তবে, মনে হল এইটুক শেয়ার করা যায়, এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রতি হার্মফুল কোন ব্যাপার নেই।