আব্রাহামিক ঐতিহ্যে দুঃখভোগ একজন মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি করে, এবং অধিকতর সম্পৃক্ত করে বাস্তবতার সাথে। এটি বাস্তবতার রূঢ় ও মর্মান্তিক প্রকৃতি সম্পর্কে একজন মানুষকে সচেতন করে তোলে। এর ফলে ব্যক্তি বাস্তবতা তথা জগত সম্পর্কে তার ছদ্ম ধারণা, সংস্কার ও মোহ থেকে মুক্তি লাভ করে। একই সাথে এই সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা মানসভূমি নির্মাণ করে যা ব্যক্তিকে সত্যের প্রতি সহৃদয় করে তোলে। পরিণামে কষ্টভোগ ব্যক্তির জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিক্রমার প্রথম ভিত্তি তৈরী করে।
এগার একের সরকার কর্তৃক খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের উপর নৃশংস নির্যাতনের পর তার বিষয়ে এই ধরনের একটি কাঙ্ক্ষা ছিল আমার এবং আমার বন্ধুদের। এটা ছিলো একজন নবীন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের কাঙ্ক্ষা,— বাংলাদেশে দুর্নীতি নামক মিথের সবচেয়ে বেশী কাহিনী যাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে, সেই তারেক রহমানের প্রতি। সেই কথায় যাওয়ার আগে প্রথমত, আসুন আমরা কিছু মিথ এবং ডিসকোর্সের কথা স্মরণ করি, যেমন টেররিজম। ইনফিনিট জাস্টিস। মানবাধিকার। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করার চেয়ে, চোখ দিয়ে দেখা খুবই সহজ, কেন এগুলোকে মিথ এবং ডিসকোর্স আখ্যা দিই। আমাদের পরিচিত ডেভলপিং কান্ট্রিগুলোতে আর একটি মিথ তৈরী হয়েছে: দুর্নীতি। যারা বাংলাদেশে উপদেষ্টা সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে সরলার্থে দেখতে ভালবাসেছেন, তাদের জন্য আমার এই লেখা নয়। কারণ, ওয়ার এগেইনস্ট টেররিজমের যুগে যারা বলে যে, আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপনাদের সাথে সহমত, এবং ওয়ার এগেইন্স্ট টেররিজমের সাথে ওয়ার এগগেইনস্ট করাপশনের যে সহোদর আত্মীয়তা, তাকে বিচার করার রাজনৈতিক দায়িত্বকে অস্বীকার করে, তাদেরকে রাজনৈতিক পাঠ দেওয়া এই নোটের উদ্দেশ্য নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক হওয়া এবং রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব জাগিয়ে দেওয়া এই লেখাটির অবস্থান।

খালেদা জানেন, যে দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, এইসব কৃষকের সাহচর্য সেটিকে আরো পরিপূর্ণ করে তুলবে।
একই সাথে তার মা খালেদা জিয়ার প্রতিও আমাদের আগ্রহ ছিল। সেই সময় খালেদা জিয়ার উপর যে জেন্ডার্ড নির্যাতন হয়েছে, তার নৃশংসতা ততোধিক নির্মম ছিল। এই বিষয়ে একটি লেখায় আমি আমার পর্যবেক্ষণের কথা বলেছিলাম, সেটির সারকথা হলো: জানুয়ারী ২০০৭ এর পর দৃশ্যমান যে প্রপঞ্চটি আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল, একটি গণ বিরোধী সরকার তার লেজিটিমেসির জন্য দুই জন নারীর শরীরের উপর যেরকম নির্ভরশীল, আর কোন কিছুর উপর তেমন টি নয়। এটা শুরু হলো, সেই দুজন নারীর শরীরটারে বিদেশে চিকিৎসার অজুহাতে, সীমান্তের ওপারে বাহির করে দিয়ে দেশান্তরী করার চেষ্টার মাধ্যমে, প্রাচীন গ্রীকের মতো। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই নারীবাদের পপুলার ডিসকোর্সগুলোর রূপান্তর শুরু হল নারী এবং পুরুষের ইকুয়াল ইমপ্রিজনমেন্ট এবং শাস্তি ঘোষণার মাধ্যমে। ইকুয়াল রাইট- রাষ্ট্র যখন তার প্রবক্তা,- শাস্তি এবং নির্যাতনের জেণ্ডারড রূপ এখান থেকেই শুরু।
এখানে, এই জায়গা থেকে বুঝতে পারা সম্ভব, জানুয়ারী ২০০৭ এর পর নারীর উপরে যে নির্যাতন সেটি কতটা জেন্ডারর্ড রূপ পেয়েছে এবং কীভাবে খালেদা জিয়ার উপর এর চরম প্রয়োগ হয়েছে, তার উপরে পানিশমেন্টের জেন্ডারড রূপটা কতটা পাশবিক রূপ ধারণ করেছিল । একটি গণবিরোধী সরকারের লেজিটিমেসি দিতে বাধ্য করার জন্য তার সকল পুত্র-পরিবার গ্রেফতার হলো এমনকি কোনপ্রকারের জামিনের অধিকার ছাড়া। কিন্তু সেটাই সব নয়। একজন রাজনীতিবিদ এবং একটি মা খালেদা জিয়া দীর্ঘ সময় অন্তরীন থাকার পর তার মুমূর্ষ সন্তানকে কোর্টে দেখতে পায় এবং তার প্রথম সন্তানের স্পাইনাল কর্ড বেঁকে যাওয়ার সংবাদই শুধু শুনে না, চিরপঙ্গু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনতে হয়। এবং এটার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, ছেলেদের জিম্মি করে, যেটি হল নারীত্বের অনিবার্য অনুভূতি, গণবিরোধী সরকারের লেজিটিমেসি আদায় করা। এটি একজন নারী নেতৃত্বের প্রতি নিষ্ঠুর, চরম এবং জেন্ডারড পানিশম্যাণ্ট ছিলো অবশ্যই।
এইসব কারণে এগার একের সরকারের জেলখানা থেকে মুক্তির পর চারদলীয় নেত্রীর কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক গতিবিধি আমার আগ্রহের বিষয় ছিল। আগ্রহ ছিল তিনি কীভাবে দলের হাল ধরেন, জরুরি সরকারের মোকাবেলা করেন, জনগণের সাথে ভেঙে যাওয়া সেতু পুনর্গঠন করেন। একজন সীমাবদ্ধ মানুষ হিশেবে তিনি আমাদের হতাশ করেন নাই। খালেদা জিয়ার ধৈর্য্য, অক্লান্ত পরিশ্রম, বিনিদ্র গণসংযোগ, মানুষের কাছে ছুটে যাওয়া, ভাঙ্গা গলায় ভোটারদের সাথে অবিরাম কথা বলে যাওয়া, এইসব খুব মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। বিগত চোদ্দদিন ধরে এই বর্ষিয়ান মহিলা কোন সময়টিতে বিশ্রাম নিয়েছেন আমার বন্ধুরা বুঝতে চেষ্টা করছিল। খালেদা যখন রাত্রি দ্বিপ্রহরের পরও অঝোর কুয়াশার মধ্যে কোন এক অখ্যাত ষ্টেশনে নেমে তৎক্ষনাৎ সমবেত হওয়া হাজার হাজার জনতার উদ্দেশ্যে ভাঙ্গা গলায় ধানের শিষে ভোট চেয়ে কথা বলেন, আর গলায় গামছা বাঁধা এক অশীতিপর বৃদ্ধ শীতের কাঁপুনি উপেক্ষা করে খুশিতে লাফিয়ে উঠেন নেত্রীকে দেখে, এই দৃশ্যটি মন কাড়ে। খালেদা জানেন, যে দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, এইসব কৃষকের সাহচর্য সেটিকে আরো পরিপূর্ণ করে তুলবে।

বিপরীতে, কাচের ঘেরাটোপে বক্তৃতা দিয়েই নিরাপদ থাকতে চাইলেন শেখ হাসিনা, মানুষের কাছে গেলেন না। এই ঘটনাটি ইন্টারেস্টিং।
সবশেষে গতকাল বেতার টিভিতে দেওয়া জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তার ভাষণ শুনতে শুনতে আমার শুরুতে বলা সেই সাফারিংসের থিউরির কথাই মনে হচ্ছিল বারবার। খালেদা পেরেছেন, আমাদের আশাকে উসকে দিয়েছেন আবার। খালেদা নির্বাচনে জয়ী হোন বা না হোন, তিনিই জিতবেন। এই প্রথম আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের একজনের মধ্যে একই সাথে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর পেলাম, যেটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভরা, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে চুড়ান্ত সচেতন, বিরোধী রাজনীতি সম্পর্কে বিষোদগারে আগ্রহী নন, কিন্তু সমালোচনামূলক অবস্থান ছেড়ে দেন নাই, অবাস্তব প্রতিশ্রুতিমুখর বক্তব্যের ফুলঝুড়ি ছুটাতে ব্যস্ত নন, এবং আত্মসমালোচনা ভুলে যাননি।
খালেদা জিয়া, শুধু তাই নয়, এই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় নেতাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সতর্ক পর্যবেক্ষক হিশেবে সবচেয়ে সাহসি উচ্চারণটি করেছেন: ‘ধর্মের নামে সন্ত্রাসের সৃষ্টি এবং তাকে মোকাবেলার জন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে এই পৃথিবীকে আরো অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে লড়তে হবে, এই বিষয়ে আমরা খুবই সচেতন। তবে সেইজন্য দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কোন টাষ্টফোর্স গঠন করার প্রয়োজনীয়তা নেই। কেননা এ ধরণের কোন জোট গড়ার সঙ্গে দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে।’
যদিও এই নির্বাচনে জনগণকে কেবল স্থানীয় ইস্যু এবং জীর্ণ অতীতচারিতায় সংঘঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, খালেদা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন জাতি হিশেবে আমাদের ভবিষ্যত বৈশ্বিক পরিসরে আমাদের সঠিক অবস্থান ও ভূমিকা নির্ধারণেই নিহিত।
খালেদা, আপনাকে সালাম। আপনার জয় হোক।
লেখাটা ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখে, লেখকের ব্যক্তিগত ব্লগে ‘খালেদা জিয়া: দগ্ধ থেকে বিদগ্ধতা’ শিরোনাম ছাপা হইছিল।