Interviews

মাহবুব মোর্শেদ

রিফাত হাসানের সঙ্গে

January 17, 2023   0 comments   12:35 pm
রিফাত হাসানের সাক্ষাৎকার মাহবুব মোর্শেদ

এটাকে আমি, দর্শনও না বলে, কোন কিছু না বলে, বলি যে, আমাদের ভ্রমণটা। মানে, আমি আমাদের ভ্রমণটারে ইগনোর করে কোন কিছু করি নাই শেষ পর্যন্ত। এটাকে শুধু দর্শন বলা যাবে না। তবে এইটা দার্শনিক ভ্রমণও তো।

Share

রিফাত হাসানের জন্মদিনে, রিফাত হাসানের সাক্ষাৎকার

১৭ জানুয়ারি, ২০২৩, রিফাত হাসানের জন্মদিনে, রিফাত হাসানের এই ইন্টারভিউ নেন কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ, ক্লাবহাউজে। অডিও ফরমেটে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় দীর্ঘ। মাহবুব মোর্শেদের পাশাপাশি শ্রোতাদের মধ্য থেকে মৃদুল মাহবুব, সালাহ উদ্দিন শুভ্র, মোর্শেদুল আলম, আবু তাহের তারেক, ওয়াসিম মাহমুদ, রুদ্র মোহাম্মদ এবং সুরঞ্জন আহমদও প্রশ্ন করেন রিফাত হাসানকে৷ এই ইন্টারভিউ-আড্ডায় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন ব্রাত্য রাইসু, লুনা রুশদি, মুরাদুল ইসলাম, মোকাররম হোসাইন, ড্রাবিড় হাসান খান, জাহাঙ্গীর আলম, তানজিল মাহমুদ শাহ এবং আরো অনেকে। সাক্ষাৎকার ট্রান্সক্রাইব করেছেন ইবনে শামস। ইন্টারভিউর মুদ্রণ ভার্সনে শ্রোতাদের প্রশ্নের দীর্ঘ ও বর্ণনামূলক অংশ বা কমেন্টগুলো বাদ রাখা হযেছে, মূল আলাপের কোন কোন অংশও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, লেখকের উত্তরের অংশেও লেখকের দিক থেকে প্রয়োজনীয় এডিট করা হয়েছে, সাক্ষাৎকারের চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে, দৈর্ঘ্য কমাতে আর অস্পষ্টতা এড়াতে।

তানজিল মাহমুদ শাহ: রিফাত ভাই বোধহয় জয়েন করেছেন। রিফাত ভাই কথা বলছেন।

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, রিফাত হাসান জয়েন করেছেন বলে মনে হচ্ছে, তার একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি।—

তানজিল মাহমুদ শাহ: রিফাত ভাই চলে আসছেন, রিফাত ভাই কথা বলেন তাহলে।—

রিফাত হাসান: ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ তানজিল। মাহবুব ভাই, শুনতে পাচ্ছেন?

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, শুনতে পাচ্ছি। এর মধ্যে আপনি আসার আগে আমরা কথা শুরু করে দিয়েছিলাম। তো তার ফলে ফর্মাল যে শুরু, সেটা আগেই শুরু হয়ে গেছে।—

রিফাত হাসান: আমি একটু অপরাধবোধে ভুগতেছিলাম। সরি। আমার কিছু করার ছিল না। একটা আনপ্লান্ড  ফ্যামিলি প্রোগ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ছিলাম আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, আচ্ছা। তো ভালো হইছে। যেহেতু আজকে আপনার জন্মদিন। ফলে ফ্যামিলি প্রোগ্রাম থাকবেই। এটা ধরে নিয়ে আমরা মনে করি যেটা, থাকারই কথা, না থাকার কথা না। 

রিফাত হাসান: এরকমই হইছে। আমাকে না জানিয়ে এরা প্রোগ্রাম করে ফেলছে। সন্ধ্যা হতে হতে দেখি লোকজন চলে আসছে। এখানেই সমস্যা হয়ে গেছে আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা আচ্ছা। বেশ একটা মুখরোচক খাবারের আয়োজন ছিল নিশ্চয়।—

রিফাত হাসান: হা হা। হুম। 

মাহবুব মোর্শেদ: বোঝা যাচ্ছে (হাসি), তো আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই।—

রিফাত হাসান: থ্যাঙ্কিউ মাহবুব ভাই।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, অন্যরাও, অনেকেই আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। লুনা রুশদি জানিয়েছেন। মোহাম্মদ মোরশেদুল জানিয়েছেন। তারপরে ওয়াসিম মাহমুদ জানিয়েছেন। মাইকেল স্কফিল্ড জানিয়েছেন। তানজিল মাহমুদ শাহ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মৃদুল মাহবুব জানিয়েছেন। তারপরে—

রিফাত হাসান: আচ্ছা আচ্ছা। থ্যাংকস টু অল।

মাহবুব মোর্শেদ: তো, পরপর দুই জন্মদিনে, বোধ হয় গতবারের জন্মদিনে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল, না? মানে আপনার ঐ প্রোগ্রামে আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম। নাকি তার আগের বছর? সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে যে প্রোগ্রামটা হলো—

রিফাত হাসান: হাঁ হাঁ, গত বছরই তো, সম্ভবত।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা গত বছর। তখনও আবহাওয়াটা এরকমই ছিল । হালকা শৈত্যপ্রবাহ ছিল ঢাকায়। এবং আমার মনে পড়ছে, এবার যেমন আমার একটু হালকা ঠান্ডা লেগেছে, গতবারও এরকম হালকা হালকা ঠান্ডা ছিল ।—

রিফাত হাসান: আপনার ঠাণ্ডা লেগেছে নাকি?

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, একটু একটু ঠান্ডা লেগেছে। এবং গতবার যে ছিল, করোনার প্রকোপ ছিল বেশী, এবার সেটা দেখা যাচ্ছে না। এটা একটা পার্থক্য এবং ইতিবাচক পার্থক্য। আর আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন অনেকে, আপনি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ওগুলো দেখেন।.. 

রিফাত হাসান: হু আমি দেখছি।—

মাহবুব মোর্শেদ: খুবই ভালো হয়।—

রিফাত হাসান: আমি এগুলা দেখছি, এবং ফাঁকে ফাঁকে জবাব দেবার চেষ্টা করবো, যদি সম্ভব হয়।

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, তো এই জন্মদিন দিয়ে কথা শুরু করি?—

রিফাত হাসান: আচ্ছা।—

মাহবুব মোর্শেদ: জন্মদিন উপলক্ষে গতবারের ঐ আয়োজনটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। তো এবারও আপনার সঙ্গে একভাবে ঘটনাচক্রে কথা হয়ে যাচ্ছে। জন্মদিন উপলক্ষে। জন্মদিনের ব্যাপারটা আপনি বলেন। জন্মদিনের ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?—

রিফাত হাসান: আসলে তো, মানে, আমাদের যে বয়স, আমাদের যে এনভায়রনমেন্ট থেকে বড় হওয়া, এখানে জন্মদিন বলে কোন ব্যাপার ছিল না।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: আমাদের যে বড় হওয়া, এই বড় হওয়ার স্মৃতিতে কোন জন্মদিন ছিল না। জন্মদিন ব্যাপারটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের পরের জেনারেশানগুলার ভেতরে আর কি! অথবা কোন বিখ্যাতজনের জন্মদিন দেখতেছি। কিন্তু সাধারণ ফ্যামিলিতে জন্মদিন ব্যাপারটা সে রকম ছিল না আমাদের সময়ে। সেজন্য নিজের একটা জন্মদিন থাকবে সেটা ভাবার সুযোগই হয় নাই।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। এখন কি, এই যে ধরেন, জন্মদিনের ব্যাপারটা ছিল না। আমাদের ফ্যামিলিতে বোধ হয় কমনলি এই জিনিশটা আছে। সেটার কারণ যে শুধু কোন একটা দৃষ্টিভঙ্গি তা না। আমার কাছে সব সময় মনে হয় যে, এর পেছনে একটা বোধ হয় অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিল আর কি! যে জন্মদিনটা ঘটা করে পালনের ক্ষেত্রে, এটা তো একটা খরুচে ব্যাপার আছে এর সঙ্গে। একটা গিফট দেয়ার ব্যাপার আছে, কেক কাটার ব্যাপার আছে। সেগুলা আছে, ফলে এক ধরনের বোধ হয়, এটা ঐভাবে ফ্যামিলির মধ্যে নানান হিসাব নিকাশের কারণে, ঐভাবে বোধ হয় উদযাপনের রীতিটা ঠিক চালু হয়ে ওঠেনি আমাদের পরিবারগুলোতে। এখন অবশ্য সেটা অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে।—

রিফাত হাসান: এটা কি তখনো পর্যন্ত গ্রামগুলোতে চলতো? এখনো কি গ্রামগুলোতে চলে? মানে, আমরা গ্রামে বড় হইছি তো, ছোটবেলাটা তো আমাদের গ্রামে কাটছে—

মাহবুব মোর্শেদ: আমারো তাই।

রিফাত হাসান: আচ্ছা। তো, গ্রামের সময়টাতে আমি জন্মদিন ব্যাপারটা তেমন দেখি নাই আর কি! কিন্তু আমরা শহরে আসার পর দেখলাম, একদম খুব নরমাল ফ্যামিলিতেও জন্মদিন ব্যাপারটা পালন করা হচ্ছে নানান ভাবে। আমাদেরও আস্তে আস্তে এইটার সাথে অভ্যস্ততা, তখন, শুরু হয়ে গেছে আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, আমার কাছে মনে হয় যে, জন্মদিন জিনিসটা এক ধরনের, মানে বাংলাদেশে বা আমাদের ফ্রেন্ডসার্কেলে বিশেষভাবে, চালু হওয়ার পেছনে বোধহয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোন একটা ভূমিকা আছে।—

রিফাত হাসান: ডেফিনিটলি আছে, আছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আছে কি?—

রিফাত হাসান: আছে, আছে একদম। আমি এটা স্টোরিতে শেয়ার করলাম।— অর্জয়িতার কমেন্ট পড়লাম, এইটা অনেকেই ফলো করেন।—  

মাহবুব মোর্শেদ: ও আচ্ছা, রিয়ার পরামর্শ মোতাবেক?—

রিফাত হাসান: জ্বি জ্বি৷ 

মাহবুব মোর্শেদ: তো, যেটা জিগ্যেস করছিলাম যে, জন্মদিন বিষয়টা পালিত হওয়ার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা আছে কিনা। আপনার কি মনে হয়?—

রিফাত হাসান: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা আছে হচ্ছে যে, যেসব ক্ষেত্রে, মানে ধরেন, নরমালি একজন মানুষ বিখ্যাত হওয়ার আগ পর্যন্ত, তার যে একটা জন্মদিন থাকতে পারে, তারে নিয়ে কনসার্ন দেখা দেওয়ার ফ্যামিলিতেও কোন কারণ থাকে না আর কি! সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ব্যাপারটা, যখন ফেসবুক মনে করিয়ে দেয়, অনেকেই ব্যাপারটা বলতে থাকে, তখন দেখা যায়, নিজেদের ঘরের ভেতরেও একটু আলাপ সালাপ তৈরী হয়। আমার জন্মদিনের ক্ষেত্রে যেটা, সেটা আমাদের বিয়ের পরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে এইটার সম্পর্ক নেই। আমার জন্মদিন নিয়ে বিয়ের আগে কখনো কাউকে কনসার্ন হইতে দেখা যায় নাই। বিয়ের পরে, দেখা যাচ্ছে, আমার বউ কনসার্নড হইতেছে আমার ব্যাপারে, আমিও তার ব্যাপারে কনসার্ন হচ্ছি। তো, এভাবেই জন্মদিন ব্যাপারটা আসলো। এইটা নিয়ে আমরা সচেতন হলাম।

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। কিন্তু এই যে ধরেন, একটা বয়স পর্যন্ত আপনি চলে এলেন। এবং বিস্তর অভিজ্ঞতার, নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এলেন। এখন এসে, ধরেন এই বয়সে এসে আপনার উপলব্ধিটা কেমন কাজ করে? মানে, এই জীবন সম্পর্কে উপলব্ধিটা কেমন কাজ করে?—

রিফাত হাসান: আমার আসলে জীবন সম্পর্কিত উপলব্ধিটা, মানে, এইটার আসলে অনেক চেহারা আছে। আমি এক ধরনের একটা ভ্রমণের ভেতরে ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ফেইজে। কিন্তু আমার ভেতরে সবসময় ভাবটা ছিল এরকম, ঐ যে জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা আছে না, আমার কোথাও যাওয়ার খুব তাড়া নেই, খুব আস্তে আস্তে চলতে পারি। মোটরকার সম্ভবত কবিতাটা।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, হাঁ, মোটরকার।—

রিফাত হাসান: মানে, আমাদের অত তাড়াহুড়া করে কোথাও যাবার নেই, সেরকম একটা ব্যাপার আছে ওখানে। তো, আমারও সেরকমই একটা ভাব আছে আর কি, জীবন সম্পর্কিত। এখন আস্তে আস্তে সে ভাবটা আরো একটু প্রবল হচ্ছে আর কি! মানে, তেমন তাড়াহুড়ার কিছু নাই।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, এটা কীভাবে তৈরী হলো? মানে আপনি তো প্রায়ই তরুণ, কিন্তু তারপরও এই যে একটা ধীর স্থির, চিন্তাশীল ব্যাপার। এটা কি আপনি সচেতনভাবে আয়ত্ত করেছেন?—

রিফাত হাসান: উমম, না মনে হয়। এটা সচেতন ভাবে আয়ত্ত করার ব্যাপার থাকতে পারে যদি আমার, ধরেন, খুব সচেতনভাবে একটা ‘ক্যারিয়ার’ গঠনের মতো ব্যাপার যখন থাকে। কিন্তু আমাদের যেটা চিন্তাভাবনা, সেই চিন্তাভাবনা আসলে আমাদের ছোটবেলা এবং কৈশোরের সময়, যারা চিন্তা ভাবনা করে, তাদের চিন্তাভাবনা করার শুরুটা তো হয় একদম কৈশোর থেকে। এমনকি আরো ছোটবেলা থেকেও এই জিনিশটা শুরু হয় নানান ভাবে। নানান প্রশ্ন, নানান অভিজ্ঞতা।— আমাদেরগুলোও এরকমই ছিল, যতোটুক মনে আছে। কোন সচেতন ব্যাপার ছিল না। সচেতন ব্যাপার ছিল যে, যখন জিনিশগুলাকে আমি গুছাইতে গেলাম। মানে, আমার কাছে যখন প্রশ্নটা আসে। তখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে আসে প্রশ্নগুলা। তো যখন গুছানোর প্রশ্ন আসলো, তখন হচ্ছে আমি একটু সচেতন হইলাম যে, তাহলে আমি কীভাবে গুছাবো? এই ধরনের ঘটনা আমার আছে, ধরেন, একটা সময়ে এসে আমার মনে হলো যে, আহা, খুব একটা ননসেন্স লাইফ লিড করছি। এটার কোন অর্থ তো প্রয়োজন। তো, অর্থটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে, তখন একটু গুছালাম। তখন আরো অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হলো। যাদের কথাবার্তা, যাদের সাহচর্য আমাকে খুব প্রভাবিত করেছে। সেরকম একজন মানুষ আছেন, আমি স্যার ডাকতাম, মুঈনুদ্দিন আহমেদ খান উনার নাম। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন নাম, আমার কাছ থেকে, মাঝে মধ্যে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, হাঁ, উনাকে নিয়ে আমি জিজ্ঞেসই করতে চাচ্ছিলাম। আমি ইনফেক্ট ভেবে রাখছি। উনার সঙ্গে আপনি দেখা পেলেন কোথায়?—

রিফাত হাসান: উনার দেখা পেলাম হচ্ছে, আমাদের একটা চিটাগং এ সংগঠন ছিল। সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চাপীঠ এটার নাম।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো এখানে আমরা, আমরা হচ্ছে যে, চেষ্টা করতাম, বিভিন্নজন, বিভিন্ন চিন্তা, ডিফরেন্ট চিন্তা ভাবনার মানুষজনকে নিয়ে এসে তাদের কথাবার্তাগুলো শোনার। এবং তাদের সাথে ইন্টারেক্ট করার চেষ্টা করা। আমাদের একদম স্পেসিফিক কোন গোল ছিল না যে, আমরা এই কাজটা করবো। তো, আমরা যেটা প্লান করেছিলাম, সেটা হচ্ছে, আমরা সবার কথাবার্তাগুলা শুনবো। এই শোনার ব্যাপারটাই আমাদের কাজ একমাত্র। এর মাধ্যমেই, এর ভেতরেই, একদিন মুঈনুদ্দিন স্যারকে নিয়ে আসলাম। স্যার তখন আমাদের, উনি হচ্ছেন  যে ইসলামিক ট্রেডিশনের লোক। উনি একসময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর মহাপরিচালক ছিলেন। তার আগে, করাচি ইউনিভার্সিটিতে পড়াইতেন। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টটা উনি প্রতিষ্টা করছেন। ইসলামিক হিস্ট্রির উপর উনার যথেষ্ট কাজ আছে। ব্রিটিশ ভারতে বেঙ্গল মুসলিমের যে হিস্ট্রি, তাতে তার কাজগুলাকে খুব গুরুত্বের সাথে ধরা হয় আর কি! তো, উনি আমাদেরকে, উনার এইসব ফিল্ড নিয়ে কিছু ক্লাস নেওয়ার কথা হয়। তো, আসার পরে, উনি আমাদের প্রথম ক্লাসটা নিছিলেন হচ্ছে, আল হামদুর তাফসীর।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: হাঁ। আমি খুব বিরক্তির সাথে ওখানে গেছিলাম প্রথমে। তারপর উনার ক্লাসের ভেতর ডুকে এতো মুগ্ধ হলাম। কারণ হচ্ছে কি, উনার যেটা পদ্ধতি, পদ্ধতিটা ছিল এমন, মানে উনি আমাদেরকে গল্প করতে করতে আলহামদুটা বুঝাচ্ছিলেন আর কি! বলে যে, আমি আলহামদু পড়লাম। পড়ে কোনভাবে বুঝতে পারলাম না যে, আলহামদু এর অর্থ কী হতে পারে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো, আমি এটা নিয়ে তাফসিরকারকদের তফসিরগুলো ঘাঁটলাম। লাইব্রেরিগুলো সব তন্নতন্ন করলাম। সবাই দেখতেছি, আলহামদুর এক অর্থ, ‘প্রশংসা’ করছে। কিন্তু আমার মন ভরতেছে না। তখন আমি আল্লাহরে বললাম, আল্লাহ এরা তো কেউ আমারে আলহামদুর অর্থ শেখাইতে পারতেছে না। তুমি আমারে শেখায়ে দাও। তখন আল্লাহ আমারে বলল যে, তুমি কোত্থেকে শিখতে গেছিলা? বললাম যে, আমি এই এই তফসিরগুলা পড়লাম, অই অই বইপত্রগুলা পড়লাম। তখন আল্লাহ আমারে বলল যে, তুমি মূর্খদের কাছে তো যাও নি। তাদের কাছে যাও। মুর্খরা তোমাকে কোরআন বুঝিয়ে দেবে। আমার কোরআন তো তুমি জ্ঞানিদের কাছ থেকে শিখতে পারবা না। তারপর আমি মুর্খদের কাছে গেলাম। তাদেরকে জিগ্যেস করলাম যে, তোমরা আলহামদুলিল্লাহ কখন বলো? তখন মূর্খরা জানায় যে, আমরা যখন পেট ভর্তি করে ভাত খাই, তখন আলহামদুলিল্লাহ বলি।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। হুম।—

রিফাত হাসান: তখন আসলে, মঈনুদ্দিন স্যার যেটা বললেন, যে ভাত খেয়ে তো আসলে মানুষের প্রশংসা করা যায় না। ভাত খাওয়ার পর যেটা ঢেকুর ওঠে, সেটা হচ্ছে কৃতজ্ঞতার ঢেকুর।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।

রিফাত হাসান: তো, প্রশংসা হচ্ছে তাই, যেটা হচ্ছে যে, আসলে আপনি মানুষকে প্রশংসা করার, মানে আপনার যোগ্যতাও থাকার ব্যাপার আছে। প্রশংসা ব্যাপারটা এমন যে, আপনি অতিরিক্ত করতে পারেন সেখানে। কিন্তু কৃতজ্ঞতার ব্যাপার হচ্ছে যে এমন, যেখানে অতিরিক্ত কিছুই থাকে না। কৃতজ্ঞতার ভেতরে, মানে, আপনার নিজের যোগ্যতার ব্যাপার থাকে না। যার প্রতি কৃতজ্ঞ হচ্ছেন, তার যোগ্যতার ব্যাপার। মানে আলহামদু ব্যাপারটা এই জায়গা থেকে বোঝার ব্যাপার আছে। মানে উনি—

মাহবুব মোর্শেদ: হু।

রিফাত হাসান: মানে, উনার বেসিক ইয়েটা ছিল এরকম। কোরআন শরীফটা বুঝতে হলে আসলে মুর্খদের কাছে, কোরআন শরীফটা তো জ্ঞানীদের কাছে নাজিল করে নাই, উম্মীর কাছে নাজিল করা হইছে। মূর্খরা কোরআন শরীফকে যেভাবে বোঝে, সে বুঝটা আগে জরুরি,  জ্ঞানীদের কাছে যাওয়ার আগে। তো, আমার এখানে কিছু গুছানো হলো। মুঈনুদ্দিন স্যার আমাকে কিছু গুছাই দিলেন। এরকম অনেক ঘটনা, অনেকের ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করছে।—  

মাহবুব মোর্শেদ: উনি কি জুনিয়রদের সাথে মিশতে খুব পছন্দ করতেন?

রিফাত হাসান: সবার সাথেই মিশতে পছন্দ করতেন। মঈনুদ্দিন স্যারের ব্যাপারটা হচ্ছে, উনি খুব, যেই তার কাছে যাবে, তারে খুব গুরুত্ব দিতেন। খুব সাধারণ মনের মানুষ ছিলেন। তাকে গুরুত্ব দিয়ে ফিলোসোফিও বুঝাইতেন। কখনো কখনো এমনও হইছে, মঈনুদ্দিন স্যার কোন লেখা লিখলেন, সেটা আমাদের কাছে পাঠাইতেন। তারপর বলতেন, লেখাটা পড়ে এই ব্যাপারে তুমি একমত কি একমত না, লিখে জানাবা। সর্বশেষ একটা লেখা এরকম দিলেন, আমার ড্রয়ারে এখনো পাওয়া যাবে। 

মাহবুব মোর্শেদ: এইটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং। তো, আপনি যেটা বললেন যে, আমরা মুঈনুদ্দিন খানের ব্যাপারে ডুকে গেলাম, সেটা হলো যে, উনি আপনাকে প্রভাবিত করেছিলেন একভাবে।

রিফাত হাসান: সবসময়েই না। একটা সময়ে মুঈনুদ্দিন স্যার প্রভাবিত করেছিলেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: একটা সময় প্রভাবিত করেছিলেন, এবং সেই বয়সটার কথা কি আপনার মনে আছে যে, এই সময় উনার দেখা পেয়েছিলেন এবং আপনাকে উনি নাড়া দিয়েছিলেন।—

রিফাত হাসান: সময়টা মনে হয়। আমি অনার্স ফার্স্ট, সেকেন্ড ইয়ারের সময় হবে।—

মাহবুব মোর্শেদ: ওহ। এর আগে, ধরেন, এর আগে আপনি কখনো বুঝতে পেরেছিলেন? যে, আপনার মধ্যে একটা ভিন্নধরনের, ভিন্নভাবে চিন্তার, ভিন্নভাবে দেখার, ভিন্নভাবে নিজেকে প্রকাশ করার তাড়না তৈরী হচ্ছে? এ রকম খেয়াল করেছেন?

রিফাত হাসান: হাঁ, এটা তো খেয়াল অবশ্য করেছি। খেয়াল করেছি বলতে, এটা যদি খেয়াল না করতে পারতাম, তাহলে তো আমার জার্নি শুরু হইতো না।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ।

রিফাত হাসান: আমি যেটা বুঝি, আমার জার্নিটা, অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে বলতে, এমন কি হচ্ছে যে, ফাইভ সিক্সের সময় থেকে, আমার মনে আছে, আসলে একটা কাকতালীয় ঘটনাই ছিল। তো, সে সময়ে একটা পরিবেশের ভেতরে পড়ে গেছিলাম। যেখানে থাকতাম, মাঝে মধ্যে এসে, ওখানে একটা ছোটখাট, তখনকার জন্য বিশালই, বইপত্রের লাইব্রেরি ছিল। আর।—

মাহবুব মোর্শেদ: এটা কোথায়?

রিফাত হাসান: এটা হচ্ছে আমার এক আপার বাসা।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা আচ্ছা। নাইস।—

রিফাত হাসান: বইপত্রের লাইব্রেরি বলতে, ঐ রুমে যিনি থাকতেন, উনি আসলে একসময় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াইতেন। এখন বাংলাদেশে নেই। এখন উনি কুয়েতে বা অন্য কোন দেশে, কোন একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। আমার তালতো হোন আর কি! উনার বইপত্র।

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। 

রিফাত হাসান: তো, সে সময়ে, উনার সংগ্রহশালাটা আমার সামনে পড়ছিল আর কি! যখন সিক্সে, সেই সময়কার কথা বলছি। তো, সেই সময়ে আমি, আমার মনে আছে, আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পড়তেছিলাম। তারপর, মানে উনার সংগ্রহে যেসব, যা যা ছিল আর কি! সে সময়ে লা মিজারেবল পড়ছি আমি। প্রচুর নিহার রঞ্জনগুপ্তও। তারপর, তখন আমি মাদরাসায়ও পড়তাম।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং তো।

রিফাত হাসান: সে সময়ে বসে বসে আমি এগুলাও পড়তাম, আবার মাদরাসায়ও পড়তাম, একই সাথে। তো সে সময়ে অভ্যাসটা তৈরী হয়ে গেছিল কি, প্রচুর বই পড়ার অভ্যেস তৈরী হয়ে গেছিল। এবং গল্প বলুন, উপন্যাস বলুন, তারপর হচ্ছে এই যে, এই ধরনের গদ্য, পড়ার চেষ্টা করতাম। পড়তাম প্রচুর। তো, ওখানে তো আমার, একধরনের অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছিল। আর আমার যেটা মনে আছে, আমি যখম গ্রামে ছিলাম, তখন তো আরো অনেক ছোট বয়সে গ্রামে ছিলাম। সেই সময়েও আসলে, মানুষের ঘটনাগুলো স্পেসিফিকেলি ধরতে পারা সম্ভব না যে, আমার আসলে জার্নি কোথায় কীভাবে শুরু হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার ইয়েগুলাকে বুঝতে পারতাম। মানে আমি কোথায় কি ধরনের জিনিসগুলোকে ফেইস করছি। পিকুলিয়ার কিছু পলিটিকাল ফেনোমেনন ফেইস করেছি, আমরা যখন গ্রামে ছিলাম ছোটবেলায়, আমার মনে আছে। সেটা হচ্ছে, গ্রামে আমাদের ছোট ছোট ছেলেপেলেরা, সালমান রুশদির ফাঁসি চেয়ে মিছিল করতো। এবং এরশাদকে নিয়ে কথা বলতো, এরশাদকে নিয়ে স্লোগান দিতো। তো, আমরাও সেসময় এসব স্লোগান-টোগান দিয়ে, একসাথে মিছিল করতাম গ্রামে। এটা হচ্ছে যে, আমাদের বাড়ির গলির ভেতরে করতাম। যখনই মেইন রোডে যেতাম, বড়রা আমাদের তাড়িয়ে দিত। আমরা ভয়ে ভয়ে আবার চলে আসতাম। মানে, এ ধরনের একটা এনভাইরনমেন্টের ভেতরে ছিলাম আমরা। তারপরে হচ্ছে, আরেকটা এনভায়রনমেন্ট ছিল আমাদের ওখানে, সেটা হচ্ছে, আমার বড় ভাইয়া তখন শহরে থাকতো। উনি দেখতাম, ইরানের যেটা কালচারাল সেন্টার আছে, ইরান দূতাবাসের তখন কিছু নিউজলেটার টাইপ ছিল মনে হয় সেই সময়—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ 

রিফাত হাসান: সেগুলা উনি আনতেন। এই নিউজলেটারগুলা আমরা পড়তাম তখন। উনি একটু এইসবে প্রভাবিত লোক ছিলেন। তারপর আবার দেখতাম সেই সময় আমার হাতে আসল হচ্ছে যে, মুয়াম্মার গাদ্দাফির একটা বই। ‘সবুজ গ্রন্থ’।—  

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ।

রিফাত হাসান: এই সবুজ গ্রন্থটা পড়ে আমি সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই সময়ে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, খুবই ইন্টারেস্টিং।— কিন্তু আপনি যে এই যে তখন মাদরাসায় পড়ছেন, খুবই আর্লি এইজে, এবং আপনার মধ্যে এই বইয়ের দেখা পাওয়ার পরে একটা তো চেইঞ্জ অবশ্যই আসছে। এইটা কি আপনার সহপাঠি বা পরিপার্শ্বের লোকজন ধরতে পারছিল? বা তাদের সাথে কোনভাবে সংঘাত, সংঘর্ষ অনুভব করছিলেন?—

রিফাত হাসান: আমার সহপাঠীদের সাথে আমার যেটা সম্পর্ক, এটা আসলে একটু অদ্ভুত ধরনের। কারণ, আমি আসলে, সবসময় একটু ঘরকুনো ধরনের ছিলাম। একধরনের একলা একটা লাইফ লিড করতাম সে সময়ে। মানে হইতেছে কি, আমি যখন, আমার ছোটবেলাটা কীরকম কাটছে, আমি আরেকটা কথা যদি বলি, একটা অনুমান করা যাবে। সেটা হচ্ছে যে, যেমন আমার দাদী ছিলেন। দাদী মারা গেছেন আমার অনেক ছোট বয়সে। তো, দাদী হল কি, উনি আমাদের গ্রামের ভেতরে সবচেয়ে বুজুর্গ মানুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন আর কি!— খুবই সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বুজুর্গ মানুষ, এমন পরহেজগার ছিলেন যে, উনার কেউ কখনো দেখা পাইতেন না। এমনকি বাইরের মহিলারাও উনাকে দেখতে পাইতেন না। তাদের সামনেও আসতেন না আর কি! কারণ তাদেরে পরপুরুষ দেখেছে। তো আমরা যেটা করতাম—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: তো আমরা যেটা করতাম, সেটা হচ্ছে, আমরা যখন ছোট ছিলাম, সেসময় উনার সামনে বসে বসে বিষাদ সিন্ধু পড়ে পড়ে শুনাইতাম।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।

রিফাত হাসান: আমার দাদীর লাইব্রেরিতে বিষাদসিন্ধু ছিল ।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: এবং, আরেকটা ঘটনা হচ্ছে, সে সময়ে আমাদের গ্রামে আরেক বিখ্যাত লোক ছিলেন। নাম আপনারা শুনে থাকবেন। উনার নাম হচ্ছে আসকর আলী পণ্ডিত।—  

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ,  উনার নাম শুনেছি।

রিফাত হাসান: আসকর আলী পণ্ডিতের বিখ্যাত কিছু গান আছে। এই গানগুলো, অনেকেই, বেশ পপুলার কিছু গায়ক আছেন, তারা গাইছেন বিভিন্ন সময়। তো, আসগর আলী পণ্ডিত আমার দাদীদের খুব ইয়ে ছিলেন আর কি! দাদীরা সব সময় আসগর আলী পণ্ডিতের শ্লোক দিয়ে কথাবার্তা বলতেন। মানে, কোন একটা কথা বললে, বলতেন, পণ্ডিত তো এই কথা বলে গেছে। এটা আমার আর বলার কি আছে? এরকম বলতেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং।—  

রিফাত হাসান: তো, এই এনভায়রনমেন্টগুলার ভেতর দিয়ে আমরা আসছিলাম। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত লাইফটা ছিল যে সবার থেকে একটু একলা, আলাদা আর কি, সেই সময় থেকে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আলাদা, হাঁ, এটা কমনলি বোধ হয় যারা এরকম লেখালেখি করেন, চিন্তা করেন, কবিতা লেখেন, এরকম কমনলি বোধ হয় একটা বৈশিষ্ট্য থাকে যে, তারা ছোটবেলা থেকেই একলা হয়ে পড়ে আর কি! নিজে চিন্তাটার কারণে বোধহয় তারা হল একধরনের ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। বা, যে কোন কারণে হোক, আমি জানি না, তারা একটু একলা হয়ে যায়। তো, আপনার এইটা একটা বড় টার্ন ছিল মনে হয়, ঐ লাইব্রেরিটার সামনে যাওয়া, তারপরে হল মুঈনুদ্দীন খানের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং আর কোন টার্ন, আপনি বলছিলেন? বলতে শুরু করেছিলেন।—

রিফাত হাসান: আরো কিছু ঘটনা সেইসময় প্রভাবক ছিল, এটা হচ্ছে যে, আমরা যখন, তখন হচ্ছে যে, আমরা শহরে চলে আসার পরে। এই লাইব্রেরির ঘটনাটা তো শহরে চলে আসার পরেই হইছিল । কিন্তু এর পরে, আমার সাথে আরেকজন অদ্ভুত লোকের দেখা হইছিল। আমার বড় মামার কথা তো বলি নাই। মামা হচ্ছেন যে উনি ন্যাপের রাজনীতি করতেন। এখনো বেঁচে আছেন আমার মামা।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: এবং ভাসানীর খুব, একদম—

মাহবুব মোর্শেদ: ভক্ত?

রিফাত হাসান: হুম, ভক্ত আর কি!— উনি ভাসানী রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে একটা সংগঠন করেন, চিটাগাং এ। তো, উনার এক বন্ধু ছিলেন। উনার বন্ধুটা ছিলেন হচ্ছে যে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, কোন এক সময়। সশস্ত্র রাজনীতি করতেন। তো, আমার মামা ছিলেন যে, সংসার টংসার কখনো করেন নাই। আমার নানী উনাকে খোঁজার জন্যে মাঝে মধ্যে চিটাগাং শহরে আসতেন। কারণ, মানে, ছেলে কখনো দেখতে যায় না মাকে। তো, সেরকম একটা সময়ে, আমার নানীর সাথে, মামার খোঁজে আমি আসলাম শহরে, উনার আস্তানায়। তো ওখানেই মামার ঐ বন্ধুটার সাথে পরিচয় হলো, যার কথা বলতেছিলাম। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। 

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো, উনি আমার জীবনে একটা বড় প্রভাব রাখছেন সেই সময়টাতে। উনি হচ্ছেন, একটা অদ্ভুত লাইফ লিড করতেন। উনার, আখড়াটা ছিল হচ্ছে যে, চিটাগাঙে একটা আমানত শাহ মাজার ছিল, আছে এখনো। আমানত শাহ মাজারের পাশে খুব ছোটখাট গরিব হালতের কতোগুলা বোর্ডিং ছিল। ঐ বোর্ডিং এ উনি থাকতেন। মানে উনার হচ্ছে যে, উনি তো গোপন রাজনীতি করতেন, থাকার জায়গা নিয়ে তেমন কনসার্ন ছিল না। তো, আমি দেখলাম, আমরা যখন গেলাম, উনি আমাদেরকে খুব সম্মানের সাথে মেহমানদারি করলেন, যেহেতু উনার বন্ধুর মা আসছেন। কিন্তু উনার লাইফটা হচ্ছে পিকিউলিয়ার। উনার ওখানে গিয়েই, সবার আগে আমার চোখে পড়ল হচ্ছে যে, উনার পালংকের তলায় হচ্ছে তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি এগুলা সব। তারপর হচ্ছে যে—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হু।

রিফাত হাসান: মানে তলস্তয় দস্তয়েভস্কি’র বই মানে হচ্ছে ঐ রাদুগা প্রকাশনির বইপত্র আর কি! সেসব।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ।

রিফাত হাসান: তো, এগুলা সব দেখে, সবার আগে আমার লোভ পড়লো। তো, আমি উনারে বললাম যে, আমি এই বইগুলা নেবো। তখন, এইখান থেকে উনার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরী হলো। এই সম্পর্কর থেকে, উনার সাথে, এক ধরনের আমার, প্রচুর তর্কও তৈরী হইত। আবার প্রচুর ইন্টারেকশনও হইতো। প্রচুর কথাবার্তাও বলতাম। উনার থেকে অনেক স্পিরিটও নিয়েছিলাম আমি সেই সময়ে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: সে সময়েই মনে হয় স্যামুয়েল ব্যাকেটের একটা গল্প, আমি মনে হয় কবির চৌধুরীর অনুবাদে পড়ছিলাম, ঐ আমার আপার বাসার লাইব্রেরি থেকে। ‘ওয়েইটিং ফর গডো’, মাঝে মধ্যে আমি এটা বলে উঠি, খেয়াল করলে দেখবেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ।

রিফাত হাসান: ঐ ভদ্রলোক, যার কথা বলতেছি, আমার মামার বন্ধু। উনি দেখলাম, আরেকটা গল্প লেখার চেষ্টা করছেম। ওয়েইটিং ফর গডোর মতো করে। ওয়েটিং ফর গড। এইটা হচ্ছে পলিটিক্যা— উনার গল্পটা। পরে আদৌ লিখলেন কিনা জানি না। এগুলা সব মিলে উনার সাথে আমার মিলতেছিল, সবকিছুর সাথে।— ওখান থেকেই মনে হয় আমি তলস্তয়ের একটা বিখ্যাত বই পড়ছিলাম। এটা হচ্ছে যে ‘ফাদার সিয়ের্গি ও অন্যান্য গল্প’।

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ হাঁ।

রিফাত হাসান: ফাদার সিয়ার্গি গল্পটা ছিল, এটা হচ্ছে যে, আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো একটা গল্প, ফাদার সিয়ার্গিটা। মানে—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: মানে, আমাদের ভেতর তারো আগ থেকে তো একটা ধর্ম ভাবনা ছিল, বিশেষত ইসলাম ভাবনা ছিল, যেহেতু মাদ্রাসায় পড়েছি, মুসলমান। হুম? এই ইসলাম ভাবনাটার তো একধরনের একটা চরিত্র আছে। যেমন, সম্প্রদায় ভাবনা, গোষ্ঠীগত স্বার্থের চরিত্র, পরিচয়গত চরিত্রের ব্যাপার আছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু।

রিফাত হাসান: এগুলা আছে, তারপর, এগুলার বাইরে গিয়ে যখন আমি সাহিত্য, আমি যেহেতু সাহিত্য পড়তেছি, ফাদার সিয়ার্গিটা পড়ে আমি হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, কিরে, আমার যেইটা ধর্মভাবনা, সেটাকে নাড়া দিচ্ছে এইটা, পুরাপুরি।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু।

রিফাত হাসান: মানে ওখানে যেটা দেখাচ্ছেন তলস্তয়, যদ্দুর পুরনো স্মৃতি থেকে মনে পড়ে, সেটা হচ্ছে কি, এক রাজকীয় সেনা অফিসার সব‍র্স্ব ছেড়ে একদিন দরবেশ হওয়ার তরে রওয়ানা দিল, উপাসনালয়ে উপাসনালয়ে ঘুরল প্রচুর, যাযক হিশেবে। তার জীবনের যেটা ভ্রমণ, ভ্রমণটা, সে এক ধরনের, মানে সে ঈশ্বরের জন্যে ভ্রমণ করছে, সে ঈশ্বরকে খুঁজতেছে। একটা পর্যায়ে, একুশ বছর পরে, সে দেখলো যে, অনেক আয়োজন করার পরও তার ভেতরে কোন ঈশ্বরের অনুভব তৈরী হয় নাই, সে ঈশ্বরকে পায় নাই। এবং এক পর্যায়ে সে বুঝতে পারলো যে, আসলে তার পুরো জীবনটা আসলে একটা ভান সর্বস্ব লাইফ লীড করছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু বিভ্রমের মধ্যে।—

রিফাত হাসান: তো, পরে এক পর্যায়ে এসে সে যখন বুঝতে পারলো, তখন সে যাযকগিরি ছাড়ল। আবার পথে বেরিয়ে পড়ল। এবং পথে পথে হাঁটতে থাকল। ভাবলো যে, এখন থেকে আমি আর ঈশ্বরকে খোঁজার ভান করবো না, মানুষকে খুঁজবো। যাযকের জীবন থেকে, সাধারণ হওয়ার চেষ্টা করল, এক কৃষি খামারে কাজ করতে থাকল, সাধারণ হয়ে। সে দেখাচ্ছে যে, হচ্ছে, ঈশ্বরটাকে তো সে হাতে ধরতে পারে না। হাতে ধরতে পারেনা যখন, ঈশ্বরকে তার নানারকম ভাণ দিয়ে, বিভ্রম দিয়ে বুঝতে হচ্ছে। ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষকে হাতের কাছেই পাওয়া যায়, তাইলে মানুষকেই খুঁজি না কেন। তো, মানুষকে খুঁজতে গিয়ে সে দেখলো যে, এবার সে ঈশ্বরকে পাইলো আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং। আপনি প্রথম লেখা শুরু করলেন কোন সময়ে?—

রিফাত হাসান: এইটা, মাহবুব ভাই, আমার ঠিক, মানে এটা আমি স্পেসিফিকেলি বলতে পারতেছি না। তবে এইটা মনে আছে অনেক ছোট বয়সের সময়টাতেও আমি লিখতাম। টুকটাক লিখতাম। ঐ লেখাগুলা কখনো কোথাও প্রকাশ হয় নাই আর কি। লেখা প্রকাশ হওয়ার ব্যাপারটা মনে হয় ইন্টারে বা এসএসসি, মানে মাদ্রাসায় এইটারে বলে দাখিল, আমার দাখিলের পরে শুরু হয়েছে এরকম। হতে পারে আর কি কোথাও।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। তাহলে, মানে একটা জিনিস বোধ হয় বলা যায় যে, আপনি ফরমালি লেখালেখিটা ব্লগের মধ্য দিয়ে শুরু করলেন, নাকি,  তারও আগে?—

রিফাত হাসান: না, না না। তারও বহু, অনেক আগে শুরু করছি।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম। কীভাবে সেটা?

রিফাত হাসান: ব্লগে আমি যথেষ্ট, হাঁ, ব্লগে আমি যখন লেখালেখি করতেছিলাম তখন হচ্ছে আমি, অন্তত এখনো যেটুকু আমি বুঝি, সেটা হচ্ছে আমার যথেষ্ট প্রিপারেশন ছিল। প্রস্তুতি ছিল মানসিকভাবে। 

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।—  

রিফাত হাসান: তখন অলরেডি আমি বুঝে গেছি যে, আমি মোটামুটি যা বলতে চাই, কী বলতে চাই, সেটা।—

মাহবুব মোর্শেদ: এর আগে, ব্লগের আগে মূলত আপনি কোথায় লিখতেন? কী লিখতেন?—

রিফাত হাসান: ব্লগের আগে আমি আসলে, আমাদের সবারই, আমাদের অনেক বন্ধু আছেন, সবারই আসলে লেখালেখি হচ্ছে যে, কবিতা দিয়ে শুরু হইছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।

রিফাত হাসান: আমারও কবিতা দিয়েই শুরু হইছে। তারপর হচ্ছে যে, তারপর গল্প লেখার চেষ্টা করছিলাম বিভিন্ন সময়ে। তবে আমাদের একটা বেসিক আন্ডারস্ট্যাণ্ডিং ছিল। যেটা নিয়ে আমি মনে করি যে, এখন পর্যন্ত, আমি অনেকগুলো ঘটনা থেকে নিজেকে, অনেকগুলো জিনিশের প্রভাব থেকে নিজেরে মুক্ত রাখতে পারি।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।

রিফাত হাসান: সেটা হচ্ছে যে, আমরা যখন কবিতা লিখতেছিলাম, সে সময়ে আমার একটা সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল, যে আমি ঠিক কবি পরিচয় নির্মাণ করব না। কারণ আমি দেখতেছি কি, যারা কবিতা লিখে, লিখতেছে, ধরেন, এক ধরনের একটা পরিচয় নির্মাণ করছে। এই ব্যাপারগুলো আমার খুব বোরিং লাগতেছিল। এবং এটার একটা চরিত্র আছে। চরিত্রটা হচ্ছে কী রকম? মানে, কবি হয়ে ওঠা, তারপর নিজেকে কবি বলা, এগুলার ভেতরে একটা কেমন মিনমিনে ব্যাপারও ছিল। তখন হয়ত এটার ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। মানে, এই মিনমিনে ব্যাপারটা কী। এখন অনেক স্পষ্টভাবে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে পারি, মিনমিনে ব্যাপারটা কী। রাবীন্দ্রিক ব্যাপার আছে, এপলিটিক্যাল থাকার ব্যাপার আছে, সমাজ থেকে দূরে থাকার ব্যাপার আছে। কিন্তু তখন এটুকু বুঝতাম যে, এ জিনিসগুলো আমার হওয়া চলবে না। হুম? কিন্তু কবিতা লিখতাম। আমরা চিন্তা করতাম যে, আমরা কবিতা লিখবো, যে কোন রকম কবি পরিচয় নির্মাণ করা ছাড়াই।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হু,  কবিতার আনন্দে কবিতা লিখা।—

রিফাত হাসান: কবিতার আনন্দে কিনা বলতে পারবো না। এটা তেমন নিষ্পাপ কিছু ছিল বলেও মনে হয়না। মোর পলিটিক্যাল সিদ্ধান্তও ছিল। মানে এমন না যে, আমি মনের আনন্দে কবিতা লিখতেছি, স্রেফ এরকম কিছু না আর কি!

মাহবুব মোর্শেদ: কিন্তু কবি পরিচয়ের প্রতি কি একটা অনিহা ছিল কি? অবচেতনে?

রিফাত হাসান: ছিল। অবচেতনে না, একদম সচেতনে ছিল। সচেতনে একটা অনিহা ছিল । অনিহা ছিল এই কারণে যে, সে সময়ে যারা আমাদের সামনে কবি পরিচয়ে হাজির ছিল তাদের প্রতি অনীহা ছিল। এবং তাদের ভাবভঙ্গি থেকে শুরু করে, তাদের যেটা, কী বলবো, কনশাসনেস, পলিটিক্যাল ইয়ে, বোঝাপড়া, এগুলা কোনটাই আমি ঔন করতে পারতাম না। আমি দেখতাম যে কি, আমি যেটুকু বুঝি, অন্ততপক্ষে বোঝার চেষ্টা করি, সেটুকু আমাদের যারা কবিতা নিয়ে কথা বলেন, কবিতা লিখেন, তারা এটুকু বোঝার ক্ষমতা রাখেন না বলে মনে হইছে সে সময়ে।—

মাহবুব মোর্শেদ: ওরকম কবি বললে কার ছবিটা আপনার সবার আগে ভাসে?

রিফাত হাসান: যেমন, শামসুর রাহমান। অবশ্য, শামসুর রাহমান, কবি হিসেবেও আমাকে কখনো আগ্রহী বা প্রভাবিত করতে পারেন নাই।

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।

রিফাত হাসান: আমি যখন মাদরাসায় পড়তাম, সেসময়ে আরেকটা ঘটনা ছিল। পাবলিক লাইব্রেরি ছিল, এটা হচ্ছে, যেটা মুসলিম হল, মুসলিম হলের পাশের বিল্ডিং। তো আমি, যেটা হইতো, বেশির ভাগ সময়ে মাদ্রাসা থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে আসতাম। আমার মাদ্রাসা হচ্ছে যে, পাবলিক লাইব্রেরির থেকে আরেকটু দূরে। পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে আসলে আমার কাজ ছিল, শুধু কবিতা পড়া। তখন মোটামুটি বাংলা ভাষার আধুনিক কবিতার কাউকে তেমন বাদ রাখি নাই আর কি, সেই সময়। পড়তাম। প্রচুর পড়তাম কবিতা। একদম বিষ্ণু দে থেকে শুরু করে এমনকি আবুল হোসেনের মতো কবিকেও পড়ে দেখছি সেই সময়।

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। এরপরে আমরা যখন আপনার দেখা পেলাম ব্লগে, তখন হলো, মনে হয়েছিল আমাদের প্রাথমিকভাবে যে, রিফাত হাসান, ঐ যে গত জন্মদিনে আমি যেটা বলছিলাম, অনেকেই মনে করছিল যে, ফরহাদ মজহার, ফরহাদ ভাই হলো রিফাত হাসান ছদ্মনামে লিখতেছে। কেউ কেউ সরাসরি বলছিলেন যে, এটা, ইনি তো ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহারের সাথে আপনার ইন্টারেকশনটা কীভাবে ঘটলো?

রিফাত হাসান: ফরহাদ ভাইয়ের সাথে আমাদের ইন্টারেকশনটা আসলে শুরু হয়েছিল, চিটাগং এ চর্চাপিট- যেইটার কথা বললাম। এখানে বললাম কি?— উনারে আমরা ইনভাইট করছিলাম। ওখান থেকেই ফরহাদ ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিচয় এবং যে কারো সাথে পরিচয় হওয়া মানে তো একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়া। ফরহাদ ভাইয়ের সাথেও একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল সেই সময়ে। খুবই মিনিমাল ছিল এইটা। সেসময়ে। পরবর্তিতে আর একটু গভীর হইছে। আর ফরহাদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় মানে তো, আমি মনে করি যে, এইটা একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। এখন কতটুকু ব্যাপারটা বৈপ্লবিক থাকবে জানি না, মানে এখনকার তরুণদের জন্য। কিন্তু সেই সময়ে আমরা যখন ছিলাম, আমাদের জন্যে এটা একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল । মানে ফরহাদ ভাইয়ের চিন্তা থেকে শুরু করে সবকিছু। খুবই প্রভাবশালী ছিল সে।—

মাহবুব মোর্শেদ: উনার কোন ব্যাপারটা আপনাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করছিল ।—  

রিফাত হাসান: ফরহাদ ভাইয়ের, আমার মনে হয়, প্রথম ফরহাদ ভাই মনে হয় আমারে ইয়ে করছিল ফরহাদ ভাইয়ের মোকাবেলা বইটা। বই আকারে না। তখন তো পত্রিকায় পড়তাম ফরহাদ ভাইকে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ, যুগান্তরে প্রকাশিত হইতো ধারাবাহিকভাবে।—

রিফাত হাসান: যুগান্তরের আগে আজকের কাগজে লিখতেন মনে হয় সে সময়ে। 

মাহবুব মোর্শেদ: আজকের কাগজেরটা অন্য। কৃষি বা এসব বিষয়ে ছিল একটা মনে হয়। 

রিফাত হাসান: হু আমি ঠিক স্পষ্ট মনে করতে পারতেছি না। তবে উনার লেখা কয়েকটা পত্রিকায় পড়তাম। প্রথম আলোতেও পড়ছিলাম কিছুদিন।

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।

রিফাত হাসান: প্রথম আলো তো অনেক পরের ঘটনা। প্রথম আলো তো একদম শেষ দিকে আসছে। এবং ইয়ে হয়ে গেছে প্রথম আলোর ব্যাপারটা। মানে ফরহাদ ভাইয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে কিরকম, ফরহাদ ভাই তো সেই সময়ে হচ্ছে যে, আমরা যেসব জিনিসগুলা খুব ক্রিয়েটিভলি ভাবতে চাইতেছিলাম, আমার একটা ব্যাপার ছিল, সেটা হচ্ছে যে, আমার আসলে, ধরেন খুব, মানে একটা, আমাকে পিউর কোন একাডেমিক লেখা খুব একটা এন্টারটেইন করতে পারে নাই কখনো। কিন্তু পিউর কোন কাব্যও আমাকে এন্টারটেইন করতে পারে নাই। ফরহাদ ভাই ছিল একটা মাঝামাঝি ব্যাপার। ঠিক না একাডেমি না কাব্য। আমার প্রত্যক্ষ প্রশ্নকে উনি ডিল করতেছিলেন সেই সময়ে। এখন, সেসময়ে আমারও অনেক জটিল মন ছিল, যে কারণে ফরহাদ ভাই আমার খুব পছন্দের ছিল সে সময়ে। আমার এমনো মনে আছে, সামওয়ান, আমার কোন একজন বন্ধুর সাথে, মেয়ে, তাকে আমি বলতেছিলাম ফরহাদ ভাই এরকম এরকম।— তো, এরকম ফরহাদ ভাইয়ের কোথাও কোন একটা প্রোগ্রাম হইতেছে, দেখতে বললাম তারে, দেখে শুনে সে বলল, এরকম আনকালচারড লোকরে তোমার পছন্দ? সে বলতেছিল ।—  

মাহবুব মোর্শেদ: কেন?

রিফাত হাসান: মানে, আটকালচারড লোক বলতে আমরা যেটাকে, রাগী একটা জিনিস আছে না? বুদ্ধিজীবিতার একটা রাগী ভঙ্গি, ফরহাদ ভাই এবং আহমদ ছফারা এটার বাংলাদেশে ইন্ট্রুডিউসার আর কি! এবং হুমায়ুন আজাদও! এই ভঙ্গি বা এদেরে তো সাধারণ মানুষ পছন্দ করবে না। 

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।

রিফাত হাসান: এটাকে আটকালচারড বলবে, তারপর ইয়ে বলবে। এই ঘটনার কারণে সে অপছন্দ করছে। মানে হচ্ছে যে, আমাদের সাথে যারা চলতো, তারা সবাই ফরহাদকে পছন্দ করত যে এমন না।…. 

মাহবুব মোর্শেদ: হু হু, বুঝতে পারছি। তারা তাকে এক ধরনের সমালোচনামূলক ভাবে দেখল আর কি৷ 

রিফাত হাসান: মডারেট যে কোন মানুষ পছন্দ না করার মতই ফরহাদ ভাই কথাবার্তা বলতেন। বা, ফরহাদ ভাইয়ের কথাবার্তা সেসময়ে শোনার জন্য প্রস্তুতিরও দরকার ছিল। আমি এমন অনেককে দেখতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, নানান গুরু বিষয়ে গম্ভীর অপনিয়িন দেন ও পপুলার, কিন্তু ফরহাদ ভাইয়ের কথাবার্তা শোনার বা বোঝার মতো তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই, সেই সময়ে। একটা রিয়েকশন রেখে, মানে কোন একটা জিনিস বোঝার জন্য প্রস্তুতি না থাকলে, ফরহাদ ভাইয়ের বোঝাপড়াগুলো  কেমন সেটা পরের ব্যাপার। সেটা নিয়ে এখন আমরা নানান আলাপ তুলতে পারি। সেই সময়ে আমরা যে পলিটিক্যাল প্রশ্নগুলো ডিল করছিলাম। এগুলোতে সেই সময়ে ফরহাদ ভাইয়ের রেস্পন্সগুলো আমাদেরকে খুবই প্রভাবিত করছিল ।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ সেটা আমাদেরকেও, আমাকেও পার্সোনালি খুব প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে ধরেন মোকাবেলা, ভাবান্দোলন এই দুইটা বইয়ের কথা তো কোন ভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব না। ফরহাদ ভাইয়ের সাথে কি পার্সোনালি ইন্টারেকশন হতো আপনার? পরে?

রিফাত হাসান: না। পার্সোনাল ইন্টারেকশন ফরহাদ ভাইয়ের সাথে সেই রকম হইতো না। কখনোই হইতো না। মানে, আমি হচ্ছি কি, আমার একটা স্বভাব হচ্ছে যে, আমি মানুষের সাথে পার্সোনালি তর্ক করতাম না, বিশেষ করে গুরুজনদের সাথে, বড়দের সাথে। তো, ফরহাদ ভাইয়ের সাথেও সেই জন্য, সে রকম তেমন বড় কোন আলাপ সালাপ হয় নাই কখনো। দেখা হইলে কথাবার্তা হইতো এরকম আর কি! ফরহাদ ভাই তো আসলে অনবরত কথাবার্তা বলতে পারেন। তো ফরহাদ ভাইই আসলে বেশীর ভাগ কথা বলতেন দেখা হলে। আমার একটা লজিক আছে, সব সময় ফলো করি। যারা অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, যাদের বয়স হয়ে গেছে। যারা একটা সময়ে এসে গেছে, তাদের কাছে, মানে তাদেরকে আমার দেয়ার কিছু নাই আর কি! ফরহাদ ভাইকে আমার দেওয়ার কিছু নাই শেষ পর্যন্ত। ফরহাদ ভাই থেকে নেওয়ার কিছু থাকলে থাকতে পারে অথবা ফরহাদ ভাইকে আমার চেইঞ্জ করারও কিছু নেই। কিন্তু আমার কাছ থেকে আসলে, আমার যেটুকু সম্ভব, আমার কাছ থেকে সে বিনয়টা উনি পাবেন, এটা উনার প্রাপ্য আমি মনে করি।—

মাহবুব মোর্শেদ: আর কোন লেখক, বুদ্ধিজীবী আপনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন বলে মনে হয়?—

রিফাত হাসান: আমার আসলে, সেই সময়, একটা সময়ে যখন কবিতা লিখতাম, সেসময়ে অনেকেই প্রভাবিত করছিলেন। তারপরে হচ্ছে যে, ও আচ্ছা, আহমদ ছফা তো আমাকে সেসময় অনেক প্রভাবিত করছিল বলে মনে হয়। আহমদ ছফার একটা ইন্টারভিউও নিছিলাম আমরা।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ আপনি লিখছিলেন একবার।—

রিফাত হাসান: হু। সে সময়ে আমি অপেক্ষাকৃত, অনেক কাঁচা ছিলাম। অনেক প্রশ্নও করছি তারপরও। কিন্তু তারপরও, পরে, ইন্টারভিউটা আমরা ফেলে দিছিলাম। মানে, তেমন কোন কাজের ইন্টারভিউ হয় নাই মনে করে ফেলে দিছিলাম। তো এটার আসলে একটা ভালো বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ছিল আর কি! এখন যদি থাকতো।—

মাহবুব মোর্শেদ: ও, মানে এটা সংরক্ষণ করেননি কোথাও? কোন পত্রিকায়ও ছাপা হয়নি?

রিফাত হাসান: না না। এটা হইছিল কি, আমরা একটা পত্রিকা করতেছিলাম। তো, এই পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে এটা নিছিলাম আর কি! পত্রিকাও আর প্রকাশ হয় নাই আর উনার সাক্ষাৎকারও সংরক্ষণ করি নাই। মানে নষ্ট হয়ে গেছে আর কি! চলে গেছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। ও, আপনার বইগুলো সার্চ দিতে গিয়ে দেখলাম, রকমারিতে দেখলাম, আপনি দুটি বই অনুবাদ করেছেন।—

রিফাত হাসান: না। না না না। এরকম কোন ঘটনা না। এটা মনে হয় ওরা রিফাত হাসান নামে আর কেউ আছে কিনা আমার জানা নাই। তবে ওরা ভুলে করছে এরকম হবে আর কি! আমার কোন অনুবাদ নেই।—

মাহবুব মোর্শেদ: ও, ভুলে করছে তাহলে। দুইটা বই, আপনার নামের ওখানে গিয়ে দেখবেন যে, দুইটা বই, আপনার অনুবাদ বই হিশেবে, আপনার নামের ওখানে এন্ট্রি করা আছে। বই প্রসঙ্গে আসি। আপনার বইয়ের যে কনসেপ্ট, সেটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। যেমন, একটা থিমের ভিত্তিতে আপনি হলো, ইন্টারভিউ, ব্লগ পোস্ট, ফেসবুকের লেখা, তারপরে আলাদা করে লেখা, এগুলো সব সংকলিত করেন। তো, এই বইয়ের আইডিয়াটা আপনার মাথায় কীভাবে এলো? এই যে, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি একটা বই, টেক্সট কন্সপিরেসি ও রূপকথা আর একটা বই, এই বইগুলার আইডিয়া আপনি, মানে এইভাবে যে বইটা করবেন, এই আইডিয়াটা কীভাবে এলো আপনার মাথায়?—

রিফাত হাসান: এই আইডিয়াটা মাথায় আসছে হচ্ছে। আমি প্রথমত বই করার পরিকল্পনা কখনো ছিল না সেই সময়ে। কিন্তু আমি খুব সিরিয়াসলি লেখালেখি করতেছিলাম। যে সময়ে আপনাদের সাথে পরিচয়, অন্তত ব্লগে আপনাদের সাথে যখন পরিচয়। সেই সময়ে সিরিয়াসলি লেখালেখি করছিলাম। তখন মনে হইলো যে, আমরা যে লেখালেখি করছি, এগুলার একটা গুরুত্ব দাঁড়াইছে এবং এইটারে আরো বেশী গুরুত্ব দিয়ে, মানে গুরুত্ব তৈরী করা দরকার আর কি! মানে এইটার প্রভাবটারে আরো বিস্তৃত করা দরকার। কারণ হচ্ছে যে, মানে, আমি যে সময়ে এই লেখালেখিগুলা করতেছিলাম, সেই সময়টা তো, আপনারা জানেন, এমন একটা সময়, এই সময়ে পুরো একমত একটা ব্যাপার চলতেছিল সারা বাংলাদেশে। এবং যে কোন রকম দ্বিমত পোষণ করছে, তাদেরকে নানান ভাবে হ্যারাস করা হচ্ছে। আমার এইটা তো মনে আছে, সেই সময়ে আপনাদের সাথে যখন পরিচয়, সে সময়ে, মানে আপনাকেও তো যে পরিমাণ হেনস্থা হইতে হইছে সিপি গ্যাং এর হাতে। এগুলা আমি খেয়াল করছি। তো, আমার মনে হইছে যে, এই একসাথে আমাদের লেখালেখি ব্যাপারটা এমন, যে, লেখালেখি করা মানে হচ্ছে যে আসলে লেখালেখির ক্ষমতাসহ তৈরী করতে হবে, একইসাথে। মানে আমি খুব কোন নিরীহ লেখালেখির পক্ষে না আর কি! আমি যে লেখালেখিটা করতে চাই, এইটা খুবই, খুবই ইফেক্টিভলি করতে চাই, আপনার যতোরকম টুল্সগুলো আছে এগুলোকে ব্যবহার করতে চাই। সমাজে সেসময়ে প্রভাবশালী যতোরকম টুল্স আছে, এই টুলগুলো ব্যবহার করতে আমার কোনরকম রক্ষণশীলতা নাই আর কি!—  

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, এই বই করার পরে আপনার কী মনে হলো? যেমন ব্লগে আমরা যে লেখালেখি করি, আপনি যে লেখালেখি করেছেন, বা ফেইসবুকে যে লেখালেখি করেছেন তো সেগুলোর ইম্পেক্ট তো একরকম। সেগুলো ধরেন, তাৎক্ষণিক একটা ইম্পেক্ট তৈরী করে। এবং সেটার যে রিডারশিপ অনেক বেশী হয়, কিন্ত বই এ হল সেটা দূরবর্তী একটা ইমপেক্ট তৈরী করে এবং রিডারশিপ বোধহয় তুলনামূলকভাবে কম। এই পার্থক্যটা কেমন? মানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ব্লগে মত প্রকাশ করা, লেখা, নিজের মতামত জানানো এবং বইয়ে জানানো, এই দুইটার মধ্যে পার্থক্যটা কেমন?—

রিফাত হাসান: এই দুইটার মাঝে পার্থক্যটা আসলে আলাদাভাবে বেশী বুঝতে পারি নাই। কারণ হচ্ছে যে, আমরা এমন একটা সময়ে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছি যে সময়ে একটা বইয়ের প্রভাব আর সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখির প্রভাব মোটামুটি কাছাকাছি, ওভারলেপিং করে। বইয়ের ব্যাপারটা আলাদা গুরুত্ব এই জায়গাতেই শুধু, সোস্যাল মিডিয়ায় একটা লেখারে আপনি নিজের মতো করে সংরক্ষণ করতে পারবেন না। এটা হচ্ছে ফেইসবুকের অধীন, তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের অধীন। সেজন্য যেকোন মুহূর্তে চাইলে ওখানে ঢুকতে পারবেন না। সবার এক্সেস থাকবে না। আপনি এমন পাঠকের কাছে পৌঁছাইতে চান, যারা ফেসবুকে থাকবে না, ফেইসবুক ব্যবহার করবে না, তাদের জন্য বইটা গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের একটা ঐতিহাসিক ব্যবহারিক গুরুত্ব এরকম অনেকগুলো জায়গায় তৈরী হয়ে আছে। সেজন্য বইটা হয়ে গেলে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে যে ধরেন, আপনার লেখালেখিগুলার একটা শরীর তৈরী হয়, যেইটা হাতে ধরতে পারবেন। এই জিনিসটা আসলে, মানে সোস্যাল মিডিয়ার বাইরেও এই জিনিসটার ইম্পেক্ট আপনি বুঝতে পারবেন৷ 

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। আপনি ঐ যে, সম্পর্ক বন্ধুত্ব ও রাজনীতি এই বইটায় একভাবে বলেছিলেন যে, রাজনীতি হল এক ধরনের সম্পর্ক। তো, এটা আপনার কাছে কী মনে হয় যে, শেষ পর্যন্ত যে সম্পর্ক নির্মাণের প্রক্রিয়া, আমাদের রাজনীতির যে বিকাশ, ব্লগের সময়টা থেকে যদি ধরি, বিশ বছরে তো একটা আকার পেলো, আপনার কী মনে হয় যে, সম্পর্ক তৈরীর ক্ষেত্রে কি আমরা কিছুটা আগাতে পারলাম? নাকি পিছিয়ে গেলাম?

রিফাত হাসান: এটা একটু স্পেসিফিকলি বলা শক্ত।

মাহবুব মোর্শেদ: হু।

রিফাত হাসান: আমি যে সম্পর্কের কথা বলছি, সে সম্পর্কটাকে আমি অনেক ভাবে একটু বোঝার চেষ্টা করি আর কি! যেমন, এইটা হচ্ছে যে, ধরেন, ইবনে খলদুন একটা ‘আসাবিয়াত’, মানে সম্পর্কের কথা বলেন, রাজনীতি তৈরী হওয়ার সূত্র হিশেবে। এটার সাথেও আমি কিছুটা রিলেট করি, পুরোপুরি  যদিও না। মূলত, আমি পৃথিবীতে মানুষের যেটা ভ্রমণ, এইটারে একটু বোঝার চেষ্টা করি সম্পর্ক দিয়ে। সম্পর্ক, বন্ধুত্ব এবং রাজনীতি দিয়ে। তাই আমি রাজনীতিরে সম্পর্কের জ্ঞান বলি। এটা হচ্ছে, ধরেন, আমাদের এখানে বয়ানগুলো কীভাবে তৈরী হয় মানুষ সম্পর্কিত? হয় ধর্ম দিয়ে তৈরী হয়, অথবা পলিটিক্স দিয়ে তৈরী হয়। তো, আমি মানুষ সম্পর্কিত বয়ানটাকে ধর্ম এবং পলেটিক্সের, মানে উভয়ের এসেন্সের ভেতর থেকেই আসলে, বাইরে গিয়ে না, বোঝার চেষ্টা করেছি এবং এখানে কোরআন শরীফেরও শরণ নিয়েছি কখনো কখনো। মানে, কোরান শরীফ মানুষের অস্তিত্ব ও অপরকে কীভাবে দেখেছে, তার। মানুষের যেটা ভ্রমণ, ঐ যে আপনি কনফারেন্স অফ বার্ডের কথা বলেন না মাঝে মধ্যে? ঐ—

মাহবুব মোর্শেদ: মানতেকুত তায়ের।

রিফাত হাসান: হা মানতেকুত তায়ের, ঐ মানতেকুত তায়ের হইতেছে আসলে কোরআন শরীফে মানুষের নফসের ভ্রমণের বিভিন্ন পর্যায় আছে না, ঐ পর্যায় নিয়ে কথা বলে। মানুষের যে আত্ম, তার বিভিন্ন পর্যায় আছে ভ্রমণের, তার একটা পর্যায় হচ্ছে আসলে সম্পর্ক। তারপরে বন্ধুত্ব এবং এখান থেকে আসলে মানুষের আলটিমেইট ভ্রমণটা শুরু হয় আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, কিন্তু আমি একদম প্রাকটিকালি জিনিসটা বুঝার চেষ্টা করছি, যে, আসলে যেহেতু এই বিষয়টা আপনি পর্যবেক্ষণ করেন, একটা রূপান্তর কি ঘটছে আমাদের সমাজে? যে এখানে বিভিন্ন মতের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরী হতে পারছে, বিভিন্ন কর্ণারের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরী হতে পারছে। এরকম ঘটনা কি আপনি লক্ষ্য করছেন?—

রিফাত হাসান: হাঁ। কিছু জিনিস তো আমি এখানে লোকেইট করি। মানে, ধরেন, ক্ষমতার পর্যায়ে জিনিসটা ডায়নামিকেলি বুঝতে পারা যায় না। ক্ষমতা নিজেই তো আসলে একটা মূর্তি হাজির করে আপনার সামনে। সেটা দিয়ে আপনাকে ডমিনেইট করে, বাকি সবকিছু ঢাইকা রাখে। তো, ক্ষমতার পরিসরের বাইরে, মানুষ-সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলা আমি লোকেইট করি। যেমন, ধরেন, আমাদের রাজনীতির কতোগুলা মৌলিক পরিবর্তন হয়ে গেছে অলরেডি। যেটা আমরা দুইটা জায়গায় দেখি, বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেখি। এটা এর আগে কখনোই হয় নাই। ইভেন, নব্বইয়ের যেটা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সেখানেও যে জিনিসটা সম্ভব হয় নাই, ওখানে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের টাইমে তো প্রত্যেক দল আলাদা আলাদা ফ্রন্টে লড়াই করেছে। মানে, প্রত্যেকেরই একটা রক্ষণশীল অবস্থান ছিল যে, আমরা অমুকের সাথে আন্দোলন করবো না, অমুককে সাথে রাখবো না বা থাকব না ইত্যাদি। রক্ষণশীল অবস্থা থেকেই তারা লড়াই করছে এবং শেষ পর্যন্ত এটার একটা পরিণতি হইছে, নানানভাবে একটা ইয়ে তৈরী হইছে। কিন্তু এখানে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যখন নুরুরা একটা আন্দোলন তৈরী করতে গেলো, ওদেরকে যখন বলা হইল, যে, তোমরা যারা এখানে আন্দোলন করছো, এখানে জামাত শিবির আছে, অমুক আছে, তমুক আছে। তখন সে বলতেছিল যে, আমাদের তো এগুলা বাছার ব্যাপার না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, আসলে আমরা একটা গোল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি, এই গোল এর সাথে যারা একমত থাকবে, তাদের সাথে আন্দোলন করতে আমাদের কোন অসুবিধে নেই।

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।

রিফাত হাসান: এই রকম কথা কিন্তু, এর আগে বাংলাদেশের পলিটিক্সে আর কখনোই কেউ বলতে পারে নাই। একমাত্র নুরুই বলছে। এবং এই জিনিসটা একটা সিগনিফিকেন্ট ঘটনা এই কারণে যে, এইটা একটা, আপনার, ভ্যালু তৈরী করে দিছে আগামীদিনের রাজনীতি বিবেচনায়। ভ্যালুটা এমন, এরপরে যদি কেউ পলিটিক্স করতে আসে, বা আন্দোলন সংগ্রাম করতে আসে, সে যদি আবার পুরনো স্বরে বলে, আমরা অমুক থাকলে আন্দোলন করবো না, তমুকের সাথে আন্দোলন করবো না, তখন তাদেরকে বলা যাবে যে, তোমরা তো আসলে ননপ্রগ্রেসিভ, তোমরা তো আসলে মৌলবাদী অবস্থানে, মানে, রক্ষণশীল থাইকা যাইতেছো, আগের মত।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, হাঁ এটা একটা চেইঞ্জ বোধহয় আনছে।—

রিফাত হাসান: এই ধরনের ছোট ছোট জায়গাগুলোতে আপনি লক্ষ্য করবেন। বড় সড় জায়গাগুগুলাতে আপনি লক্ষ্য করতে পারবেন না, কেন জানেন? বড় সড় কোন জায়গাই আপনি দেখতে পারবেন না, এই সময়টাতে। কারণ বড় সড় ব্যাপারগুলা হয় মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে, পত্রিকা নিয়ন্ত্রণ করছে, পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করছে, মানে, যেখানে একটা ক্ষমতা হাজির আছে, সেখানে আপনি এই জিনিসটা বুঝতে পারবেন না। যেখানে ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার থাকবে, সেখানে আপনি বুঝতে পারবেন যে, এখানে কিছু একটা ঘটছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, হাঁ। এখন আপনার, কবিতা বিষয়ে আপনার চিন্তাগুলো কেমন? যেমন আপনার কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার বোধহয় একটা বই প্রকাশিত হয়েছে, জল্লাদ খানায় বইসা কবিতা পাঠ।—

রিফাত হাসান: জ্বি জ্বি।—

মাহবুব মোর্শেদ: কবিতা বিষয়ে আপনার চিন্তাগুলো কী রকম?—

রিফাত হাসান: কবিতা বিষয়ে চিন্তা— কীভাবে বলি আমি? আমরা আসলে, লেখা তো, লেখালেখি শুরু করছিলাম কবিতা দিয়ে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ।

রিফাত হাসান: এবং তখন, এক ধরনের, মানে, সেই সময়ে যেসব লেখালেখি হইতো, কবিতা লেখা হইত, মনে হইতো যে, আমরা যেটা করতেছিলাম, এগুলো তার বাইরের ঘটনা ও ধারা। মানে, আমরা যে কবিতাগুলা লিখতেছিলাম, সেগুলা হচ্ছে যে, কবিতার যেটা মূলধারা, বাংলাদেশে চলতো, সে জায়গা থেকে দেখলে আমাদের গুলোকে কবিতাই মনে হবে না আপনার। আবার আমাদের জায়গা থেকে দেখলে তাদেরগুলোকে কবিতা মনে হবে না। অনেকটা সে রকম মনে হইতো সে সময়ে আর কি! তো, এইখানে প্রবলেমটা কোন জায়গায়? এটা কিন্তু কোন ভাষার, ভাষা নিয়ে আমাদের খুব বেশী ইয়ে ছিল না আর কি! মানে, কী বলবো? আমাদের কাজটা ঠিক ভাষা নিয়ে ছিল না আর কি! আমাদের কাজটা  ছিল  হচ্ছে যে, মানে কোন জিনিসটারে আমরা ডিল করতে চাইতেছি, এই জিনিশটা, এসেন্স নিয়ে।—

মাহবুব মোর্শেদ: মানে কবিতার মাধ্যমে আপনারা কি চিন্তাটাকে বেশী গুরুত্ব দিতেন? দর্শনটাকে বেশী গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন? নাকি, অনেকে যেটা বলে, বাংলাদেশে যেটা চিন্তা এক ধরনের আছে যে, কলকাতার যে বলয়, সেখান থেকে বের হয়ে আসা? কোন ব্যাপারটা ছিল? আপনাদের প্রয়োরিটির মধ্যে কোন ব্যাপারটা ছিল ?—

রিফাত হাসান: এটাকে আমি, দর্শনও না বলে, কোন কিছু না বলে, বলি যে, আমাদের ভ্রমণটা। মানে, আমি আমাদের ভ্রমণটারে ইগনোর করে কোন কিছু করি নাই শেষ পর্যন্ত। এটাকে শুধু দর্শন বলা যাবে না। তবে এইটা দার্শনিক ভ্রমণও তো।—

মাহবুব মোর্শেদ: এই আমাদেরটা কারা? এই আমাদের বল্লেন যে?

রিফাত হাসান: এইটা, আপাতত, ‘আমি’। কিন্তু আমাদের বলতে আমাদের যেটা বন্ধুপরিমণ্ডল, অনেকেই আজকের এই ক্লাব হাউজের অনুষ্ঠানেও আছে। কমেন্ট করছেন তাদের একজন, মোরশেদুল আলম। এখানে মজার ঘটনা আছে। সেই সময় আমি এবং মোরশেদ, আমরা দুইজন। আমরা দুইজনই খুব সিরিয়াসলি কবিতা লিখতাম। এবং সেই সময় আমাদের মাথায় আসছিল যে, আল মাহমুদের কবিতা ছাপাইতো হচ্ছে শিবনারায়ণ রায়। না? শিব নারায়ণ রায়ের কবিতা ছাপানোর পরে আল মাহমুদ খুব বিখ্যাত হইছিল । তো, শিব নারায়ণ রায়ের কাছে আমরা কবিতা পাঠালাম, সে সময়ে। তো, দেখি কি, শিব নারায়ণ কিছুদিন পরে ছাপিয়েও দিলেন আমাদের কবিতা। আমার আর মোরশেদের। তখন তো খুব খুশি আমরা। আরে আমরা তো কবি হয়ে গেলাম। তো, আমরা বলতে সে ধরনের কিছু বন্ধুবান্ধব। এক সাথে হাঁটতাম। আর কিছু না। মানুষের বাকি ভ্রমণটা তো তার নিজের। মূলত আমি নিজের ভ্রমণের কথাই কইতেছি।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা আচ্ছা। তো আপনারা, আপনি তো চট্টগ্রামে থাকেন। চট্টগ্রামে একটা তো বন্ধু সার্কেল আপনাদের আছে। সেই বন্ধু সার্কেলের মধ্যে এই যে চিন্তাচর্চা, এই ব্যাপারগুলোর ইম্পেক্টটা কী রকম হয়?—

রিফাত হাসান: বন্ধু সার্কেল বলতে, এইটা আসলে বুঝা মুশকিল, তবে আমাদের, মানে, সবসময় একটা বন্ধুমহল ছিল। এখনো একটা বন্ধু সার্কেল আছে। কিছুদিন আগে একটা ছিল । তো, বন্ধু সার্কেল সবগুলাই হচ্ছে যে কি, চিন্তা ভাবনার জায়গা থেকে মোটামুটি কিছু কিছু সম্পর্ক হইছে।— আবার, আমাদের, যেটা ব্যক্তিগতভাবে বেড়ে ওঠার ব্যাপার ছিল না?—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।

রিফাত হাসান: বেড়ে উঠার সাথে যে বন্ধুরা ছিল, সেই জায়গা থেকে কারো কারো সাথে বন্ধুত্ব শুরু হইছে। আবার চর্চাপিঠ ছিল, ওখান থেকে কিছু বন্ধুত্ব শুরু হইছে। এরকম আর কি! প্রভাব আছে। প্রভাবটা কীভাবে আছে, এইটা আমি ঠিক বুঝাইতে পারবো না। নানান ভাবে আছে। খুব ন্যাগেটিভলিও আছে, এইটার আবার খুব প্রগ্রেসিভ কিছু ব্যাপারও আছে, এর ভেতরে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা মানে বন্ধুদের মধ্যে— 

রিফাত হাসান: হুম?

মাহবুব মোর্শেদ: বন্ধুদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ লেগে থাকে। এ রকম কি?

রিফাত হাসান: না, এটা তো জগতের সব বন্ধুত্বের ভেতরই থাকে। (হাসি)

মাহবুব মোর্শেদ: হা হা হা। নিশ্চয়।—

রিফাত হাসান: এইটা, মানে, এই সংঘাত-সংঘর্ষের ব্যাপারগুলো, আমার মনে হয় না এই ক্ষেত্রে কোন রকম প্রভাবিত করবে। মানে, বন্ধুদের মধ্যে এই জিনিশটা নরমালি থাকে আর কি! কিন্তু, আমি, খুব বেশি, পার্সোনালি হচ্ছে, সংঘাত সংঘর্ষ, ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এইসব নিয়ে পাবলিক স্পেসে কথাবার্তা বলারে ইগনোর করতে চাই।

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ। আর একটা জিনিশ আমি বিশেষভাবে বুঝতে চাই। চট্টগ্রামে তো শিল্প-সাহিত্যের চর্চার একটা ধারাবাহিকতা আছে। এখানে, ধরেন, অন্য একটা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে গিয়ে, আপনারা যখন সেখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন, তখন ঐ তাদের সঙ্গে, আগে যারা আছে, তাদের সাথে সংঘাতের ব্যাপারটা কেমন তৈরী হয়?—

রিফাত হাসান: একটু আর একবার বলবেন কথাটা? একটু আনমনা হয়ে গেছিলাম হঠাৎ।

মাহবুব মোর্শেদ: মানে, চট্টগ্রামে তো অনেকদিন ধরেই শিল্প সাহিত্য চর্চার একটা ধারা আসছে। চলে আসছে। তো আপনারা, আপনি যখন বা আপনার বন্ধুরা যখন তাদের সাথে ইন্টারেক্ট করতে যান, বা ইন্টারেক্ট করতে যান না, কিন্তু আপনাদের যে প্রভাবটা তৈরী হলো, অল্টারনেটিভ একটা ওয়েতে।—

রিফাত হাসান: হু হু—

মাহবুব মোর্শেদ: মানে, ধরেন ব্লগ এবং ফেসবুকের মধ্য দিয়ে। এই ব্যাপারটাকে, ওখানকার যারা ধারাবাহিকভাবে চর্চা করে আসছিলে, তারা কীভাবে গ্রহণ করে?—

রিফাত হাসান: উমমমম, আসলে, সব সময়ই, আমার একটা ইয়ে ছিল হচ্ছে কি, ঢাকা বা চট্টগ্রাম, আলাদাভাবে এই ধরনের কোন ঘটনারে আমি কখনো গ্রাহ্যও করারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি নাই। এমনকি, অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েও নিই নাই। নেওয়ার চেষ্টাটাই করি নাই আর কি। তো, এই কারণে আমি আলাদাভাবে বলতে পারবো না যে, চিটাগং এ আলাদাভাবে কে কোথায় কীভাবে কি কাজ করছে, তারা তাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আমার চোখে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের খোঁজ খবর নেয়াটারে গুরুত্বপূর্ণও মনে করি নাই। সেজন্য আলাদাভাবে কোন খোঁজখবরও আমার নেই। হঠাৎ যাদের সাথে দেখা হয়, হয় বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, আলাদাভাবে কোন সাহিত্যিকের সাথে দেখা হয় না কখনো। লেখালেখি করে, সেই জায়গা থেকে গুরুত্ব দিয়ে কারো সাথে দেখা হয়না আমার। 

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। মানে ঐ রকম ইন্টারেকশনের ব্যাপারগুলো মানে… 

রিফাত হাসান: না, এরকম নাই…. 

মাহবুব মোর্শেদ: রিফাত হাসান একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী, এইটা জানার পরে, ধরেন, চট্টগ্রামে আগে থেকে যিনি বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত, তিনি যখন আপনার সাথে কথা বলেন হঠাৎ করে, তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? এরকম ঘটনা ঘটে না কখনো?—

রিফাত হাসান: হাঁ এরকম হয়তো বা ঘটতে পারে, আমার আসলে তেমন চোখে পড়ে নাই। আমার সাথে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে যে আসলে, আমার সাথে যাদের হৃদ্যতা তৈরী হয়েছিল আগে থেকে, বা নতুনভাবে হঠাৎ পরিচয় হলাম, কথাবার্তা বল্লাম, এর বাইরে কেউ বুদ্ধিজীবী, সেই জন্যে এখানে কারো সাথে আমার পরিচয় বা কথাবার্তা কোনটাই হয় নাই আর কি! মানে, আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত কেউ একজন আছেন, তার সাথে আমি দেখা করবো, যোগাযোগ করতে হবে, এরকম ঘটে নাই আর কি! করা হয় নাই আর কি! এমন কি কেউ আমার সাথেও সেটা করে নাই। এবং যেটা হইছে, ঢাকা থেকে প্রচুর লোকজন আসছে বিভিন্ন সময় আমার সাথে দেখা করতে। এবং শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকজন আসছে বিভিন্ন সময়। এমন কখনো হয়নাই যে চিটাগং এর প্রতিষ্ঠিত লোকজন বা চিটাগং এর অমুক জিগ্যেস করছে যে, ভাই আপনিও চিটাগং আছেন, আমিও চিটাগং আছি। জানতাম না। এরকম আর কি! মানে এরকম ঘটে নাই আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: মানে, এই ব্যাপারটাতে একটা, শেষ পর্যন্ত, চিটাগং-এ কে কাজ করছে, ঢাকায় কে কাজ করছে, বা আরেকটা জায়গায় কে কাজ করছে—

মাহবুব মোর্শেদ: এটা ঐভাবে মেটার করেনা।—

রিফাত হাসান: রাইট। এইটা মেটার করেনা এবং এটা আঞ্চলিক প্রশ্ন। তো, আঞ্চলিক প্রশ্নের জায়গা থেকে কোন একটা জিনিশ যখন আপনি গুরুত্ব দিতে যাবেন, সে জায়গাটার আসলে আঞ্চলিক গুরুত্বের বাইরে আর কোন গুরুত্ব নাই। কিন্তু চিটাগাঙের যদি কেউ একজন, যেমন চিটাগাঙের একজন আছেন, যার সাথে কোন চেষ্টা করা ছাড়াই পরিচয় হইছে, এবং পরে বন্ধুত্বও হইছে কিছুটা। জিয়া হাসান। আমরা কেউ কারো কাছে পরিচিত হইতে যাই নাই।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হু। না, আমি হল অন্য একটা জায়গা থেকে প্রশ্নটা করেছি। সেটা হলো যে, ফিজিক্যাল উপস্থিতি যেখানে থাকে, সেখানে একটা, মানে, ফিজিক্যাল উপস্থিতি মানে আমরা তো একটা বড় অংশের জীবন যাপন, চিন্তা ভাবনা, লেখালেখির একটা বড় অংশ আসলে ভার্চুয়ালি করি। এবং সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হুম? কিন্তু আপনি যেখানে বা আমি যেখানে ফিজিক্যালি উপস্থিত আছি, যেমন, উদাহরণ হিসেবে আমি একটা বলি, ধরুন, আমি মিরপুরে থাকি। তো মিরপুরে যারা থাকে, এখানে যেহেতু কাছে, ঢাকা শহরে অনেক জ্যাম আছে। আমার হঠাৎ যদি মনে হয়, যে, আচ্ছা মিরপুরে কে আছে, তার সঙ্গে আড্ডা দিই। তো, সেটা ধরেন, আমরা এক ধরনের করে ফেলতে পারি। যে, মিরপুরে কারা আছে, তাদেরকে এরেঞ্জ করে, আড্ডা দেয়ার ইচ্ছে হলো, একসাথে চা খাওয়ার ইচ্ছে হলো। ঘরে ভালো লাগছে না, বা শাহবাগের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা ফোন দিয়ে কানেক্ট করে ফেলি, দেখা করে ফেলি। এই জিনিসটা ঘটে অনেকসময়। ঐ জন্য জিগ্যেস করছি যে, ফিজিক্যাল উপস্থিতির ব্যাপারটা। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মধ্যে, বুদ্ধিবৃত্তিক লোকজনের মধ্যে, কী রকম হয় আসলে ওখানে, সেই দিক থেকে প্রশ্নটা করছি।—

রিফাত হাসান: স্বাভাবিকভাবে, ঢাকা যেহেতু অনেক বড় শহর, মিরপুর গেলে এবং শাহবাগ গেলে, দুইটা আলাদা একটা শহরের মতই আর কি। সেই কারণেই অনেক বড় হিশেবে আপনারা ইয়ে করতে পারেন, অভিজ্ঞতাটা আপনাদের সেরকম। কিন্তু চিটাগং এ আমরা আসলে সেরকম কোন, আর বিশেষ করে আমার লেখালেখি-চিন্তাচর্চার অরিয়েন্টেশনটা যেহেতু সে রকম চিটাগং কেন্দ্রিক না, মানে, এমন না যে, ধরেন, চিটাগাঙের বুদ্ধিজীবীদের সাথে, বা লেখালেখি যারা করে তাদের সাথে বড় হইছি। ঘটনা সেভাবে যেহেতু তৈরী হয় নাই, আমার সে রকম কোন, এখানকার কোন ইয়ে তৈরী হয় নাই। অনেকের সাথে সম্পর্ক আছে। কিন্তু সম্পর্কটা এমন ভাবে তৈরী হয় না যে, ধরেন আমরা একটু একা আছি, সবাইকে ডেকে একটু আড্ডা দিবো সে রকম, অতো বেশী না আর কি! এটা বুদ্ধিজীবি বা লেখক কেন্দ্রিক না আর কি! এটা বন্ধুবান্ধবকেন্দ্রিক আছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ। সেটা তো সবারই থাকে।

রিফাত হাসান: হু হুম।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। মোহাম্মদ মোরশেদুল একটা কমেন্ট করেছেন যে, আপনার গল্পগুলো শুনতে শুনতে গদ্যের কথা মনে হচ্ছিল। কিছু গল্প আছে অসাধারণ।— গল্পগুলোর কথা এলো না, এটা একটু বলছিলেন উনি৷ 

রিফাত হাসান: আচ্ছা আচ্ছা—

মাহবুব মোর্শেদ: এটা একটা, ভালো একটা ব্যাপার যদি—

রিফাত হাসান: আচ্ছা, মোরশেদ ভাইকে আমি একটু, উনাকে এখানে ইনভাইট করা যায়? উনি একটু বলুন তাইলে। নাকি?—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।—

রিফাত হাসান: উনাকে ইনভাইট করেন তাহলে, উনি কী বলেন, দেখি।— 

মোরশেদুল আলম: আমাকে কি শোনা যাচ্ছে?—

রিফাত হাসান: হাঁ, শোনা যাচ্ছে। ঠিকাছে। আপনি একটা কথা বলতে চেয়েছিলেন। এখন বলবেন?—

মোরশেদুল আলম: আচ্ছা, মাহবুব ভাইকে ধন্যবাদ। অন্য সবাইকেও, শুভেচ্ছা। আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে কি, গদ্যের প্রসঙ্গটা আসলে আর একটু আসলো না। আমার কাছে যেটা মনে হয় যে, রিফাতের গদ্যের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। যেটা হচ্ছে, এই সময়ে যারা লেখালেখি করছেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দর্শনের জায়গা থেকে যারা লেখালেখি করছেন, তাদের যে গদ্যগুলো হয়, গদ্যের মধ্যে যে একটা মোহনীয়তার ব্যাপার, বা টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার আছে, সেটা আমার কাছে মনে হয়েছে যে কি, রিফাতের গদ্যের মধ্যে একটা আলাদা ছাপ আছে, আলাদা একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে সব সময়। একটা বোর ফিল করার ব্যাপার থাকে না। সেটাই সব সময়, সেটা একটা ছোট মন্তব্য থেকে শুরু করে কোন লম্বা লেখাও যদি হয়, সেটা সবাইকে ধরে রাখতে পারে। সে জায়গা থেকে, তার যে গল্প, আমি গল্প পড়ে অনেক বেশী মুগ্ধ, রিফাতের। একটা দুইটা গল্প, যেগুলা এর মধ্যে প্রকাশ করেছেন, আমার কাছে মনে হয় যে কি, গল্পগুলোর প্রসঙ্গ আসতে পারে, এবং রিফাত আসলে নিজে কী মনে করে? তার গদ্যগুলো, আসলে, সে কীভাবে এই গদ্যগুলোকে, তার নিজের গদ্যটাকে গড়ে তুলেছেন।—

রিফাত হাসান: আচ্ছা, আচ্ছা।—  

মোরশেদুল আলম: এটা আর একটু ডিটেইল আসতে পারে।—

রিফাত হাসান: আচ্ছা। মাহবুব ভাই, আমি মোরশেদের কথা বলছিলাম না? ইনি হচ্ছেন মোরশেদ।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, তাইলে আপনি একটু বলেন, আপনার গদ্যের বিষয়ে একটু বলেন।—

রিফাত হাসান: আচ্ছা। আমার গদ্যের বিষয়ে মোরশেদ ভাই আসলে ঠিক কোন ব্যাপারটা ধরার চেষ্টা করছেন, আমি বুঝতে পারছি না। উনি গল্পের কথা বললেন। আমি মাঝে মধ্যে গল্প লিখি। আমি বন্ধুদেরকে বলি যে, সামনে যে বই হবে, তা গল্পের, কোন ইন্টালেকচুয়াল আলাপের না। এই গল্পের ভাষা কীভাবে নির্মাণ হল, এইটা নিয়াই হয়ত মোর্শেদ ভাই আমাকে কিছু কইতে বলতেছেন। তো, আমি এর উত্তরেও তো কেবল গল্পই বলতে পারি। আমরা বন্ধুদের আড্ডায় যেসব গল্প করি, আমার সন্দেহ, সেইসব গল্প নিয়াও একটু বলার লোভ হয়ত মোরশেদ ভাই উসকে দিতে চাইতেছেন। যেমন, আমার বাবা ছিলেন হচ্ছে যে, পাকিস্তান আমলে সরকারি চাকরি করতেন। তো, বাবা আমাদেরকে গল্প করতেন হল, উনাদের অফিসে সে সময়ে সবাই উর্দু বলতো। কিন্তু বাবা উর্দু পছন্দ করতেন না। বাবা অফিসে কথা বলতেন, ইংরেজীতে। তো, এই যে উর্দু না পছন্দের যে ব্যাপারটা, এইটারে আমি এখন ভাষা ঘৃণা ও জাতীয়তাবাদের অসুখ বইলা বুঝি, এক, দ্বিতীয় হচ্ছে যে, উনার ভেতরে ভাষার বিশুদ্ধতা নিয়ে, উনার নিজের একটা খুঁতখুঁতি ছিল আর কি! নানান ভাবে। যেমন, আমরা ভুল ইংরেজি বললে বহুদূর থেকে শুধরে দিতেন। হা হা, মজার ব্যাপার হল, আমার ইংরেজি এখনো বিস্তর ভুলে ভরাই থাকে। উনার একটা পলিটিকাল জার্নিও ছিল। কিন্তু, পলিটিকাল জার্নিটা খুব বেশী এক্টিভ ছিল না। যেমন উনি শেখ মুজিবকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। সব পুরনো ঐতিহ্যবাদিদের মত আওয়ামীলীগ ছিলেন। কিন্তু, মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধে কোনরকমের সক্রিয় অংশগ্রহণ নাই বাবার। শুধু একটা ঘটনা জানা আছে, সেটা হচ্ছে যে, ঐ খাতুনগঞ্জের ঐদিকে আমাদের একটা দোকান ছিল, উনি স্বাধীনতার আগেই সরকারি চাকরির থেকে অবসর নিয়ে অবসরের টাকাগুলো দিয়ে ব্যবসা শুরু করছিলেন অইখানে। ওখানে, ঐ ৭১ সালে, আমাদের যে দোকান, দোকানের উপরে উনি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিছিলেন। ঠিক কোন মাসে, জানা নেই। বাবার এক বন্ধু, এই গল্পগুলো আমার বাবা কখনো বলেন নাই, শুধু সেই বন্ধু থেকে শোনা। বন্ধুটি ছিলেন, মুসলিম লীগ করতেন। মারা গেছেন এখন। আমার বাবাও তো আর বেঁচে নেই। তো, বন্ধুটির বয়ানেই গল্পটি হল, বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর পর, সেই সময়ে মুসলিম লীগের মিছিল আসছে, মুসলিম লীগের মিছিলে ছিল বাবার সেই বন্ধু, এই ভদ্রলোক। বাংলাদেশের পতাকা দেখেই উত্তপ্ত মিছিলের থেকে সবাই আমাদের দোকানটা জ্বালিয়ে দিতে উদ্ধত হল। তো, বাবার সেই মুসলিমলীগার বন্ধু, সেই সময়ে, দোকানটা বাঁচানোর জন্য, ওদের বললেন যে, সহজ সরল, বোকা মানুষ, তেমন বিপদজনক কিছু না। বোঝে নাই। এবং পরে ওরা স্রেফ পতাকাটা নামিয়ে নিয়েই চলে গেল। দোকান জ্বালিয়ে দিল না। তো, এই গল্পগুলোতে বাবাদের সেরকম কিছু পলিটিক্যাল ইগোও কল্পনা করা যায়, যেইটা আমাদের দেখায় আমরা আর তেমন করে ঠাহর করি নাই পরে।

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: আর উনারা ছিল, যেহেতু, উনাদের সময়ের পুরনো শিক্ষিত মানুষ, অনেক পুরনো একটা কলেজ আছে চট্টগ্রামে, নাম শুনে থাকবেন, কানুনগোপাড়া কলেজ। বাবা ছিলেন কানুনগোপাড়া কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্র, বাবারা দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে কলেজে যেতেন। এটা হচ্ছে, বৃটিশ আমলের কথা হবে। তো, ভাষা বা কীভাবে গল্প কইবেন, তারে নিয়ে উনার, মানে খুব পিকিউলিয়ার গল্প, মানে এক্সপেরিমেন্ট আছে। গল্পটা হচ্ছে, মানে, আমার বাবা যখন বিয়ে করছিলেন, উনি ছিলেন বড় মেয়ের জামাই আর কি! সবার বড় মেয়ের জামাই। তো, উনার উপরই পড়ছিল, আমার আম্মাদের বাকি বোনদের বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। তখন, বাবা একটা কাজ করলেন। আমার একটা খালাম্মা, যিনি ছিলেন, পড়ালেখায় অসম্ভব ভালো, সুন্দরী হিশেবেও গ্রামে খুব নামকরা ছিলেন। তো, উনার বিয়ের জন্যে গ্রামের ভেতরে সব যুবকের একটা আগ্রহ ছিল। তো, যখন প্রচুর বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগলো, তখন আমার বাবা একটা প্রস্তাব দিলেন। বললেন যে, তোমরা একটা কাজ করো। তোমরা যারা যারা বিয়ে করতে চাও আমার শালীকে, সবাই আমার কাছে একটা চিঠি দাও। কেন বিয়ে করতে চাও। যার চিঠি সবচেয়ে পছন্দ হবে আমার, তার কাছেই আমি বিয়ে দেবো, আমার শালীকে। তো, যেটা হলো, প্রচুর, বহু পাতায় ভরা চিঠি আসতে থাকল। তো, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসল, যে ভদ্রলোকের চিঠি সবচেয়ে ছোট এবং অল্প কথায় বলতে পারছেন, আমার আব্বা তাকেই বিয়ে দিলেন। উনি ছিলেন যে, একজন স্কুল মাস্টার। সেই স্কুলের হেডমাস্টার হইছিলেন পরে। যিনি, যার চিঠি সবচেয়ে ছোট হয়েছে, এবং অল্প কথায় বলতে পারছেন উনি। এই ধরনের ছোট ছোট নানান ঘটনা, হয়তো বা আমাকে প্রভাবিত করছে। হইতে পারে। আমার ঠিক ধারণা নাই আর কি আলাদা কইরা! কোন জিনিসটা আমাকে আলাদাভাবে প্রভাবিত করছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: এই গল্পটাতো খুব ইন্টারেস্টিং।—  

রিফাত হাসান : হু হুম।

মাহবুব মোর্শেদ: খালার বিয়ে দেয়ার ঘটনাটা। ঘটনাটা খুব ইন্টারেস্টিং৷ 

রিফাত হাসান: হাঁ। আমার আব্বার এই ঘটনা, আমার আম্মা বলতেন সব সময়। আমার খালাম্মাটাও বলেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: নাইস। তো আপনার সেই খালু, সংক্ষিপ্ত কথায় যিনি কাজের কথাটা বলতে পারছিলেন, উনি তো, মানে, আপনার আব্বার চয়েস তো ভালো ছিল  মনে হয়, নাকি?—

রিফাত হাসান: ডেফিনেটলি ভালো ছিল কি খারাপ ছিল, আমরা বুঝতে পারি নাই। আমাদের আসলে বোঝার বয়স হয় নাই। ততো দিনে খালুটাও মারা গেছেন। আমার খালাম্মাটা এখন বেঁচে আছেন। ওদের আসলে কথাবার্তা বলার মতোও এখন তেমন ইয়ে নেই।—

মাহবুব মোর্শেদ: কিন্তু খালা যখন কথা বলতে পারতেন, তখন কি বলে নাই যে, তোর আব্বা, আমাকে এরকম একটা বিপদের মধ্যে ফেলে দিলো। চিঠি—

রিফাত হাসান : হা হা। এরকম কখনো কখনো ঠাট্টা মশকরা তো করেছিলেনই। তো, এখানে হচ্ছে যে, ওরা সবাই ছিল যে, আমার আব্বার ভক্ত আসলে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান : মানে, আমার আব্বার সিদ্ধান্তের বাইরেও আর কোন কথা কইতো না। আমার আব্বা কেমন মানুষ ছিলেন, তা বুঝতে এখানে আরেকটা ঘটনা আপনারে বলি, ওইটা মজার। আমরা যে কবিতা লিখতাম, এটা আমার আব্বা জানতেন। তো আমার আব্বা জানার কারণে দুই দিন দুইটা ঘটনা ঘটাইছে। একটা ঘটনা ঘটাইছে, সেটা হচ্ছে, একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতেছিলেন। তো, ওখান থেকে, রাস্তার উপর পড়ে থাকা, উনি একটা কবিতা পাইলেন। কবিতা হচ্ছে,  মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা নাকি উনার নাম?

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হা। এরকম…. 

রিফাত হাসান: এরকম কেউ একজন মনে হয়। তো, উনার একটা কবিতা, নিয়ে এসে, উনার পছন্দ হইছে, আমারে দিয়ে বল্লো, তুই কি এরকম কবিতা লিখতে পারবি, জিন্দেগিতে?—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: তো, আমি তখন, কবিতা বিষয়ে, আরো অনেক, মানে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাদের চর্চা ইতিহাস এইসব থেকে অনেক উপরে চিন্তা করতেছি। (হাসি)।— বাবারে পাত্তাই দিলাম না। তারপর, এরকম অনেক ঘটনাই ঘটছে আর কি! এবং এইটা নিয়ে আমার লেখা একটা গল্পও আছে। এইটার নাম হচ্ছে যে, আমার নাস্তিকতা, মিথ্যা কথার বয়ান ও একটি শাদা রঙের মেঘ। ও আচ্ছা, ইন্টারেস্টিং গল্পটা। সেই সময় আমি কবিতা লিখতাম। তো, সেই সময়ে একদিন করলেন কি, শহরে আমার বাসায় এসে, হঠাৎ করে আমার পড়ালেখা বন্ধ করে কবিতা লেখা অবস্থায় দেখতে পেলেন। তো, দেখার পরে, উনি তৎক্ষনাৎ যেটা করলেন, সেটা হচ্ছে, আমার কবিতাটা নিয়ে চলে গেলেন। বাড়িতে। কবিতাটা আমার থেকে নিয়ে ফেলে।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: তারপরে যেটা হইলো, সেটা হচ্ছে যে, উনি গ্রামে চলে যাওয়ার পরে, আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হলো, যে আমার আব্বা, এতোবড় কাজ করতে পারলেন আমার সাথে?—  আমার কবিতা নিয়ে ফেলছেন? তখন করলাম কি, আমি, আবার কবিতাটা লিখলাম স্মৃতি থেকে, লিখে, আমার গুন্নি আপাকে জানালাম, যে, বাবাকে খবর দিয়ো, কবিতাটা আমি আবার লিখে ফেলেছি।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম হুম।—

রিফাত হাসান: এরপর হইছে কি, আমার আব্বা আমাকে একটা চিঠি লিখছিলেন সেই সময়ে,  চিঠিটার ভাষাটা আমি আপনাকে বলছি। এটা হচ্ছে, আমার আব্বার চিঠি। অই গল্পে হুবহু উল্লেখ করেছি, এইটা খুলে এখন পড়ছি।—

‘দোয়াপর সংবাদ

খোকন থেকে জানলাম, তুমি আগে থেকে আরো বেশী সাহিত্য চর্চা করছো। সায়েদাও বলেছে, তুমি নাকি আমি যাহা এনেছি, তাহা আবার লিখে ফেলেছো। এটা কি তোমার জিদ না অভ্যাস? খারাপ অভ্যাস এবং জিদ দুইই হারাম। অতএব, দুইটাই পরিত্যাগ করো। অন্যথা, তোমার জীবন অন্ধকার। টেস্ট পরীক্ষার আগে থেকে তুমি পরীক্ষার জন্যে তৈয়ার হও৷ (এটা মনে হয়, ইয়ের সময় হবে, মানে, এসএসি বা এরকম কোন সময়ের হতে পারে আর কি। রিফাত)। ইনশাআল্লাহ তুমি কৃতকার্য হবে। ছাত্র জীবনে সাহিত্যচর্চা জরুরত মতো করতে হয়। যেনো তুমি ভালোভাবে ক্লাস পার হয়ে যেতে পারো। এই সময়ে সাহিত্য চর্চা করলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। হওয়া যায় নাস্তিক। অর্থাৎ, তুমি কিছু নিয়ম কানুনের অধীন নয়। তোমার ইচ্ছে মতোন তুমি চলবে। তাই তুমি হবে নাস্তিক। সাহিত্য প্রত্যেক মানুষের দরকার। তাই প্রতিটা ক্লাসে সাহিত্য আছে। সাহিত্য মানুষকে সভ্যতা শিখায়। অসময়ে সাহিত্য করতে গেলে মানুষ অসভ্যতা শিখে। তাই সমাজে লাঞ্চিত হয়। এখনও সময় আছে, তুমি পড়ালেখায় মনোযোগ দাও। ইনশাআল্লাহ কৃতকার্য হবে। হিতাকাঙ্ক্ষী অনেকেই আছে। এখানে আর লিখলাম না।—

ইতি, আহমদুর রহমান। তারপরে আমাদের ঐ গ্রামের নাম আর তারিখ দিলেন আর কি!—

এই হচ্ছে আমার আব্বা।—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। খুবই ইন্টারেস্টিং। হাঁ।—

রিফাত হাসান: উনি নাস্তিকতার এখানে একটা সংজ্ঞা দিলেন। আর সাহিত্যেরও সংজ্ঞা দিলেন এখানে।—

মাহবুব মোর্শেদ: হুম।—

রিফাত হাসান: উনি নাস্তিকতার যেটা সংজ্ঞা দিলেন, সেটা হল, তুমি কোন নিয়ম কানুনের অধীন না, এইটাই হচ্ছে নাস্তিকতা। মানে, আল্লাহয় বিশ্বাস, অবিশ্বাস এটা নিয়ে কোন কথা বললেন না কিন্তু। খেয়াল করেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম। মানে, কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। খুবই মজার। আপনার আব্বা। আপনি যে মাঝে মাঝে একটা বাড়ির ছবি দেন, সেটা কী, সেটা কোথায়?—

রিফাত হাসান: সেটা আমাদের গ্রামে। এটা—

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা গ্রামে।—

রিফাত হাসান: হাঁ, আমাদের গ্রামে। এটা আমার আব্বা বেঁচে থাকা অবস্থাতেই আমরা, আমার বড় ভাইয়াসহ সবাই মিলে করছিলাম। 

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা। যেখানে বাড়ির সামনে লুঙ্গি পরে চেয়ারে বসতে আপনি খুব পছন্দ করেন।—

রিফাত হাসান: হাঁ, বাড়ির সামনে লুঙ্গি পরে বলতে, বাড়িতে যতক্ষণ থাকি, বাড়িতে শুধু না, আমি শহরেও বাসায় যতক্ষণ থাকি, লুঙ্গি পরে থাকি।—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, সেটা তো আমরাও করি।—

রিফাত হাসান: আচ্ছা আচ্ছা।

মাহবুব মোর্শেদ: কিন্তু ঐ বাড়িটার ছবি আমরা অনেকবার দেখছি। ফলে ঐটা— 

রিফাত হাসান: হু হুম।  

মাহবুব মোর্শেদ: বলতে পারলাম আর কি!—

রিফাত হাসান: এখানে হচ্ছেটা কি, আমাদের এই বাড়িটাতে একটা পুকুর আছে। আমার ছোটবেলাটা কাটছে, ঐ পুকুরঘাটে বসে বসে। পুকুর ঘাটে একটা চেয়ার নিয়ে বসতাম। মোড়া নিয়ে বসতাম। মানে, এই ঘটনা তো আগে কেউ কখনো ঘটায় নাই। ওখানে কেউ, ধরেন, পুকুর ঘাটে গিয়ে কথা বলা, মানে, আলাদাভাবে বই, এই বই পড়ার ব্যাপারটা তো একটা দৃশ্য আলাদাভাবে। এই দৃশ্য সম্ভবত বিভ্রান্তিকরও কিছুটা। কারণ এই দৃশ্য দেখেই আমাদের আশেপাশে, অন্তত আমার চাচাতো ভাই, বোনেরা, আমাকে ছোটবেলাতেই মাঝে মধ্যে ডাকতো, এই কবি ভাই আসছে। তো, এইসব ঘটনাগুলো থেকে, একটু, মানে, পরে এসে বুঝলাম যে, না, এই ধরনের পরিচয় নির্মাণ করা যাবে না। আমার নাম কোন কবি ভাই হবে না।—

মাহবুব মোর্শেদ: (হাসি) আচ্ছা। দেখি আমরা আর কেউ কথা বলতে চান কিনা। 

রিফাত হাসান: আচ্ছা। এখানে মোকাররম ভাই আছেন। রাইসু ভাই আছেন। এদের কেউ যদি কথা বলতে চান, কথা বলতে পারেন। এবং আচ্ছা, সুরঞ্জন আছেন। সুরঞ্জন অলরেডি কিছু কমেন্ট করছে। সুরঞ্জনকে ইনভাইট করা যায়।—

মাহবুব মোর্শেদ: এ ইনভাইট করতে পারি। দেখি উনি কি বলেন।—

রিফাত হাসান: ও, লুনা আছেন। লুনাকে তো ইনভাইট করা যায়। লুনা রুশদি৷ 

মাহবুব মোর্শেদ: লুনাকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। সুরঞ্জনকে ইনভাইট করেছি। সুরঞ্জন জয়েন করতে পারছেন না মনে হচ্ছে। লুনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। লুনা যদি হাত তুলেন, তাহলে আপনাকে আমি ইনভাইট করতে পারি।—

রিফাত হাসান: আচ্ছা, সুরঞ্জন বলল যে, আমি আজ অডিওতে না যাই, কমেন্ট থেকে আলাপ, আচ্ছা আচ্ছা। সুরঞ্জন কিছু কমেন্ট করছে, কমেন্টগুলোকে, আমি চাইতেছিলাম সে যদি মুখে বলে, এটা নিয়ে আলাপ করা যায়। কিন্তু কমেন্ট যেইটা করছে, আলাদাভাবে, খুবই ব্যক্তিগত হওয়ায়, এইটা নিয়ে কমেন্ট না করাটাকে আমি প্রেফার করছি আর কি!

মাহবুব মোর্শেদ: হু হুম।

রিফাত হাসান: সুরঞ্জন, এমনি, মানে খুবই ইফেক্টিভ, খুব সার্প চিন্তা করতে পারে একজন। আমি পছন্দ করি। এবং আমি ব্যাক্তিগতভাবে পরিচিত হইছি কোথাও সুরঞ্জনের সাথে। এই আর কি!—

মাহবুব মোর্শেদ: লুনাকে পাচ্ছিনা। আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: মোকাররম ভাইকে কি পাওয়া যাচ্ছে?—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, উনাকে দেখি পাই কিনা। ইনভাইট করছি, দেখি উনি আসে কিনা। মৃদুল মাহবুব কিছু বলবেন?—

রিফাত হাসান: এখানে, মানে অনেকেই তো আছেন। মৃদুল মাহবুব আছেন। মুরাদুল ইসলাম আছেন। তারপর আছেন, অর্জয়িতা রিয়া আছেন। তারপর আবু তাহের তারেককেও তো দেখলাম। সালাউদ্দিন শুভ্রও আছেন।—

মাহবুব মোর্শেদ: মৃদুল কথা বলবে, আসছে মৃদুল মনে হয়৷ 

রিফাত হাসান: আচ্ছা, আচ্ছা।—

মাহবুব মোর্শেদ: মৃদুল আপনাকে এড করছি। মৃদুল মাইক্রোফোন অন করেন।—

মৃদুল মাহবুব: হাঁ হাঁ মিউট ছিল। রিফাত ভাই, মাহবুব ভাই কেমন আছেন?—

রিফাত হাসান: এই তো, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?—

মৃদুল মাহবুব: হাঁ, ভাল আছি। আমি তো আপনাদের আলোচনা শুনছি। ভালো লাগছে। এবং যেভাবে আসলে, যেটা হয় আর কি, রিফাত ভাই, যে, আমাদের তো আসলে সম্পর্কগুলা ধরেন ফেইসবুকের লেখালেখি, ব্লগের লেখালেখি, বা বই সম্পর্কিত। কিন্তু এর বাইরে যে একটা ব্যাক্তি মানুষ থাকে, বা আপনি অনেকগুলা গল্প বললেন। বা আপনার বেড়ে ওঠার কথা বললেন। এগুলা তো আর লেখালেখির ভেতরে ঐভাবে আসে না বা বোঝাও যায় না। যেহেতু দূরে দূরে থাকা। তো, ভালো লাগলো এই জিনিসগুলা খুব। আলোচনা শুনে। আপনাদের, মানে ব্যাক্তি রিফাতকে অনেক চেনা গেলো। দেখা গেলো। বোঝা গেলো। বা এইগুলা হয়ত পরবর্তীতে, আপনার লেখা পড়তে গেলেও হয়ত আরো বেশী, অনেক বেশী, অনেক কিছু কানেক্ট করা যাবে। বা বোঝা যাবে। এরকম।—

মাহবুব মোর্শেদ: হু হু।

মৃদুল মাহবুব: এটা আপনার জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আরেকটা কথা বলছিলেন, রিফাত ভাই, আরেকটু বিস্তারিত হয়ত জানা যাইতে পারে আপনার কাছে, মানে, আপনার মতো করে আর কি! যে আপনি কীভাবে দেখেন জিনিসটা।—

রিফাত হাসান: কোন জিনিসটা?

মৃদুল মাহবুব: সেটা হলো, আপনি যেমন বলতেছিলেন যে, কবির কোন পরিচয় নির্মাণ আপনি করতে চান না। বা, হইতে চান নাই। হুম? তাহলে আপনি আসলে কবি হিশেবে কী হইতে চাইছেন? মানে, আপনার ব্যাক্তিটাকে কীভাবে প্রকাশ করতে চাইছেন এখানে।—

রিফাত হাসান: ও, আচ্ছা। এটা হচ্ছে সেই সময়কার ঘটনা। পরের ঘটনা বলা যাবে না। পরে তো আসলে আমি কবিতা নিয়ে খুব বেশী অগ্রসর হই নাই। মানে, আমরা যখন কবিতা প্রথম দিকে লেখা শুরু করছিলাম।—

মৃদুল মাহবুব: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: সেই সময়ে আমার, আমরা কতোগুলা বেসিক জিনিস ভাবতাম। সেটা হচ্ছে যে, আমরা কোন ফর্মে লিখছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না আমার কাছে।—

মৃদুল মাহবুব : হু।

রিফাত হাসান: আমি কী লিখছি, কী কইতে চাইলাম, আমার পলিটিকস ও দর্শন, সেটা ঠিকমত কইতে পারলাম কিনা, এই ভাষার প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ।— সেটা কবিতা হইতে পারে। সেটা গদ্য হইতে পারে, যে কোন কিছুই। এমনকি, আমরা সে সময়ে একটা কথা বলতাম প্রায়, আমার বিভিন্ন লেখায় আছে সেটা। সেইটা হচ্ছে যে, আমি যে কবিতা লিখছি এবং আরেকজন যে কৃষি কাজ করছে— 

মৃদুল মাহবুব: হুম—

রিফাত হাসান: উভয় ঘটনার যেটা দূরত্ব, সেই দূরত্বটা আসলে আধুনিক মানুষের তৈরী করা।

মৃদুল মাহবুব: আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: মানে হচ্ছে, আমি মনে হয় তলস্তয়ের এরকম একটা কথা পড়েছিলাম কোথাও। সম্ভবত বিনয় ঘোষে। এবং এটা বোঝার জন্য আমি নিজেও কাজটা করছিলাম। সেটা হচ্ছে যে, কৃষিকাজের সাথে, মানে, চারা রুইয়ে দেয়ার অভিজ্ঞতার সাথে যার পরিচয় হয় নাই, যারা শস্যের উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সংযুক্ত না, তাদের কাছে জীবনের প্রকৃত অনুভূতি কখনো ধরা দেবে না। তাঁর কথাটা পুরো মনে না পড়লেও এরকমই কাছাকাছি কিছু বলেছেন তিনি।—

মৃদুল মাহবুব: হুম।..

রিফাত হাসান: তো, আমি, একটা সময়ে, এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য, সেই অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার আব্বার কিছু পরিচিতি তো দিলাম। আমার আব্বা, তখন, মানে শহর আর চাকরিবাকরি ছেড়ে, এমনকি এর পরে যা ধরলেন, ব্যবসাও ছেড়ে গ্রামে চলে আসছিলেন। শেষ জীবনে।— গ্রামে চলে এসে, হল কি, আমাদের অল্প জমিজমা ছিল। আমাদের বেশী জমিজমা ছিল না। এখনও তাই। তো এই অল্প জমিজমাগুলোকে উদ্ধার করে, নিজে একটু চাষবাস করার জন্যে, নিজে চেষ্টা করলেন। উনারা তো আসলে শহরে অভ্যস্ত হওয়া মানুষ, কখনো এগুলো করেন নাই। সারা জীবনে। কিন্তু উনি দেখতাম যে, জমির আলের উপরে গিয়ে বসে থাকার চেষ্টা করতেন। যারা কাজ করতেছে তাদের সাথে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করতেন। তো, আমি করলাম কি, সেই সময়টাতে যারা, জমিতে যারা কাজ করে, তাদের সাথে গিয়ে, ধান চারা নিজের হাতে রোয়ার চেষ্টা করলাম। তো, আমি তখন রুইতে গিয়ে যেটা অনুভব করলাম, এই অনুভবটার ভেতরে আসলে আমি ঠিক বলতে পারব না, কোন একটা আরোপ থাকতে পারে কিনা। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমি তো মানসিকভাবে প্রিপায়ার্ড ছিলাম, যে, আমি এই জিনিসটা ভাববো। এটা হইতেও পারে। ঘটনা হচ্ছে, আমি আসলে বুঝতে পারতেছিলাম যে, এখানে আসলে আমি একটা জিনিস সৃষ্টি করছি। মানে এই সৃষ্টিটা আমি যে কবিতা লিখছি, তার থেকে আলাদা না, বরং আরো অনেক প্রখর ব্যাপার আর কি! আমি যে একটা সজীব জিনিস তৈরী করছি, একটা চারা রুইয়ে দিচ্ছি, এই চারাটা কিছুক্ষণ পরে, আস্তে আস্তে আস্তে আস্ত বড় হবে। বড় হতে থাকবে। এই জিনিসটা, মানে, প্রত্যেকটা কৃষক কিন্তু দেখা যাবে কি, সে কোন না কোন সময় এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইতে পারে আর কি! যদি এটা তার লাইফস্টাইলের ভেতরে থাকে।—

মৃদুল মাহবুব: আচ্ছা, আচ্ছা।—

রিফাত হাসান: সেই জাগা থেকেই মূলত এই কথাগুলা বলা। কবি না হওয়ার ব্যাপারটা আসলে এমন না যে, কবি ব্যাপারটারে আমরা অপছন্দ করেছি কখনো। এই জাগা থেকে না।—

মৃদুল মাহবুব: আচ্ছা। বুঝছি। বুঝছি। ক্লিয়ার।—

রিফাত হাসান: থ্যাঙ্কিউ।—  

মাহবুব মোর্শেদ: এরপরে সালাহ উদ্দিন শুভ্রকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি।—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: আমার নাম সালাহ উদ্দিন শুভ্র। আমি লেখালেখি করি আর কি! আর রিফাতের লেখা পড়ি। রেগুলার। মোটামুটি। ফেসবুকে তো পড়াই হয়। বইও পড়া হইছে। রিফাতকে নিয়ে তো এর আগেও আলোচনা করছিলাম। তো, আমার একটা প্রশ্ন। যেটা রিফাত বিষয়ে সবসময় মনে হয় যে, চট্টগ্রামে। এই আলাপটা কিছুটা হইছেও। রিফাত বলছেনও। মোরশেদ নামের একজনের কথাও বলছেন। আমি শুরু থেকেই আলোচনা মোটামুটি শুনছি ভালোই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে। উম, কিন্তু এই যে রিফাতের যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, মানে এটা তো ঠিক, মানে একটু ডিফরেন্ট।— কারণ, রিফাতের যেহেতু একটা, মাদরাসা বা ঐ ধরনের ওরিয়েন্টেশন থেকে রিফাত আসছেন। এবং সেটার একটা ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউশন, এই কন্টিনিশানের ছাপ যেটা আমি বলবো, আর কি! রিফাত সেটা ফিল করেন, আমার মনে হয় আর কি! বিগত, বিশেষ করে গত এক বছরে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তার সঙ্গে অন্যদের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন বা বিরোধ, এই সমস্ত জায়গা থেকে, মানে রিফাতের এক ধরনের টানাপোড়েন আছে কিনা। আমি যেটা বুঝাইতে চাইলাম আর কি! যে, একটা ইসলামিস্ট ঘরানা বললে হয়তো বিষয়টাকে আরো জনসাধারণ বুঝতে পারবে আর কি! মানে, নন-ক্রিটিক্যালি হয়ত বুঝতে পারবে। যে, এই একটা চাপ রিফাত ফিল করেন কিনা। আরেকটা বিষয়, মানে রিফাতের লেখার মধ্যে এক ধরনের, এটা বোধ হয়, রাইসু ভাই গতবার বলছিলেন, যে মানে, একটা ডিসিশনের দিকে না যাওয়া, রিফাতের চিন্তা একটা কমপ্লিট কিছু, সলিড কিছুর দিকে না যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। এই দুইটা বিষয়ে আমি একটু জানতে চাই। আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

রিফাত হাসান: আচ্ছা, থ্যাঙ্কিউ। এই, আপনাকে আরেকটু, আপনি আরেকটু যদি ক্লিয়ার করেন শুভ্র। সেটা হচ্ছে যে, এই যে ইসলামিক ঘরানার কথা বললেন। এটা কি কোন স্পেসিফিক ঘরাণার কথা বল্লেন, নাকি ওভারল সারা বাংলাদেশের—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: না, ওভারল না। আমি সহজ বোঝানোর জন্যে ইসলামিস্টটা বলছি। আমি বলতে চাইছি যে, মানে আমি এটাই বুঝাইতে চাইছি যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে আপনাকে আমার একা মনে হয় আর কি! মানে আপনার ঐ পরিচিত, বন্ধুমহল, যাদেরকে আমরা চিনি, চট্টগ্রামের সবাইকে তো আমরা চিনি না। আমি নাম মেনশন না করে যতোটা বুঝানো যায় আর কি!—  

রিফাত হাসান: হুম, ঠিক আছে। আর দ্বিতীয় কথা যেইটা বললেন—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: মানে, আপনার লেখার মধ্যে আমার যদ্দুর মনে পড়ে, মানে রাইসু ভাই বলছিলেন, যেখানে আপনার জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা হইছিল আর কি! সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে। একটা লুপ থাকে, আপনার লেখার শেষে একটা লুপ তৈরী হয় আর কি! এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?—

রিফাত হাসান: লুপ এর সাথে একই সাথে আপনি আরেকটা শব্দ বলছিলেন বোধ হয়, রিজিড—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: মানে সলিড কিছু পাওয়া যায় না আর কি!—

রিফাত হাসান: সলিড কিছু পাওয়া যায় না। আচ্ছা। আচ্ছা। ঠিক আছে, বুঝতে পারছি। আমি একটু বলার চেষ্টা করি, এটা তো আসলে, রাইসু ভাই, বা আপনি, বা পাঠকরা আমারে কীভাবে রিড করবেন আমাকে, এটার একটা গুরুত্ব আছে আমার কাছে। হুম? এইটারে গুরুত্ব দিয়ে আমি হয়ত ভাববো সামনে, আমি কীভাবে ইয়ে করছি। কিন্তু, একটা প্রশ্ন, চিন্তা ব্যাপারটারে খুব বেশী ধরেন, অমনিপটেন্ট কিছু মনে করেন কি? আমি মনে করি না। মানে এটা খুব স্ট্রিক কিছু হইতে পারবে, সলিড কিছু হইতে পারবে, সেরকম কিছু না আর কি! মানে, চিন্তা ইটসেল্ফ নিজেকে খুব বেশী ডেস্ক্রাইব করতে পারেনা। মানে, আমি আরো কীভাবে বলি, মানে একটা আমাদের এখানে একটা ঘরানা আছে, চিন্তা চিন্তাকে চিন্তা করতে পারে। সেধরনের একটা ঘরানা আছে। আপনি, যারা এখানে আছেন, অনেকেই শুনে থাকবেন এটা। মানে আমি চিন্তারে সেরকম অমনিপটেন্ট কিছু মনে করি না, যেটা নিজেই সবকিছুকে ডেস্ক্রাইব করতে পারে। সমাধান দিয়ে ফেলতে পারবে। চিন্তা হচ্ছে যে মূলতই আপনি আপনার মূহুর্তগুলো ধরতে পারার ব্যাপার। মানে আমি যে জার্নিটা করছি, সেই জার্নিটাকে সৎভাবে ধরতে পারার ব্যাপার।— মানে কোন ভান ছাড়া, কোন আরোপ ছাড়া। আমার অবস্থাটাকে যদি আমি ধরতে পারি—  এটাই চিন্তার যদি কোন গুরুত্ব থাকে জগতে, এটাই গুরুত্ব আর কি! মানে এর বাইরে আমি যখন, এগুলার বাইরে যখন আমি পিউরলি, ধর্মের কথাও বলবো। সেটা ধর্মও হবে না আবার, আমি যেটা বলবো, এমনকি না-ধর্মের কথা বললেও, না-ধর্মও হবেনা আর কি! কোন কিছুই হবে না। আমার একটু মনে হয় আর কি! শুভ্র আরেকটা যেটা বললেন, এরকম আরেকটা কমেন্ট এখানে আরেকজন করলো, সুরঞ্জন আহমেদ। মানে চিটাগং এ আমার পরিচিত বন্ধুদের সাথে আমার কোন টানাপোড়েন আছে কিনা। এটা নিয়ে মাহবুব ভাইয়ের উত্তরে আমি কিছু কথা বলছিলাম। এইখানে আবার বলি, বন্ধুত্ব মানেই, এর নানানরকম টানাপোড়েন থাকবে। এইসব ব্যাক্তিগত ঘটনাই। এর বাইরে, আমার লেখালেখির জার্নিটা ছিল সব সময় একা একাই। ব্যক্তিগত বন্ধু বান্ধব ছিল। তারাও লেখালেখি করত। এইটুকুই।

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: মানে এই বিরোধটা, চিন্তার না। বিরোধটা রাজনৈতিক, বা আদর্শিক না।—

রিফাত হাসান: একদম না। আমি মনে করি। মানে, এটারে এখন ধরেন, অনেকেই এমন করতে পারে, আমি কখনো যেহেতু এইটারে নিয়ে পাবলিক স্পেইসে কথা বলি না, কেউ এইটারে আদর্শিক লুক দিয়ে গ্লোরিফাই করতে চাইল। আমি এটারে খুব গুরুত্বহীন মনে করি। এবং কেউ যদি দিতেও চায়, সেটারেও মতলবি বইলা সন্দেহ করতে চাই প্রথমে!—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: হাঁ, বুঝতে পারছি। কিন্তু, আসলে বিষয়গুলো আমাদের কাছে যেভাবে আসছে, তাতে মনে হইছিল যে, গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অনেকেই, আমরা সামাজিক মাধ্যম বলতে ফেসবুকে এবং সামনাসামনিও এগুলা নিয়ে আসলে দীর্ঘ আলাপ চলছিল আর কি! সে জায়গা থেকে আমি প্রশ্ন করছি। জানতে চাইছি আর কি! আপনার কাছ থেকে তো এটা জানা হয় নাই কখনো।—  

মাহবুব মোর্শেদ: না আমার মনে হয় যে, এটা যেহেতু উনি বলতে চাচ্ছেন না ফলে, এইটা নিয়ে আমরা আর ইয়ে না করি, হে?

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: হুঁ, ঠিক আছে।

মাহবুব মোর্শেদ: সুরঞ্জন এসছেন।— সুরঞ্জন কি কিছু বলবেন।—

সুরঞ্জন আহমেদ: এখানে আমি সালাহ উদ্দিন শুভ্র ভাইয়ের একটা পয়েন্ট নিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম। মানে, মাদ্রাসার প্রশ্ন আর এই যে একরম, চট্টগ্রাম বা মফস্বল, এগুলা কোন প্রভাব ফেলতেছে কি আপনার চিন্তায়? বা এই সমস্ত ব্যাপার স্যাপারগুলোতে আর কি! ঐ ব্যাপারটা বোধ হয় আপনি পুরোপুরি এক্সপ্লেইন করছিলেন? নাকি—

রিফাত হাসান: কোনটা?— মানে হচ্ছে যে, মাদরাসা এবং আর একটা হচ্ছে, ঐ, আঞ্চলিক সমস্যাগুলা? এরকম?

সুরঞ্জন আহমেদ: হাঁ, মানে এই চিন্তাগুলা মানে মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা, শুভ্র ভাই যেইটা নিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।

রিফাত হাসান: আচ্ছা, না, শুভ্র যেটা বলতেছিলেন, সেখানে, এরকম কোন কথা তো আসে নাই, আমি যতোটুক খেয়াল করেছি। এটা আপনার প্রশ্ন হিশেবে আমরা আলাপে আনতে পারি, আর শুভ্র যেটা বলতেছিলেন, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আলাপ। সে আলাপের আমি, একটা উত্তর তো দিচ্ছিলাম। আপনারটা শেষ করেন, তারপর আমি একসাথে শেষ করি।—

সুরঞ্জন আহমেদ: আমি মূলত শুভ্র ভাইয়ের প্রথম প্রশ্নতে ছিল যেইটা, ইসলাম, মানে মাদ্রাসা থেকে এসে—

সালঅহ উদ্দিন শুভ্র: আমি, আমি ক্লিয়ার করি একটু। আমি, মানে আমার প্রশ্নটা রিফাতের ব্যক্তিগত জার্নির না আর কি! আমি বলছিলাম যে, এই যে, মাদরাসা বা সংশ্লিষ্টদের সাথে তার যে বন্ধুত্ব বা ইসলামিস্টদের সঙ্গে তার যে যোগাযোগ, এই বিষয়টার বর্তমানের পরিস্থিতি। বর্তমানের কী পরিস্থিতিতে আছে, সেটা জানতে চাইছিলাম। আমি জানতে চাইতেছি রিফাত কি একা ফিল করেন কিনা। চট্টগ্রামে বা এই বন্ধুমহলের মধ্যে।—

রিফাত হাসান: ও, আচ্ছা। আমার আলাদাভাবে সেরকম কোন ইসলামিস্ট ঘরানার বা অন্য কোন ঘরানার সাথে বন্ধুত্ব ছিল না কখনো। এই বন্ধুত্বটা হচ্ছে যে, আসলে আমাদের বেড়ে ওঠা যাদের সাথে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব। তাদের পরিচয় ইসলামিস্ট হোক বা মার্কসিস্ট হোক, সেটা, মানে সেটা খুব ভিন্ন আলাপের কনটেক্সট হবে আর কি।—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: বা মাদ্রাসা থেকে আসা হোক। হাঁ, সেটাই। এটাই আমি ক্লিয়ার হইতে চাইতেছিলাম। কারণ আমরা তো আসলে রিফাত বিষয়ে কম জানি।—

রিফাত হাসান: এটা খুব বেশী মাদ্রাসা থেকে উঠে আসার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। আমাদের এখানে বন্ধু যারা ছিল, তাদের ভেতরে মাদ্রাসার থেকে উঠে আসা ছেলে পেলে আমার বাইরে একেবারেই নেই।—

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: বা হয়ত আমরা যাদেরকে চিনি। বা আমি যাদেরকে চিনি এরকম একটা ব্যাপার আছে আর কি!—

রিফাত হাসান: হাঁ হাঁ, সেইটা সম্ভব।

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: সেটাই

রিফাত হাসান: বুঝতে পারছি।

সালাহ উদ্দিন শুভ্র: ওকে।—  

সুরঞ্জন আহমেদ: ঐটাতে আমি আরেকটু এক্সটেন্ড করতে চাইতেছিলাম। মানে, বাংলাদেশে এরকম ইন্টেলেকচুয়াল জগতে, মানে এই মাদ্রাসা প্রশ্নটা কিছুটা। ধরেন, আমরাও মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের, অনেকটা। মানে, আমি তো এখনো এইচএইচসি, মানে আলিম পরীক্ষা দিলাম।

রিফাত হাসান: আচ্ছা, আচ্ছা। ওকে।—

সুরঞ্জন আহমেদ: আরো অনেকেই আছে। তো, মাদ্রাসা প্রশ্নগুলা, যেমন কেউ একজন কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে, এই বিষয়গুলো বোধহয় এখনকার সময়ে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না।—  

রিফাত হাসান: হু হু। ডেফিনেটলি। এটা তো এখন, তেমন কোন ঐ ধরনের..।— আগেকার দিনে যেটা হইতো, সেটা হচ্ছে যে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া যখন আসছে, এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাহিত্যাঙ্গন বলেন, লেখালেখি বা চিন্তার জগৎ বলেন, ঐ জায়গায় একধরনের একটা, মানে, সাহিত্যের সম্পাদক, পত্রিকার সম্পাদক বা লিটল ম্যাগ সম্পাদকদের এক ধরনের একটা আঞ্চলিকতা, তারপর মাস্তানি ছিল। এগুলোকে আঞ্চলিকতা বলতেছি। কিন্তু এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশে যখন নানানরকম সোশাল মিডিয়া গ্রো করা শুরু করলো, যেমন ব্লগ, আমাদের এখানে যেটা ব্লগ ছিল, ব্লগটাও একটা সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবেই আসছিল শেষ পর্যন্ত, হুম? এইসব জিনিসগুলো আস্তে আস্তে এই ঘটনাটাকে এলিমিনেট করে ফেলছে। এখানকার পাওয়ারগুলোকে এলিমিনেট করে ফেলছে। যেমন, এখন কোন সাহিত্য সম্পাদকের কোন পাওয়ার নাই শেষ পর্যন্ত।— কবিতা কী, সেই জিনিসটা বোঝার জন্য, মানে কেউ, কোন একটা কবি, কখনো কোন একটা সাহিত্যসম্পাদকের কাছে গিয়ে তার সাথে কথা বলবে না। আমার এটা মনে আছে, আমার এক পরিচিত বড় ভাই বন্ধু ছিল, যিনি খুবই ভালো কবিতা লিখতেন, আমাদের সময়ে। সেই সময়ে। আমরা তখনো ভালো কবিতা লিখতে শিখি নাই সেই সময়ে। তো, সে রকম সময়টাতে আমার এটা মনে আছে, আমি আপনারে বুঝাতে চাচ্ছি, বাংলাদেশে সাহিত্য সম্পাদক ব্যাপারটা কীরকম প্রভূত্ব তৈরী করছিল সেটার ঘটনা বুঝাইতে চাচ্ছি। আর কিছুই না। তো, উনি দেখা যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে নতুন একটা সাহিত্য পত্রিকা তৈরী হইছিল, নাম ছিল হচ্ছে শৈলী।— এটা কোন সালের কথা আমি বলতে পারবো না। যখন নতুন নতুন হইছিল আর কি! তো, শৈলীতে উনি করলেন কি, একগুচ্ছ কবিতা পাঠালেন, তারপর পাঠানোর পরে সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখলেন এবং আমরা যেহেতু ছোট ভাই। আমি সবসময় বড় ভাই মান্য করতাম। মানে উনার সাথে মোটামুটি আমরা আড্ডা দিতাম। দিনরাত আড্ডা দিতাম, সেরকম মানুষ ছিল। হুম? তো, চিঠিটা আমিই পোস্ট করলাম, ডাকঘর আমার পথে ছিল। তার আগে পড়তে দিল। তো, উনার যেইটা সম্পাদকের কাছে চিঠি, চিঠিটা পড়ে প্রথমে আমার এতো বিরক্ত লাগলো। আমি, মনে মনে বল্লাম যে, কী ব্যাপার, একটা সম্পাদকের কাছে কবিতা পাঠানোর সময় তারে যদি এরকম তেলতেলে চিঠি লিখতে হয়, এবং যে পাঠাচ্ছে সে কিন্তু খুবই ভালো কবিতা লেখে। এমন না যে, সে খারাপ কবিতা লিখে, আর সেটা নিয়ে তার কোন হীনমন্যতা থাকা দরকার। ঘটনা হচ্ছে যে, এতো একটা বড় চিঠি দেয়ার পরও, তার কবিতা কিন্তু ঐ পত্রিকা ছাপায় নাই। তো, আমার মেজাজ খারাপ বেশী হয় নাই। মেজাজ খারাপ হইছে, যে পাঠাইছে তার উপর। কারণ হচ্ছে যে, আমার মনে হল, তার কবিতা না ছাপানোই দরকার ছিল। কারণ সে হচ্ছে যে, এই পাওয়ারটাকে ইগনোর করতে জানে নাই। আমার কথা হচ্ছে যে, সেই সময়ে এই পাওয়ারটাকে এলিমিনেট করা দরকার ছিল এবং সেই জিনিসটা এখন এলিমিনেট হইতে পারছে ঠিক মতো। এখন বাংলাদেশে কোন সাহিত্য পাতায় কার কবিতা ছাপানো হচ্ছে এটা নিয়ে কে কতোটা ভালো কবিতা লিখতেছে, কে কতোটা ভালো গল্প লিখতেছে এটা ডিটারমিন হয়না। কে ভালো চিন্তা করতে পারতেছে এটাও ডিটারমিন হয়না। এবং এটাই হচ্ছে যে, এখনকার জমানায় আপনি যখন মাদরাসা থেকে উঠে এসে ভালো কবিতা লিখতে পারছেন বা ভালো চিন্তা করতে পারছেন। এই ঘটনাগুলোকে এখন আর সেই জায়গা থেকে চিন্তা করার দরকার নাই আর কি তেমন। একটা সময় তো ছিল, যে সময়ে এই ঘটনাগুলো ছিল না। যেমন আমাদের আবুল ফজলরা মাদরাসার ছাত্র ছিল মনে হয়। একটা সময়ে। আবুল ফজলের আমি আল হাদিসের, কোরআনের গল্পের বই পড়ছি মনে হয়। আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারতেছি না, কিন্তু আমি এরকম কিছু গল্প পড়ছি। এবং উনি মাদরাসার ছাত্র ছিল মনে হয়। এবং মৌলভি লেখা হয়তো উনার কিছু কিছু লেখায়, উনার নামে। আমি সেজন্য রিসেন্ট একটা লেখায় মৌলভি লিখছিলাম ঐ আবুল ফজলের নামের আগে। ও, আহমদ ছফার যেটা বাঙালি মুসলমানের মন, ওখানেও মনে হয় আবুল ফজলকে দেখেই বাঙালি মুসলমানের মন লিখছিলেন। না? মাহবুব ভাই?

মাহবুব মোর্শেদ: ঠিক তাই৷ 

রিফাত হাসান: আবুল ফজলকে দেখেই লিখছিলেন আর কি! উনিও মাদরাসার ছাত্র ছিলেন।—  

মাহবুব মোর্শেদ: আচ্ছা, আবু তাহের তারেক আসছেন। আমরা তার, আমরা অলরেডি দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছি৷ 

রিফাত হাসান: দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে?

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে। আবু তাহের তারেক, আপনি বলেন একটু?

রিফাত হাসান: তারেক, কী খবর?

আবু তাহের তারেক: এইতো ভালো আছি।— আচ্ছা আপনারা মাহবুব ভাইরে কি মাহবুব বলেন না মোর্শেদ বলেন কোনটা?—

রিফাত হাসান: মোর্শেদ তো পরের নাম। শুরুরটা দিয়েই বলি আমরা। এটাই তো মাহবুব ভাই?—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ হাঁ, মাহবুব বললেই ভালো।—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা। মাহবুব ভাইয়ের লগে তো আমার আলাপ হয় নাই পার্সোনালি। তো, অনেক ভালো লাগতেছে আপনার এই ব্যাপারটা আর কি! অনেক কানেক্টিভ একটা ঘটনা।—রিজিড কম তো, তাই কানেক্ট করা ইজি। ফলে এইটার বিভিন্ন রকম ইফেক্ট থাকবে আমাদের মধ্যে, বা সোসাইটিতে। আর রিফাত ভাইকে আমি দুইটা জিনিস জিগ্যেস করতে চাইতেছি। প্রথমটা হচ্ছে মোহাম্মদ আজমের গত জন্মদিনে উনাকে বলা হইছিল, যে শাপলা আর শাহবাগ নিয়ে উনার একটা মত দিতে আর কি!—

রিফাত হাসান: শাপলা আর শাহবাগ নিয়ে—?

আবু তাহের তারেক: উনার ক্রিটিক আর কি, উনি কী রকম ভাবে এটা দেখেন।

রিফাত হাসান: আচ্ছা আচ্ছা।—

আবু তাহের তারেক: তো উনি এটার বিস্তারিত উত্তর দেন নাই, বাট একটা কথা বলছিলেন এইভাবে, যে, শাহবাগ বিষয়ে কোন ন্যারেটিভ তৈরী হইছে কিনা। যদি ন্যারেটিভ তৈরী না হয় তাইলে পরে শাহবাগ বা শাপলা এটা যতো বড় জিনিস হোক না কেন এটা এখনো ম্যাটার করে না। এইরকমই বলছিলেন আর কি! মানে উনার কথাটারে আমি ট্রান্সলেট করতেছি আমার মতো করে। আমার মনে হয় আপনিও এই ইন্টারভিউটা খেয়াল করে থাকবেন।

রিফাত হাসান: আমি ইন্টারভিউটা খেয়াল করি নাই, তবে আজমের সাথে আমার মনে হয় ফেসবুকেই এই ধরনের কোন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ হইছিল, এরকম।—

আবু তাহের তারেক: তো, উনি বলছিলেন, আমার মনে হইতেছে, এটা কি কোন ন্যারেটিভ তৈরী করছে কিনা। যদি ন্যারেটিভ তৈরী করে না থাকে তাইলে পরে যতোগুলো ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, এটা ঘটনা না। 

রিফাত হাসান: ন্যারেটিভ তৈরীর কী মানে?—

আবু তাহের তারেক: আই ডোন্ট নো, সো, এই ব্যাপারে আপনি কোন বক্তব্য দিতে চান কিনা। মানে আপনার মত নিতে চাইতেছিলাম আর কি।

রিফাত হাসান: মানে, কথা হচ্ছে যে কি, উনি ন্যারেটিভ তৈরী করা ব্যাপারটা দিয়ে কী বুঝাতে চাইছেন, সেটা না জেনে বেশী কথা বলতে পারবো না। তবে, এটা নিয়ে আমাদের যে তর্ক ছিল,  সে সম্পর্কে আমি খুব ওয়াকিবহাল আছি। সেটা হচ্ছে যে, আমি কতোগুলো জায়গায় খুব স্পষ্ট কথা বলতে চাই। পলিটিক্সটা স্পষ্ট করার ব্যাপার। পলিটিক্স তো কোন ধোঁয়াশা রেখে কথা বলার ব্যাপার না। যার কারণে আমি বলেছি, শাহবাগের কোন গ্রে এরিয়া ছিল না। উনারা সবাই, আজমরা বা আরো অনেকেই যারা যারা আছেন, আজম, আরো কারা কারা যেন বলছিল, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। মনে আছে যে, আজমের সাথে এরকম একটা আলাপ বা তর্ক হইছিল। একটা গ্রে এরিয়ার কথা আজম কইতেছিলেন।— আমি বলতেছিলাম যে, না, শাহবাগে কোন গ্রে এরিয়া ছিল না। শাহবাগে যেটা ছিল, হয় শত্রু নয় মিত্র। এর বাইরে আর কোন ঘটনা ছিল না।— শক্র মিত্র বলতে, হয় ফাঁসির পক্ষে, না হয় ফাঁসির বিপক্ষে। আর ফাঁসিকে বলতেছিলাম হচ্ছে যে, খুনের কনসেনসাস। একটা খুনের কনসেনসাসের পক্ষে দাঁড়িয়ে যতোরকম আন্দোলন বা আপনি যা কিছু করেন না কেন, মাঝখানে এসে এখন যারা গ্রে এরিয়ার কথা বলছে, এরা মূলত শাহবাগকে ডিজঔন করতে চাচ্ছে। শাহবাগ বলতে, আমাদের এখানে রাইসু ভাই আছেন। রাইসু ভাই একটা প্রস্তাব করেছিলেন যে, আপনারা শাহবাগ বলিয়েন না। গনজাগরণ মঞ্চ বলেন। কারণ হচ্ছে যে, শাহবাগ বলার সাথে সাথে শাহবাগের পাশাপাশি আরেকটা প্রতিপক্ষ দাঁড়ায়। যেইটা প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো, নিজের স্পেইসটা সে জায়গায় নেয় নাই আর কি! আচ্ছা, আমরা গনজাগরণ মঞ্চও বলতে পারি। 

আবু তাহের তারেক: না, এখানে আমি আপনার ইন্টারভিউ যদিও, আমি আর একটু যদি বলি, ইন্টারেক্ট করি আপনার ইন্টারভিউতে। আই ডোন্ট নো। বাট আমার কাছে মনে হয় যে, এটা গণজাগরণ মঞ্চ হিশেবে যেভাবে আমাদের পাবলিক মনে আছে, এর চাইতে বেশী শাহবাগ হিশেবেই আছে আসলে। সো এইটাকে ঘৃণাবাদ থেকে বাঁচাবার জন্য শাহবাগ না বলে গনজাগরণ মঞ্চ বলা আসলে আমার কাছে মনে হয় দরকার নাই। আমরা এর বিরুদ্ধে অন্যভাবে কাজ করতে পারি৷

রিফাত হাসান: আচ্ছা। হুম এটা কিছুটা ঠিকই আছে। এবং এখানে কতোগুলো জিনিস, যেমন ধরেন, আপনি একটা জায়গায় গিয়ে, আপনি একটা পয়েন্ট তুলতে পারলেন। তার মানে এই জায়গায় আপনার একটা কনসার্ন আছে। এই কনসার্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইযে ব্রাত্য রাইসু, এই জাগাটা তুললেন এই জাগাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।—  

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে, এরপরে আমরা যতোবারই শাহবাগ বলবো তখনই আমরা মাথায় রাখবো যে, না এখানে ব্রাত্য রাইসুর একটা নোকতা বা আপত্তি আছে। এইটা বহাল থাকতেছে। বলতে পারি, আমরা শাহবাগই বলতে পারি। কিন্তু তার সাথে সাথে রাইসুর আওয়াজটা বারবার ইকো করবে। ইকোটা চলুক। এটাই হচ্ছে যে তর্ক।—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো, বলতেছিলাম যে, যারা শাহবাগকে ডিজঔন করতে চাচ্ছে তারাই আসলে একটা গ্রে এরিয়ার কথা বলছে। যে গ্রে এরিয়াটাই মূলত তাদের নিজেদের অবস্থান।—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: যারা ডিজঔন করতে চাচ্ছে তাদের অবস্থান। যারা ঔন করতে চাচ্ছে তাদের অবস্থান না। যারা ঔন করতে চাচ্ছে, তাদের কোন গ্রে এরিয়া ছিল না। তাদের একদম স্পষ্ট এরিয়া ছিল যে, তারা ফাঁসি চায়। তাদের আন্দোলনটা ফাঁসির দাবীর। আর কোন এরিয়াই ছিল না তাদের। এখন যেসব বলে, তা পরের, ডিজঔন করতে থাকার সময়ের ডেভেলপমেন্ট।—

আবু তাহের তারেক: তাইলে পরে এসে আমার প্রথম প্রশ্নটাই আর কি একটু স্পেসিফিকেলি জানতে চাইবো আপনার কাছ থেকে। যে, আপনে তো প্রত্যক্ষভাবে শাপলা এবং শাহবাগের আন্দোলনের সময়ে বিভিন্নভাবে ক্রিটিকাল একটা সিচ্যুয়েশনে ছিলেন। এর পরে আজকে প্রায়, মনে করেন, দশ বছর হয়ে গেছে। তো আপনে কীভাবে শাপলা এবং শাহবাগের আন্দোলনকে বর্তমান সিচ্যুয়েশনে দেখেন আর কি! এইটা এজ প্রেসাইজলি পসিবল আপনি যদি বলতে পারেন। যদিও আমি জানি এটা একটা বিশাল ঘটনা। মানে, আপনার পক্ষ থেকে এই আলাপ শুনতে পারাটাও আমাদের কাছে বিশাল ব্যাপার। মানে, এই ঘটনাটাকে আপনি কীভাবে এখন দাঁড়ায়ে দেখেন আর কি! আগের প্রেক্ষিতে না দেইখা, বর্তমানের প্রেক্ষিতে কীভাবে দেখেন। সেটা।

রিফাত হাসান: আচ্ছা। যে কোন ঘটনারে যখন আপনি একটা বড় ন্যারেটিভ আকারে বুঝতে চান, দেখবেন কি, প্রথমত, বা শেষ পর্যন্ত ছোট ছোট ঘটনাগুলোর মধ্যে বিশাল কোন মিল নেই। কিন্তু, মূলত, তুচ্ছ বিষয়ের গুরুত্ব যতোটুকু, সেটুকু ধরতে পারতে হবে আপনারে। মানে, আমরা যদি বাটার ফ্লাই এফেক্ট যেগুলো আছে, অইগুলারে আমলে নিই, ওখানে দেখবেন যে, খুব তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও আপনি যখন কথা বলেন, এইটার ইফেক্ট আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে।—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো, শাহবাগের যেটা গুরুত্ব, আমি বলতেছিলাম যে, শাহবাগ একটা গনহিস্ট্রিয়া তৈরী করে দিছে আমাদের মধ্যে। এটা শুধু শাহবাগ শুরু করছে, সে রকম তো না। গণহিস্ট্রিয়ার ব্যাপারটা তো আসলে একাত্তর থেকে আমাদের এখানে যেটা বুদ্ধিজীবীতার ডেভেলপমেন্ট হইছে, তার ভেতরেই আছে। এই ডেভেলপমেন্টে দেখবেন, এইটা এই গণহিস্ট্রিয়ার জ্বালানি হিশেবে তৈরী হইছে। এর বাইরে নিজেদের আর কোন ডেভেলপমেন্ট ঘটায় নাই। এটা নিয়ে আমি লম্বা লেখা লিখেছিলাম। এখন শাহবাগ আমাদেরকে প্রথম বড় ঘটনার মাধ্যমে দেখিয়ে দিলো যে, দেখো, গনহিস্ট্রিয়ার চেহারাটা এরকম হইতে পারে আর কি! তাইলে, মানে, এই জিনিসটা শাহবাগে এসে শুরু হলো বা কোথায় গিয়ে শেষ হলো, ঘটনা তো সেরকম না। ঘটনা হচ্ছে, ইতিহাসের প্রত্যেকটা মোমেন্টের ভেতর থেকে আমরা আসলে কিছু আর্ন করি শেষ পর্যন্ত। শাহবাগ থেকে আমরা কিছু আর্ন করেছি। এবং শাপলা থেকেও, শাপলা, আমি শাহবাগ ভারসেস শাপলা যেটা পপুলারলি বলা হইতেছে, আমি খুব সচেতনভাবেই এইখানে শাপলা শব্দটা এইভাবে বলি না। কারণ শাপলা যখন বলবো, তখন ব্যাপারটা হচ্ছে শাহবাগ ভারসেস শাপলার ভেতরে আমি থেকে যাবো। আমি এর বাহিরে থেইকাই ইতিহাস পড়ি। আমি হেফাজত বলি সরাসরি।—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: তো হেফাজতের ব্যাপারটাও কীরকম ছিল, হেফাজত আসলে একটা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মোমেন্টে কিছু নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনারে রেসপন্স করতে সক্ষম হইছিল। এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কিন্তু দেখেন, এখন না শাহবাগের কোন গুরুত্ব আছে, না হেফাজতের গুরুত্ব আছে। কিন্তু এই ‘গুরুত্ব নেই’ ঘটনাটা দিয়ে সেই সময়ে তারা যে ঐতিহাসিক ভূমিকাগুলো পালন করছিল, তা নেই হয়ে যায় না আর কি! এগুলা খুবই, খুবই সিগনিফিকেন্ট ঘটনা ছিল। এবং এগুলো আরো বহুদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পলিটিকসে, বুদ্ধিজীবিতায় ভ্যালুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মানে, পাঁচই মে যেইটা মতিঝিলে যৌথবাহিনীর অভিযান ছিল—

আবু তাহের তারেক: আচ্ছা।

রিফাত হাসান: সেই অভিযান তো বহুদিন ধরে আমাদের এখানকার ভ্যালুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কথাবার্তা, পলিটিকস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ, থামিয়ে দেওয়া হইছে এখানে, এই ঘটনাগুলো। এবং আরেকটা জিনিস হচ্ছে যে, শাহবাগ আর হেফাজতের উত্থানের একটা বড় গুরুত্ব হচ্ছে যে কি জানেন, হেফাজতের উত্থানের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে, সুরঞ্জন যেইটা বলতেছিল একটু আগে, মাদরাসা ছাত্র বা বাংলাদেশে ইসলাম ঘরানার লোকজন, ইসলাম ঘরানার লোকজন কিন্তু বড় একটা অংশ বাংলাদেশে। এবং মানে ইসলাম ঘরানার লোকজনও যেভাবে ধরেন, কবিতা লেখে, নিজের মনের আনন্দে কবিতা লেখে, কবিতা পড়ে, তারপর হচ্ছে তারও যেমন একটা দিনযাপনের, বিনোদনের ব্যাপার আছে। মানে, কালচার, নিজের একটা জগত তৈরী করার ব্যাপার আছে। এগুলার, এই ব্যাপারগুলো কিন্তু আমাদের আলাপের ভেতরে সবসময় অপর হয়ে ছিল। তারা সে সময় খুবই দূরের একটা ঘটনা ছিল। কিন্তু শাহবাগ, হেফাজতের ঘটনা হচ্ছে যে, হেফাজত, যদিও ধরেন, পলিটিক্যালি এই মুহূর্তে তেমন কোনরকম ইম্পেক্টই নাই। কিন্তু হেফাজতের ঘটনাটা মাদরাসার ছাত্রদের একটা, মানে, বুদ্ধিবৃত্তিক থেকে শুরু করে, ভালো উত্থান তৈরী করে দিছে। এই উত্থানটা এমন, যে, এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তারা আর অপর হয়ে থাকবে না। এটা কিছুটা যদিও মনে হবে আপনার, এই জিনিসটা কি কোন প্রতিক্রিয়া? তা, যে কোন ঘটনাই প্রথমে প্রতিক্রিয়া দিয়ে শুরু হয়। তো, এই প্রতিক্রিয়াটার, এটার ভেতর দিয়েই আপনি দেখবেন যে, এর ভেতর থেকে একটা, মানে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে মাদরাসার ছাত্রদের যেটা অংশগ্রহণ, সেটার একটা খুবই মিনিংফুল কিছু বাঁক তৈরী হবে সামনের দিনগুলোতে। এখন, আমাদের অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব দেখতেছি, বন্ধুবান্ধব, মানে ফেসবুকে যাদের সাথে পরিচয়, যাদের সাথে বাস্তবেও পরিচয় হইছে কখনো কখনো, যাদেরকে কখনো আমরা খেয়ালই করি নাই, এই মাদরাসার থেকে উঠে এসে এই ছেলেপেলেগুলা এমন সব কথাবার্তা বলতে পারতেছে। এইসব কথাবার্তাগুলো তো আগে কখনো কল্পনাই করা যায় নাই। আমি নিজে মাদরাসা থেকে সে রকম, মাদরাসার লিগেসি বেশী বহন করি নাই বলে এখন সেভাবে ভাবতে পারতেছি না, ঘটনাগুলো কেমন হইত আমি থাকলে। কিন্তু, যারা একদম পুরো সময়টাই মাদরাসায় কাটাইছে, মাদরাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে আবার কবিতা লেখতেছে। খুবই ভালো ভালো কবিতা লেখতেছে। অসাধারণ কবিতা লিখতেছে তারা। তো এগুলো তো আগে সম্ভব ছিল  না।—

আবু তাহের তারেক: এইটা আসলে সম্ভব ছিল না কীভাবে বলি। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যে জড়িত, চিন্তক, বা অনেক লোকই আসলে মাদরাসা থেকে উঠে আসা। যেমন জহির রায়হান মাদরাসা থেকে আসছেন। তারপরে, তারেক মাসুদ মাদরাসা থেকে আসছেন। আপনি মাদরাসা থেকে আসছেন। আমি নিজে মাদরাসা থেকে আসছি। তারপরে সাম্প্রতিক সময়ে আমি যদি চিন্তা করি, হাসান রোবায়েতের ঘটনা, যে কবি হিসেবে উঠে আসার ব্যাপারটা এই যে, শাপলার ঘটনার আগের। মানে, জাস্ট আমার পরিচিত হিশেবে বললাম আর কি! তো, মাদরাসা থেকে উঠে আসা লোকের ঘটনা বা আর্টের লগে ইন্টারেকশনের ঘটনা আমার কাছে মনে হয় এখন হয়তো একটু সিগনিফিক্যান্ট আকারে আসতে পারে। বাট আগেও ছিল । আমি এটা বলতে চাইতেছি আর কি!—

রিফাত হাসান: আগে বলতে কত আগে ছিল? আপনি এটা কি হেফাজতের উত্থানের আগে, এটা তেমন দেখছেন? আমার মনে হয় না।—

আবু তাহের তারেক: না, এইটাই তো আমি বল্লাম। জহির রায়হান…

মাহবুব মোর্শেদ: তারেক, আমার যেটা মনে হয় যে, রিফাত হাসানের যেটা পর্যবেক্ষণ, সেটা হলো ঠিক আছে। মানে, এটা আগে ছিল। কিন্তু সেগুলো এখন যেমন আমরা এইটা দেখতে পাই একটা বড় আকারে, মানে একটা পর্যবেক্ষণ হিশেবে দাঁড় করাতে পারি, সেটা আগে ছিল না। আগে অবশ্যই ছিল, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যাক্তি মাদরাসা থেকে আসছে। সে রকম মাদরাসা তো আমাদের এ শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘ দিন ধরে আছে।

রিফাত হাসান: এগজাক্টলি।—

মাহবুব মোর্শেদ: ফলে সেটা ছিলই। তো, আমার কাছে মনে হয় কি যে, আলোচনাটা একেবারে শাহবাগ, শাপলা, তাত্ত্বিক নানা আলোচনার মধ্যে গেলে, রিফাত হাসানের উপরে যে আমরা আজকে যে বিশেষ ফোকাস করছি সেটা থেকে বোধহয় এক ধরনের সরে যায় আর কি!—

আবু তাহের তারেক: এটাই, এটাই আমি ভাবতেছিলাম। ওকে। তাইলে পরে—

মাহবুব মোর্শেদ: হাঁ, আমরা এইটা নিয়ে আলাদা আলোচনা করতে পারি। আলাদাভাবে কথা বলতে পারি। তো, আমার মনে হয়, আজকের মতো আমরা এই আলোচনাটা শেষ করি, নাকি?—

রিফাত হাসান: হু হু। শেষ করতে পারি।—

আবু তাহের তারেক: শেষ করার আগে, আরো অনেকে তো আছেন বোধ হয়। কেউ কেউ কি বলতে পারেন? যেমন সালাউদ্দিন শুভ্রের কথাগুলা আমার ভালো লাগছে।—

মাহবুব মোর্শেদ: শুভ্র বললো, মানে একটা ইন্টারভিউ তো ইন্টারেক্টিভ হইলে ভালো। রিফাত হাসানের কথাগুলো আমরা শুনছি। সেই মুডটা কিন্তু আর ফিরবে না। ঐ মুডটা হলো একেবারে ইন্টেন্সিভ আলোচনার মুড। সেটা বোধ হয় এখন আর ফিরবে না।—

রিফাত হাসান: (হাসি)।

মাহবুব মোর্শেদ: রিফাত যদি রাজি থাকে, আমরা শেষ করে দিই নাকি?—

রিফাত হাসান: হু। শিওর। শেষ হোক।—

মাহবুব মোর্শেদ: আমরা এই আড্ডা তো এইখানেই শেষ না। আমরা আরো আড্ডার আয়োজন করবো। আমার মনে হয় যে, আজকের মতো শেষ করি। কারণ, আড়াই ঘন্টা হয়ে গেছে। 

রিফাত হাসান: হু হু। একদম।

মাহবুব মোর্শেদ: আপনাকে আবারো জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। যারা এতক্ষণ আমাদের কথা শুনলেন, সবাইকে ধন্যবাদ দিই। কারণ, অনেক ধৈর্য ধরে, দীর্ঘ সময় ধরে শুনছেন। আবার কথা হবে। নানা বিষয়ে আমরা কথা বলতেই থাকবো। ক্লাব হাউজে। আমাদের সঙ্গে থাকবেন।—

রিফাত হাসান: ঠিক আছে মাহবুব ভাই। ধন্যবাদ। আমারও বেশ ভালো লাগলো। আর যারা কথা বলেছেন, তারাও অনেক ধৈর্য ধরে অনেক শুনেছেন। কথা বলেছেন। থ্যাঙ্কিউ সবাইকে।—

মাহবুব মোর্শেদ: থ্যাঙ্কিউ।—

মাহবুব মোর্শেদ, কথাসাহিত্যিক। বুদ্ধিজীবী।

Leave the first comment