Blogs

রিফাত হাসান

ভারতবন্দনা: সেইসব নিম্মবর্গ

May 19, 2014   0 comments   2:56 pm

বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ভারতে দলিত, মুসলমান ও আর আর নিম্নবর্গের নিজস্ব লড়াই আছে। ঐতিহাসিকভাবে সেই লড়াইয়ের কোন অংশ না গান্ধী না মোদি হতে পেরেছে, আমার মনে হয়েছে। সেই লড়াইকে সমগ্রর হিশেবে তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। বরং উগ্র ঘৃণা ছড়িয়েছে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। যেমন গুজরাট। উত্তর প্রদেশ। ফলত রক্তক্ষয়ি দাঙ্গা ও গণহত্যার দায় আছে এই নিম্নবর্গ নেতাদের।

Share


মে ২০১৪ র কোন একটা দিনে এই নোট ড্রাফট করা। সেই সময়ে মোটে ভারতে মোদি ক্ষমতায় এলেন বা আসিতেছেন, এরকম কিছু একটা রব। এই আলাপে মোদির ক্ষমতাকালের আলাপ নেই, তেমন দরকারও নেই। বরং আমরা যা ঠাহর করেছিলাম, তার একটি বাছ-বিচার খাড়া করা যায় এর পরের মোদির ক্ষমতাকালরে পাঠের সময়। দেখা গেছে, ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই নিম্নবর্গ মোদির ভারতে গোরক্ষা সমিতির নজিরবিহীন তৎপরতা ও মুসলমানদেরে ‘গোমাংস’ খাওয়ার অভিযোগে খুনের ঘটনা বাড়তে লাগল। কাশ্মিরের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ, মুসলমান ও বাঙালিদের বাংলাদেশি বইলা খেদাওয়ের হুঙ্কার ও নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন, রোহিঙ্গা গণহত্যায় বার্মার জান্তাকে সরাসরি সমর্থনসহ বহু ঘটনা ঘটালেন মোদি, যার ফলে বাংলাদেশে মোদি রাষ্ট্রীয় সফরে এলে পরপর দুইবার ‘মোদি নট ওয়েলকাম’ বইলা আন্দোলনের নয়া ফেনোমেনন দেখা গেল।

আশ্চর্য, গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সময়ে গণহত্যার ইতিহাস সত্বেও, বিজেপির হিন্দুত্ববাদরে এড়িয়ে, সামান্য চাওয়ালা থেকে নিম্নবর্গ প্রধানমন্ত্রী মোদির উত্থান, সম্ভাবনা, নিম্নবর্গের ক্ষমতায়ন— এইসবের আলাপ হইতেছে। আগ্রহউদ্দীপক পাঠ বটে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে আমার অনাগ্রহ নেই। পড়শির আগুনের আঁচ তো লাগে, পাশের ঘরেও। সীমান্তে, নগরে, সবখানে। ফলে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। বরং, চোখ কান খোলা না রাখলে, বিস্তর ক্ষেত্রে পড়শির আগুনের আঁচ সামলানো কঠিন।

নিম্নবর্গ নিয়ে আলাপ হচ্ছে। ভারতের রাজনীতিতে নিম্নবর্গের উত্থান আজকের নয়। গান্ধি থেকে শুরু করে নরেন্দ্রভাই মোদি সবাই নিম্নবর্গ। বা মার্কিন মুলুকে কালো বারাক হোসেন ওবামা যখন শাদা গণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠেন, তখন আসলে এটি কালোদের অর্জন হয়ে ওঠে না। এইটুক অভিজ্ঞান আমাদের থাকা উচিত, ভারতরে পাঠের সময়।

তবে, বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ভারতে দলিত, মুসলমান ও আর আর নিম্নবর্গের নিজস্ব লড়াই আছে। ঐতিহাসিকভাবে সেই লড়াইয়ের কোন অংশ না গান্ধী না মোদি হতে পেরেছে, আমার মনে হয়েছে। সেই লড়াইকে সমগ্রর হিশেবে তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। বরং উগ্র ঘৃণা ছড়িয়েছে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। যেমন গুজরাট। উত্তর প্রদেশ। ফলত রক্তক্ষয়ি দাঙ্গা ও গণহত্যার দায় আছে এই নিম্নবর্গ নেতাদের।

এদিকে আমরা যখন নমঃশুদ্র ও বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লড়াই শুরু করলাম, তখন তারা সবাই সেই লড়াই আত্মসাতের তালে ছিলো। তখনও, এখনও।

সেই দিক থেকে ভারতের সেইসব নিম্নবর্গ আমাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের শত্রু হয়েছে, ব্রাহ্মণ্যবাদের পতাকা হাতে।

কংগ্রেস-বিজেপির রাজনীতি নিয়ে ভারতের নাগরিকদের মধ্যে নানান পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে, কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গের উত্থান আলাদা কোন মানে তৈরি করে না আমার মধ্যে। ওরা রাজনৈতিকভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের পতাকার মধ্যেই বসবাস করে ও তার থেকে বেরয় না, কখনোই।

আবার, ভারত একটা রাষ্ট্রমাত্র নয়, ইউনিয়ন। রাষ্ট্র হিশেবে ভারতীয় ইউনিয়ন স্বাধীকারকামী, স্বকীয় জাতিপরিচয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর স্বাধীনতার আকাঙক্ষারে দমিয়ে তাদের জনগণের উপরে নিপীড়ণ ও আধিপত্য কায়েম রেখেছে দিনের পর দিন। যেমন, কাশ্মীর, অরুণাচল, আসাম, মিজোরাম, মেঘালয়সহ উত্তরপূর্ব ভারতের আর আর সাত বোন রাজ্যগুলো, যা কখনোই ঐতিহাসিকভাবে ভারতের অংশ ছিল না। বাংলাদেশে এই আধিপত্যবাদের ভূ-কৌশলগত মিত্র হিশেবে তারা সরকারগুলোকে পাশে চায়।

পাশাপাশি, নিজের অঙ্গরাজ্যগুলোর বাইরেও, প্রতিবেশি দেশগুলোর প্রতিও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণবাদী ও আধিপত্যবাদি, যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আদর্শিকভাবে এই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের কৌশলগত মিত্র হিশেবে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠিরে আমরা দেখতে পাই।

ফলত, এই নিম্নবর্গের আলাপের বাইরে আইসা ভারতরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও আমাদের যোগ কী, তার বোঝাপড়ার দরকার আছে। ভারতের নির্বাচন ও এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে, পুরনো আলাপটি আবার পাড়ি, আসেন।

রাষ্ট্র হিশেবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটি কেমন?

এই জাগায়, অনেকবার কওয়া কথাটি আবার বলে নিই: বন্ধুত্ব নয়, বিনিময়, ব্যবসা ও কূটনীতির প্রশ্ন। যেহেতু রাষ্ট্র। আমরা যেন ভুলে না যাই।

ব্যবসার কথাতেই আসি। অপরিণত পুঁজির সাথে ব্যবসা ও যে কোন রকম বিনিময় ক্ষতিকর, এরকম একটি তর্ক আছে। বিশেষজ্ঞ মহলের এই তর্কটি আমরা অভিজ্ঞতা দিয়ে টের পাই। ভারতের সাথে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তা এই অভিমতকে জোড়ালো করে। পানি, ভূমি ও বাণিজ্য, সব জায়গায় এখনো জমিদারের মত আচরণ ভারতের।

আবার দেখুন, কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, যুদ্ধপরিস্থিতির মত স্রেফ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী শুধু ১০ বছরে প্রায় ৯৫০ জন বাংলাদেশীকে খুন করেছে আমাদের সীমান্তে। কয়েকদিন আগে আমাদের ভূখণ্ডেই ঢুকে পড়ল বিএসএফ।

ভূমির ভাগ ও পানির নায্য হিস্যার প্রশ্নে ভারতের আচরণ হল মাস্তানির মত। অপরাপর গুণ্ডামির পাশাপাশি এইটাও একটা কারণ হতে পারে যে, ভারতে এখনো পুঁজির বিকাশ হয় নাই। তাই ভারতের অর্থনৈতিক লেনদেন ও আচরণ অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সাথে সামন্ততান্ত্রিক রয়ে গেছে। কূপমন্ডুক। আপনার সাথে ব্যবসা হবে, আপনার অংশ লুটপাট করেই। কৃপণ ও কূপমন্ডুক প্রতিবেশির যা স্বভাব। সব চেটেপুটে খাবে, আপনার অংশটি দিতে কৃপণতা করবে। কারণ হল, অবিকশিত পুঁজি স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ দেখে না, দাদাগিরি কোয়ালায়। পাড়ার ক্ষেপাটে মাস্তানের মত।

আমি মনে করি, এই ধরনের রাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করতে হলে আমাদেরও সমান লাঠিয়াল হতে হবে। সীমান্তে, বাণিজ্যে এবং কূটনীতিতে, সবখানে। তার আগে নয়। কারণ আমাদেরও অপরিণত পুঁজি।

অপরদিকে, পরিণত পুঁজি নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেই স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ, ভারসাম্য ও কোটা নিশ্চিত করে থাকে। কেন বাংলাদেশের জন্য ভারতের পুঁজি ক্ষতিকর এবং পশ্চিমের পুঁজি কম ক্ষতিকর, তা নিয়ে এমন একটি আলোচনা আছে। আমি এই আলোচনাটি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই দুর্বল দিকটির আলোচনা আরো ব্যাপকভাবে হওয়ার পক্ষে।

পাশাপাশি, ভারতের শাসক দল নির্বাচনের ভোট এবং তারে কেন্দ্র কইরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াসমূহ, যার কোনটাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জায়গা থেকে কূটনৈতিক প্রজ্ঞাপ্রসূত কিনা, তার ভাবনা জরুরি।

আমাদের অভিজ্ঞতায়, বাংলাদেশের রাজনীতি ভারত-তোষণ ও ভারত-বিরোধীতা, উভয় ব্যবসায়ের জন্য দারুণ। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা পর্যায়ে ভারতের অনুপ্রবেশ বা অংশগ্রহণ এবং তার উপরে ভর করে আলাদিনের চেরাগের উপরে বরদাতা দৈত্যের মত ভারতের অবস্থান গ্রহণ এই রাজনীতির একটি নিয়তি দিয়েছে।

তার উপর আমরা ভৌগলিকভাবে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত, ফলত ভারতের যে কোন রদবদলের ঢেউ না চাইতেই নিয়তির মত বাংলাদেশের উপরেও এসে পড়ে।

যেমন ভারতের সম্প্রতি নির্বাচন, যেখানে আওয়ামী লীগের বহুদিনের বন্ধু কংগ্রেসের করুণ পরাজয় ঘটেছে। বা তার আগে ৫ তারিখে বাংলাদেশের একদলীয় নির্বাচন, যার বাস্তবায়নে তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ ছিলো বলে অভিযোগ আছে।

ভারতের সাথে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটা মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না হওয়া বা একই সাথে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দলবাজ কূপমণ্ডুকতাও এর কারণ বইলা মনে হয়। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়ভাবে রাজনীতি করার জন্য প্রথমটির এজেন্সি নিয়েছিল, বিএনপি পরেরটির। মাঝে মধ্যে এইসব ওভারল্যাপ করে, যেমন ভারতবিরোধী রাজনীতির জনপ্রিয়তায় জয়ের ভাগ বসানোর চেষ্টা, সাম্প্রতিক প্রথম আলো ইস্যুতে। এইসব তো হয়। কিন্তু বহিঃরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়েরই চরিত্র ক্ষতিকর বইলা মনে করি।

একচেটিয়া ভারতবিরোধীতার রাজনীতি বা ভারত তোষণমূলক রাজনীতি বাদ দিয়ে, ঐতিহাসিক দাসত্ব ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরে একটা ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক দরকার।

ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচন বাংলাদেশে বেশ আলোচিত হচ্ছে। দেখে শুনে মনে হয়, আওয়ামী লীগ যেমন ভারতের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিজস্ব মিত্র তৈরি করেছে, বিএনপি ও এই দলের তরুণ নেতা তারেক রহমান নিজেদের জন্য ভারতে তেমন কোন মিত্র তৈরির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে চাচ্ছেন। মোদিকে আগ বাড়িয়ে অভিনন্দন, তারেককে মোদির আমন্ত্রণ বা বিএনপির হর্ষ দেইখা তেমন কিছু আমাদের নজরে পড়ে। এইটা একটা সিগনিফিকেন্ট ঘটনা হতে পারে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কারণ বাংলাদেশে দুটি প্রধান দল থেকেই ভারত নিজস্ব মিত্র পেয়েছে। এইটাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত কেন্দ্রিক যে ক্ষমতা-স্ট্রাকচার, তাতে প্রভাব পড়বে বা পরিবর্তন ঘটবে। ভারসাম্যও হয় তো তৈরি হবে। কিন্তু এইটা কতদূর?

মূলত, কংগ্রেস এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি শয়তানের ঘোটপাকানি ছিলো। কিন্তু তার বিপরীতে বিএনপি কর্তৃক ভারতের অভ্যন্তরীণ একটা দলের সাথে অপ্রাকৃত সম্পর্কের এই মহড়ার ব্যাপারটি কেমন? আমার দৃষ্টিতে এইটারে কংগ্রেসের কোলে বইসা ক্ষমতায় টিকে থাকা আওয়ামী লীগের বিপরীতে বাংলাদেশে বিজেপির আশির্বাদ নিয়ে বিএনপির দলগত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কসরত হিশেবে পাঠ করা যায়।

এই অপ্রাকৃত সম্পর্ক এর বাইরে কূটনৈতিক সাফল্যে ব্যবহার হবে না, বা বিএনপি সক্ষম হবে না বলেই আমার ধারণা। কারণ জিয়াপুত্র এখনো তার পিতার মতো আন্তঃদেশীয় রাজনীতিতে প্রজ্ঞা দেখাতে সমর্থ হন নাই। বরং এটি আর একটি শয়তানের ঘোট পাকানিতে পরিণত হওয়ারই সম্ভাবনা।

এবং এখন চেরাগের উপরের দৈত্যটি উভয় মূর্তিতে বর দাতার ভূমিকায় থাকবে। একবার কংগ্রেস একবার বিজেপি। একবার গাঁধি, একবার মোঁদি, দৈত্যের চেহারা ও দাসমণ্ডলি পরিবর্তন হল মাত্র।

এলাহি ভরসা।

Leave the first comment