বাংলা, বেঙ্গল, জাতীয়তাবাদ ও কালিকাপ্রসাদের একটি গান
কোন এক গর্গ চ্যাটার্জির বরাতে একটা গানের ভিডিও দেখলাম। কালিকাপ্রসাদের। মৃত্যুর আগে ভদ্রলোকের নাম শোনা হয় নাই, কিন্তু ছবি দেইখা মনে হইতেছিল আগে দেখছি কোথাও। অসচেতনে বোধ হয় গানও শোনা হইছে, কারণ তার মৃত্যুর পরে যেসব গান সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াইছে, সেইসব সুরের সাথে আমার একটা একা একা গুনগুনানির সম্পর্ক আছে।
গর্গ আলাপটা তুললেন, কারণ গানটা ‘আমার সোনার বাংলা’। দেখা যাচ্ছে, কলকাতার কোন একটা প্রত্যন্ত জায়গায় ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে যখনই ধরল কালিকার দল, দর্শক সারির সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। গর্গ বলতেছেন, এই দাঁড়িয়ে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের লাঠির ভয়ে নয়, যেভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়। তার ভাষায়, ‘কোন জাতীয় সঙ্গীতে বে-রাষ্ট্রের মানুষ সটানে দাঁড়িয়ে যায়। কাউকে বলতে লাগে না। এইটা অভাবনীয় ঘটনা’।
হাঁ। অভাবনীয় ব্যাপারই মনে হল প্রথমে। কালিকার কণ্ঠ এই গানে অতি সরল ও সাধারণ লাগল। কিন্তু শুরুর সাথে সাথে সব দর্শক উঠে দাঁড়াল, এইটাতে প্রথমে মন একটু আর্দ্র হল। বাংলাদেশ, আমাদেরই দেশ তো! পরে, বেশ সময় নিয়ে ভাবলাম, কেন দাঁড়াল? রাষ্ট্রচিহ্নগুলোর সামনে এই দাঁড়াতে বলাটারে আমি রাষ্ট্রের ধর্মভাব বলি।
গর্গর ভাবটা বাঙালি জাতীয়তাবাদী। খেয়াল করলাম, দিল্লীর অধীনতা, আধিপত্য নিয়ে কথা বলেন। গর্গ বলছেন, দিল্লীর সব প্রপাগাণ্ডা মেশিন যথেষ্ট একটিভ থাকা স্বত্বেও, কলকাতার দর্শক শ্রোতারা বিনা দ্বিধায়, স্বতঃস্ফূর্ততায় দাঁড়িয়ে যায় ভিন দেশের জাতীয় সংগীতের সামনে। গর্গ বলছেন, এইটার রূপ কেমন হত, যদি দিল্লীর প্রপাগাণ্ডা মেশিনগুলো না একটিভ থাকত?
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আবার দিল্লীর আধিপত্য নিয়ে কথা বলা— এইটা অভিনব। একটু ইউটোপিয়ান কি? বাঙালি— এই ভাবের যে জাত্যাভিমান, মহান ভাব, তারে প্রশ্ন করা জরুরি মনে করেছি সব সময়, এখনো করি। জাতীয়তাবাদ তো আত্মগর্ব ব্যাপার, ফলত ‘সারে জাহা সে আচ্ছা’ একটা ব্যাপার এখানে থাকে। ফ্যাসিস্ট ভাবের উপকরণ। বাংলাদেশে এই জাতীয়তাবাদের যে চেহারা, তার ভেতরে থেকে দিল্লীর অধীনতারে প্রশ্ন করা যায় না, বরং এই অধীনতার সাথে সখ্যতা আছে, আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। ‘ফাগুনে তোর আমের বনে’ শুনলে আমারও মন উদ্বেল যে হয় না, তা নয়। কিন্তু সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকায় বলেছি, বাংলাদেশে রাষ্ট্র নেই। আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। যেমন ‘আমার সোনার বাংলা’। মানে রাষ্ট্র-কল্পনা। এইটারে আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ বলেছি। এই জাতীয়তাবাদের সাথে, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সমপ্রসারণবাদের গভীর সখ্য তৈরি হয়ে আছে সাংস্কৃতিকভাবেই। আমার পর্যবেক্ষণ হলো, এর সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনা তথা ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোতে ইন্ডিয়ান আধিপত্য সম্প্রসারণ ও বজায় রাখার জন্য কৌশলগত রাজনীতির সম্পর্ক ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সম্পর্ক ও সখ্যতার রাজনৈতিক পাঠ জরুরি। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো, গর্গ কথা বলছেন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের ভেতরে থেকেই।
ইন্ডিয়ার ভেতরে থেকে দিল্লীর অধীনতা নিয়ে কথাবার্তা বলনেওয়ালা বাঙালি আত্মগর্বিরা এইটারে কীভাবে ডিল করেন?
ইদ, বাংলাপক্ষ, জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির যে নয়া বানানরীতি, তাতে ঈদ এর বানান হয় ‘ই’দ। ভাষায় এমন প্রমিতকরণ নিয়া আমরা কথা বলছিলাম। দেখলাম, এইবার ‘ই’দ, মানে প্রমিত বাংলা একাডেমির ব্যারাম তেমন ছিলো না। কোন একটা ফোন কোম্পানির ফেসবুক ক্যামপেইনে ‘ই’দ দেখা গেছিল একটু, তারপর আর না। অইখানে, দেখলাম, সবাই হাসাহাসি করল। আমার তো প্রিন্ট মিডিয়া বা ঈদ সংখ্যা দেখা হয় নাই। অইখানে কেমন ছিলো, জানার উপায় নেই।
কিন্তু, কলকাতার একই দিনে ঈদ হল, কলকাতার বানানে হল না; এইটা আমাদের ভাষা আন্দোলনও বটে, ম্যাড়মেড়ে কলকাতার বিরুদ্ধে।
ওইদিকে, পশ্চিমবঙ্গে এইবার তাদের নিজেদের ‘ভাষা আন্দোলন’ এলো বুঝি।
আমাদের সর্বস্তরে প্রমিতের বিরুদ্ধে জেহাদ, ওদের হিন্দী বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে, ওদের ‘তাহজিব’ ‘তমদ্দুন’ রক্ষার তমদ্দুন মজলিশ হিশেবে আপাতত দেখা যাইতেছে ‘বাংলাপক্ষ’ নামের সংগঠন। প্রতিক্রিয়াশীলতা, জাতীয়তাবাদ ও ফেসিজমের সবরকম ব্যারাম ওদের তৎপরতায় আছে, কিন্তু ওদের ‘ভাষা আন্দোলন’ গুরুত্বপূর্ণ মনে হল।
এর গুরুত্ব আগামী দিনে আরো পরিস্কার হবে।
তবে, আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে সন্ত্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী অখণ্ড ইনডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা কৌশলের রাজনীতি, আর ওদের কনসার্ন এই ইউনিয়নের ভেতরে বইসাই স্রেফ ভাষা প্রশ্ন, যা আমরা বায়ান্নে শেষ করেছি ও তার পরে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
এইটাও গুরুত্বপূর্ণ বটে, তবে দিল্লী হনুজ দূর অস্ত।
ওদের শ্লোগান জয় বাংলা। একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আন্দোলন থেকে এর উৎপত্তি হলেও, জয় বাংলা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কেবল একটি ফ্যাসিস্ট দলের শ্লোগান, বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডসহ সব ধরনের গুম খুন ও ভেদাভেদের রাজনীতির বৈধতা দিতে ব্যবহৃত হয়, ওরা এই শ্লোগানটিরে নিজেদের আন্দোলনে গ্রহণ করেছে। মাঝখানে অর্ধ শতাব্দীর ফারাক।
এই ফারাকরে অতিক্রম করে ওদের জয় বাংলা নতুন কী কথা কইতে পারবে? ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন থেকে ওদের কোন মুক্তিযুদ্ধ হবে কি?
জয় বাংলা: চক্রব্যুহচক্র
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আত্মগর্বিদের ‘জয় বাংলা’ নিয়ে কথা বলছিলাম।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে, আমাদের এই সময়টি এমন, যখন সব রকমের খুনের একটাই চক্রব্যূহচক্র এবং সব খুনের একটাই রাষ্ট্র অনুমোদিত সার্বজনীন প্রতিপক্ষ। কিন্তু আপনি যখন প্রতিবাদ করতে যান, শুধু বলেন, জয় বাংলা। একটি সার্বজনীন নিরাপদ রাষ্ট্র অনুমোদিত শ্লোগান। যখন আপনি খুন হবেন, তখনও, যখন আপনি খুন করতে যাবেন, তখনও। অভিজিৎ মরার পরেও আপনার শ্লোগান সেই জয় বাংলাই। বিশ্বজিতকে খুনের সময়ও আপনার শ্লোগান ছিলো জয় বাংলা। এই জাগায় এসে, আপনি খুনী, নাকি খুনের প্রতিপক্ষ, তার বিচার করা দুরূহ হয়ে ওঠে।
আবার, ভারতের হিন্দুত্ববাদী ও মুসলমানের মাস কিলিং এর শ্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’ আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী জয় বাংলা শ্লোগানের যে গণবিরোধী মেটামরফসিস, তার সখ্যতাও টের পাই আমরা। একটা কাছা খোলা বর্ণহিন্দুত্ববাদ, আর একটা বাংলাদেশে সেই বর্ণহিন্দুত্ববাদের এজেন্ট আর ভারতীয় আধিপত্যবাদের টুল হয়ে উঠল দ্রুতই।
বাংলাদেশে আমাদের কাছে এই ‘জয় বাংলা’ যে ভারতরে আবশ্যিকরূপে হাজির করতে তৎপর, তার মোদি-গাঁধি সব একই চেহারা, বাংলাদেশের জমিদার হতে চায়। আবার এই জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান থিকা বহু দূরে অধুনা ফ্যাসিবাদের গুম খুন ও হামলায় কাপালিকদের স্তব-মন্ত্রেও ব্যবহৃত হয়। আমাদেরে তার বিরুদ্ধেই লড়াই আর কসরত করতে হয়। ফলত লড়াই ও শ্লোগানের এই যে মেটামরফসিস, এইটারে মোকাবেলার পথ খুঁজতে হচ্ছে আমাদের। দরকার নয়া শ্লোগান। নয়া পথ। নয়া রাজনীতি। যেহেতু মোদি গাঁধি সব একই ভাষায়, বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ভাষায় কথা কয় এখানে।
ফলত, আমাদের পাঠটি অন্যরকম। এবং আমাদের লড়াইটিও। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আত্মগর্বিদের মতো নয়।
তারপরও, এই জয় বাংলার ইতিহাস কি নেই হয়ে যাবে?
আবার, পশ্চিম বাংলার বা ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের অনেকেই যেভাবে আশঙ্কা করেন, এইটারে কি অবিভক্ত বাংলার শ্লোগান কওয়া যাবে?
ইতিহাসে দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের এই আশঙ্কা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলত, এইটা স্পষ্ট করে দিছিলেন যে, আমরা পূর্ব বাংলাই। অবিভক্ত বাংলা নিয়া এই অঞ্চলের জনগণের, মানে মুজিবের তেমন আগ্রহ নেই।
তো, জিয়াউর রহমান এই বাংলা নামের ফাঁকি ও এই জাতীয়তাবাদের সমস্যা খেয়াল করতে পারছিলেন। তাই উনি নতুন শ্লোগান প্রস্তাব করলেন, যেখানে বাংলাদেশের পুরো নামটাই রাখা হলো, কোন খণ্ডিত বাংলা না। জয় বাংলা নয়, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এই শ্লোগানে জিয়া বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি আর অন্য ভাষাভাষী ও এথনিক জনগোষ্ঠির ভেদরে অনুৎসাহিত করলেন। যদিও, অনেকেই এখানে ইসলাম গন্ধ খুঁজে পান। বিপরীতে, আমি এই ইসলামগন্ধ খুঁজে পাওয়ারে একটা রোগ বিশেষ হিশেবে পাঠ করি।
রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত ও নরেন্দ্র মোদি
ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের অপরিহার্য চরিত্র যে বর্ণহিন্দু, হিন্দুত্ববাদী ইন্ডিয়ার ধারণা ও জায়োনিস্টদের চিন্তার একটা মিলের জায়গা আছে। সেটি কেমন?
যখন রবীন্দ্রনাথ পড়বেন, আর যখন নরেন্দ্র মোদি পড়বেন, তখনো, মিলিয়ে পড়তে পারা দরকার। রবীন্দ্রনাথ কিছুটা উদার হিন্দুত্ববাদী, যেখানে আর সবরে জায়গা দিতে চান হিন্দুত্বের শর্তে, সে আলাপ আমরা বহু করেছি।
সেদিন ডিসকভারি চ্যানেলে বেয়ার গ্রিলসের ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ নামের অনুষ্ঠান দেখতেছিল বাচ্চারা। অতিথি ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের সুপারহিরো রজনিকান্ত। রজনিকান্তর কথা শুনতে শুনতে চমকালাম। ভদ্রলোক বলছেন, ‘দেখুন, জগতের সব ধর্মের জন্য সব রাষ্ট্র, পুরো পৃথিবী খোলা। কিন্তু আমরা হিন্দুদের জন্য কেবল একটি দেশ, ভারত। আর নেপাল আছে। তারপরও আপনি দেখবেন ভারতে মুসলমানরা খ্রীষ্টান আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা বহাল তবিয়তে সৌহার্দ্যের সাথে বাস করে এবং আমরা একসাথে মিলে মিশেই বাস করতে চাই সব সময়।’
হা হা। মোহাব্বত দেইখা পাগল হবেন না যেন। বরং আসুন, দেখি। মুখে শেখ ফরিদ; কিন্তু এই মোহাব্বতের গূঢ়তত্ত্বটি, মানে বগলে কী? ‘পৃথিবীতে ইহুদীদের ইজরায়েল ছাড়া আর রাষ্ট্র নেই’, এই তত্ত্ব দিয়াই জায়োনিস্ট রাষ্ট্র ইজরায়েল ফিলিস্তনের ভূমিতে দখলদারিত্ব বহাল রাখে আর ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে আর পুরো দুনিয়া থেকে তার বৈধতা নিয়ে বেড়ায়। রজনিকান্তর বগলেও তাই, যদি আপনি তার মোহাব্বতের তত্ত্বের সাথে বাস্তবের, তার সময়ের ভারতরে মিলিয়ে পাঠ করেন, দেখতে পাবেন।
দেখতে পাবেন, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ আর নরেন্দ্র মোদি, এই তিন খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মহাভারতে। রবীন্দ্রনাথ আর রজনীকান্ত জায়োনিস্ট ভারততাত্ত্বিক আর মোদি হলেন বাস্তবে তলোয়ার হাতে সেই ভারততত্ত্বের যোদ্ধা। তাদের ভারত ধারণায় হিন্দু হইয়া না থাকিলে মুসলমান হিশেবে আপনার কী হাল হয়, তা দেখার জন্য দূরে কোথাও যেতে হবে না, স্রেফ ভারতের সংবাদপত্র দেখলেও হবে। দয়া করে বলিউড আর রজনিকান্তের মুভির উদাহরণ দেবেন না, এইগুলো হিন্দুত্ববাদের ইন্ডাস্ট্রি।
জাতীয়তাবাদ, সম্প্রদায় ও আদর্শবাদ: বিজেপির ভারত
বিজেপি হিন্দুত্ববাদী ভারত চায়, সেই হিন্দুত্ব কেমন? যদিও চরিত্রে কমিউনাল, এই হিন্দুত্বের চরিত্র হল ‘অখণ্ড’ ভারত তত্ত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ; কোন হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র না।
জাতীয়তাবাদ, মানেই পবিত্র রক্ত ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা আছে, ফলত হাড়ে মজ্জায় ফ্যাসিস্টও এই রাষ্ট্র, প্রচুর মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে এখানে। জাতীয়তাবাদ হেতু কিছু হিন্দু ধর্মীয় ফেনোমেনন এই রাষ্ট্রে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরা কোন হিন্দু ধর্মীয় কোড দিয়ে দেশ চালানোর কথা কয় না, বাংলাদেশের ইসলামিস্টদের মত। জাতীয়তাবাদ ও বর্ণাশ্রম এই অঞ্চলের সবচেয়ে পপুলার ফেনোমেনন, ফলত বিজেপির রাজনীতি ভারতের সংখ্যাগুরু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে জনপ্রিয়ও।
বিপরীতে, বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের আন্দোলন মুসলিম বা অন্য কোন পপুলার জাতীয়তাবাদরে ধারণ করে না, ইসলামী রাষ্ট্র ধরনের আপাদমস্তক আদর্শবাদী ও রিজিড চরিত্রের কিছুরে সামনে আনার চেষ্টা করে, যারে খোদ মুসলিমরাও ভয়ের চোখে দেখে। এই কনসেপ্ট তো জনপ্রিয় নয়ই, এই অঞ্চলের মুসলমানরা এই ইসলামী রাষ্ট্রবাদীদের ধর্মীয় রাষ্ট্রধারণারে রিজেক্ট করে। তাই, দেখা যায়, হেফাজতের নবী অবমাননার প্রতিবাদ মিছিলে লক্ষ লক্ষ লোক অংশগ্রহণ করলেও, নির্বাচনে জিতে শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় প্রশ্নে আদর্শগতভাবে উদার আওয়ামীলীগ বা বিএনপি।
বরং উভয়ের দুই জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদের প্রস্তাব আছে। এক. বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দুই. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ভারতে বিজেপির রাজনীতি কেন সফল হয়, আর কেন বাংলাদেশে জামাত রাজনীতি বা আর আর ‘ইসলামী রাজনীতি’ কেন ব্যর্থ হয়, এখানেই তার ইশারা।
সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরে এক কইরা দেখার পপুলার প্রবণতা আছে এখানে, যা পুরোপুরি ভুল ও গবেট অবস্থান। বাংলাদেশের ইসলামিস্টদেরে সাম্প্রদায়িক দল হিশেবে ট্রিট করলে বিজেপির সাথে তুলনায় সহজ হয়, কিন্তু ইসলামিস্টরা আদতে সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী দল নয়, আদর্শবাদী ও রিজিড চরিত্রের দল।
এদেরও আদর্শবাদ হেতু শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ও ফ্যাসিস্ট চরিত্র প্রবল। তবে, চরিত্রের দিক থেকে জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় রাষ্ট্রধরনের রাজনীতির মধ্যে প্রথমটির ডাইনামিসিটি অপেক্ষাকৃত বেশি।
যদিও এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ পপুলারলি সবাইরে হিন্দু হইতে বলে, একই সাথে সব কিছুরে একোমোডেইটও করতে পারার সম্ভাবনা বহাল থাকে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের হিন্দু। রবীন্দ্রনাথের যে মহাভারতপ্রকল্প, তাতে হিন্দু কেবল ধর্মীয় না, পলিটিক্যাল এনটিটি। আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের আর আর জাতিসত্তাগুলোরেও একোমোডেইট করার সম্ভাবনাসহই জারি থাকে। পপুলারলি।
রবীন্দ্রনাথ ও মোদির যে মহাভারতবাসনা
আমাদের পাঠ হল, রবীন্দ্রনাথের যে হিন্দু, আর মোদির যে হিন্দু, দুই-ই চরিত্রে সর্বভারতীয়, এবং এই অঞ্চলে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের আত্মপরিচয়, এর দূরতর ফলাফলসহ আরো গভীর ভাবে বলতে গেলে সংস্কৃতি ও রাজনীতির নির্ণায়ক মানে কর্তা হয়ে ওঠার জন্য উন্মুখ।
আবার, ধারণা করি, রবীন্দ্রনাথের যে আত্মপরিচয় সংকট, তাই তার হিন্দুত্ব প্রশ্নের আলাপ। তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন, পিতার সূত্রে। ফলত ভারতে তার আত্মপরিচয় সংকট ছিলো। এই সংকটে তিনি ধর্মচ্যুত, ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও যে হিন্দু সমাজেরই লোক, রীতিমত প্রবন্ধ ফেঁদে তারে এইটা কৈফিয়ত আকারেই বলতে হইছে। এই কৈফিয়তের এমন ধার যে, তার এই বাসনা সব সম্প্রদায়েরই আত্মপরিচয়ের নির্ণায়ক যেন। বলতেছেন, ‘মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোনো বিশেষ ধর্ম নহে । হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম’। এইখানে তার যে হিন্দুত্ব বা হিন্দু, তার রূপ নিয়া আলাপ চলে। কিন্তু আমার অসংহত মনে হয় না।
মূলত এই যে সর্বভারতীয় হিন্দু বাসনা, জাতিগত পরিণাম, এই বাসনাতেই ইন্ডিয়ায় হিন্দুত্ব অহিন্দুদেরকে হিন্দু হইতে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথের এই হিন্দুত্বের সাথে মোদির হিন্দুত্বের এই জাগায় সখ্য গভীর বরং। উভয়েরই লক্ষ্য, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ। অনেকেই, এই পাঠের বিপরীতে বিধাননগরে বিজেপি একটিভিস্ট কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য ভাঙার উদাহরণ দেন, বা বিজেপির পপুলার রবীন্দ্রবিরোধীতার উদাহরণ দেন। এইটা ইন্ডিয়ার ভেতরগত আদর্শের সংঘাত, উদারতা ও আরো নানান প্রশ্নে। মোদিবাদীদের যে রবীন্দ্রবিরোধিতা, তার কারণ রবীন্দ্রনাথ ভারতে কংগ্রেস প্রমুখ অল্প উদারবাদীদের আইকন। বা রবিবাবুর অচ্ছ্যুত ধর্ম, ব্রাহ্ম হওয়া। এইসব। মতাদর্শগত বিরোধ না বইলা মনে হয় আমার। ঠাকুরের গানই তো ইন্ডিয়ার জাতীয় সঙ্গীত। বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ইউনিয়নের আইকন, এবং বাংলাদেশের জন্য রবি ঠাকুর, বিশ্বভারতি, বিএসএফ সমার্থক। এমনকি কংগ্রেস বিজেপিও। এখানে বিজেপি আর কংগ্রেস ভাগ নেই, উভয়ই ভারতীয় ইউনিয়নের কাপালিক সাধক মাত্র। আর, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে যে কোন একটিভিজমই হিন্দুত্ববাদে পাশ ফেরে, ভারতে এইটার মধ্যে উদার অনুদার অল্প তফাত আছে মাত্র।
তফাত হয়তো আপনি দেখতে পাবেন এই জাগায় যে, রবীন্দ্রনাথের হিন্দুত্বে রবিবাবু বলছেন, এখানে বসবাসকারী সব হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টানেরও অনিবার্য পরিণতি ও পরিচয় হিন্দুই। এইটা কিছুটা ইনক্লুসিভ ধারণা। মোদির হিন্দুত্বে, দেখা যাবে, ইনক্লুসিভ কোন ধারণা ছাড়াই বরং শরণার্থী সমস্যা তৈরি করবে অহিন্দুদের ক্ষেত্রে। আপনি যদি সরলীকরণ বলেন, আমি তা করতেই চাই, রবীন্দ্রবিরোধী হিশেবে না, রবীন্দ্রনাথ ও মোদির যে মহাভারতবাসনা, তার ক্রিটিক হিশেবে।
হিন্দুমহাসভা
স্রেফ অনাগ্রহ না, মুসলমানি শব্দ নিয়া আলাদা কইরা বাংলাদেশের সেকুলার পরিমন্ডলে যে ‘আপত্তি’ বা ঊষ্মা, তাদেরে কীভাবে পাঠ করবেন?
নিশ্চিতই মানবেন, শব্দ বা ভাষা কোন সেক্যুলার ব্যাপার না। ফিললজি বিষয়ে সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি থাকলে বা হিন্দু পুরাণ পড়া থাকলে বুঝবেন, হিন্দু পুরাণের বাইরে আপনি আপনার পরিচিত বাংলা ভাষায় কোন একটা দিনের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারবেন না, কোনভাবেই। সে হিশেবে, আমি বলি যে, আমরা হিন্দু মহাভারতে বসবাস করি, যা একই সাথে আমার মহাইতিহাসের অংশও।
সেই জায়গাতে, নারীবাদী পোর্টাল চালানো এক ধর্মে ‘হিন্দু’ নারীর বিষ্ময়, এই অঞ্চলের ‘মুসলমানে’রা কেন কথায় কথায় মুসলমানি আরবীতে আল্লা খোদার নাম নেয়, হোক সাংস্কৃতিকভাবেই! আর কমিউনিষ্ট বলুন, নারীবাদী বলুন, হিন্দু পুরানের ভেতরে নিঃসংকোচ দিনযাপনের পাশাপাশি ‘কেন দিনশেষে মুসলমান’ই আর তার থেকে ‘বহু দূরের’ই থাইকা যান।
খেয়াল করেন, মুসলমানি শব্দ মানেই, ‘তার থেকে দূরের’ ব্যাপার। স্রেফ মূর্খতা না, এইটা বর্ণবাদী ছুতমার্গেরও ব্যাপার, আমার পাঠ বলে।
এই জাগা থেকেই আমি বলি যে, আমাদের শিক্ষিত সমাজ মূলত ‘বর্ণহিন্দু’।
তাদের ক্লাব, সামাজিক নাড়াচাড়া ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞান মূলত হিন্দুমহাসভাই, খেয়াল করলে বুঝবেন। জ্ঞান ও কল্পনায় এনারা হিন্দু মহাভারতেই থাকেন। যে হিন্দু মহাভারতে তাহাদিগের ঠাঁই ছিলো না কখনো, কদাপি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারণ তাহাদিগের তরি ছোট, ক্ষুদ্র, বর্ণবাদী, হিংস্র। কেবল আপনারি সোনার ধানে ভরপুর হইয়া চলে যাবে সে তরি, আপনারে পাড়ে রাইখাই।
তথাপি যে সোনার তরি আপনার ধান নিয়ে ভাগছে, তার দিকেই মুগ্ধ নেত্রে চাহিয়া থাকিবেন এই হিন্দু মহাসভা।
টেগোরিয়ান স্টেইট
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে চেহারা, তারে আমি রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্র বলি। এই চেহারাটা কেমন?
ডোমিনেন্টলি আমরা ঠাকুরের ভেতরেই আছি। এইটা আপনি ঠাহর করতে পারবেন, শুধু একটা নিক্তি দিয়ে। এই রাষ্ট্র ও এর অপরাপর সব সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অর্গান সর্বভারতীয় ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা পলিসির সাথে কৌশলগত সখ্য বজায় রাখে ও সর্বভারতীয় ভাবাদর্শের এডভোকেট।
মিডিয়া থেকে বুদ্ধিজীবী সমাজ কেউ ব্যতিক্রম নয়। এই মতাদর্শিক লয়ালিটির কারণেই ওরা সীমান্তে বিএসএফের খুনোখুনির প্রতিরোধ দূরে থাক, প্রতিবাদ তক করতে পারে না।
এখন বাংলাদেশে আদর্শিকভাবে এই ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের ভাবগুরু ও ভাবাদর্শ হিশেবে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, কেবল মাটির দেবতা হিশেবে নয়, এখানে তার চিন্তা-ভাবনা ও বাস্তবিক তৎপরতার অবদানও ছোট নয়, তার উদাহরণ আমরা দেখেছি।
ফলত পটের পুতুল, জমিদার ও দেবতা হিশেবে যেমন, ভাবাদর্শগতভাবেও ঠাকুর এই অবস্থার প্রতি আশির্বাদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যার ভেতরে আটকে আছি, এইটারে টেগোরিয়ান স্টেইট বলছি, এইটার ডোমিনেন্ট অবস্থার কারণে।
রবীন্দ্রকাব্যের আমি ভক্তও বটে, কিন্তু ভাবাদর্শ হিশেবে দাঁড়িয়ে আছে যেটি, সেটি কেবল কাব্য, পুতুপুতু ভক্তি ও গান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। তাই তার ভারত দর্শন হাজির করেছি, যা কেবল রবির নয়, সব ভারতঠাকুরেরও মনের গোপন কথা।
ফলত সীমান্তে পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যার সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের কৌশলগত নিরাপত্তা, ফলত ভয়ের পরিবেশ তৈরি, একই সাথে নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের জাতঘৃণার ব্যাপার আছে। এই ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘৃণা ও ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তায় কৌশলগত ভয়ের পরিবেশ বজায় রাখা, এর বাইরে আর কিছু দেখেন কি? আমি দেখি না।