Blogs

রিফাত হাসান

পাঁচ মে: বন্ধুত্ব, রাষ্ট্র ও মানুষ সম্পর্কের পুনর্বিবেচনা

May 6, 2017   0 comments   12:49 pm
Primary Author: রিফাত হাসান

ভণিতা: রাষ্ট্র ও মানুষ ভাবনা বাংলাদেশে মানুষের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তিগুলো স্পষ্ট না। ফলত, রাষ্ট্র এখানে একটা কাল্পনিক বিভ্রম তৈরি করে। বড় বড় বুদ্ধিজীবীরাও রাষ্ট্রের ক্রিটিক, বা রাষ্ট্র নিয়া অবজেক্টিভলি চিন্তা করার দায় এড়িয়ে যান। পার্টিজান আলাপ করেন। হিংস্র পশু ও ইনসানরূপী পশু (beast and unjust men) থিকা আত্মরক্ষার তাগিদেই রাজনৈতিকতার (সম্পর্ক, আসাবিয়াত) জন্ম; আরব-আফ্রিকান বংশোদ্ভূত পণ্ডিত ইবনে খলদুনের আলাপটা এই ধরনের অনুমান দিয়ে শুরু। খলদুনের পর্যবেক্ষণ বহু বছর ধরে ইতিহাস শাসন করেছে ও করছে। জর্মন পণ্ডিত কার্ল স্মিথ এইটারে বলতেছেন, শত্রু ও মিত্রের ভেদজ্ঞান। এই জ্ঞানের বাইরে কোন রাষ্ট্র নেই, সব ইউটোপিয়া। স্মিথের এই বয়ানে কোন মানুষ নেই, আছে শুধু বন্ধু ও শত্রু। অধুনা রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলাপগুলোর মধ্যে স্মিথের এই ভাব বেশ পপুলার। কিন্তু, এই বিষয়টারে আমি মানুষের সম্পর্কের রূপান্তরের জায়গা থেকে জানতে ও বুঝতে আগ্রহী। সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব। রাজনীতি হল মূলত সম্পর্কের জ্ঞান। ফলত বন্ধুত্ব দিয়েই মানুষের রাজনৈতিকতার শুরু ও গন্তব্য। বাকি সব পরের আলাপ। মানুষের রাজনৈতিকতা ও রাজনৈতিক সংগঠনের গোঁড়ার এই ভাব আধুনিক রাষ্ট্রে আইসা ব্যাহত হয়। রাষ্ট্র নিজেই বিস্ট হয়ে মানুষের বন্ধুত্বের ভাব নষ্ট করে। প্রত্যেককে নাগরিকে রিডিয়ুস করে আর আর সত্তাগুলোরে বিসর্জন দিতে বলে। এইটুকু ভণিতা দিয়ে শুরু করতে হল, কারণ আমাদের ভেতরে ঘাপটি মেরে বইসা থাকা রাষ্ট্র বিষয়ক মিথ, নাগরিক ধারণা, আইডেন্টিটি, জাতীয়তাবাদ, ঘৃণা…

Share
ভণিতা: রাষ্ট্র ও মানুষ ভাবনা

বাংলাদেশে মানুষের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তিগুলো স্পষ্ট না। ফলত, রাষ্ট্র এখানে একটা কাল্পনিক বিভ্রম তৈরি করে। বড় বড় বুদ্ধিজীবীরাও রাষ্ট্রের ক্রিটিক, বা রাষ্ট্র নিয়া অবজেক্টিভলি চিন্তা করার দায় এড়িয়ে যান। পার্টিজান আলাপ করেন।

হিংস্র পশু ও ইনসানরূপী পশু (beast and unjust men) থিকা আত্মরক্ষার তাগিদেই রাজনৈতিকতার (সম্পর্ক, আসাবিয়াত) জন্ম; আরব-আফ্রিকান বংশোদ্ভূত পণ্ডিত ইবনে খলদুনের আলাপটা এই ধরনের অনুমান দিয়ে শুরু। খলদুনের পর্যবেক্ষণ বহু বছর ধরে ইতিহাস শাসন করেছে ও করছে। জর্মন পণ্ডিত কার্ল স্মিথ এইটারে বলতেছেন, শত্রু ও মিত্রের ভেদজ্ঞান। এই জ্ঞানের বাইরে কোন রাষ্ট্র নেই, সব ইউটোপিয়া। স্মিথের এই বয়ানে কোন মানুষ নেই, আছে শুধু বন্ধু ও শত্রু। অধুনা রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলাপগুলোর মধ্যে স্মিথের এই ভাব বেশ পপুলার। কিন্তু, এই বিষয়টারে আমি মানুষের সম্পর্কের রূপান্তরের জায়গা থেকে জানতে ও বুঝতে আগ্রহী। সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব।

রাজনীতি হল মূলত সম্পর্কের জ্ঞান। ফলত বন্ধুত্ব দিয়েই মানুষের রাজনৈতিকতার শুরু ও গন্তব্য। বাকি সব পরের আলাপ। মানুষের রাজনৈতিকতা ও রাজনৈতিক সংগঠনের গোঁড়ার এই ভাব আধুনিক রাষ্ট্রে আইসা ব্যাহত হয়। রাষ্ট্র নিজেই বিস্ট হয়ে মানুষের বন্ধুত্বের ভাব নষ্ট করে। প্রত্যেককে নাগরিকে রিডিয়ুস করে আর আর সত্তাগুলোরে বিসর্জন দিতে বলে।

এইটুকু ভণিতা দিয়ে শুরু করতে হল, কারণ আমাদের ভেতরে ঘাপটি মেরে বইসা থাকা রাষ্ট্র বিষয়ক মিথ, নাগরিক ধারণা, আইডেন্টিটি, জাতীয়তাবাদ, ঘৃণা প্রমুখ সাপ বিচ্ছুটি পরিস্কার না করে মাঝখান থেকে আলাপ শুরু করলে আপনি পুরনো, পার্টিজান তর্কে ডুবে যাবেন। আমাদের এখানে যেমন হয় আর কি। ফলত আমরা আজকের এই আলাপের বরাতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্ররেও ক্রিটিক কোন জায়গা থেকে করা দরকার মনে করি, তার আলাপও করতে চাই। রাষ্ট্র বইলা যে একটা পরম কর্তৃত্বশীল বায়বীয় পদার্থ দাঁড়িয়ে আপনারে শাসন করছে, তারে, তার কর্তৃত্বরে প্রশ্ন করা দরকার।

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের প্রতি নৈতিক জায়গা থেকে প্রশ্ন তোলা, বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও যে কোন রাজনৈতিক ঘটনাঘটনের আলাপ এই প্রশ্নটির সাথে জড়িত। ৫ মে বিষয়ক আলাপটিও ব্যতিক্রম নয়। ৫ মে ২০১৩, একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে এই আলাপের। ইতিহাসে এই সময়টা শাপলা প্রটেস্ট বইলা পরিচিতি পাইছে, তার কিছুদিন আগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রথম যা সবার নজরে আসে। ঘটনাটির চার বছর পূর্তিতে, এখন, একটি অবজেক্টিভ আলাপের সময় উপস্থিত বইলা মনে হয়। কারণ রাষ্ট্রের সেই সময়ের বিরাজমান টেনশনগুলো কিছুটা প্রশমিত হইছে, হাওয়া একটু ঠান্ডার দিকে। যদিও এইটারে কৃত্রিম পরিস্থিতি বইলা ঠাহর করা যায় সহজেই। যাই হোক, রাষ্ট্রের প্রধানের সাথে সেই সময়কার হেফাজত নেতৃত্বের সাথে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক তৈরি হইছে, এইটা দৃশ্য হিশেবে অভাবনীয় ও চমকপ্রদ।

সেই দিনটি ফিরে দেখা যাক। হেফাজতে ইসলাম নামের ব্যানারে একদল নাগরিকের রাজধানীতে জমায়েত হওয়া, কিছু নাগরিক দাবী দাওয়ার কথা বলে, শাপলা চত্ত্বরে অবস্থান, এইসব ঘটেছিল এইদিন। পরে মধ্যরাতে তাদের ঢাকা ছাড়ার কথা বলে অপারেশন ফ্লাশ আউট হয়েছিল, যাতে ৩০, মতান্তরে ৬০, মতান্তরে, তাদের নিজস্ব জবানিতে ৫ হাজার হেফাজত কর্মী নিহত হয়। সমালোচকদের মতে, দুনিয়ার ইতিহাসে কোন নাগরিক আন্দোলন দমনে এই ধরনের অপারেশনের নজির নেই। হেফাজতকে বিতাড়ন করে তাদেরকে আর ঢাকায় ঢুকতে না দেয়ার হুমকি দেওয়া হইছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। পরে, অনেক পরে কিছু কিছু নিখোঁজ কর্মী ফিরে আসছে বলে মিডিয়ায় খবর আসছে, যার খবর মিডিয়া দিচ্ছে এইভাবে: মৃতরা ফিরে আসছে: বিপাকে হেফাজত। এইভাবেই হেফাজতের মিডিয়া রিপোর্টিং হইছিল।

এই জায়গা থেকে, ৫ মে ঘটনারে কেন্দ্র করে আমাদের রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবিতা ও মিডিয়াসমূহের পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। তাদের ভাষা, ভ্রুভঙ্গি ও কটাক্ষ। আমাদের বন্ধু আ-আল মামুনের মন্তব্য কোট করা যেতে পারে: ‘আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে মার্কিনি মিডিয়া যেমন রক্তপাতহীন নিপাট যুদ্ধের খবর পরিবেশন করে, আমাদের মিডিয়াগুলোও সেরকমভাবেই ঢাকা থেকে হেফাজত খেদানোর গল্প পরিবেশন করেছে’। মানে, এমবেডেড জার্নালিজম। যেন কিছুই হয় নাই, কোলেটারাল ডেমেজ ছাড়া। হেফাজত কর্মীদের খুন নিয়ে রিপোর্ট করার অপরাধে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার প্রধান গ্রেফতার হয়েছেন, যদিও হেফাজত নেতৃত্ব বলেছেন, অধিকারের রিপোর্টে হত্যাযজ্ঞের সামান্যই এসেছে। জাতীয় পত্রিকাসহ কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বন্ধ হয়েছে।

সাবঅলটার্ন নিয়া আমাদের এখানে ফ্যাশন বুদ্ধিজীবিতা আছে। গৎবাঁধা সাহিত্য-পরিভাষা, আধিপত্য ও কল্পলোক দিয়ে সবকিছুরে নৃতাত্ত্বিকভাবে ডিফাইন করার চেষ্টা করা হইছে সব সময়, হেফাজত নিয়াও তাই। তাদের নতুন কোন ভাষা বা চিন্তা নেই। ফলত গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের ঢল এসে একদিন শহর দখল করে নেবে, এই স্লোগান দিয়ে যারা একদিন সাহিত্য গান করেছিলেন, সেই তারাই হেফাজতের গেঁয়ো মানুষদের হত্যাযজ্ঞ ও শহর ছাড়া করায় যৌথ বাহিনীকে সাধুবাদ জানাইছিল। মূলত রাষ্ট্র কোন নেগোসিয়েশনে না গিয়ে তার যাবতীয় টুলস ব্যবহার করে তাদের শয়তান চেহারা বানিয়ে হত্যা ও দমন করে। এর সাথে যুক্ত ছিলো এন্থনিও গ্রামশীর সেই গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও মিডিয়া।

বাংলাদেশ বিপ্লবোত্তর বুদ্ধিজীবিতার সমস্যা

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার দীনতা বিপুল। এদের সিংহভাগই পার্টিজান ও সুবিধাভোগী। ফলত এরা দলবাজিতার বাইরে কোন কিছু দেখতে ও বুঝতে অক্ষম। এরা নিজেদের ঘেরাটোপের ভেতরে জনমনুষ্যহীন একটা আইসোলেটেড দ্বীপে বাস করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উত্থানপর্ব আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। ইতিহাসের এই ঘটনাটারে আমরা নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের বাংলাদেশ বিপ্লব বলি। কিন্তু গণ-মুক্তিযুদ্ধের পরের হঠকারি নেতৃত্ব নিজেদের দুর্বৃত্তপনা, ক্ষমতা ও অক্ষমতার প্রয়োজনে এই বিপ্লবকে আত্মসাৎ করেছেন এবং একটি প্রতিবিপ্লবী রাষ্ট্র ও নাগরিকসমাজ কায়েম করেছেন। এই প্রতিবিপ্লবী নাগরিকসমাজের প্রতিনিধি হিশেবে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণীর ভাবনা-চিন্তার একটা বড় স্রোত একাত্তর থেকে এ পর্যন্ত সুবিধাবাদী। ফলত, স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে মৌলিক ভাবনা ও বুদ্ধির চর্চা অনুপস্থিত এখানে। আবার যারা এই সুবিধাবাদের বাইরে, তারা সিরিয়াসলি ভাবতে ইচ্ছুক নন, সরল ও অবিকশিত থেকে গেছেন। যে যার রোমান্টিক জায়গায় সীমাবদ্ধ, কূপমণ্ডুক। রাষ্ট্রের কোন ঐতিহাসিক পর্যালোচনা দাঁড় করাতে অক্ষম। যার কারণে আমরা সব সময় অতীতচারি, স্মৃতিকথক, কোন বোঝাপড়ায় নেই। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবাসনার জায়গায় যে গোলযোগ তৈরি হয়ে আছে, তার ফলে রাষ্ট্রের পরিণত, মৌলিক, গতিশীল ও অবজেক্টিভ ক্রিটিক দাঁড়ায় নাই।

মূলত বাংলাদেশের উত্থান মুহূর্তে ভূমিকা পালনকারী দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী, বুর্জোয়া (সরলিকৃত অর্থে) মধ্যবিত্ত শ্রেণী-উদ্ভূত পলিটিক্যাল এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী ইন্টালেকচুয়াল এলিট; উভয়ের পাকিস্তানি হেজিমনির বিরুদ্ধে যে দৃশ্যত অবস্থান ছিলো, তা বাংলাদেশ-বিপ্লব পরবর্তি সময়ে তার চরিত্রের মৌলিক কোন ট্রান্সফরমেশন ঘটাতে পারে নি। ফলে এই উভয়বিধ শ্রেণী বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ— হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভেতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়েন ও শক্তির জায়গাগুলো— ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর আবহ নিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের যে জনপ্রিয় আগ্রহ বর্তমানে জারি আছে তাতে উল্লিখিত দুটি শ্রেণীরই ইমেজ বীরসুলভ, পর্যালোচনামূলক নয়। তাই পরবর্তি সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের র‍্যাডিক্যাল পুনর্গঠনে উভয়ের যে মৌলিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিলো, সেটি স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় প্রবলভাবে অনুপস্থিত।

ফলত রাষ্ট্র, সমাজ ও ধর্মরে সব সময়ই এই আইসোলেটেড জায়গা থেকে বিচারের পাল্লাটা ভারি। ধর্ম, ইসলাম বা ইসলামগন্ধের যে কোন কিছুরেই একরৈখিক স্কেল দিয়ে মাপতে অভ্যস্ত সবাই। মাপার স্কেল যেহেতু তাদেরই হাতে, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতই মাপেন। এইটা মূর্খতা ও গোয়ার্তুমি বিশেষ। সমাজ থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা।

অথচ সমাজ খুব সজীব জায়গা, রাষ্ট্রের বাইরে এইটার অন্য যে ডাইনামিক্স ও শক্তিমত্তার জায়গা আছে, তা উনারা বুঝতে অক্ষম। ফলত জামাতে ইসলাম বলুন আর হেফাজতে ইসলাম, উনাদের কাছে সবই এক। যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নরেও ওরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের চেয়ে জামাত রাজনীতি বা ইসলামি রাজনীতিরে বিচারের টুলস হিশেবে নিয়েছে। অন্তত বুদ্ধিজীবীকুল। হেফাজত প্রশ্নেও তাদের অবস্থান অন্ধের হাতি দর্শনের মত। অথচ উভয়ই দুই প্রান্তের ব্যাপার। ফলত বাংলাদেশে সামাজিক মুভমেন্টগুলোর ভেতরকার ডাইনামিক্সগুলো ধরতে উনারা ব্যর্থ। এখন উনারা যে ভাষায় ওদের বিষয়ে কথা বলেন, তা অনেকটা ক্লাসিক্যাল এনথ্রোপলজিস্টদের একটি বিশেষ ঘরানার গবেষণা পদ্ধতির কথা মনে করিয়ে দেয়, যা ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখা বা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে যাবতীয় জ্ঞানীয় টুলস সরবরাহ করেছিল।

অপরাধ, শাস্তি ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থা

৫ মের ঘটনাপঞ্জির পপুলার বিবরণগুলো আপনারা দেখেছেন ও পড়েছেন। এখন, এই লেখার দায় হলো যা কিছু উহ্য ছিলো, যে আলাপ হয় নাই তারে সামনে নিয়ে আসা। নাহ, কোন গোপন সত্য তুলে আনার ব্যাপার না। যা আপনাদের চোখের সামনে ঘটেছে কিন্তু ভিন্ন পাঠ করেছেন। মানবিক মর্যাদা ও তার অপমান তখন আপনারে পীড়া দেয় নাই, যখন একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য আপনারা টিভির সামনে বইসা এনজয় করছিলেন। তা হলো— ৫ মে ঢাকা দখলমুক্ত করার সময়ে হেফাজত কর্মীদের কান ধইরা বসায়া রাখা। মিডিয়াকর্মীরা তাচ্ছিল্যভরে সেই ছবি পরের দিন প্রচার করে। কোন রাজনৈতিক আন্দোলন দমন-নিপীড়নের ব্যাপার শুধু নয়, আরো গভীরতর আলাপ এইটা। রাজনীতিতে আমাদের বিভিন্ন পক্ষপাত আছেই। আমাদের পক্ষপাতগুলোর রাজনৈতিক জয়-পরাজয় ঘটে। এই ন্যূনতম বৈপরীত্য ও জয়-পরাজয় মেনে নিয়েই আমরা রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব নিয়ে বসবাস করি। কিন্তু রাষ্ট্রে একত্র বসবাসের কিছু কনসেনসাস থাকে। সেই কনসেনসাসগুলো আমরা ভুলে যাই। এই ঘটনার সাথে মিলিয়ে আমি পাঠ নিতে আগ্রহি অপরাধ ও শাস্তি ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বইসা থাকা প্রাসাদসম দৈত্য দানবগুলোরে।

অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থার অন্তর্গত দর্শন হল সংশোধন ও জনশৃঙ্খলা। শাস্তিরে যদি ডিভাইন ব্যাপারও ধইরা নিই, তাও এর উদ্দেশ্য হলো পরকালীন মুক্তি। মানে, এই শাস্তির মাধ্যমে তার অপরাধমুক্তি ঘটবে ও পরকালে বঞ্চিত হবে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদিও আমাদের ভাববার সময় অল্প, কিন্তু গভীরভাবে ভাবা দরকার। মূলত বাংলাদেশে অপরাধ ও শাস্তিব্যবস্থার নামে যারে প্রমোট করা হয় তা হল অপমান, ঘৃণা ও প্রতিশোধ ব্যবস্থা। সেই জন্যই আমরা শাহবাগ মুভমেন্টের পরে বাংলাদেশে যে আইনের অব্যবস্থা ও প্রতিশোধ ও অপমানের সংস্কৃতি চালু হয়— তার সমালোচনা করি। কারণ বিচারের পরিবর্তে কেবলই ফাঁসি চাওয়া, অপমান ও প্রতিশোধের ভাবনা এবং তা যে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন তৈরি করছে তা আমাদের কোথায় পৌঁছুবে বলা মুশকিল, সেই সময়ে আমরা বলছিলাম। এখন স্বয়ং প্রধান বিচারপতির ভাষ্য: দেশে পূর্ণ আইনের শাসন নেই। ফলত, ৫ মে ঢাকা দখলমুক্ত করার সময়ে হেফাজত কর্মীদের কান ধইরা বসায়া রাখা— এইটা আপনি তেমন খেয়াল না করলেও, একটা বড় ঘটনা। না শাস্তি, না দমন, এইটারে নাগরিক অপমান বলা যায়। মিডিয়ায় তাদেরে ছোট ও তুচ্ছ কইরা প্রচারের কারণে এই অপমান আরো বড় হয়েছে। রাষ্ট্রের বা মিডিয়ার এই অধিকার নেই। এমন নাগরিক অপমান সম্ভবত বাংলাদেশ বা অন্য কোন ইতিহাসে তেমন একটা ঘটে নাই। এইসবই হলো সেই ফেনা, যার তলায় দাঁড়িয়ে ছিলো শাহবাগ। অপমান, ঘৃণা ও প্রতিশোধ ব্যবস্থা ছড়িয়ে যার শুরু। এই অবস্থার বিরুদ্ধে মানবিক মর্যাদার জন্য লড়াইটা তাই আমাদের শাহবাগ ও তার স্পন্সর রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই লড়তে হবে— একটি মানবিক রাষ্ট্রের জন্য।

এই ঘটনার পরে আরো ঘটনা ঘটেছে। আপনাদের মনে পড়বে, শ্যামল কান্তি নামে এক শিক্ষকের ঘটনা। হেফাজত কর্মীদের কানে ধইরা বসায়া রাখার ঘটনার সাথে কিছুটা তুল্য দৃশ্য এইটা। যখন নারায়নগঞ্জে শিক্ষক শ্যামলকান্তিরে ইসলাম অবমাননা করার অভিযোগে কানে ধইরা উঠবস করানো হয়, আমরা বলেছিলাম— এই ঘটনার ভেতরে সংখ্যাগুরুর বাহাদুরি থাকে, গ্রাম্য মাতব্বরি বুদ্ধি থাকে, প্রতিশোধস্পৃহা ও অমর্যাদা ও অপমান থাকে— আর কিছু থাকে না। বলেছিলাম, শ্যামলকান্তি যদি কোন অপরাধ কইরা থাকেন— নবী বিষয়ে কটুক্তি ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ঘৃণার প্রচার— তার আইনি সমাধান আছে— অন্তত আইনে। মূলত সামাজিক যে বিচার ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চালু আছে— রাষ্ট্রের অব্যবস্থার বিপরীতে আমি তার প্রমোটর হলেও— কখনো কখনো এর সাথে রাষ্ট্রের মালকিনরা জড়িত হয়ে পড়লে অপমান ও অসামাজিক শাস্তি ও প্রতিশোধ প্রথাই এর মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন গলায় জুতার মালা পরিয়ে হাঁটানো— কানে ধরে উঠ-বস-বেত্রাঘাত— ইত্যাদি অপমান। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আদালতেও কখনো কখনো এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটে না। যেমন রাষ্ট্রের নাগরিকদের এজলাসে দাঁড় করিয়ে অপমানের ঘটনা বা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে নাগরিকদের কটাক্ষ করার ঘটনা।

মূলত বুদ্ধিজীবী, সরকারী মিডিয়া ও শাসক গোষ্ঠীর আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ধারণা কিম্ভূত। তার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার। জনপ্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ আর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড একই ঘটনা নয়। সব আলো বন্ধ করে দিয়ে, রাতের অন্ধকারে, নিরস্ত্র, ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, ইবাদতরত ও ঘুমন্ত জনসমাবেশের উপরে হামলা কোন আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজ নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার এর কথা বলা হচ্ছে এখন, এটি সেই ঘটনা। এইটা আপনারা অনেকেই মানেন না, অথচ আপনারা বিচার চান। কীভাবে, কোন দর্শনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের এই চাওয়া?

রাষ্ট্র ও সমাজ: রাষ্ট্রর ধর্ম হয়ে ওঠা

এই অবস্থার একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে। তা হল, রাষ্ট্র সর্বেসর্বা হয়ে বইসা থাকে প্রভুর আসনে। এইটারে আমরা বলি, রাষ্ট্রের ধর্ম হয়ে ওঠা। নাগরিক বইলা একটা অথর্ব গোষ্ঠী তৈরি করা হয়ে গেছে, যার কোন চরিত্র নেই। এইটারে আমরা একাত্তর পরবর্তি প্রতিবিপ্লবী নাগরিক সমাজ বলেছি। ফলত, রাষ্ট্রের অটোক্রেটিক হতে সমস্যা থাকে না, এইটাতেও সমন্বিত কনসেনসাস দেখা যায়। কনসেন্ট নয়, কনসেনসাস। মানে, কনসেন্ট বা জনমত বইলা কিছুর তোয়াক্কা না করার সর্বসম্মত চয়েস। ফলত সমাজ সামনে আসে।

আমাদের এই আলাপে সমাজ গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই ৫ মের ডাইনামিক্স বোঝা যাবে। ২০১৭ সালে আইসা কেন শেখ হাসিনা সেই হেফাজতের খড়কুটো ধইরা দাঁড়িয়ে যেতে পারলেন। এইটার উত্তর সমাজে। হেফাজত নাগরিক আন্দোলন হলেও, তার রুটস সমাজে, যার স্টক হোল্ডার বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দল। এখানেই হেফাজতের শক্তিমত্তা। তাই, দেখা যায়, হেফাজত বাংলাদেশের দলগত রাজনীতির ধার ধারে না, মূলত সামাজিক আন্দোলনই হেফাজতের আন্দোলন। কিন্তু নাগরিক বুদ্ধিজীবীরা এইটারে রাজনৈতিক আন্দোলনে রিডিয়ুস করতে চেয়েছেন। উনারা হেফাজত বা কওমি সম্প্রদায়ের ডাইনামিক্স বুঝতে পারেন নাই। দেখা গেছে, বিএনপির সরকার পতনের দায়িত্ব হেফাজত নিয়া বইসা আছে বইলা একটা ভুল তথ্য ছড়াইছে এর দ্বারা। যা ভুল বইলা প্রমাণিত হইছে।

ফলত উনারা, নাগরিক বুদ্ধিজীবীরা সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ধরনের আলাপ তুলে থাকেন। কিন্তু এইটা একটা দ্রুত সমস্যা নিরসনের চিন্তা ও সমাজরে ভেতর থেকে নিতে না পারার সমস্যা। সমাজ তো গণতন্ত্র প্রশ্নের সাথে একই ক্যাটাগরিতে আলাপযোগ্য না। গণতন্ত্র হল রাষ্ট্র প্রশ্ন। উদার সমাজ নিয়া গণতন্ত্রে বা নাগরিকতার নিক্তিতে আলোচনা তাত্ত্বিকভাবেও শুদ্ধ না। বরং আমি মনে করি, সমাজসমূহের স্বয়ম্ভুতা ও নিজেদের ভেতরে সম্প্রীতি প্রশ্নরে সামনে এনে নাগরিকতা প্রশ্নরে ক্রিটিক করতে হবে। আমাদের নাগরিক বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রে নাগরিকদের ভেতরে আইনি বন্ধনরে সমাজ ঠাওরিয়ে কথাবার্তা বলেন, প্রায়ই দেখা যায়। যেখানে অধিকারই সব। কিন্তু সমাজ শুধু অধিকার সর্বস্ব না। আমরা যদি স্রেফ নাগরিকতার পূজারি হই, তখন যারা রাষ্ট্রের জালিম চরিত্রের বিলয়ের কথা বইলা একটা মানবিক প্রকল্পের উদ্ধোধনের প্রশ্ন আনেন, তাদের জন্য এই আলাপ আমাদের কোন কাজেই আসবে না।

রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর আর সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর— দুটি ভিন্ন প্রত্যয় ও প্রশ্ন। একটি প্রচলিত ব্যবস্থারে সহনীয় করার প্রকল্প, যেমন সিভিল সোসাইটি। রাষ্ট্ররে ব্যালেন্স করার জন্য রাষ্ট্রেরই অন্তর্গত আর একটি অংশ। সেখানেও নাগরিকের বাইরে কিছু থাকে না। এইটা সমাজকে ভাগ না, রিডিয়ুস করছে নাগরিকে। আমি তার প্রশ্নে ক্রিটিক্যাল থাকতে চাই। কিন্তু সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, এটি অন্ধ বিশ্বাস মাত্র। সমাজের কোন গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটে না। বরং সমাজের সাথে গণতন্ত্র প্রশ্ন আনলে সমাজ থাকে না, অইটা রাষ্ট্র হযে যায়। অধিকার খুব ছোট জায়গা। এত ছোট জায়গা যে, যার অধিকার তাকে অধিকার অধিকার বইলা চিল্লাইতে হয়। কিন্তু সোসাইটির জায়গায় রাষ্ট্র ও সমাজ সমানে সমানে একে অপরের সাথে নেগোশিয়েট করতে বাধ্য হয়।

ফলত, সমাজকে ইগনোর কইরা নাগরিকে রিডিয়ুস করে ফেলা আর সামাজিক শক্তির জায়গার সাথে নেগোসিয়েশন, এই দুই ঘটনার মাঝখানে একটা ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্টে নিয়ে আসার ব্যাপার আছে।

আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র হল, এইটা প্রত্যেক মানুষকে আলাদা আলাদা পার্টিক্যালে পরিণত করে, প্রত্যেককে অক্ষম ও আলাদা পার্টিক্যাল হিশেবেই জিইয়ে রাখতে চায়। আর সোসাইটি পার্টিক্যাল না, সমগ্র। সমাজ ইডিওলজিক্যালি অথবা অরগানিক্যালি ফর্মড হয়। এর বেসিক হচ্ছে ইডিওলজি। এই ইডিওলজি ব্যাপারটারে নাই করে দেওয়ার জন্যই রাষ্ট্র হইছে। ইতিহাসবিদ মঈনুদ্দীন আহমদ খানের মত স্মরণীয়: আধুনিক রাষ্ট্র হল একটা প্রটেস্ট্যান্ট ব্যাপার। এইটা ধর্মরে প্রটেস্ট করে। তবে, সমস্যা হলো, উল্টা নিজের ধর্ম হয়ে ওঠার চেষ্টা।

ফলত, সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা যায়, শেখ হাসিনা সমাজকে ডিল করতে চাচ্ছেন। রাষ্ট্র যখন সমাজকে ডিল করা শুরু করবে তখন পলিটিকসের জন্য সেইটা নতুন অভিজ্ঞতা ও সম্ভাবনা। হিস্টোরির অবজেক্টিভ ফ্রেমওয়ার্কটাই এমন যে, হাসিনাকে এই রেসপন্সই করতে হচ্ছে। হেফাজতকেও। এই ঘটনায় অনেকেই অবুঝের মত গোস্বা হইছেন, কিন্তু এইটা হিস্টোরির অবজেক্টিভ রেসপন্স। এইটা সিটিজেন মেকার্সদের ট্রাজেডি যে, উনারা সমাজের ডাইনামিক্স ধরতে পারলেন না। আর একটা গ্রুপ তো বর্ণবাদী, এদেরে রাষ্ট্রের জায়গায় আদার কইরা দিয়ে, গুলি করে, ঢাকা ছাড়া করতে পেরে খুশি ছিলো, এখন হঠাৎ রাষ্ট্র সমাজের সাথে কেন বসতে চাচ্ছে তাই নিয়া গোস্বা। তাই, রাষ্ট্রনায়করা যদি নিজেদেরকে নেগোশিয়েট করার জায়গায় এইরকম নতুন ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়, এইটা ওয়াইজম্যানশিপ। রাষ্ট্র যখন ফর্ম হয়, তখন তো তাকে নাগরিক বানানোর ধান্ধা করতে হয়। এই ধান্ধায় তাকে নানান বুদ্ধিজীবীও পালতে হয়। তখন সে বুদ্ধিজীবীদেরকে দায়িত্ব দিয়ে দেয় যে, মানুষকে সর্বোচ্চ নাগরিক হিশেবে অনুভব করতে শেখানো, নিজে নিজে।

কিন্তু সমাজ শক্তিশালী জায়গা, কারণ সে পার্টিক্যাল নয়। যেহেতু নাগরিকে রিডিয়ুস হয় না। সে প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে ইগনোর করে, যেমন কওমি মাদ্রাসা। প্রটেস্ট করে, যেমন ৫ মে। ফলে এখানকার রাষ্ট্রকে এখন ভাবতেই হচ্ছে যে, কম্যুনিটির সাথে সে কী রেসপন্স করবে। হাসিনার এই পদক্ষেপ সেইটারই অংশ কিনা, হাসিনার ওয়াইজম্যানশিপ কিনা, ভেবে দেখতে হয়। হাসিনা ইতিহাস ঘটিয়ে দিয়েছেন, শত বছরের কওমি লিগেসিকে গুরুত্ব দিয়ে, তার সাথে নেগোসিয়েশনে গিয়ে নিজের ওয়াইজম্যানশিপ বোঝাতে পেরেছেন, যদি এটাই তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। ফলত এইটা আশা করা যায় যে, এইসব বিষয়ে কাজ করার জন্য নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীরও উদয় হবে।

হেফাজতের আন্দোলন

হেফাজতের মূল শেকড় সমাজে হলেও, তাদের আন্দোলনের চরিত্র মূলত নাগরিক আন্দোলন। নাগরিক আন্দোলন, সমাজের শক্তির জায়গা থেকে। হেফাজত ও বাংলাদেশের ইসলামী ধারার জনগোষ্ঠী ইতিহাসের অপর। বাংলাদেশ বিপ্লবোত্তর প্রতিবিপ্লবী নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা নির্মিত আধিপত্যবাদী ইতিহাসে এরা ‘অদেশপ্রেমিক’ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ‘অপর’ হয়ে ছিলো। ফলত পপুলার মিডিয়া হেফাজতকে অপর কইরা তাদের নাগরিক আন্দোলনের অধিকারকেও নাই কইরা দিছে। এদেরকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলখেল্লাধারী ‘দেশপ্রেমিক’ এবং সাংস্কৃতিক বর্ণবাদীদের কামনা-বাসনা থেকে আলাদা করে বোঝার দরকার আছে।

অরাজনৈতিক সংগঠন, এইটা হেফাজতের ডাইনামিক্স, শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা। এদের শক্তি ও ভিত্তি হচ্ছে সমাজ। যে সমাজে সব রাজনৈতিক দলের স্টক আছে। ধর্ম, এইটারে ইগনোর করে কিছু ইহতে পারে না। হেফাজত এর সাথে আর আর ইসলামী দলগুলোর পার্থক্য হল, হেফাজতের ৭১ এর কোন অপরাধবোধ নেই, এরা সবার আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্ররে ঔন করে। হেফাজতের এপ্রিলে হওয়া প্রথম লংমার্চে কলেমা খচিত পতাকার পরিবর্তে বেশির ভাগই দেখা গেছে বাংলাদেশের পতাকা। ফলত এইটারে যুদ্ধাপরাধ দিয়া বিচার করা সম্ভব হবে না, ইসলামী দল জামাতের মত। কিন্তু জামাতের মত ওরা কোন ধর্মীয় রাষ্ট্রর কথা কয় না, এইটা খেয়ালে রাখতে হবে। কারণ তাদের রুটস সমাজে, রাষ্ট্রে না।

হেফাজতের আন্দোলন অরাজনৈতিক, তাইলে আপনার সবিস্ময় প্রশ্ন: তাহলে কী ছিলো আপনাদের শাপলা চত্বর। এই জায়গায়, আমার মনে হয়েছে, হেফাজত, ১৩ দফা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ইসলাম এইসবের একটা একত্র রাজনৈতিক পর্যালোচনা হাজির করা প্রয়োজন। তো, দেখা যাচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে আমাদের যে বোঝাপড়া, হেফাজত সচেতনে বা অচেতনে তার অংশ নয়। বা আদতেই হেফাজতের আন্দোলনটির স্বরূপ কী?

হেফাজত কোন নয়া রাজনীতির বয়ান প্রস্তাব করে নাই। সে চেষ্টাও তাদের ছিলো না। ধর্মরাষ্ট্র বা ইসলামী রাজনীতির যে পপুলার বয়ান, যেমন উপমহাদেশে জামাত বা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্রাদারহুডের রাজনীতি, তার মধ্যেও ওরা যায় নাই। বিএনপি আওয়ামীলীগের মতো দলীয় রাজনীতিতেও ওদের আগ্রহ নেই। আপনি বরং এর একটা সেক্যুলার চরিত্র পাবেন পপুলার ধর্মনিরপেক্ষ বয়ান মতে, যখন ওরা বলে যে, আমাদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই, কিছু ন্যূনতম দাবী দাওয়া আছে শুধু। যা আপনারা যে কোন দলই সমাধান করতে পারেন। নাগরিক অধিকারের জায়গায়, তাদের নিজেদের ভাষায়, কিছু দাবী দাওয়া পেশ করেছে মাত্র ওরা।

অনেকের মতে ওরা ব্লাসফেমি আইন এর দাবী করেছে। এইটা অসত্য। সত্য হলো ওদের সেই সময়কার তের দফায় ব্লাসফেমি আইনও নেই। ওরা মুসলমানের নবী হয়রত মুহাম্মদ স. এর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারকারীদের বিচার ও শাস্তি দাবী করেছে। এই দাবীকে অন্যদের সম্মিলিত ঘৃণা প্রচারের বিপরীতে ওদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা হিশেবে দেখা যায়। বরং এই জায়গা থেকে এই আলাপ তোলা জরুরি ছিলো যে, আপনি কারো ডিফেইম বা কুৎসা ও গালাগাল করার অধিকার রাখেন কিনা, এইটা সেক্যুলার প্রশ্ন। ইতিহাসে ব্লাসফেমি আইন নামে যা হাজির, তাও মূলত একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্ন, যা তার ভেতরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিবাদ এবং অস্থিরতাগুলো থেকে বাঁচিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে নিরাপদ করে।

হেফাজত যেহেতু নাগরিক মুভমেন্টই করেছে, দল নয়, আর আর নাগরিক মুভমেন্টগুলোর মতই হেফাজতরে ক্রিটিক করা দরকার।

হেফাজতের নারী প্রশ্ন, ক্ষমতার ক্রিটিক নেই বললেই চলে। হেফাজত যেই ধরনের ইসলামের কথা কয় তারে প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু হেফাজত বা কওমিদের যে সামাজিক ভিত্তি আছে, আর যে গণতান্ত্রিক এপ্রোচ আছে, তা বাংলাদেশে হাজির এক্সট্রিমিস্ট পন্থা যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা আইএস বা জামাত, তাদের সাথে ক্ষমতার একটা ইকুলিব্রিয়াম পয়েন্ট তৈরি করে। হেফাজত চরমপন্থী না।

ইসলামী চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটা ভাল রিমেডি, নেগোসিয়েশন ও আলাপ চালানোর জায়গা হতে পারে হেফাজত। বর্তমান বিশ্বে, এমন কি বাংলাদেশেও এইটা আপনার ভ্রুভঙ্গি ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং বাংলাদেশে আর আর রিএ্যকশনারি গোষ্ঠী যেমন আওয়ামীলীগ, বিএনপি বা জামাতের তুলনায় হেফাজত বা কওমিরা অধিকতর গণতান্ত্রিক। আর আর ইসলামী মুভমেন্টগুলোর তুলনায়ও। অন্যেরা ফ্যাসিস্ট। এইটা গুরুত্বপূর্ণ।

কওমি মাদ্রাসা: দাস ব্যবস্থা?

দাস ব্যবস্থা, কওমি মাদ্রাসা নিয়া এই ধরনের একটা কথা হইছিল ২০১৪ সালে, একটি পপুলার নিউজ পোর্টালের গোল টেবিল বৈঠকে। কিন্তু কে কার দাস? যে সমাজে পুঁজিই ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরের প্রশ্নহীন দাস সকল প্রশ্ন করছে, দাস। আধুনিক মানুষের এই মুক্তি চাওয়ার গল্প আর এক দাসত্বের অহঙ্কার থেকে উদ্ভূত।

আমরা ইতিহাসে আক্ষরিকভাবে দাসযুগ অতিক্রম করেছি, এইটারে অস্বীকারও করতে ভালবাসি। কিন্তু পুঁজির দাস হওয়ারে গ্লোরিফাই করি। সভ্যতা, আধুনিকতা, আলোকায়ন। নিজের এই দাস ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থেকে, যারা অনাধুনিক, পুঁজির প্রশ্নহীন দাস নহেন, তাদের মুক্তি দাবি করি। নচেত সামরিক অভিযান চালাও। ঢাকা ছাড়া করো। এইটা হলো, আধুনিক ও বর্ণবাদী মন, পুঁজির সেবাদাস শ্রেণী। এদের এই সামরিক অভিযানেই আনন্দ। এই মুক্তি চাওয়ার সাথে গণহত্যার বাসনা জড়িত।

এই দাসতাত্ত্বিকদের পূর্বানুমাণ হলো, আধুনিকতা জগতের শেষ ও চুড়ান্ত পরিণতি। তাই আধুনিকতার পূর্বানুমাণগুলোর ভিত্তিতে এরা অনাধুনিক বিষয়গুলোরে বিচার এবং শাস্তি দিতে ইচ্ছুক। আধুনিকতার বাইরে কি কোন কিছুরই অস্তিত্ব সম্ভব নয়? এটি শুধু প্রশ্ন নয়, এই রকম সম্ভাবনা যদি আমি না ভাবতে পারি, তাহলে মানুষ হিশেবে আমার অস্তিত্ব অর্থহীন। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে আধুনিকতার বাইরে যারা চিন্তা করতে সক্ষম, তার মধ্যেই কেবল সম্ভাবনা জিইয়ে আছে। সম্ভব হলে, ননসেন্স কিছু কথা কওয়া দরকার। আমরাও কই, কবিতায়, তবে আধুনিক আধিপত্যবাদী ভাষায়। আমাদের রেশনাল মন এই ভাষাটিরেও রেশনালিটির অঙ্গ হিশেবে তৈরি করে নিয়েছে। তাই, এমন কি এই ভাষাটিরেও ভাঙ্গা দরকার।

একবাল আহমেদ এর বয়ান ও হান্টারের বিবরণ

একবাল আহমেদ তাঁর Islam and Politics নামক লেখায় আলোচনা করেছেন, মুসলমান ও আলেম-ওলেমাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ কীভাবে ও কী কারণে পপুলার বয়ানে অরাজনৈতিক হয়ে উঠেছে ৬৫০ সালে উমাইয়াদের খেলাফত দখলের পর। ট্রেডিশনাল আলেমগণ কেন মুসলিম রাষ্ট্রের ইসলামী চরিত্রকে অস্বীকার করে তার থেকে দূরে রাখে নিজেদেরকে, তার পিছনে তিনটি প্রধান কারণ আছে বলে মনে করেন একবাল। এক চার খলিফার পর থেকে হাতে গোণা কয়েকজন শাসক ব্যতিত (যেমন ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (৭১৭-২০)) বাকী কেউই ধর্মনিষ্ঠ নন (presumed impiety)। দ্বিতীয়ত মুসলিম রাষ্ট্র কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষ (secular) আইন ও তার চর্চা ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে প্রায় সর্বত্র। তৃতীযত ইসলামী বিশ্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক খণ্ডাংশে বিভক্ত থাকলেও (যেমন সুলতানাত, আমিরাত, শেখ বা বর্তমানের প্রজাতন্ত্র) নীতিগতভাবে সকল ধর্মতাত্ত্বিকগণ স্বীকার করেন যে, একক মুসলিম উম্মাহ (single Umma (Muslim nation)) ও একজন খলিফার (Caliph (or Imam)) অস্তিত্ব ব্যতিত আর কিছুই ঐশি আইনে (divine laws) এবং রাসুলের উদাহরণে স্বীকৃত নয়। একবালের মতে, উল্লেখিত তিনটি উপাদানের অনুপস্থিতিতে, আলেমগণ প্রায় এক হাজার বছর ধরে জন্ম নেওয়া মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব এবং আধুনিক কালের সরকার পদ্ধতি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনাকে অন্তত একটি শর্তে স্বীকার করে নিয়েছে— রাষ্ট্রক্ষমতায় ন্যূনতম ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে এবং জনসাধারণের ন্যূনতম আস্থা অর্জনে সক্ষম হতে হবে।

সূত্র: Islam and Politics/ Eqbal Ahmad : 1985। বাংলা অনুবাদটি মোহাম্মদ আজগর খান সম্পাদিত ও হাসান আজিজুল হক এর মুখবন্ধে অনূদিত ইসলামী রাজনীতি ও রাষ্ট্র: পাকিস্তান অভিজ্ঞতা / ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে নেওয়া, মূল টেক্সটের সাথে মিলিয়ে ঈষৎ সম্পাদিত।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাকর (civil servant) ও উপদেষ্টাদের একজন ডব্লিউ হান্টার এর বর্ণনা ইন্টারেস্টিং। আলেমদের জিহাদী আন্দোলনে দিশাহারা ইংরেজ সরকারের জন্য একটি গবেষণা সন্দর্ভ তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলেন হান্টার সাহেব, যার ফলশ্রুতিতে তার বিখ্যাত দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস বইটি লেখা। তার বইয়ের শুরুতে তিনি অবাক ও আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করেন, ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা’ অকৃতজ্ঞ মুসলমানরা ‘প্রকাশ্যে কোন রকম রাখ-ঢাক ছাড়াই শুধু একটা আলোচনাকে গুরুত্বের সাথে সামনে নিয়ে আসছে বারবার, সেটা হল, ইংরেজ বাহাদুরের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ করা ফরজ কিনা। বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতেও শুধু এই আলোচনা। উত্তর ভারতের আলেম সমাজ এবং বাংলার মুসলমানরা ফতোয়া ও ইশতেহার জারি করেছে জিহাদ নিয়ে। এমনকি সংখ্যালঘু শিয়ারাও এ ব্যাপারে নিজেদের মুদ্রিত মতামত জানিয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সে ইসলামের খাঁটি পাবন্দ হয়ে চলবে, নাকি মহারাণীর শান্তিপ্রিয় প্রজা হিশেবেই বাস করবে— সে সম্পর্কে।’ তো বইয়ের শেষদিকে হান্টার সম্মুখ সমরগুলোতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বা জিহাদ মুসলমানদের উপরে ফরজ কি ফরজ নয়, এই নিয়ে আলেমদের মধ্যে যে ফতোয়াযুদ্ধ শুরু হল, তার বিবরণ দিয়েছেন। ফতোয়ার বিষয়: দারুল হরবে, নাকি দারুল ইসলামে জিহাদ ফরজ। মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির ফতোয়া, যেখানে পূর্বানুমান ছিলো ইংরেজ অধ্যুষিত বাংলা হল দারুল ইসলাম। সুতরাং এখানে জিহাদ ফরজ নয়। আবার আর এক গ্রুপের ফতোয়া, যেখানে পূর্বানুমান ছিলো ইংরেজ অধ্যুষিত বাংলা হল দারুল হরব, এবং এই দারুল হরব যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ ফরজ নয়। পরের বক্তব্যটিকেই ইংরেজ সরকারকে প্রমোট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন হান্টার তার সন্দর্ভে। এর ফলে এইটা একটা দারুল হরব হিশেবে প্রতিষ্ঠা পায়, আবার অন্যদিকে বেপরোয়া নেটিভদের জিহাদী আন্দোলন থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে।

আজকে যে কওমি মাদ্রাসা ও তার নেসাব নিয়ে শাসক গোষ্ঠী আতঙ্কিত, তখনও হান্টার একই আতঙ্ক ব্যক্ত করেছিলেন। হান্টার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে শুধু নয়, ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসা থেকে যারা বেরুচ্ছে, তারাও এক একটা জেহাদ প্রচারকারী হুজুর। এর কারণ হিশেবে তিনি মাদ্রাসার পাঠ্যে জেহাদ এর চ্যাপ্টারকে দুষলেন।

সূত্র: দি ইণ্ডিয়ান মুসলমানস/ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার/ ১৮৭১/ অনুবাদ: আব্দুল মওদুদ। আহমদ পাবলিশিং হাউজ।

একবাল আহমদের এই বয়ান বা হাণ্টারের এই বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ, যা হেফাজতের অরাজনৈতিক অবস্থানগুলোর ব্যাপারে আমাদের বোঝাপড়াতে সহযোগিতা করবে। একবালের বয়ানে যে শর্ত তার সাথে হান্টারের বিবরণে যে ফতোয়ার কথা আমরা পাই, তার কিছুটা মিল আছে। সেটি হল, মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করা বা রাষ্ট্রক্ষমতায় ন্যূনতম ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করার শর্ত। হেফাজতের ঘোষণায় দেখা যায়, এইরকম কিছু শর্তে ওরা আজও অরাজনৈতিক হয়ে থাকছে, তাদের আন্দোলনে, তাদের কর্মসূচীতে, নিজেদের ভাষায়।

পর্যালোচনা ও উপসংহার

হেফাজতের আন্দোলনের ভাবটি হচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, আমরা আগেই বলেছি। যার ভেতরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দাবী দাওয়া আন্দোলনটিকে একটা জাতীয় রূপ দিয়েছে। হেফাজত এর আন্দোলন আমাদের নাগরিক অধিকার ধারণাটির বর্ণবাদী অংশটিরে প্রশ্ন করতে সক্ষম হয়েছে। ঘৃণা প্রচার এর বিরুদ্ধে এদের আন্দোলনকে আমরা মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বলেছি। এদের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক নয়, বড়জোর র‍্যাডিক্যাল বলা যায়। এরা আধুনিকতার প্রশ্নহীন ভোগী নয়, যা আমাদের ভোগী ধারণার জীবন-প্রশ্নের সাথে এদের সম্পৃক্ত করে না। তাই আমরা বর্ণবাদী এদের সাথে আচরণে। কিন্তু এর বাইরেও হেফাজতের আন্দোলনের নিস্পৃহ পর্যালোচনা করা দরকার।

অন্যান্য ধর্মীয় ভাবধারাগুলোর মধ্যে ইসলামের গুরুত্ব হচ্ছে, এটি ইহজাগতিক প্রশ্নগুলোর অমীমাংসা রেখে দেয় না, মোকাবেলা করতে বলে। রাজনীতি, রাজনৈতিকতা, আইডিয়া, আইডিওলজি— এইসব শব্দের সাথে ইসলামের যে ক্লাসিক্যাল আক্বিদা-চিন্তা উম্মাহ ও খেলাফত ভাবনা, তার সম্পর্ক ও ব্যবধান এখনতক পদ্ধতিগত আলোচনায় খুব একটা হাজির নেই। আধুনিক রাষ্ট্র ভাবনার অন্দরমহল থেকে ইসলাম প্রশ্ন তোলার জন্য আলাপ দরকার। এটি পরিষ্কার না করে কথা বললে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। আমি মনে করি, ইসলামের ভেতর থেকে কোন ইসলাম প্রশ্ন উদয় হয় না। ইসলাম প্রশ্ন হলো যখন আপনি বাহির থেকে ইসলামকে মোকাবেলা করতে চাহেন, সে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বা আপনার বিপ্লবী চিন্তায় বা আপনার পুঁজিবাদী আগ্রহে ইসলামরে কীভাবে জায়গা দেবেন, সেই প্রশ্ন। আবার, ইসলামের জায়গা থেকে আধুনিক রাষ্ট্রভাবনা ও রাজনীতিরে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, হেফাজত এর এই বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা পলায়নপর, আমাদের রাজনৈতিক অভিপ্সা নেই দ্রষ্টব্য।

আমরা বলেছি, হেফাজতের ভাবটি হল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তো, কালচারাল প্রপোজিশন দাবী দাওয়া দিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় না। এইটা তো ঐতিহাসিক অর্জনের ব্যাপার। আবার লক্ষ্য করুন, হেফাজতের ইনসাফ এর ধারণাটি কেমন। এতগুলো মানুষ মারা যাবার পরও এই হত্যাযজ্ঞের বিচার এদের কনসার্ন নয়। এরা বলেছিল, এই তের দফা মেনে নিলেই এদের আর কোন অভিযাগ নেই। (এখন যেমন, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেওয়াতেই তারা খুশি)। কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীও এই গ্রুপের এক সময়কার পপুলার দাবি ছিলো। স্পর্শকাতর দাবি এইটা। কাউকে অমুসলিম ঘোষণার প্রশ্ন রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়াটা আরো নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করা। আমি মনে করি, কাউকে মুসলিম বা অমুসলিম ঘোষণার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে না। রাষ্ট্র প্রশ্নটির ফয়সালা না করে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের প্রশ্নটি রেথরিক। কোরআন ও সুন্নাহবিরোধীসব আইন বাতিল করার প্রশ্নটি সেই রাষ্ট্র থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার শর্তসমূহের একটি। একই সাথে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বয়ানগুলো থেকে নিজেদের পলায়নপরতা।

নারী শিক্ষা নিয়ে হেফাজত প্রধানের উক্তি ও এক্সপ্রেশন প্রচুর সমালোচিত। মূলত নারী প্রশ্নের ঐতিহাসিক মীমাংসা করতে ব্যর্থ হেফাজত। আমি মনে করি, এখানে ধর্ম এবং কালচারাল কমপোনেন্ট গুলোকে ওভারলেপ করার সমস্যাটি বড়। যে কোন স্থানিক কালচারাল এক্সপ্রেশনকে ইসলামের ধর্মীয় বিধি বিধানের সাথে গুলিয়ে ফেললে যা হয়, তা সারা দুনিয়াব্যাপি আরবীয় ইসলাম বা আরো বহু মৌলবাদী ইসলামের জনক। এর সাথে বাঙালি মুসলমানের (ছফা অর্থে নয়, বাঙালি মুসলমান বিষয়ে ছফার বয়ান আলোক-আক্রান্ত ও খণ্ডিত, হীনমন্য) প্রাণের সম্পর্ক রচিত হয় নাই কোনদিন, ইসলামের সম্পর্ক কদ্দুর তা তো বাহাস এর বিষয়।

এর সাথে আছে নারী বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি। সভ্যতায় নারী ও পুরুষের যোগ্যতা, অবস্থান ও অবদানকে আমি মনে করি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বিবর্তন। নারীর বিষয়ে ইসলামের অবস্থান তাই, যা আরবে বহু বছরের নারী ধারণাকে প্রশ্ন ও বাতিল করে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এর উদ্দেশ্য নারীকে বাতিল করা নয়, বরং পুরুষের সহযোগী হিশেবে সমান্তরালে জায়গা দেওয়া। রসুলুল্লাহর সময়ে মসজিদে নারীর জন্য জামায়েত হতো, যা হযরত ওমরের আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি মনে করি, ইতিহাসের এই ঘটনা ইসলামের সভ্যতাকে ব্যাহত করেছে ও বহু বৈষম্য এবং বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। এখানে ইসলাম কাজ করে নাই, কাজ করেছে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা পুরুষতন্ত্র। ইসলাম দাসপ্রথাকে যেমন সরাসরি নিষিদ্ধ করে নাই, কিন্তু দাস বানানোর যে সভ্যতা, তার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। নারীর ব্যাপারেও ইসলামের কথা তাই।

সভ্যতার মৌলভি প্রভুরা দাস এর ব্যাপারে মুক্তকণ্ঠ হতে পারেন না, কারণ বর্তমানে আমরা আক্ষরিক অর্থে দাস প্রথাকে ইতিহাসে অতিক্রম করে এসেছি। সভ্যতার মৌলভি পুরুষেরা নারীর ব্যাপারে মুক্তকণ্ঠ এখনো হন, কারণ ঐতিহাসিকভাবে আমরা পুরুষতন্ত্রকে এখনো অতিক্রম করতে পারিনি। বরং জীবনে যাপনে দর্শনে বয়ানে আমাদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রই হাজির থাকে।

আপাতত এটুকুই। তবে সামনের দিনগুলোতে তাদের আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও সমাজের সাথে তার সম্পর্ক বিবেচনায় আরো গভীরতর পর্যালোচনা প্রয়োজন হতে পারে বলে আমরা মনে করি।

Leave the first comment