অনেক দিনের পর বাড়ি
পুরো এক বছর পর বাড়িতে পৌঁছুলাম, ঘন ও গভীর মধ্যরাতে। কালো মানুষের রূপের মত অন্ধকার চারিদিকে। তার ভিতরে প্রাচীন মসজিদের গম্বুজের মতো অচিন গাছের চুড়োগুলোয় মহিরূহ নিরবতা। অন্ধকারের ভিতর রিকসার টুংটাং শব্দে আরো জাঁকিয়ে বসছিল নৈঃশব্দ্য। গ্রামের পাততাড়ি গুটিয়ে সবাই একসাথে শহরে চলে আসার পর এক বন্ধুকে খুব মন খারাপ করে বলেছিলাম, আমাদের বাড়ি হারিয়ে গেছে। আসলে শহরেতো মানুষের বাড়ি থাকেনা; শহরে পান্থশালা থাকে। আমি, আজ অনেকদিন পর, সেই পান্থশালার পাট চুকিয়ে কিছুদিনের জন্য আমার নিজের ঠিকানায় বেড়াতে এলাম। ঘন, গভীর মায়া ধরানো অন্ধকারের ভিতর অনেক দূরে একটি ল্যামপোস্টের মতো আমাদের গ্রাম। ঝিঁঝির অবিরাম জিকিরের সমুদ্দুর পেরিয়ে অল্প কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টিভেজা অন্ধকার আর হালকা চাঁদের আলো ভেদ করে ফুটে ওঠল বাড়ি। দরজা খুলে দাঁড়ালেন আমার মা। আমি আমার মাতৃকন্দরে আশ্রয় নিলাম।
আমরা কবিতা লিখতাম।
আমরা কবিতা লিখতাম। মহামতি তলস্তয়ের একটা ভাবনা পড়ে একবার বুক কেঁপে উঠলো আমার; যারা শস্যের উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সংযুক্ত না, তাদের কাছে জীবনের প্রকৃত অনুভূতি কখনো ধরা দেবে না। তাঁর কথাটা পুরো মনে না-পড়লেও এরকমই কাছাকাছি কিছু বলেছেন তিনি। আমি তখন ঘটনাচক্রে কিশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই গ্রামে ফিরে এলাম একবার। বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে, অবসর নিয়ে গ্রামে চলে এসে অজীবন দূরে সরিয়ে রাখা গ্রাম আর কৃষিকে আপন করে নেওয়ার দ্বিধান্বিত চেষ্টায় লিপ্ত। গ্রাম তাঁকে আপন করে না কোনভাবেই, ধানের জমিও তার সাথে অপরিচিত অতিথির মতো আচরণ করছিল। কিন্তু বাবা মৃত্যুর আগে শরীরের সামর্থ যতদিন ছিল সাধনা করেছেন, জমির মন পেতে। অবসরের প্রথম দিকে, আমি তার সেই চেষ্টায় সহযোগি হয়ে বেশ কয়েক মাস থেকে গেলাম। আর ধান চাষের জমিতে রোয়া রোপনের চেষ্টা করলাম নিজে নিজে। পৃথিবীর সেই সুন্দরতম মধুর মহূর্তগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেওয়া যাবেনা। আহ, সেই মুহূর্তগুলোর আনন্দময় অনুভূতি এত অসাধারণ যে, তখন কবিতাকে মনে হতো তুচ্ছ ব্যাপার। মনে হতো আমি একটি এত সজিব সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত, আর কোন কিছুর সাথেই তার তুলনা হতে পারে না। বুঝলাম, আমাদের পরিচিত শব্দ জীবন’বোধ’, যার থেকে বিবিধ কলা এবং সাহিত্য উৎসারিত, তা শহুরে মানুষের বুদ্ধিজীবীতা বা দর্শনের ব্যাপার, আর জীবন ‘যাপন’ ব্যাপারটি কৃষি কাজের সাথেই সম্পর্কিত। তবে মজার ব্যাপার হলো, কৃষক গোষ্ঠির কোন লোক যখন শহুরে মধ্যবিত্ত্বের মোটা বোধের আওতায় কিছু কথা বলে, আমরা অইটারে দর্শন বা অন্যবিধ শহুরে নাম দিয়ে বুঝতে চাই। কিন্তু, কথা হলো, ওদেরকে দার্শনিক হতে হবে কেন? দর্শন এবং এইসব ভীষণ কলা অস্থির চিত্তের অস্থিরতা। আমার মনে হল, এই জায়গা থেকে কবিতা, সাহিত্য গান শিল্পের নানান প্রকরণ এবং মানবিক তৎপরতাগুলিরে একবার সেচে দেখা দরকার।
এর একটা রজনৈতিক দিক এবং ক্ষমতাসম্পর্কও আছে। আমরা যেখানে বাস করছি, মূলত একটা কাগজের সভ্যতায়; যেটা স্রেফ কেরানিগিরি, মানে, কৃষকের ধনের হিশেবনিকেশ করেই এবং লুটপাট করেই তার সভ্যতাগিরিরে জিইঁয়ে রাখে। অথচ সেই সভ্যতায় কৃষকের কোন স্থান নেই। খাবার যোগায় কৃষক, খাবার উৎপাদন করে কৃষক, আমরা তার হিশাব নিকাশের শাস্ত্র দর্শন কবিতা সাহিত্য চিত্রকলা ইত্যাদি ফাঁপা জিনিশ শুধু ফলাই। আর কৃষক সেখানে নেই। এই যে না থাকা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রে তাদের নাই হয়ে থাকা- এই বিষয়গুলির গুরুতর পর্যালোচনা দরকার।
মন’রে কৃষি কাজ জানো না
আসলে আমরা অই কৃষকের তুলনায় একটা ছদ্ম জীবন যাপন এমন কি যাপন না, যাপনের ভান করেছি; আর ওখানে মহত্তর কিছুই নেই। এবং যখন কবিতা লিখি, তখন কৃষকের মতো লিখতে পারি না। এই বোধ যখন আসে, তখন মনটারে ঝাঁকি দিয়ে বলি; মন’রে কৃষি কাজ জানো না…
ভাবনায় পড়ে যাই, কবিতা কেন?
তারো আগে, কবিতা কী?
তারো গভীর আগে কবিতা শিল্প কৃষিকাজ এবং মানুষের সম্ভব সকল রকম তৎপরতাগুলারে আরো গভীরভাবে ভাবতে চাই। ভাবা দরকার।