‘টেক্সট কন্সপিরেসি ও রুপকথা’ নোক্তা দিয়া দেখায় যে, ফ্যাসিবাদের একটা টোটালিটারিয়ান টেক্সট আছে। আছে একটা ফর্ম।
এই ফর্মের জামানায় রিফাত হাসানরে ফর্ম ভাঙতে দেখা যায়। রিফাত হাসান নিজে স্বীকার করেন- ‘আমি তো আসলে নিজেরে ভাঙার ভেতর দিয়ে যাইতে চাই। ভাঙাটা এমন না যে, আমি শুধু শুধু ভাঙতে চাই। কিন্তু ভাঙাটা জরুরি।’
ভাঙার জরুরত না বুঝলে রিফাত হাসানরে গুলাই ফেলার সম্ভাবনা থাকে। ফর্মহীন হওয়া মানে দর্শনের ফ্যালাসি হইয়া সন্দেহের পর সন্দেহে যাইতে যাইতে অমীমাংসার মাঝেই যাত্রা না। রিফাত হাসানও সমাধানের দিকে একটা ফর্মের মত আসেন। কিন্তু তা-ই সর্বত্র না, একমাত্র না বা চিরস্থায়ি না। তবে সমাজ উপযোগের স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে তার ভাঙন, সে জন্যই আলাপ। আমাদের মার্কসিজম যদি সমাজ অনুসারে সেই ফর্ম ভাঙতো তবে বোধ করি এই জরুরত আরও মিটতো।
‘ফর্মের ভেতর যখন আপনি আটকে থাকবেন, তখন গল্পই পড়বেন, তখন আপনি কবিতাই পড়বেন, তখন আপনি উপন্যাসই পড়বেন।… মানে ফর্ম যারা পালন করে তাদের এ ধরনের একটা ব্যাপার আছে, যে, মানে তাদের মনে আছে যে, আমাকে সাহিত্যিক থাকতে হবে, আমাকে ঔপন্যাসিক থাকতে হবে, আমি কবি, আমি অমুক বিষয়ে কথা বলব না।’
এইটা হইল ফ্যাসিবাদের একটা ননরিস্কি ফর্ম, বর্ম। লেখক এর বাহির হইয়া আগান, মানে গণজীবনের জিগ্যাসারে কন্সপিরেসির অসাহিত্যিক ফর্ম থিকা সাহিত্যে আনেন। সাহিত্য মানেও একটা ফর্ম। তাই ইহা বুঝতে হলে ফর্ম ভাঙার মুহূর্ত আর দরকারটারে বুঝতে হইবে। টোটাল রাজনীতি না, আবার মানুষের দাস দশা উৎরাইয়া সংকটময় টোটালিটারিয়ান সোসাইটির নৈতিকতার ধারণা, টোটেম, ট্যাবুগুলো ভাইঙা ফ্যাসিবাদরে মোকাবেলা করবে এমন স্বর্বজনীন লিটারেচার। রাজনীতিও সেই অর্থে মনে করছি।
কমিউনিজমের ফ্যাসিস্ট বিশেষ খায়েশও ভাঙা আছে এইখানে। মানে জাসদরে যখন মারা হইছিল, তখনই রাষ্ট্র বল প্রয়োগের হাতিয়ার, আবার বিএনপি-জামাতরে বা গার্মেন্টস শ্রমিকরে মারার পরে নাগরিক ইস্যুতে রাষ্ট্র হাতিয়ার না। কমিউনিস্টদের এমন বোধের দরজায় খিল আঁটা অবস্থারে নক করে এই সাহিত্য।
মুক্তিযুদ্ধের পপুলিস্ট টেক্সট বা ফর্মরে কন্সপিরেসির ভিতর আলাপ করার দরকার পরে। উর্দু আর বাংলার দ্বৈরতে যে জাতীয়তাবাদী কন্সপিরেসি, তারে নাগরিকের বেমালুম রূপকথার দৃষ্টিকোণ থাইকা উদ্ধার করার যাত্রা দেখি। লেখক মনে করেন, পাকিস্তানিরা এখানে যেসব অবিচার ও লুটপাট চালিয়েছে, এইটার বিরুদ্ধে তখন একটা প্রতিবাদের অস্ত্র হয়েছে ভাষা। ভাষা তেমন ফ্যাক্ট না। তবে ফ্যাক্ট তখন হয়ে দাঁড়ায় যখন কিছু উর্দুভাষী আপনার বিরুদ্ধে অবিচার চালায়। তখনকার মত বাধ্য হয়ে এইসব ফ্যাক্ট গ্রহণ করার নৈতিকতারে ক্লিয়ার করেন তিনি।
সাহিত্যের রাজনৈতিক একটা ট্যাবু হইছে ধর্মহীন পরিসরে আলাপ। এমনকি রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট ধর্ম বাসনার খপ্পরে পরা নাগরিকের নৈতিক ধর্মবোধরেও বের করে আনেন রিফাত হাসান। মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া না গাওয়ার প্রশ্নে একজন সেকুলার জাজের খবরদারিকে ক্রিটিক্যালি বলা হয় যে, কারোর রিলিজিয়াস বিলিফ ঠিক করে দেওয়া ও রিলিজিয়াস কারেক্টনেস নিয়ে কথা বলা কোর্টের কাম না। সেকুলারিজমরে রাষ্ট্রের আইনি ফর্ম দিয়া গণআকাঙ্খার নৈতিক সেকুলার দশার বন্দিত্বরে প্রশ্ন করাই এইসব আলাপ।
শাহবাগ দিয়া যুদ্ধাপরাধকে একরৈখিকভাবে জনপ্রিয় রোষানলে ফালানো হইছিল। সেখানে বিচারের পক্ষে থাকা যাবে না- তা না, কিন্তু বিচার অভিমুখে জাস্টিস নিশ্চিতকরণের আলাপ জারি রাখা চাই। জুরিস্টোক্রেসির ফর্মের বাইরে পাবলিক, মানে সামাজিক ইন্টারেস্ট অনুসারে বিচারের জন্য আলাপের খেদগুলা তো রয়েই গেছে, সেইখানে ক্রিটিক্যালি হাজির থাকা চাই। রাজনৈতিক এই বিচারে আওয়ামী লীগের মতামতসহ বিদেশি এনজিও, বিদেশি অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যনীতির সঙ্গে অপরাধীর সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের দিকটা ইনজাস্টিসের আড়ালে পড়লো কি না, এই আলাপই হইল পলিটিক্যাল বোধ।
বহিটা সাক্ষাৎকারমুলক। কিন্তু হেডলাইন বা ভেতরের বিষয়ভিত্তিক আখ্যান সাক্ষাতের ফর্ম ভাইঙ্গা দেয়। কে এম এ রাকীব, মাসুদ জাকারিয়া, নূরে এলাহি শাফাতরা সকলে দীর্ঘ আলাপে জড়িয়ে পড়েন, রিফাত হাসানের সাথে। কবিতার পাখি, প্রবন্ধের জন্য দূর দেশের ইতিহাসের ভাড়াটে ঘটনাগুলার এলিট নিরাপদ বোধের ভিতর আলাপ নয়, বরঞ্চ টেক্সটহীন বিষয়গুলারে দিয়া টেক্সটের কন্সপেরিসি ভাঙেন রিফাত হাসান।
এই মর্মে দেরিদার ভুল একটা পারসেপশনরে ধরায়ে দেওয়া যায়। ফয়েজ আলমের এক সাক্ষাৎকারে পাইছিলাম; ‘দেরিদা যেটা নিয়া কথা বলেন… যে, টেক্সটের বাইরে কিছু নেই, আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি উপনিবেশের লোক। আমি জানি টেক্সট বা বয়ানের উদ্দেশ্য আছে, পেছনের ইতিহাস আছে, পরম্পরা আছে। আমি টেক্সট পাঠ করতে চাই সেইসব সমেত।’
রিফাত হাসানের ‘টেক্সট কন্সপিরেসি ও রুপকথা’ সেই আকাঙ্ক্ষায় টেক্সটের বাহিরে গিয়া বা নাগরিকের আকাঙঙ্ক্ষারে পলিটিক্যাল বোঝাপড়ায় আইনা টেক্সটরেই বিনির্মাণের সম্ভাবনাময় কইরা তুলে।
ভাষায় আরও খেয়ালিপনা ছিল ‘সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি’ বহিতে। এইখানে কতকটা সচেতন মনে হইল রিফাত ভাইরে। যেহেতু তাঁর মতে, ভাষায় তিনি সিলেক্টিভ না, যেভাবে ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত হইয়া আসে, সেভাবেই তার ডেলিভারি। এইটা ঠিক আছে। আর এইখানে টার্মোলজিক্যাল সিগনেচারে একটু সচেতনতাও পাই। ইন্টালেকচুয়াল পারিভাষিক দরকারও হইতে পারে। যেমন- ‘সম্বিত’। এইটা শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এ বেশ ব্যবহৃত হইতে দেখছিলাম।
মনে করি যে, ট্যাবু, ফ্যাসিবাদের দরকারে যে যে নান্দনিক বিষয় আর রাজরাজড়ার গৌরবান্বিত বিষয়রে বাঁধাই করে টেক্সট আমাদের রুপকথায় নিয়া যায়, সেই ধোঁকা, সেই কন্সপিরেসিরে ভাইঙ্গা গণমানুষের গলিঘুপচির দিকে আগাইতে থাকে ‘টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রুপকথা’। নৈতিকতার বৈচিত্রের ভেতর যখন ঝামেলা বাঁধে, কেবল সেই মুহূর্তে যেমন লালন বা বাউলবাদ নৈতিকতার ফর্মরে ভাইঙ্গা মানুষের কথা কয়, তেমনি রিফাত হাসানও ক্রিটিক্যাল দরকারে ফর্মহীন করেন ষড়যন্ত্রের সকল ফর্মরে। আইন, ইনসাফও নাগরিক নিরাপত্তামুলক রাষ্ট্রের দরকারে এমন বাতাচিত চলে ।
ওয়াহিদ রোকন, লেখক।