১.
ফয়সল আরেফিন দীপন ও তার বাবা আমাদের অস্বস্তি তৈরি করেছেন। একটি হত্যাকাণ্ডে প্রচুর আবেগ তৈরি হয়। স্মৃতি ও স্মৃতিকথা আসে। মিডিয়া সেইসব নিয়ে মাতে। যে কোন ঘটনার এরকম কিছু গল্প, স্মৃতি ও আহাজারি থাকেই। মিডিয়া, এমন কি তার বন্ধুরাও মিডিয়ার অনুবর্তী হয়ে এমন কিছু আহাজারিই হাজির করছেন, আর তেমন কিছু দেখছি না।
এই আবেগ ও নিরাবেগের বন্যায় মিডিয়া ও অন্যান্য ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো কোন কাহিনীটি কীভাবে হাজির করছে, কোনটিকে আড়াল করছে, তার রাজনীতিটুকু পাঠ করার ধৈর্য আমাদের থাকে না, আমরা ভুলে যাই।
দীপনের মৃত্যুতে এরকম অনেকগুলো অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
যেমন, তিনি একদিকে নিহত ব্লগার অভিজিত রায়ের প্রকাশক, আবার অন্যদিকে সরকারের অপছন্দের লোক, বিদ্যমান রেজিমের প্রতি ক্রিটিক্যাল, ক্ষুরধার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হক তার বাবা। ভদ্রলোকের মধ্যে, অনেকেই আর এক ফজলুল হকের ছায়া দেখতে পান, বিশেষত যখন দেখেন, তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে অভিজিত রায়ের প্রকাশক, সম্ভবত। দীপন তো গণজাগরণেরও কর্মী, ছিলেন। হক সাহেব নয়া দিগন্তে লেখেন, এই ব্যাপারটি হয়ত তখনও তেমন জানা শোনা হয় নাই অনেকের, কারণ উনি বেশ নিভৃত ধরনের লোক, আমারও অভিজ্ঞতা বলে। ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোকে তোওয়াজ না করার, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে উড়িয়ে দেবার একটা ব্যাপার তার মধ্যে আছে। এজন্য তার আশ-পাশের, অন্তত হৈহৈবাজ লোকেরা তার ব্যাপারে ব্যাপক অস্বস্তিতে থাকেন, আমি দেখেছি।
এর মধ্যে গণজাগরণসহ প্রগতিশীল লোকেরা নিজেদের লোক হিশেবে এই হত্যার প্রতিবাদ করে ফেলেছে। ফলত, দীপনকে ‘শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক’ বইলা খালেদা জিয়ার বিবৃতি নতুন অস্বস্তি তৈরি করেছে। কিন্তু দীপনের বাবা এইসবের ধারে কাছে না গিয়েও যখন বললেন, আমি বিচার চাই না; তখন সবচেয়ে বড় অস্বস্তিটা তৈরি হল। পুতুপুতুভাবে রাষ্ট্রের অবিচারের কাছে ধর্না না দিয়ে রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি প্রকাশ্য অনাস্থা আনলেন। এই অনাস্থার ব্যাপারটি রাষ্ট্র কীভাবে নেবে? রাষ্ট্রের ইগোর জায়গাটি কতটা প্রতিক্রিয়াশীল, তা জানতে ও বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করার দরকার হল না, একজন আওয়ামীলীগ নেতা স্বয়ং পিতাকেই হত্যাকারীদের দোসর বললেন। তার মতে, বাবার দলের সমর্থকরা অভিযুক্ত হবে, তাই বাবা সন্তানের হত্যার বিচার চান না। যেন, বিচার চাই না— এই ব্লাসফেমি থেকে দীপনের বাবার নিস্তার নেই। হয়তো, রাষ্ট্রদ্রোহ বা আদালত অবমাননা মামলার শিকার হবেন জনাব হক। অসামান্য ব্যাপার।
মোটামুটি তুলনারহিত। শিষ্টাচারের সব সীমালঙ্ঘন, একজন বাবা ও শিক্ষকের প্রতি।
এইরকম একটি মন্তব্যের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামত, এমনও একটা সময় ছিলো। কিন্তু এখন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় বইলা কিছু নেই। তার বদলে ওই জায়গাগুলো স্রেফ উন্নয়ন ভাবনায় কাতর তরুণদের কনজারভেশন সেন্টার হিশেবে ব্যবহৃত হয় এখন। ফলত, একজন পুত্রহারা পিতা ও শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হকের অবমাননাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি ধুলোর মত হাওয়া হয়ে উড়ে যায়। এই ব্যাপারটি কেমন?
বেশ কিছুদিন আগে, একজন কিশোর লেখক ও শিক্ষকের বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটি মিডিয়া ও তরুণদের অনুভূতিতে উত্তেজনা তৈরির জন্য ভাল একটা দৃশ্য হইছিল। এ দৃশ্যের যাবতীয় ন্যাকামো, ও ভণ্ডামি ধরা পড়ার পরও, সেই অমর দৃশ্য নিয়ে আমাদের সাংবাদিক ও তরুণদের নস্টালজিয়া যায় নাই বহুদিন। এই নষ্টালজিয়া কখন ঘটে, এর সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি নিয়া আলাপ করছিলাম আমি।
জনাব হকের এরকম কোন বৃষ্টিতে ভেজার মতো ইমেজ বা রোম্যান্টিক মূর্তি তৈরি হওয়া সম্ভব নয় বটে। তিনি এইসব মূর্তি ভাঙার মানুষ, গড়ার নয়। তবে এটি সত্য, এই অবমাননা ও অমর্যাদার ব্যাপারটি কেমন, তা বুঝে ওঠার পর্বটির জন্য আমাদের যে ভ্রমণের দরকার, তার জন্য আমরা এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি হারিয়ে ফেলেছি।
২.
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কোন চোরাগুপ্তা ব্যাপার নয়, প্রকাশ্য জনসমাগমের ভেতরে, সশস্ত্রভাবে হামলা হয়েছে প্রত্যেকটিতে। স্বভাবতই এ পর্যন্ত প্রত্যেক খুনেরই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো। কিন্তু, কোন খুনের সময়ই প্রত্যক্ষদর্শী এগিয়ে আসে নাই প্রতিরোধে। কেন?
প্রথমত, এমন হতে পারে, সব সময়ই প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে থাকে, এরা কারা? সরকার সমর্থিত কেউ নয় তো? ছাত্রলীগ বা গোয়েন্দাসংস্থা বা অন্য কোন বিশেষ বাহিনী? শান্তিরক্ষী? প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষে, নিজেরা একত্রিত হয়ে একটি খুনকে মোকাবেলা করা সম্ভব। খুনীকে ধরে ফেলা, শায়েস্তা বা অন্তত প্রতিরোধ সম্ভব।
কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই ভেতরে বাস করে রাষ্ট্র। যার মানে হল বন্দুকের নল। রাষ্ট্র যদি খুন করতে নামে, তার হরেক ধর্মীয় বিধি বিধান সহ নাম আছে, যেমন ফাঁসি, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, ‘জঙ্গি’— এইসব। এইসব ধর্মীয় বিধিবিধানসমেত রাষ্ট্ররে আমরা ভয় পাই। রাষ্ট্রের বাইরে একটি খুনকে মোকাবেলা হয়ত সম্ভব, কিন্তু রাষ্ট্র যখন বন্দুকের নল নিয়ে আপনার পেছন ছুটবে, আপনি তার ভয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে থাকেন। আপাতত বাংলাদেশে এরই নাম নাগরিক। ফলত, রাষ্ট্রের অন্ধ, বধির ও বাধ্য নাগরিক হয়ে, আমরা ধীরে ধীরে মানুষ হিশেবে মরে আছি। এক একটি পঁচা দুর্গন্ধওয়ালা থলথলে মাংস বিশেষ, যে ভয় পায়।
আমরা এক অদ্ভুত ভয়ের গুহা ও সংস্কৃতিতে বাস করছি, যে শুধু নিজেরেই বুঝে, যাচে, পূজা করে, কোনমতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আর কিছু নয়। একজন বন্ধু খুন হবার সময়ে এগিয়ে আসে না। অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে। এই ভয় থেকে নিস্তার নেই। গৌতম বুদ্ধ এই আত্ম, এই অহমের থেকে নিস্তারের জন্য নির্বাণ প্রস্তাব করেছিলেন। আমাদের নির্বাণ কীভাবে হবে, আল্লাহ মালুম। রাষ্ট্রের, নাকি এইভাবে খুন হতে হতে নিজের বিলয়ে?
৩.
এ পর্যন্ত খুনগুলো যে পরিকল্পিত, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। প্রত্যেক খুনের পরেই তার দায় স্বীকার করা হচ্ছে, তারো আগে ক্ষমতাসীনরা ও পুলিশ প্রশাসন হত্যাকারীদের ব্যাপারে আগাম অনুমান হাজির করেছে তৎক্ষনাৎ। যেন এর বাইরে কোন কিছুই ঘটার নেই দুনিয়াতে, সবই এই সমীকরণে বাঁধা। প্রত্যেকটি অনুমানই একই গ্রুপ বা বিরোধী পক্ষকে উদ্দেশ্য করে। এর মাধ্যমে আমাদের এমন ধারণা হওয়া সম্ভব, এইসব খুন কিংবা খুনীদের ব্যাপারে সরকার পুরোপুরি অবগত ও সচেতন আছেন, তাই হেলে দুলে, ঠাট্টা মশকরা দিয়ে বিষয়গুলোরে হালকা কইরা রাখতে চান। যেন, কিছুই ঘটে নাই, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া।
বিপরীতে, এখন পর্যন্ত একটি খুনেরও সঠিক তদন্ত হয় নাই, প্রত্যেকবার খুনী খুন করে বহাল তবিয়তে ধীরে সুস্থে পালাতে পেরেছে। প্রত্যেক খুনেরই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও প্রায়ই পাওয়া গেছে, যায় সাধারণত, খুনীদের ধরার অপেক্ষায়, এই ধরনের ব্রেকিং নিউজ আমরা প্রায়ই পাই। পেয়ে সুখী থাকি।
সম্ভবত, আঘাতকারীরা একটি আলোচিত খুনের মতলবে ছিলো। কাউরে আহত করা বাংলাদেশে খুব একটা বড় ঘটনা হিশেবে বিবেচ্য নয়। এটি খুনের নগরী। বড় কোন খুন না হলেও আলোচনায় আসে না। ব্লগার খুন একটু অতীত হইছে, সবাই এ ধরনের খুনে একটু সন্ত্রস্ত হলেও, বিরক্তও বটে। আপাতত গা সওয়া। এই গা সওয়া পরিবর্তনে কিছুদিন আগে যেমন বিদেশি হত্যা হল, পরপর দুবার। তাই, এইবার নতুন ক্যাটাগরি বেছে নেওয়া হইছে, সম্ভবত। প্রকাশক। টুটুল।
কিন্তু শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে, আহমেদুর রশীদ টুটুলের উপরে হামলা করে ব্যর্থ হয়। ওখানে অতিরিক্ত দুজন সঙ্গীসহ থাকার কারণেই, হয়তো টুটুল প্রাণে বেঁচে যান। যখন ব্যর্থ হয়ে গেছে বইলা দৃশ্যমান হয়, এমন ভাবা যেতেই পারে যে, এর পরেই পরবর্তি টার্গেট ঠিক হয়। দীপন। অথবা, হয়তো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে, সেরকমই, পরপর দুটি খুন একসাথে ঘটানোরই প্লান ছিলো। টুটুল সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, সে আমাদের সৌভাগ্য শুধু।
তবে, লালমাটিয়ার ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে।
আমার মনে হইছে, এটি প্রথম ঘটনা সম্ভবত, যেখানে এই ধরনের খুনগুলোর কোন একটিতে প্রতিরোধ হল। অন্তত উপস্থিত বন্ধুদের দ্বারা, নিজের জানবাজি রেখে। আহমেদুর রশিদ টুটুলের বন্ধু ভাগ্যই বলতে হয় এ ক্ষেত্রে। টুটুলকে মারতে আসা হামলাকারীদেরকে সম্ভবত প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন উপস্থিত দুই বন্ধু, তারেক রহিম ও রণদীপম বসু। তাই তাদেরও গুরুতর জখম হতে হল। এ ব্যাপারে কারো সরাসরি বিবরণ যদিও এখনো পাওয়া যায় নাই, ঘটনাপঞ্জি থেকে স্রেফ অনুমান করছি। যদিও বাইরের উপস্থিত দর্শককুল কেউই এগিয়ে আসে নাই, কিন্তু এই বন্ধুদের থেকে যাওয়া ও প্রতিরোধে অংশ নেওয়া, শুধু তাই নয়, জীবন বিপন্ন হচ্ছে জেনেও তাতে পিছপা না হওয়া, অবশেষে মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে সবার ফিরে আসা, এই সবই সিগনিফিকেন্ট।
আমাদের ভেতরে কিছু কি জাগছে? বন্ধুত্ব? সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির নতুন উত্থান সম্ভাবনা দেখতে পাই আমি।
৪.
হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারগুলো ফলো করেছেন কি? এ ব্যাপারে প্রচুর কন্সপিরেসি আছে। আপাতত কেউ সেটি তেমন বিশ্বাস করছে না। আমিও। তবে, বিচার বিশ্লেষণের জন্য একটু নোকতা নেওয়া যায়। যেমন, এতদিন হত্যাগুলোর দায় স্বীকার করত দায়েশ বা আইএস। এইবার দায় স্বীকারের খবর এসেছে আল কায়েদার। এটি চমকে যাওয়ার মত ঘটনা নয়, তবে যারা ঘটনাগুলোর পূর্বাপর ঘটনাপঞ্জি রাজনৈতিকভাবে বুঝতে অক্ষম, তাদের জন্য এখানে বিশেষ তত্ত্ব আছে।
আইএস এবং আল কায়েদা নিয়ে যাদের ন্যূনতম জানাশোনা আছে, তারা জানেন, উভয় গোষ্ঠীর স্বার্থ, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি এক নয়। ‘জঙ্গি’বাদ বলুন বা যাই বলুন, দায়েশ এবং আল কায়েদার মূল পার্থক্য আমি যেভাবে দেখি, দায়েশ এর দৃশ্যমান টার্গেট ইসলামিক স্টেট বা বিশ্বাসগত গোঁড়ামি দিয়ে একটা নতুন সাম্রাজ্য ফেনোমেনন তৈরি করা, যার নাম দিয়েছে ওরা ‘খেলাফত’। আর আল কায়েদার টার্গেট বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো, তাদের ভাষায় যা মুসলমানদের উপর জগদ্দল অন্যায়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ফলত, আল কায়েদা ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর উপরে হামলা করে, যেমন টুইন টাওয়ার। এখানে বিশ্বাসগত ফেনোমেনন খুব বেশি নেই বলে আমার পর্যবেক্ষণ। এই দিক থেকে আল কায়েদা যখন জেহাদের কথা বলে, তখন তা মোর রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আল কায়দার কোন খেলাফত জাতীয় ভাবনা বা প্রস্তাবনা খুব একটা চোখে পড়ে নাই আমার।
আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশে যখন জেএমবি সিরিজ বোমা হামলা ঘটাল, তাও কিন্তু এদেশের আদালতপ্রাঙ্গনেই ঘটিয়েছে, যা রাষ্ট্রের প্রধান ধর্মনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে জেএমবির সাথে আলকায়েদার সম্পর্ক কল্পনা করা হয়।
তো, ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর বাইরে, শুধু নাস্তিকতার কারণে কেউ আল কায়েদার টার্গেট এই ব্যাপারটা এ পর্যন্তকার আমার পর্যবেক্ষণে অবিশ্বাসযোগ্য। কোথাও এমন নজির নেই। অথচ, মজার ব্যাপার হলো, এই মুহূর্তের বাংলাদেশে আল কায়েদা, আই এস ভাই ভাই হয়ে একযোগে প্রেসরিলিজ ও চাপাতি হামলার তুফান বয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোতে এদের আঘাত কই? এটি কি ‘জঙ্গি’ রাজনীতির ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক উন্নতি/অবনতি বা রূপান্তর জাতীয় কিছু?
৫.
আরো কিছু কন্সপিরেসি করা যাক। তা আপাতত ছোট ছোট পয়েন্ট আকারে নোট করি। পরষ্পর সাংঘর্ষিকও হতে পারে, কিন্তু বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, যেমন, বাংলাদেশে এখন ক্ষমতার সর্বোচ্চ শেখরে সেক্যুলাররা, গুপ্তহত্যাগুলোও চলছে সেক্যুলারদের কে লক্ষ্য করে। হত্যাকারীদের কোন হদিসই পাচ্ছে না সরকার/ র্যাবের বহুত দাম দিয়ে কেনা পাগলা কুকুরগুলো। এইটা কতদূর সম্ভব কল্পনা?
আবার, এমনও অনেকেই ভাবছেন, এই মুহূর্তে দেশে রাজনীতিহীনতা বিরাজ করছে। এই রাজনীতিহীনতার ভেতরে যেটুক কথা বলবার সুযোগ ও সম্ভাবনা এখনো অবশিষ্ট আছে, তা হলো লেখক সাহিত্যিক, শিল্পীদের পক্ষ থেকে। এইটা বিকল্প মাধ্যম। এই মাধ্যমের উপরে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ পুলিশ র্যাব সমেত লাঠিপেটা করে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণের মতো উপায়ে অসম্ভব। তাই বিকল্প উপায় কী হতে পারে? অজানা ভয়, যেখানে আততায়ী সম্পর্কিত কোন তথ্য নেই। ফলত, প্রকাশকদের উপরে হামলা শুরু হল, এমন ভাবা যায় কি? কারণ এই ঘটনাগুলোর পরে, প্রকাশনা শিল্পে এর পরে আর কেউ সাহস করে এগিয়ে আসবার আগে কয়েক বার ভাববে। শুধু অনুগ্রহভাজন লোকেরা থাকবে, এমন।
হাঁ, এইভাবে, একের পরে এক যা দানা বাঁধছে, তা হলো কন্সপিরেসি। বিপরীতে একের পর এক খুন হতে থাকবে, তার সমাধা হবে না। যতক্ষণ আমাদের রাজনীতিতে কনসেনসাস তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনীতির পরিবর্তে ষড়যন্ত্রই তার স্থান দখল করেছে। কী ক্ষমতাসীন, কী যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, প্রত্যেকের একই অবস্থা। এই অবস্থার কারণে সবাই বিদেশি দূতাবাস, বন্ধু বা লবির উপরে ভরসা করে বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি বা ক্ষমতার বৈধতা নিতে তৎপর।
ফলত, এই সুযোগটির সঠিক ব্যবহার করে গুপ্তঘাতক গোষ্ঠী। যদি কন্সপিরেসি করি, বলা যায়, এই তৃতীয় শক্তি হতে পারে আইএস এবং তার ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর পরিচর্যাকারী পশ্চিমাশক্তি, মোসাদ, বা প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দাসংস্থাগুলো। বা বাংলাদেশের ভেতরের কোন সংস্থা? কারণ, সরকারও, অফিসিয়ালি বিশ্বাস করে না, এখানে আইএস বা আল কায়েদা আছে। অনেকেরই মনে থাকতে পারে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত নির্বাচনের সময়ে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ভারতের অতিরিক্ত মনোযোগের পর থেকে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। বা এরকম আরো আরো অনুমান সম্ভব। পরিস্থিতি কত জটিল আকার ধারণ করতে পারে, তা বোঝা যায়, গতকালকে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি নিজেও হত্যার সম্ভাব্য শিকার হতে পারেন। যদিও অন্যরা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও পরিস্থিতিরে ভাল বলেছেন, এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত করার গন্ধ পেয়েছেন এখানে।
যদিও, আদতে দুনিয়া একাত্তরে আটকে নেই— এটি সবাই জানে।
এই মুহূর্তের যারা জগতের সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে জামাত শিবির, স্বাধীনতাবিরোধীতা এইসব থেকে আমাদের বেরুতে দেয় না, তারা শয়তান বটে।
আমি সবসময়ই বলে এসেছি, এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের বিচার মানেও ঠিক যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়। এখন দুনিয়াতে স্বাধীনতার অর্থেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ষাটের দশকের স্বাধীনতা আর ২০১৫ সালের স্বাধীনতা এক নয়। এইটুকু বুঝ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা— এই ফাজলামো থেকে বের হতে আমাদের আরো কত বছর অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহ মালুম।
দুনিয়াতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধের যুদ্ধ শুরু হইছিল নাইন ইলেভেনের পরে। কিন্তু সেই যুদ্ধের প্রকৃতিও এখন এক নয়। আল কায়েদার বিপরীতে আই এস দাঁড়িয়েছে, মোর ফেনেটিক একটি গ্রুপ, যাদের রাজনীতি হল রাজনীতিগুলোকে নস্যাৎ করে আকাঈদ/অবিশ্বাসের কুট ঢুকিয়ে দেওয়া। দুনিয়া এখন পরাশক্তিগুলোর নতুন শক্তি পরীক্ষার জন্য অস্ত্র ও অর্থবলে জাঁকজমক সাজসজ্জায় তৈরি হয়ে আছে। ভূ কৌশলগত অবস্থানের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোতে নতুন লড়াই শুরু হবে। এই সময়টিতে স্রেফ যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের কসমোলজি নিয়ে আমরা বসে আছি, আমাদের গন্তব্য কোথায়?
৬.
তবে হাঁ, শেষমেষ আমরা একটা জাগায় এসে পৌঁছেছি। ফাঁসি চাই থেকে বিচার চাই না— এটি অন্য এক ভ্রমণ বটে। আমরা মূলত কখনোই বিচার চাই নাই, যখন ফাঁসি চেয়েছি তখন ফাঁসিই চেয়েছি, বিচার নয়। সেই অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় উত্তরণের মাজেযা হল, আমাদের বোধোদয়, যে, আমাদেরই ইচ্ছেমত এখানে অবিচার প্রতিষ্ঠিত হইছে, ফলত এখানে আর কখনোই বিচার সম্ভব নয়। ফলত আমরা বলছি, মানে, আমাদের বলতে হচ্ছে, বিচার চাই না।