fbpx

The
Rifat Hasan
Website

রিফাত হাসানের
অফিসিয়াল সাইট

Blogs

রিফাত হাসান

নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমান পাঠ

April 7, 2022   4 comments   11:20 pm
Photo taken From NewyorkTimes. Riots that took place in the streets of Calcutta in 1946 between Muslims and Hindus claimed thousands of lives.

ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান ধারণা, তারে নিয়া যে ভাবনা চিন্তার চর্চা ও দায়, বা মুসলমান বাংলায় কই থিকা এল, এই আলাপগুলোর গুরুত্ব হল, ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান কখনোই একা হাজির থাকে নাই। বাঙালি মুসলমান ব্যাপারটা এমন, এখানে ইতিহাসের নমঃশূদ্র, চণ্ডাল, দলিত, কৃষিজীবী, কাঠুরে, জেলে ও আর আর বর্ণহীন, অনার্য স্বাধীন নৃগোষ্ঠি সমহিমায় বিরাজ করে, বাঙালি মুসলমানের সাথে। এই থাকারে বাদ দিয়া কোন বাঙালি মুসলমান থাকে না, বাঙালি মুসলমান হয়ই না। বাঙালি মুসলমান শব্দের গুরুত্ব এখানেই।

Share

আমি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘটনারে ‘নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের বাংলাদেশ বিপ্লব’ বলেছি সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকাতে। সবাই বাঙালি বা বাঙালি মুসলমান বলে, বাংলাদেশ রাষ্ট্ররে স্রেফ বাঙালি, বা বাঙালি মুসলমানের ঘটনা হিশেবে চিহ্ণিত করার এই পপুলার প্রবণতার বিপরীতে আমি বলি নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের ঘটনা। এই ঘটনাটি কেমন?

১.

ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান ধারণা, তারে নিয়া যে ভাবনা চিন্তার চর্চা ও দায়, বা মুসলমান বাংলায় কই থিকা এল, এই আলাপগুলোর গুরুত্ব হল, ইতিহাসে বাঙালি মুসলমান কখনোই একা হাজির থাকে নাই। বাঙালি মুসলমান ব্যাপারটা এমন, এখানে ইতিহাসের নমঃশূদ্র, চণ্ডাল, দলিত, কৃষিজীবী, কাঠুরে, জেলে ও আর আর বর্ণহীন, অনার্য স্বাধীন নৃগোষ্ঠি স্বমহিমায় বিরাজ করে, বাঙালি মুসলমানের সাথে। এই থাকারে বাদ দিয়া কোন বাঙালি মুসলমান থাকে না, বাঙালি মুসলমান হয়ই না। বাঙালি মুসলমান শব্দের গুরুত্ব এখানেই।

ফলে বাঙালি মুসলমানরে সাম্প্রদায়িক প্রত্যয় হিশেবে পাঠ, নাকচ ও মুসলমানি চিহ্ণের প্রতি ঘৃণাবাদি রাজনীতির যে মহড়া বর্ণবাদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের তরফে (যার সাথে উপমহাদেশে বর্ণহিন্দু ও জাতপাতভেদের যে রাজনৈতিক এজেন্সি, মুসলমান ও মুসলমানি চিহ্ণরে আদার কইরা রাখা, ভারতীয় বাংলাভাষি মুসলমানদেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার বর্ণবাদী হুঙ্কারের যে এজেন্সি, তার ঐতিহাসিক সখ্য আছে), আবার জাতীয়তাবাদী প্রত্যয় হিশেবে পাঠের যে ধরণ মৌলবাদী ইসলামের সম্প্রদায়গত ও নিছক ধর্মীয় বয়ানের তরফেও, উভয়রে ক্রিটিক ও নাকচ করতে পারাটা সর্বাগ্রে জরুরি।

২.

ফলত আপনি বাঙালি মুসলমান প্রশ্নরে ইগনোর কইরা থাকতে চাইলেও, আপনি তার ভেতরেই থাকিতে থাকেন। কারণ আদার হইতে থাকেন, অন্যদের বয়ানে, বাঙালি মুসলমান হিশেবেই। কারণ আপনি ‘বহিরাগত’, বা অনার্য, অচ্ছ্যুত, চাষাভূষো, ছোটজাত।

এই জাগায় আইসা আপনার আত্মপরিচয় বা বাঙালি মুসলমানের পরিচয়ের খোঁজ গুরুতর পলিটিক্যাল কাজও বটে। আলাপের শুরুতে একটা নোক্তা দিয়া রাখা ভাল, কেউ ‘সঠিক ইতিহাস’ লিখিল কিনা, তারে নিয়া আমার আগ্রহেরে চেয়ে, আমি ইতিহাস বলার ধরণের পাঠ ও তার পলিটিকসটা পড়তেই আগ্রহী। সঠিক ইতিহাস লেখার কাজটা তো যদুনাথ দীনেশ রহিম করিম অসীম ইটন আর মোহর আলীরা করেছেনই, নানান ভাবে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে, ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আদমশুমারি হওনের পরে, হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠি আর হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সাহিত্যিক, আবার ইতিহাসের পাঠক, সবার মধ্যেই বাঙালি মুসলমান নামের এই উপদ্রপ কই থিকা এল, হঠাৎ এই চিন্তা গুরু হয়ে দেখা দিয়েছিল, ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন। এই চিন্তা, ১৮৭০ এর আদমশুমারি হওনের আগ পর্যন্ত, তেমন কইরা গুরু ছিল না। কিন্তু আদমশুমারির পরে যখন দেখা গেল, বাংলায় মুসলমান ব্যাপারটা বেশ গুরুই, এইটারে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভবই, তখন দেশের অর্ধেক লোক কেন, কবে, জনগোষ্ঠির কোন অংশ মুসলমান হইল, সেই প্রশ্নে বিচলিত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলতেছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাসে ইহার অপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব আর নাই।’ (বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা, ১৮৮০)। আবার, ব্রিটিশ শাসকেদের অধীনে খ্রিস্টান মিশনারিরা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে দেখে, এরা অলরেডি ইতিহাসে কনভার্টেড মুসলমান। ফলে, শাসকদের ব্যাপক সুবিধা পেয়েও খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের ব্যাপক উদ্যোগ আশানুরূপ ফল পাওয়া না যাওয়ায়, এইখানে ইসলাম কীভাবে এত বাড়ল, তা জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠল ওরাও (আকবর আলী খান/ বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ)।

ফলে, নানান তত্ত্ব তালাশ শুরু হল। ইতিহাসে আর রাজনীতিতে।

অখন্ড, বৃহত্তর ভারত বলিয়া যে ইউটোপিয়া, তার থিকা যে বঙ্গ বইলা আলাদা একটা ঘটনা আছে (দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ (‘পূর্ববঙ্গীয় বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক’ ছিলেন দীনেশ, ছফা উল্লেখ করেছেন), যা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার, নিরদ সি প্রমুখ ‘সমগ্র ভারত এক, অখণ্ড ও অচ্ছেদ্য’-বাদীদের মনঃক্ষুন্নের কারণ হইছিল), আবার তার মধ্যেই বঙ্গের মুসলমান যে আরো অন্য চরিত্রের ঘটনা (ননমাইগ্রেটেড, কনভার্টেড নিম্নবর্ণের হিন্দুরও বাইরের, অহিন্দু, অনার্য, ভাটি বাংলার সন্তান বাঙালি মুসলমান), এই আলাপ গুরু হতে শুরু করল।

ফলে, বাঙালি মুসলমান নিয়া আলাপ ইতিহাসেরই ঘটনা। এইটা গুরু আলাপ, কোন পাতানো আলাপ না। এই আলাপ চলবে। খোদ এই খোঁজটারেই ‘জাতিবাদি রাজনীতি’র খোঁজ বইলা নাকচ বা আর আর ‘আপত্তি’গুলো অতি সংবেদনশীলতা। কোন কোন অংশের এই ধরণের আপত্তি ও নাকচের যে ভঙ্গি, তারে নিয়া ক্রিটিক্যাল থাকার ব্যাপার আছে বরং।

আহমদ ছফা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। ব্রাত্য রাইসুর তোলা ছবি। ১৯৯৫

যেমন, ছফার হীনমন্য অথচ হামদরদি বাঙালি মুসলমান ধারণার উপরে গইড়া ওঠা বুদ্ধিজীবী সমাজের ‘আপত্তি’গুলো। এরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী বটে, কিন্তু উদার থাকিত চান বইলা অনুমান করি। কারণ এরা ছফার বাঙালি মুসলমান প্রত্যয়টিরে ভালবাসেন, এর হীনমন্য উপাদানগুলোসহই। দরদিও থাকেন। কিন্তু পপুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদি ঘরানার বাইরে বাঙালি মুসলমান প্রশ্নের যে কোন আলাপ, কাজেই ছফার ‘বাঙালি মুসলমান’ ধারণার বিপদরে নিজেদের বিপদ ধইরা নেওয়ার পূর্বানুমান পাবেন তাদের আপত্তিগুলোতে। বিপদ তো বটেই, বিশেষত ছফার ‘বাঙালি মুসলমান’ ধারণার বিপদ তৈরী দরকারিও, আমি সব সময় বলি। বাঙালি মুসলমান মানেই যে ছফার হীনমন্য বাঙালি মুসলমান না, ইতিহাসের আরো গভীর ও নৈর্ব্যক্তিক পাঠের ব্যাপার আছে, এই ঘটনার মুখোমুখি হতে উনাদের সাহস তৈরী হওয়া দরকার। অন্তত নিজেদের দিকে ফিরে, বা নিজেদের দিক থিকা মুখ ফিরিয়ে হলেও, এইটা বেশ দরকারি কাজ বটে।

ফলে, ছফার ক্রিটিকের প্রতিক্রিয়ায় উনাদের দাবী, ‘ইসলাম’ নয়, ‘সেকুলারিজমে’ই ফিরতে হবে। যেন বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন বেশ ইসলামেরই ব্যাপার স্যাপার। আর ইতিহাসও স্রেফ কোন ধর্মতাত্ত্বিক ও ইসলামী ব্যাপারের মতই। মজার ব্যাপার, এদের মত করেই, এই ঘটনা নিয়া রক্ষণশীল ইসলামিস্ট ঘরানারও অস্বস্তি দেখা গেছে। আবার, ইসলাম প্রশ্নের গুরুত্বের কথা কওয়া ‘নদীয়ার ভাব আন্দোলন’ ঘরানারও ‘আপত্তি’ দেখা গেছে। বলা হইতেছে, আমাদেরে এখন ‘মুসলমান প্রশ্ন’ না, ‘ইসলাম প্রশ্নে’ ফিরতে হবে। মজার। তো, ইসলাম প্রশ্ন যে মুসলমান প্রশ্ন থিকা কতটা আলাদা, এইটা মার্কসের ইহুদি প্রশ্ন পইড়া বোঝার চেষ্টা করা যায়। অন্য কোথাও।

কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, মুসলমান প্রশ্ন ভারসেস ইসলাম প্রশ্নের আলাপে উপরের ‘সেকুলারিজমে’ ফিরতে চাওয়াদের এই নদীয়ার ভাবআন্দোলন পন্থার ‘ইসলাম প্রশ্নে’ সমস্যা নেই। ‘বাঙালি মুসলমান প্রশ্নে’ আলাপ তুলতে চাওয়ায় সমস্যা। মুসলমান প্রশ্নে না থাইকা ইসলাম প্রশ্নে থাকতে চাওয়া আদর্শিক। সেকুলার ও ঐতিহাসিক না। ছফার তৈরী করে দেওয়া বাঙালি মুসলমানের পথ প্রদর্শক বা প্রফেট হিশেবে থাকিত চাওয়া। এই ঘটনারে উনারা ক্রিটিক্যালি দেখতে সক্ষম নন, নাকি উনারাও আদর্শিকই থাকতে চান?

ছফার ‘বাঙালি মুসলমান’ যেমন, তার প্রচারসমিতি ধরণের ঘটনাগুলোও ছফারে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলার আস্পর্ধা তৈরী হোক, সেইটা চান না। কেউ চেষ্টা করলেই দেওয়াল হয়ে, শাহবাগ হয়ে দাঁড়ান। এইটা একটা ইনসিকিউরিটি বিশেষ। ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের বাইরে এই ছফাএক্টিভিজমের প্রবণতা সমস্যাজনকই। এবং সেল্ফ কন্ট্রাডিক্টরি।

৩.

ফলে, বাঙালি মুসলমান দেইখাই হৈহৈ করার প্রবণতারে ইগনৌর করাই আমি হাসান মাহমুদের ‘বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন’ নামের বহি পড়লাম এবং আমার এই আলাপগুলো করার ফুরসত তৈরী হল, যা আর স্রেফ এই বইয়ের আলাপ থাকল না। হাসান বাঙালি মুসলমান সম্পর্কিত পপুলার আলাপগুলোরে এক জায়গায় নিয়ে এসে এই উসকে দেওয়ার কাজটি করতে পেরেছেন বইলাই আমার ধারণা। আপনার মধ্যেও উসকে দেবে।

ইতিহাস বিশ্লেষণের জন্য ইতিহাস ডিসিপ্লিনের লোক ও একাডেমিয়ারে একটা হুদাই আবশ্যক করে তোলার ভঙ্গি আছে হাসানের। এই ঘটনায়, হাসানরে বেশ একাডেমিক রক্ষণশীল মনে হইলেও (ফরহাদ মজহার এই ঘটনারে একাডেমিক ব্রাহ্মণ্যবাদ বলেছেন), দেখা যাচ্ছে, হাসান ইতিহাস ডিসিপ্লিনের বাইরের প্রচুর লোক, যেমন বাংলার অধ্যাপক, প্রথম আলোর সাংবাদিক এমন অনেকেরও রেফারেন্স নিয়েছেন। মানে, তিনি উদারও।

‘ভ্রান্ত’, ‘অগ্রহণযোগ্য’, ‘প্রশ্নাতীত’, ‘বিকৃতি’, ‘অপব্যাখ্যা’ এই শব্দগুলোর ডগমারে ভাঙতে পারা দরকার। পড়তে গিয়ে, ঘুরে ফিরেই এই শব্দহুলো যে কোন স্বাধীন পাঠকের জন্য পীড়াদায়ক হবে। ‘প্রশ্নাতীত’ বইলা কোন কিছুরে প্রশ্নের অতীত ঘোষণা দেওয়া জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতি না, ধর্মীয় বা একটিভিজমের পদ্ধতি। এই শব্দগুলোর ব্যবহার দেখা গেছে প্রায়ই, ছফা বা অন্যদের ডগমার আলাপ করতে গিয়ে। এইটা হল, নিজেই আর ডগমার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া, নিজের আলাপরে।

‘সমাধান’ সমস্যাজনকই। একটা উপসংহার ও সমাধান বাতলে দেওয়ার প্রবণতা, সংস্কৃতি কী হবে, এমন পথ্য হাজিরের চেষ্টা বেশ অতি সরল ঘটনা। উপসংহারে হাসান বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় কেবল না, সংস্কৃতি কী হবে, তার একটা প্রেসক্রিপশন বা প্রস্তাব খাড়া করবার চেষ্টা করেছেন, এইটারে অতি সরল বইলা পাঠ করছি আমি। পাশাপাশি, বইটা আরো কিছুটা ওয়েল এডিটেড হইতে পারত। তা না হওয়ায়, ভাষা ও শব্দের ক্লান্তিগুলোরে উৎরেই এই বই পড়তে হবে। বইয়ে অতিকথন আছে, শব্দ ও ভাষায় মিতব্যয়ি হন নাই লেখক। এইসবরে বাদ রাইখা বইটা পড়াই যায়। আপনারে ইতিহাসের মুখোমুখি করবে। ইতিহাসের মুখোমুখি হবেন, নাকি প্রচার সমিতিতেই আপনার মোক্ষ, এইটা ভাইবা নিতে পারেন আপনি। বই নিয়া আমার আলাপ এটুকুই।

৪.

‘There is, therefore, good ground to suggest that a Bengali Muslim society already passed its formative stage, took a definite shape, and breathed a new spirit of tolerance, equality and universal love in the country so much so that large masses accepted Islam and even the then Hinduism was deeply affected as traceable in some of the elements of the Chaitanya movement’. (Social History of The Muslims In Bengal: Abdul Karim: 1959)

 

পুরো ইতিহাসজুড়ে বাঙালি মুসলমান বইলা একাট্টা একটা ব্যাপার ছফা কল্পনা করেছেন, ইতিহাসে সেরকম হোমোজেনাস কিছু একজিস্ট করত বইলা প্রমাণ পাওয়া যায় না। আহমদ ছফার থ্রুতে এই প্রত্যয়টিরে আশির দশকের পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব তরুণদের সংবেদনশীল অংশ ভালবেসেছে, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও, ছফা থেকে এই প্রত্যয় ধার নিয়া তাদের বর্ণফ্যাসিজম জারি রেখেছে। এই উভয় ঘটনা কীভাবে সম্ভব হল?

ঘটনাটি মজার। আমার ধারণা, ছফার আগে, এইভাবে আলাদাভাবে বাঙালি মুসলমানরে লইয়া আলাপ কেউ করেন নাই। মুসলমানরে লইয়া আলাপ আছে। মুসলিমরে লইয়াও আলাপ আছে। বেঙ্গল মুসলিম লইয়াই তো শুরুতে ইতিহাসওয়ালাদের হৈচৈ শুরু হল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায়, এইভাবে ‘বাঙালি মুসলমান’ শব্দরে আলাদা দ্যোতনায় হাজির কইরা ছফার আগে কোন আলাপ পাবেন না। ১৮৭২ এর প্রথম আদমশুমারিতে বেঙ্গলে একটা আলাদা ধরণের মুসলমান সম্প্রদায় চিহ্ণিত হবার পরে, যা শিক্ষিত হিন্দুর প্রতিনিধি বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ সবাইর দুশ্চিন্তার কারণ হইছিল, ছফাই বোধ হয় আলাদা কইরা এই বাঙালি মুসলমান শব্দটা একই সাথে দরদ, একই সাথে এমন হীনমন্যতা ও তারল্যের সাথে উচ্চারণ করলেন। এইটা আমাদের মুসলমান চিন্তায় ছফার গুরু অবদান বটে। তার নোবল ইনভেনশন।

ছফা মহৎ বটেন। কারণ, ছফার ইতিহাসপাঠ দরদি ছিল। কিন্তু ছফার সীমাবদ্ধতা হল ছফা বাঙালি মুসলমানরে তার ইতিহাসের ভেতর থিকা বোঝার মত ধীর স্থির হইতে পারেন নাই, তাড়াহুড়ো ও জেনারালাইজেশন ছিল। তাই বাঙালি মুসলমান নামে একটা ঘটনা যে ছফার কল্পিত উত্তুঙ্গের বাইরেই, ভাটি বাংলার মাটির থিকা তৈরী হইছে, তারে পুরোপুরি খেয়ালই কইরা ওঠেন নাই। সাতটি শতাব্দী ধইরা বাঙালি মুসলমানের স্থিরচিত্র দেখেছেন ছফা, যার আর কখনোই দুলে ওঠে নাই।

ফলে, ছফার বাঙালি মুসলমানের মন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের হাতিয়ার হইছিল, ছফার মধ্যে যে দরদ ছিল, তারে ছেটে ফেইলাই। ফলত এইখানে কেবল বাঙালি মুসলমান না, খোদ ছফাও, কেবল ভূত হয়েই রইলেন, বাঙালি মুসলমানের মনের ভেতর। আমি এই ভূতের প্রতিফলন দেখি দুই হাজার তেরর শাহবাগে। সেই ভূত, যা ফ্যাসিস্ট ও বর্ণবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের ভেতরেই, সেই বয়ানের স্বাধ আহ্লাদ অন্তর্গত অসুখ ও টিকে থাকার লড়াইয়ের ভেতরে খাবি খায় ও বেরুতে পারে না।

ইউরোপিয় রেনেসাঁ ছফার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল, সেই রেনেসাঁ উদ্ভূত নয়া আধুনিকতারে নিয়া ছফার কোন ক্রিটিক ছিল না, অন্তত বাঙালি মুসলমানের মন লেখার সময়। ইউরোপিয় আলোকায়ন দ্বারা উজ্জীবিত ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু নবজাগরণ ও বাবুদের উত্থান নিয়া ছফা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন কোন দ্বিধা ও ক্রিটিক ছাড়াই, যা তার সেই ‘বাঙালি মুসলমান’রে স্পর্শই করতে সক্ষম হয় নাই, ছফার মতে। ছফার আলাপ ছিল ছাঁচাছোলা। ছফার আলাপ একটা ধাক্কার মত ছিল। এইটার দরকার ছিল বটে। কিন্তু ছফার যে আলোকায়নের আগ্রহ, তারে বাদ দিয়াই, এই ধাক্কাটার গুরুত্ব আমি ভাবি। ছফার এই আলোকায়নের আগ্রহে আলোকায়নের কোন ক্রিটিক নেই, এমন কি হীনমন্য।

ছফার ‘উন্নত রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলন’ ধরণের ডগমা ছিল, ফলে আর্থ সামাজিক প্রেরণারে আন্দোলন থিকা আলাদা কইরা পাঠের চেষ্টা ছিল। এই জায়গা থেকেই, তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা আর শরিয়তুল্লার ফরায়েজি আন্দোলনরে রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রগতিশীল, কিন্তু সামাজিক দিক দিয়ে পশ্চাতগামী বলতেছেন ছফা, যাতে উচ্চবর্ণের মুসলমানদের সমর্থনও দেখা যায় না, ছফার মতে। অথচ, ‘এসব ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হবার পর মুসলিম উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিলোপের ফলে যে নেতৃত্বশূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনিভাবে, অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি মঞ্চও তৈরী করে দিয়েছিল এই সংস্কার আন্দোলনগুলো’ (মুঈন উদ-দীন আহমদ খান: ১৯৬০/ মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ইন বেঙ্গল । অনুবাদ: মিনহাজ আমান)। আন্দোলন সংগ্রাম সম্পর্কে ছফার এই যে পিওরিটান মনোভাব, তার বিপরীতে, ছফার মৃত্যুর পরে ছফার বন্ধু ফরহাদ মজহার ক্রুসেড, জিহাদ ও শ্রেণীসংগ্রামরে নিয়া যে বিপ্লবী পাঠ দেন, তারে বিবেচনায় নিলে, ছফা নিজেই বেশ পশ্চাদপদ ঘটনা। আমি মনে করি।

শহীদে কারবালা পুঁথিতে নবী দৌহিত্র ইমাম হোসেনের খুনী সীমারের সাথে হিন্দু ব্রাহ্মণ আজরের সাক্ষাতের ঘটনারে ছফা অবাস্তব বইলা উপহাস করেছেন। অথচ বাংলার পুঁথিতে এটাই তো ঘটবার কথা। এইখানে, হোসেনের পরশি হিশেবে আজরই তো থাকেন, বর্ণহিন্দু। ফলে, অন্তত, কল্পনা আকারে হইলেও, আজর বা আর আর পরশিদেরই বন্ধু হিশেবে পেতে চাইবে বা হাজির করতে চাইবে বাঙালি মুসলমান, এটাই স্বাভাবিক। এই উদার সমাজ কল্পনারে বা সাহিত্যের অসীম সম্ভাবনারে ছফা পশ্চাদপদতা হিশেবে পাঠ করেছেন। এই পাঠে মুসলমানের সাহিত্যে শিল্পে ছফা যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদিতার সংকট দেখতে পাইতেছেন, এইটা, বোধ করি, ছফারই সংকট ছিল। এই ধরনের সংকট অধুনা ছফা ব্যবসায়ীদেরও আছে। ছফা ব্যবসায়ীরা যখন আমাদের আন্দোলন সংগ্রামগুলোর নায্যতা বিচার করতে বসেন, তখন এই প্রবণতা দেখতে পাবেন। দেখা যাচ্ছে, ছফা কখনোই মুসলমানি সাহিত্যের ‘জ্ঞানচৌতিষা’রে দেখতে পান নাই, যার কথা তার বন্ধু ফরহাদ মজহার বইলা থাকেন বিভিন্ন সময়। বিপরীতে, স্রেফ ইতিহাসের ইউটোপিয়া দেখতে পান। ছফা পিওরিটান ইতিহাস চাইতেছেন সাহিত্য, কাব্য আর পুঁথিতে। আবার আসল ইসলামের সৌন্দর্য ধরণের ভাবও পোষণ করেছেন। ছফার এই ‘ইসলাম প্রশ্ন’ কেমন?

ছফা ‘চিন্তার চাইতে আবেগের’ আতিশয্য দেখেছেন নজরুল আর জসীম উদ্দীনে, যদিও তারা ‘সফলতা’ পেয়েছেন। নজরুল জসীম উদ্দীন নিয়া স্টেরিওটাইপ আলাপ এটি। সম্ভবত, হুমায়ূন আজাদেরও এই ধরনের আলাপ আছে। দেখা যাচ্ছে, ছফার ছাত্র সলিমুল্লাহ খান এই ক্ষেত্রে ছফার থেকে অগ্রণী, আসেন, তার থেকে পড়ি। ‘এই বক্তৃতা দিবার উপযুক্ত মানুষ শহর ঢাকায় একজনই ছিলেন। তাঁহার নাম জসীম উদ্‌দীন। দ্বিতীয় জনের নাম করিতে হইলে আমি আহমদ ছফার নামটা স্মরণ করিব।’ (ইতিহাস কেন ইতিহাস নয়? দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ অথবা নতুন মহাভারত প্রসঙ্গে। সলিমুল্লাহ খান)। জসীমউদ্দীনের কবিতারে সলিমখান ‘আমাদের নতুন নাচের ইতিকথা’ বলতেছেন (জসীমউদ্দীনের ১৯৭১)। লেখক হুমায়ুন কবির নজরুল আর জসীমউদ্দীন দুইজনরে ‘পশ্চাদমুখী’ বলায় তার উত্তরে সলিমুল্লাহ ‘বাজে জসীমউদ্দীন’ লেখেন। তো, ছফার বাঙালি মুসলমানের মনের এই ‘চিন্তার চাইতে আবেগের আতিশয্য’ কি খান খেয়াল করতে সক্ষম হইছিলেন কখনো?

বাঙালি মুসলমান নিয়া ছফার অনুমানগুলোর বড় অংশ আমাদের প্রাত্যাহিক, প্রতিদিনকার সত্য বটে। কিন্তু এই কমনসেন্সের সত্যের বাইরের আরো আরো সত্য খুঁজে বের করা ক্রিটিকের কাজ। একাডেমির কাজও।

তা না কইরা ‘ছফা’ ঘটনারে তার বিখ্যাত বন্ধুদের এক অংশ ভক্তি (যেমন মহাত্মা), আর অংশ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখিতে চাহেন, বা ছফারে লইয়া নিজেরাই কেবল কথা কহিবেন, এমন জমিদারি ও দোস্তি ভাব, এইটা আমাদের জন্য বিপদই। এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা আমাদের গুরু কর্তব্য বটে।

ছফা লিখতেছেন, ‘বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝায়, তারা মাত্র দুটি আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন এবং অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার একটি তীতুমীরের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত ওহাবী আন্দোলন। অন্যটি হাজী দুদুমিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন’। অথচ ছফার বাঙালি মুসলমান, ততদিনে আরো দুইটা বড় ঘটনা ঘটিয়েছে, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকায় আমি বলেছি। এক. ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আন্দোলন। দুই. ভাষা আন্দোলন ও তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাহস। তারও বহুত পরে ছফা হঠাৎ আবুল ফজলের টুপি দেইখা বাঙালি মুসলমানের মন লিখতে বসলেন। এইখানে সাতটি শতাব্দী ধইরা বাঙালি মুসলমানের স্থিরচিত্র দেখতেছেন ছফা, ১৯৭৬ সালে আইসাও। এইটাও ছফার সেই বাঙালি মুসলমানের মনই বটে। ছফা কি নিজেরেই পড়ার চেষ্টা করেছেন?

যাই হোক, ছফার এই ‘বাঙালি মুসলমান’ ধারণা বড় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে আশির দশকের পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব তরুণদের সংবেদনশীল অংশে। এখনতক ছফার ক্রিটিক মানে সেই বিপ্লবের ক্রিটিক। সাতটি শতাব্দী ধইরা বাঙালি মুসলমানের যে স্থিরচিত্র ছফা দেখেছেন, তারে ভাঙার ব্যাপার আছে না?

৪.

In reality, Bengal in our period possessed not one but several frontiers (Introduction/ The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760/ Richard M. Eaton: 1993)

 

তত্ত্বিয় আলাপের সৌন্দর্য হল, অভিনব হওয়া। যে আলাপ ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে, তারে বাতিল করতে পারা। বা এড়িয়ে নতুন তত্ত্ব হাজির করতে পারা। এইটার একটা সৌন্দর্য আছে। অসীম বা ইটনের আলাপ পুরনো আলাপগুলোরে বাতিল কইরাই অগ্রসর হইছে, ১৮৭২ সালের আদম শুমারি পরবর্তি যে আলাদা চরিত্রের বাঙালি মুসলমান পাওয়া গেল, তারে মূলে রাইখাই। এই আলাপে বাঙালি মুসলমান বলতে নগরের যে মুসলমান, বা উপত্যকা অঞ্চলের কৃষিজীবী শ্রেণীর বাইরের মুসলমানকে ইগনৌর করা হইছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল এবং খুলনা জেলার মুসলমান সমাজ নিয়ে করা গবেষণার উপরে ভিত্তি করে ইটন পুরো বাঙালি মুসলমান বইলা একটা কৃষিজীবী সমাজ অনুমান করেছেন। সলিমুল্লাহ খান এই ঘটনারে জোচ্চুরি বলেছেন। আমি জোচ্চুরি না কইলেও, এই ঘটনারে ইটনের ইতিহাস গবেষণার সীমাবদ্ধতা আকারে পাঠ করতে পারি।

অসীম রায়ের তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাজনক দিক হল, অভিজাত মুসলমান ধরণের একাট্টা ধারণা, যা কিছুটা অতি সাধারণকিরণ। তারপরে ইসলামের প্রসারে ধর্ম বা জীবন দর্শন হিশেবে খোদ ইসলামের যে ইমপেক্ট, তারে ধরতে না চাওয়া। এই দুই ঘটনা বাংলায় ইসলামের প্রসারে যে কঠোর বর্ণপ্রথা ও অভিজাত ব্রাহ্মণদের নিম্নবর্ণ হিন্দুদের উপরে অত্যাচারের ঘটনারে তার আগের ঐতিহাসিকেরা সামনে এনেছেন, হিন্দুদেরে সেই অভিযোগ থিকা মুক্তি দিছে। বিপরীতে মুসলমান অভিজাত শ্রেণী নামে নতুন ঘটনারে আলোচনায় এনেছেন এবং কাটগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। অসীম রায় উচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণদেরও এই অভিজাত, মানে আশরাফ মুসলমানের কাতারে রেখেছেন, আরব বা আর আর জায়গা থেকে বা নবী বংশের সাথে যারা সম্পর্কিত, তারা ছাড়া।

সচেতন ঘটনা? হিন্দুর দায়মুক্তি ও মুসলমানরে কাটগড়ায় দাঁড় করাল মনে হয় না? ইতিহাস পাঠ পদ্ধতি তো নিরীহ কোন ঘটনা নয়।

ইতিহাস বলে, স্থানীয় হিন্দুদের বর্ণাশ্রমের মতো কইরা মুসলমানদের কোন ফরমাল অভিজাততন্ত্র ছিল না (পড়া যেতে পারে, Was caste-ism developped in the muslim society? / Social History of The Muslims In Bengal: Abdul Karim: 1959)। সমাজে নানান ক্ষমতাসম্পর্কে এইরকম অভিজাত তো তৈরী হয়ই। এইটারে একাট্টা অভিজাততন্ত্র দিয়া বোঝার চেষ্টা অতি সরলিকরণ। অভিজাততন্ত্রের চাইতে আরবিয় ইসলাম বা রক্ষণশীলতা দিয়া এইটারে বেটার বুঝতে পারা যায়। এইটারে অসীম ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতায়নের সাথেও, কিছুটা মিলিয়ে পড়েছেন। এইখানে আইসা অভিজাত মুসলমানদের মধ্যকার মেডিয়েটর চিহ্ণিত করেছেন অসীম, যারা সমন্বয়ী সংস্কৃতির চিন্তা করেছেন। এইটারে অসীম কইতেছেন syncretistic tradition বা সমন্বয়ী সংস্কৃতি। সমস্যা হল, এই পুরো পাঠে অসীম বা ইটন সমন্বয়ি ভাবের বাইরে ইসলামের আর কোন ভাবরে চিহ্ণিত করতে চেষ্টা করেন নাই, যারে দিয়া এই মুসলমানি প্রসাররে ধরা যায়। এই যে এসেন্সের বাইরে থাইকা ইতিহাসের বস্তুগত উপরি পাঠ, এই ঘটনা কতটা ভাল, বলা মুশকিল।

ফরমাল অভিজাততন্ত্র না থাকার পরেও, অভিজাত মুসলমান তো ছিলই। আশরাফ আতরাফও ছিল, অন্তত আঠার শতকের শেষ দিকে বা উনিশ শতকের শুরুর দিকে এরকম প্রপঞ্চ দেখা গেছে মুসলমান সমাজে। এই ঘটনার সূত্র আশরাফ আতরাফের চেয়েও স্থানীয় হিন্দু কাস্ট সিস্টেম বইলাই মনে হয় আমার। অসীমের যে একাট্টা অভিজাত মুসলমান কল্পনা, এইটাও, বোধ হয়, হিন্দু বর্ণ প্রথা থেকে উনি এডপ্ট করেছেন। ইতিহাসপুরানের অন্ধগলির থেকে দূরে গিয়ে নিজেরে দেখতে পারা তো সহজ নয়। যে ব্রাহ্মন আগে পূজনীয় ছিল, নমঃশূদ্র মুসলমান হয়েও দেখে, সেই ব্রাহ্মণ এইখানেও অর্ঘ্য নিতে বইসা আছেন। অতীত স্মৃতিগুলো তো এমনই। তাদেরকে এই স্মৃতি, কাস্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে, মুসলমান হয়েও লড়াই চালিয়ে যেতে হইছে। এখনো হচ্ছে। আমার মতে, এই ব্রাহ্মণ্যবাদ ও নয়া কাস্ট সিস্টেমের নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

কনভার্সন সম্পর্কিত বাকি আলাপগুলোর মতই এই আলাপেও, ‘নিম্নবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে কোন মাস কনভার্সন ঘটে নাই’ বা মাস মাইগ্রেশনও হয় নাই ধরণের পূর্বঅনুমান ছিল। ফলে, এমন কোন ঘটনার আলাপ এই দুজনের আলাপে আসেই নাই। মানে, অসীমদের প্রকল্পও, ঠিক একটা খাঁটি অহিন্দু ও ননমাইগ্রেটেড, নন আরব, বা ননঅভিজাত আবিস্কারের প্রকল্পই হইয়া রহিল শেষমেষ?

৫.

মা সায়েরা খাতুন ও পিতা শেখ লুৎফর রহমানের শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি ও ক্যাপশন ফ্রম বিবিসি বাংলা।

আমার পাঠে, বাঙালি মুসলমান চিন্তায় ইটনের সবচেয়ে নোবল ইনভেনশন, এমন কি বেঙ্গলে ইতিহাস চিন্তারও সবচেয়ে বৈপ্লবিক ঘটনা হল, হাজার বছরের যে বাংলা বইলা কল্পনা করা হয়, তার বাইরের ঘটনা হিশেবে এই ‘বাঙালি মুসলমান’ বা নয়া ‘কৃষিভিত্তিক সমাজ’(agrarian frontier) রে চিহ্ণিত করা, যার উদ্ভব মোঘল আমল শুরুর পরবর্তী ১৫০ বছরে। ষোড়শ শতকের শেষদিকে বাংলার জলাভূমিতে যে পরিবেশগত পরিবর্তন হয়, তার ফলে পশ্চিমের ভাগিরথি খাত পরিবর্তন করে পূর্বের পদ্মার উপর দিয়ে গঙ্গার জলপ্রবাহ শুরু হয় ও পূর্ব বাংলায় নবগঠিত বদ্বীপ অঞ্চলে প্রচুর উর্বরা জমি ভেসে ওঠে। এর ফলে পশ্চিমে গঙ্গার প্রবাহ কমে যাওয়ায় পশ্চিমাঞ্চল মৃতপ্রায় এবং পূর্বাঞ্চল সক্রিয় বদ্বীপে পরিণত হয়, ফলে এখানে নয়া স্থানীয় আদিবাসি এবং পশ্চিম থেকে আসাদের সমন্বয়ে ও মুসলমান পীর ও অন্যান্য প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে নয়া কৃষিজীবী সমাজের অভূদ্যয় ঘটে। ঘটনাচক্রে এরা সবাই অনার্য, অহিন্দু, মানে হিন্দু কাস্ট সিস্টেমের বাইরের ঘটনা, ননমাইগ্রেটেড এবং বাংলার ভূমিপুত্র, ইটনদের গবেষণায়। মানে, ইটনের গবেষণা বাঙালি মুসলমানরে সন অব দ্য সয়েল হিশেবে প্রতিষ্ঠার দায় নিয়েছে, যেখানে ধর্মের চেয়ে পলি, কৃষি ও মুসলমান পীর ও অন্যান্য পায়োনিয়ারদের কারিশমাটিক নেতৃত্বের প্রভাব বেশি। ধর্মের প্রভাব যে আলাপেই আসে নাই, তার কথা তো উপরে বললামই। কিন্তু, ইন্টারেস্টিং হল, এই নয়া ‘বাঙালি মুসলমানে’র হিস্ট্রি মাত্র তিনশ বছর, কিন্তু অহিন্দু ও আদিবাসী। এবং ১৮৭২ সালের আদমশুমারিকে বাংলার যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মুসলমান পাওয়া গেছে, তা এই গাঙ্গেয় পলিমাটির থিকা উদ্ভূত নয়া বদ্বীপেরই কৃষি সমাজ। ভাটি বাংলা। এই ভাটি বাংলারে বাইরে রাইখা যে বাঙলা, তা কেমন বাংলা?

এই ভাটি বাংলার ঘটনারে বাইরে রাইখা যে বাংলা কল্পনা করা হয়, তাই ‘হাজার বছরের’ বাঙালি। যা আমাদের উপরে রাষ্ট্রে এবং সীমান্তে রাজনৈতিকভাবে চাইপা বসে আছে, বহু বছর ধইরা। এই ‘হাজার বছরের বাঙালি’ ব্যাপারটি কেমন?

এই ‘হাজার বছরের বাঙালি’র প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের বংশধরেরা নিজেদেরে সম্ভ্রান্ত, স্থানীয় ভূমিপুত্র গরিব চাষাভূষা বাঙালি মুসলমান থিকা আলাদা, ইরাক থিকা আগত বইলা প্রচার করে, তাও পনেরশ শতকে। এই প্রচারমতে, ১৪৬৩ সালে ইরাকের বুজর্গ হজরত বায়েজিদ বোস্তামির সাথে তার পূর্বপুরুষ শেখ আওয়ালের আগমন ঘটে। ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, কিন্তু মাত্র পনেরশ শতকে ইরাক থিকা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসা। আবার তিনিই ‘বাঙালি’ জাতির পিতা হয়ে ওঠলেন, তাদের ইতিহাসে। বেশ আধ্যাত্মিক ব্যাপার বটে।

এইটারে আমরা অসীম ইটনদের কওয়া সেই আশরাফের ভূত হিশেবে পড়তে পারি।

এই ভূত ইসলামে ঐতিহাসিক ধারার চাইতে, ইতিহাসের কাস্ট সিস্টেমের ভেতরে, ব্রাহ্মণ্যবাদের স্মৃতিতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে। দেখা যাচ্ছে, ‘ইরাক থিকা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে’ হিজরতের প্রচার করলেও, ইটনের এই এলিট পরে বাংলাদেশ বিপ্লবের প্রতিপক্ষ হিশেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান হয়ে এল আর চাষাভূষো ছোটলোক বাঙালি মুসলমানের উপরে চড়াও হল।

মানে, নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানের বাংলাদেশ বিপ্লবরে আত্মসাৎ করল। এই ঘটনারে আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ বলি। আসুন, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা থেকে পাঠ করি:

‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণের আর এক নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা উপমহাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক ও জাত-পাত-বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। যার সাথে ইনসাফ ও হকের প্রশ্নে এ ভূখণ্ডের মানুষের দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের সম্পর্ক। হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহ, তিতুমিরের সংগ্রাম, ফরায়েজী ও কৃষক আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, এমন কি বাংলাদেশ আন্দোলনেও এর প্রকাশ আছে। কিন্তু, হঠকারি শাসকদের ছত্রছায়ায়, ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ হিশেবে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্দরমহলেই আবার এর উত্থান এবং প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। যার সাথে, আমরা মনে করি, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও সমপ্রসারণবাদের গভীর সখ্য তৈরি হয়ে আছে সাংস্কৃতিকভাবেই। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনা তথা ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোতে ইন্ডিয়ান আধিপত্য সম্প্রসারণ ও বজায় রাখার জন্য কৌশলগত রাজনীতির সম্পর্ক ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত।  এই সম্পর্ক ও সখ্যতার রাজনৈতিক পাঠ জরুরি।

..আমরা মনে করি, ইতিহাসে আমাদের সব মুক্তি আন্দোলনে, এবং সর্বশেষ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে গণ-মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপরারপর গন্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম গন্তব্য ছিল এই ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরাজিত করা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতার কারণে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই, আমরা আবার এই ব্রাহ্মণ্যবাদের খাঁচায় ঢুকে পড়েছি। সীমান্তে খুনোখুনি, নদীর পানি অবরোধ, ভূমি দখল, অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে দাদাগিরি, এইসবের মাধ্যমে মহাভারতের এই নতুন রবীন্দ্রনাথ আবার আমাদের উপরে বর্ণবাদী জমিদার হয়েই বোঝার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। লাঠি দিয়ে শাসন করছেন। এবং আমাদেরকে এখন, একই সাথে, এই দুই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। একজন সীমান্তে খুনোখুনি করে, একজন রাষ্ট্রে জমিদারী করে।’..(ভূমিকা অথবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ ও অন্যান্য/ রিফাত হাসান। সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি। ২০১৪)

4 comments

  • রোকন শেখ

    ইসলামের আদর্শগত প্রভাব এড়িয়ে তাত্ত্বিক পদ্ধতি ঠিক রেখে মুসলিম জাতি হিসেবে মাস কনভারসনকে ব্যাখা করার প্রয়াস মূলত ইসলাম থেকে মুসলমিকে আলাদা করা। কিন্তু এ আমলে তাত্ত্বিকগণ স্যাকুলারিজমকে বাঙালি জাতীয়তা থেকে আলাদা করেন নি।

  • মোহাম্মদ শাহ্ আলম

    মূল আলোচনার সূত্রপাত যে দুটি বইকে কেন্দ্র করে – হাসান মাহমুদের বাঙালি মুসলমান প্রশ্ন এবং আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন – এ দুটি বইয়ের কোনটির সাথে আমার দেখা হয়নি। ফলে কোন মন্তব্য করতে পারছি না। হাসান মাহমুদের বইটি সামাজিক মাধ্যমে কিছুটা আলোড়ন তুলেছে, এটা দেখেছি।

    যাইহোক, যাকে কেন্দ্র করেই সূত্রপাত ঘটুক প্রবন্ধটা স্বয়ং আরেকটি ভিন্নমাত্রায় হাজির হয়েছে। বিশেষ করে হাজার বছরের বাঙালি প্রশ্নটা।

    আজকের বাঙালির আদি পুরুষ দ্রাবিড়ীয় জাতি বলে যে অনুমান বা বয়ান আছে তাদের স্থানীয় ধর্ম যাই হোক না কেন, ড. আহমদ শরীফ বলেন এদের আগমণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে এ জনগোষ্ঠি একেশ্বরবাদী ধর্মের সাথে পরিচিত। ফলে এদের মধ্যে নানান সংস্কার আচারিক সংমিশ্রণ দেখা গেলেও এদের মূল বিশ্বাস একেশ্বরবাদ থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি।

  • very nice write up

  • চমৎকার লেখা

Leave your comment