Articles, Blogs

রিফাত হাসান

মাদ্রাসা, জাতীয় সঙ্গীত ও হাইকোর্ট

March 28, 2018   0 comments   8:15 pm

বাংলাদেশের মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত নিয়া কিছুদিন আগে যে হাইকোর্ট হল, তার বিষয়ইে এই ভণিতা। দেশপ্রেম আইনে বা সঙ্গীতে মাপার বিষয় নয়, এইটা খুব স্পর্শকাতর। তাই দেশপ্রেম নিয়া হাইকোর্টে ঘোরাঘুরি বেকুবি ধারণা। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিস্ট উপকরণও আছে। তার আলাপ এখানে নয়। মামলার বিষয়ে আসি, যেহেতু সিদ্ধান্ত ও রায় হয়ে গেল।

Share

আধুনিক ‘রাষ্ট্রে’ একজন মানুষের কতটা ‘স্বাধীন’ হওয়া সম্ভব? বা কতটা ‘অধীন’? তার সীমা কি এতই লঘু যে, হাইকোর্ট বইলা দিল, আর আপনি জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ‘দেশপ্রেমে’র প্রমাণ দিতে বাধ্য?

আধুনিক রাষ্ট্র ও আধুনিকতার ধারণার কেন্দ্র হল ‘ব্যক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’। আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের উপর ঈমান নয়, এর হা এর ভেতরে বইসাও আপনি যে ন্যূনতম স্বাধীনতার অধিকার রাখেন, এই ব্যাপারটি সম্পর্কে সচেতন না থাকলে, দলদাসদের হাইকোর্ট আপনার উপর চেপে বসবে। কারণ, এই স্বাধীনতা ও তার সীমা নিয়া দলদাসদের ধারণা ও ইচ্ছা কোনটাই থাকার কথা না।

আবার, রেজিমের দরকার দেশপ্রেম ব্যবসা। ফলত, রাষ্ট্রে নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের রক্ষাকবচ হাইকোর্ট প্রায়ই তাদের ভরসা হয়ে ওঠে।

আপনার ভরসা কী? 

বাংলাদেশের মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত নিয়া কিছুদিন আগে যে হাইকোর্ট হল, তার বিষয়ইে এই ভণিতা। দেশপ্রেম আইনে বা সঙ্গীতে মাপার বিষয় নয়, এইটা খুব স্পর্শকাতর। তাই দেশপ্রেম নিয়া হাইকোর্টে ঘোরাঘুরি বেকুবি ধারণা। এর মধ্যে একটি ফ্যাসিস্ট উপকরণও আছে। তার আলাপ এখানে নয়। মামলার বিষয়ে আসি, যেহেতু সিদ্ধান্ত ও রায় হয়ে গেল।

এই ধরনের মামলা বাংলাদেশে নতুন। হাইকোর্টে যখন এইরকম নতুন ধরনের কোন মামলা আসে, বিধি হল, এই বিষয়ে পূর্ববর্তি কোন নজির থাকলে, বহির্বিশ্বের হলেও, তারে আমলে নেওয়া ও পর্যালোচনা করা। হাইকোর্ট কি এই মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে এইরকম পূর্বনজিরগুলো পর্যালোচনা করেছে? আমার সন্দেহ, করে নাই, কারণ মামলা উত্থাপিত হয় নাই মর্মে খারিজ হইছে এই ধরনের প্রশ্ন করে যে, পবিত্র কোরআনের কোথায় আছে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না?

পবিত্র কোরানের কোথাও নেই যে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না। ফলত আমরা একটি আকর্ষণীয় আইনি বিতর্ক থেকে বঞ্চিত হলাম।

তো, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নিয়াও এই ধরনের মামলা হইছিল। একাধিক। মজার ব্যাপার হলো, ভারতেরও জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের গান। আরো মজার ব্যাপার, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়া যেমন কিছু অভিযোগ তোলা হয়, এই গান বিষয়েও অভিযোগ, রবীন্দ্রনাথ গানটি রাজা পঞ্চম জর্জের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশে রচনা করেছিলেন। এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল সেই বছরের ২৭ ডিসেম্বর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে, যার মূল এজেন্ডা ছিলো রাজা পঞ্চম জর্জকে আনুগত্যমূলক স্বাগত জানানোর প্রস্তাবনা। বাংলাদেশে যেমন জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কিছুটা উত্তপ্ত আলাপ হয় বিভিন্ন সময়ে, ভারতেও নিজেদের গান নিয়ে এই ধরনের কনট্রোভার্সি আছে। নিজেদের ভেতরেই।

ফলত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নিয়াও এই ধরনের হাইকোর্ট হইছিল বিভিন্ন সময়। তার একটা উদাহরণ এবং তাই নিয়ে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের আলাপগুলো টুকে দিচ্ছি। উপকারে আসবে।

১৯৮৫ সালে ভারতের কেরালা রাজ্যের জিহোবাস উইটনেস (Jehovah’s Witnesses) এর কয়েকজন ছাত্র বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করার কারণে, তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন অভিভাবক কেরালা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে, হাইকোর্ট বর্তমান বাংলাদেশের হাইকোর্টের কাছাকাছি মতামত দেয়, যার মূল ভিত্তি হল, ‘এই গানে এমন কিছু নেই যা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে’। (there was nothing in it which could offend anyone’s religious susceptibilities.)

পরে অভিভাবকরা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেলে, সুপ্রিম কোর্ট কেরালা হাইকোর্টের রায় বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের পুনরায় ভর্তি নেওয়ার নির্দেশ দেন।

কেন? সুপ্রিম কোর্ট যে হাই কোর্টের রায়কে রিভার্স করল, তার ভিত্তিগুলো কী? আসুন পড়ি সেই রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো। আমাদের উপকারে আসবে। খুবই ইন্টারেস্টিং।

প্রথম পর্যবেক্ষণটি আমার মনোযোগ কেড়েছে, আমরা আরো অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণের মূল্য বুঝতে পারি। হাইকোর্ট বলছে, একজন সেক্যুলার জাজের কাজ কারো রিলিজিয়াস বিলিফ ঠিক করে দেওয়া ও রিলিজিয়াস কারেক্টনেস নিয়া কথা বলা নয়। (It is not for a secular judge to sit in judgment on the correctness of a religious belief.) আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মতামত এ ক্ষেত্রে ইরিলেভেন্ট। (Our personal views and reactions are irrelevant.) হাইকোর্ট নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়েছে (the High Court had misdirected itself), কারণ প্রশ্ন এটি নয় যে, কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাস প্র্যাকটিস আমাদের যুক্তি বা আবেগের কাছে আকর্ষণীয় কিনা, বরং প্রশ্ন হল, এই বিশ্বাস প্রকৃতপক্ষে কোন নির্দিষ্ট প্রফেশন বা কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধিবিধানের অংশ হিশেবে সচেতনভাবে পালন করা হয় কিনা। (the question is not whether a particular religious belief or practice appeals to our reason or sentiment but whether the belief is genuinely and conscientiously held as part of the profession or practice of a religion.) তারপরে সুপ্রিম কোর্ট বলছে: এমন কোন আইনের প্রভিশন নেই, যা কাউকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ায় বাধ্য করতে পারে। কেউ যদি জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময়ে দাঁড়িয়ে গানে অংশগ্রহণ না করে, এইটা কোনভাবেই জাতীয় সংগীতের প্রতি অসম্মান নয়। এই সংক্রান্ত পুরো প্যারাটা পড়ুন:

‘There is no provision of law which obliges anyone to sing the National Anthem nor is it disrespectful to the National Anthem if a person who stands up respectfully when the National Anthem is sung does not join the singing. Proper respect is shown to the National Anthem by standing up when the National Anthem is sung. It will not be right to say that disrespect is shown by not joining in the singing. Standing up respectfully when the National Anthem is sung but not singing oneself clearly does not either prevent the singing of the National Anthem or cause disturbance to an assembly engaged in such singing so as to constitute the offence mentioned in s. 3 of the Prevention of Insults to National Honour Act.’                                                                                                                      

মজার না? মনে হইতেছে কি, আপনার দেশপ্রেম দুর্বল হয়ে গেল?

এলা বলে নিই, আমি মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বিপক্ষে নই। তবে আমার কাছে মাদ্রাসাগুলোর জাতীয় সঙ্গীত গাইতে না চাওয়ার অধিকারটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তার বেসিস হচ্ছে, মাদ্রাসা বা ইসলামের স্কুলগুলোর ভেতরেই খোদ সঙ্গীত ব্যাপারটি নিয়ে মতভেদ আছে। জাতীয় সঙ্গীত দূরের ব্যাপার।

হাইকোর্ট এই মতভেদের কারেক্টনেস নিয়া প্রশ্ন তুলে রীট খারিজ করেছে: পবিত্র কোরআনের কোথায় আছে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না? এলা কই, এই ধরণের প্রশ্নের এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। আমরা সব সময় বলেছি, এই ধরণের তর্ক আইনি পরিসরে মীমাংসার ব্যাপার না।

জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া যাবে না— এইটা পবিত্র কোরানের কোথাও নাও যদি থাকে, আমি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ভার্সটাই মনে করিয়ে দিতে চাই (রিপিট): একজন সেকুলার জাজের কাজ নয় কারো রিলিজিয়াস বিলিফ ঠিক করে দেওয়া ও রিলিজিয়াস কারেক্টনেস নিয়া কথা বলা। (It is not for a secular judge to sit in judgment on the correctness of a religious belief.) জাজদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মতামত এ ক্ষেত্রে ইরিলেভেন্ট। (Our personal views and reactions are irrelevant.) হাইকোর্ট নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়েছে (the High Court had misdirected itself), কারণ প্রশ্ন এটি নয় যে, কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্র্যাকটিস  আমাদের যুক্তি বা আবেগের কাছে আকর্ষণীয় কিনা, বরং প্রশ্ন হল, এই বিশ্বাস প্রকৃতপক্ষে কোন নির্দিষ্ট প্রফেশন বা কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধিবিধানের অংশ হিশেবে সচেতনভাবে পালন করা হয় কিনা।(the question is not whether a particular religious belief or practice appeals to our reason or sentiment but whether the belief is genuinely and conscientiously held as part of the profession or practice of a religion.)

পুনমুদ্রণ, ফ্রম টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা। পৃষ্ঠা ২১৩। দুয়েন্দে পাবলিকেশন্স। মার্চ ২০২১

Leave the first comment