fbpx

The
Rifat Hasan
Website

রিফাত হাসানের
অফিসিয়াল সাইট

Blogs

রিফাত হাসান

ভূমিকা অথবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ ও অন্যান্য

March 22, 2014   0 comments   2:01 pm

সে অর্থে, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আমি রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্র বলি। রবীন্দ্রমোহমুগ্ধতা এবং ভাববাদিতা, কাজেই মহাভারতের আবেগে ভারাক্রান্ত, যার নিজের কোন রাজনৈতিক প্রকল্প নেই, মহাভারত ছাড়া। মানে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলে যে বস্তুটা আমরা অভিজ্ঞতায় দেখছি আদতে সেখানে রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

Share

এই লেখাটি সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি বইয়ের ভূমিকা হিশেবে লিখিত হইছিল

১.

 

এই বইয়ের কোন প্রথাসিদ্ধ ভূমিকা থাকছে না।  তবে কিছু অমীমাংস নোট টুকে রাখা প্রয়োজন।  লেখাগুলোকে ইতিহাসের সাম্প্রতিক সময়ে জারিত করার জন্য।  একটা আলাপপর্ব।  ব্লগ ও মুক্ত গণ-যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিশেবে লেখা এই নোটগুলোর মধ্যে সূত্রধর হিশেবে।

 

সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি একটা জরুরি ভাব।  আলাপে অগ্রসর হবার জন্য এই ভাবটি গ্রহণ করেছি আমরা।  মানুষ হিশেবে প্রথমত নিজের অস্তিত্ব এবং অপর, তার বরাতে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি যার মধ্যে প্রতিদিন আমরা জারিত হই, লেখালেখি, বুদ্ধিজীবীতা ও নন্দন চর্চা করি, এইসবের একটা বিচার বিবেচনা খাড়া করার কর্তব্য পালন।  আমরা বলেছি, রাজনীতি হলো সম্পর্কের জ্ঞান।  এবং মুআমিলাতেই রাজনীতির প্রকাশ ঘটে।  সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির এই ভাব থেকেই এই বইয়ের আলাপ ও প্রসার।  এই বইয়ে আমাদের আলাপের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, আরো বিশেষভাবে বললে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকলেও, মূলত সেই সম্পর্কসূত্র বোঝাপড়ার সাধনা।  আমরা যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর ভিত্তিতে নাগরিক হিশেবে আমাদের কর্তব্য নিয়ে কথা বলি, তখনও এই সম্পর্কসূত্র থেকে বলি।  তার অংশ হিশেবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন, ক্ষমতা, সংবিধান, গণ-আকাঙক্ষা, নাগরিকতা, ভায়োলেন্স, জাতীয় স্বার্থ এইসব বিষয় আলাপের প্রয়োজনে ঘুরে ফিরে হাজির থেকেছে।   ইতিহাসে বাংলাদেশের উত্থানের ঘটনাকে একাত্তরের গণ-মুক্তিযুদ্ধের দিক থেকে আমরা বাংলাদেশ বিপ্লব বলে অভিহিত করেছি আমাদের বয়ানে।  বাংলাদেশের এই উত্থানপর্ব আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি বলে মনে করি আমরা।  কিন্তু গণ-মুক্তিযুদ্ধের পরের হঠকারি নেতৃত্ব নিজেদের দুর্বৃত্তপনা, ক্ষমতা ও অক্ষমতার প্রয়োজনে এই বিপ্লবকে আত্মসাৎ করেছেন এবং একটি প্রতিবিপ্লবী রাষ্ট্র ও নাগরিকসমাজ কায়েম করেছেন, আমাদের বিবেচনায়।

 

এই প্রতিবিপ্লবী নাগরিকসমাজের প্রতিনিধি হিশেবে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণীর ভাবনা-চিন্তার একটা বড় স্রোত একাত্তর থেকে এ পর্যন্ত সুবিধাবাদী।  ফলত, স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে মৌলিক ভাবনা ও বুদ্ধির চর্চা অনুপস্হিত এখানে।  আবার যারা এই সুবিধাবাদের বাইরে, তারা সিরিয়াসলি ভাবতে ইচ্ছুক নন, সরল ও অবিকশিত থেকে গেছেন।  যে যার রোমান্টিক জায়গায় সীমাবদ্ধ, কুপমণ্ডুক।  রাষ্ট্রের কোন ঐতিহাসিক পর্যালোচনা দাঁড় করাতে অক্ষম।  যার কারণে আমরা সব সময় অতীতচারি, স্মৃতিকথক, কোন বোঝাপড়ায় নেই।  এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবাসনার জায়গায় যে গোলযোগ তৈরি হয়ে আছে, তার ফলে রাষ্ট্রের পরিণত, মৌলিক, গতিশীল ও অবজেক্টিভ ক্রিটিক দাঁড়ায় নাই।

 

মূলত গণ-মুক্তিযুদ্ধের ভাবটি গরহাজির রেখে, কায়েমি নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীমহল বাংলাদেশ বিপ্লবের ঘটনাকে জাতীয়তাবাদের নামে একটি ইমোশনাল সুপারইগো হিশেবে হাজির করতে সচেষ্ট হয়েছে সবসময়।  এই কাজে বহুল ক্ষেত্রে তারা সফলও।  যেহেতু কোন পর্যালোচনা দাঁড়ায় নাই, বাংলাদেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্র ব্যাপারটি স্রেফ ইমোশনাল থেকেছে।  আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি যেমন।  স্কুলে দাঁড়িয়ে গান গাওয়া, সিনেমা হলে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়া, লাল সবুজের পতাকা, নিরবতা পালন এইসব।  এই ইমোশনের জায়গায় এখানে উপস্হিত হাজার হাজার টানাপোড়েন, ক্লাসের দ্বন্দ্ব, বৈশ্বিক পাওয়ার-সুপার পাওয়ারের ফেনোমেনন, এগুলোর যে ইমপেক্ট, তার বোঝাপড়ার জায়গাটা গরহাজির থেকেছে সবসময়।

 

ফলত রাষ্ট্রের যে আধিপত্যশীল ভূমিকা, নাগরিকদের সবদিক থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, সে যে অর্থেই হোক, তার ব্যাপারে স্বাধীন আলাপ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাংলাদেশে গুরুত্বের সাথে চর্চা হয় নাই।  যদিও বাংলাদেশ বিপ্লবের মূল ভাব সেই প্রশ্নেই নিহিত, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার।  দেখা যায়, কীভাবে তারা শাসিত হবেন, এই প্রশ্নচিহ্নের বিপরীতে দলবাজ বুদ্ধিজীবীরা যাই বলেন, সেটাই দুই পক্ষের দাঁড়িয়ে যাওয়া আম সাধারণের বড় অংশ মুখস্ত মেনে নেন, প্রশ্নহীনভাবে।

 

এটাও নোট রাখা জরুরি, রাষ্ট্রের কায়েমি পক্ষ কখনো প্রশ্নের সুযোগ রাখে নাই; সাংস্কৃতিকভাবে।  তাই এ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রের অবজেক্টিভ পর্যালোচনার ঐতিহ্য দূরঅস্ত, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীতার বাইরে কিছু হয় নাই।  রাষ্ট্রের যে কোন ননপার্টিজান সমালোচনাকে অপরাধ হিশেবে নেওয়া হয়েছে সবসময়।  এই অপরাধ ঘোষণায় সবার আগে এগিয়ে এসেছে সেই গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।  রাষ্ট্রদ্রোহ ইত্যাদি নানান প্রত্যয় দিয়ে যে কোন প্রশ্ন ও সমালোচনাকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখার অস্ত্র ও মুখপাত্র হয়েছেন তারা।  ভিন্নমতকে দলন করা হয়েছে, ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে হত্যা করা হয়েছে।  এর নাম দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদ।  ফলত বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিশেবে আত্মতুষ্ট ও অটোক্রেটিক থেকেছে সবসময়, নাগরিকদের কাছে।  এবং রাষ্ট্র ও তার কায়েমি পক্ষের জননিপীড়ন ও বিরোধীদের উপরে প্রতিশোধের সংস্কৃতি হেতু একটি জাতীয় প্যানিক সাইকোলজি তৈরি হয়েছে, জাতীয়তাবাদের নামে।  যেখানে একটি স্মৃতিকাতর ও জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় পরিণত হয় যে কোন রাষ্ট্র বিষয়ক আলাপ এবং তৎপরতা।  বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যখন দেশপ্রেম এর কথা বলেন, তখন এটি স্রেফ ফ্যাসিজম এর বয়ান হয়ে দাঁড়ায়।  নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও প্যানিক ছড়িয়ে দেয়।  এর ফলে নাগরিকতা নিয়েও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে কোন গুরুতর আলাপ দেখা যায়নি।  সবাই ভয়ে ও সংকোচে থেকেছে, যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে যায়।

 

সেই প্যানিক সাইকোলজি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তাড়া করছে।  আতঙ্কের, ভয়ের এবং প্রতিশোধের।  এই সাইকোলজি মানুষের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট করে দেয়।  মানুষকে জড় ও পশুতে পরিণত করে।  মানুষ সর্বক্ষণ কল্পিত শত্রু বা বাস্তব শত্রুর হামলা বা প্রতি-হামলার ভয়ে থাকে।  তখন যাবতীয় চিন্তা, কর্ম ও তৎপরতা এই প্যানিক সাইকোলজির আবহে রূপ লাভ করে।  বিনা বিচারে গুলি করে মেরে ফেলার, আসামী ধরার নামে নাগরিকদের ঘর-বাড়ি জ্বালানোর যে ঘটনা প্রশাসনের দিক থেকে, বা পিটিয়ে খুন করার, ধরে ধরে জবাই করার যে শ্লোগান, মানসিকতা ও সংস্কৃতি জনসাধারণের মধ্যে, তা এই প্যানিক সাইকোলজির উন্মত্ত ফলাফল।

 

এই ঘটনাগুলো এমন, রাষ্ট্র-রাজনৈতিকতা বিষয়ে উন্নাসিকগণ প্রথম জগদ্দল বুঝে উঠার বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এর ভিকটিম হওয়ার মধ্য দিয়ে।  সেই বুঝে ওঠাটা হলো, রাষ্ট্র শুধু ইমোশনের বিষয় নয়, এইটা প্র্যাকটিক্যালিও হাজির থাকে, জান্তব হয়েই।  বেওকুফ আমরাই শুধু কাল্পনিকভাবে গরহাজির থাকি রাষ্ট্রে, দেশপ্রেমান্ধ হয়ে।  মূলত যখন রাষ্ট্রের কোন পর্যালোচনা হাজির থাকে না, তখন দেশপ্রেম একটি ভাবালুতা ও ফ্যাসিজমের বয়ান তৈরির হাতিয়ার বৈ কিছু নয়।

 

এই প্রেক্ষিতে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশের উত্থান মুহূর্তে ভূমিকা পালনকারী দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী, বুর্জোয়া (সরলিকৃত অর্থে) মধ্যবিত্ত শ্রেণী-উদ্ভূত পলিটিক্যাল এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী ইন্টালেকচুয়াল এলিট; উভয়ের পাকিস্তানি হেজিমনির বিরুদ্ধে যে দৃশ্যত অবস্হান ছিল, তা বাংলাদেশ-বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার চরিত্রের মৌলিক কোন ট্রান্সফরমেশন ঘটাতে পারে নি।  ফলে এই উভয়বিধ শ্রেণী বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ- হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভেতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়েন ও শক্তির জায়গাগুলো- ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।  দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর আবহ নিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের যে জনপ্রিয় আগ্রহ বর্তমানে জারি আছে তাতে উল্লিখিত দুটি শ্রেণীরই ইমেজ বীরসুলভ, পর্যালোচনামূলক নয়।  তাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রেডিক্যাল পুনর্গঠনে উভয়ের যে মৌলিক ভূমিকা পালন করা সমভব ছিল, সেটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় প্রবলভাবে অনুপস্হিত।

 

এই অবস্হায়, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও বাংলাদেশ নিয়ে একটি পর্যালোচনা দাঁড় করানোর জন্য আমাদের আরো তুমুল বিতর্কে যাওয়া উচিত।  স্মৃতিকথা প্রচুর হয়েছে।  এই স্মৃতিকথার বাইরে এসে আলাপ দরকার।

 

আলাপের এই পর্বে আরো কিছু নোক্তা দেওয়া দরকার।  প্রথমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ দিয়ে শুরু করি।  পাঠক মহোদয়গণ, পাপ নেবেন না।

 

২.

 

সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা লিখতে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণ লিখতে হচ্ছে, এইটা একটা চমৎকার করুণ নিয়তি আমাদের।  ‘মহাকবি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জন্য ধানের শিসের শিশিরবিন্দু থেকে ‘মহাভারতের সাগরতীর’র প্রকল্প রচনা করেছেন।  বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভূখণ্ডগত দিক দিয়ে এই মহাভারত দ্বারা তিন দিক পরিবেষ্টিত।  ঐতিহাসিকভাবেও মহাভারতের পাত্রপাত্রিরা এই ভূখণ্ডের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন, জমিদারি করেছেন।  আবার দেখুন, রবীন্দ্রনাথের গান রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত।  এবং এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন এই নতুন রাষ্ট্রের প্রাতঃস্মরণীয়।  আমরা চাই বা না চাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে হাজির থাকবেন সব সময়, বিধির বিধান হিশেবে।  তাই এই নিয়তি এড়ানো যায় না।  স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিয়তিও এর ভেতরে ঢুকে গিয়ে রীতিমত হাঁসফাঁস করছে।

 

সে অর্থে, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আমি রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্র বলি।  রবীন্দ্রমোহমুগ্ধতা এবং ভাববাদিতা, কাজেই মহাভারতের আবেগে ভারাক্রান্ত, যার নিজের কোন রাজনৈতিক প্রকল্প নেই, মহাভারত ছাড়া।  মানে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলে যে বস্তুটা আমরা অভিজ্ঞতায় দেখছি আদতে সেখানে রাষ্ট্র বলে কিছু নেই।  আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

 

এই প্রেক্ষিতে, সর্বসম্প্রতি পত্রিকায় পড়া একটি বিবরণী নোক্তা হিশেবে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।  বাংলাদেশের ইসলামপন্হী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামিকে জনপ্রিয় অর্থে রবীন্দ্রবিরোধী হিশেবে সামনে নিয়ে আসা হয়।  সমভবত পাকিস্তান পিরিয়ডের অভিজ্ঞতায়, তখন রেডিওতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।  যদিও আমরা মনে করি না, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক পাঠ করতে সমর্থ হয়েছেন তারা।  ওদের যেটুকু বিরোধিতা, তারে আপনি দুইভাবে পাঠ করতে পারেন।  এক. বাংলা কাব্যের ভাব বোঝার জায়গায় সাংস্কৃতিক অনভ্যস্ততা, যাতে তাদের কাছে আদতেই রবীন্দ্রনাথ নামের মহামুনির কোন ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই, শুধু জাতীয় সংগীত ছাড়া।  সেক্ষেত্রে নজরুল তাদের অনেক কাছের, কারণ নজরুল ফুল পাখি লতা পাতা ছাড়াও যে বিদ্রোহের কথা লয়ে আসেন কবিতায়, তা উপনিবেশে বেড়ে ওঠা বাঙালির ইতিহাস ও মুক্তির আকাঙক্ষায় আরাধ্য ছিল এবং তাদের সাথে সহজে কথা কয়।  দুই. এই অনভ্যস্হতার কারণে সাম্প্রদায়িক অর্থে হিন্দু রবীন্দ্রনাথকে তারা অপছন্দ করে থাকতে পারেন।  আমরা মনে করি, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রবীন্দ্র-বিরোধিতাও সাম্প্রদায়িক আক্রোশ-উদ্ভূত ছিল।

 

তো, সর্বসম্প্রতি আওয়ামী লীগ এমপি গোলাম মওলা রনি তার কারাগারের দিনলিপিতে জামাতের শীর্ষ নেতা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আব্দুল কাদের মোল্লার গলায় মধুর রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিবরণ দিয়েছেন, যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।  মোল্লা সাহেবের গলার স্বর কতটা মধুর, তার গান কোন জাদুতে কারাগারে মানুষদের টেনেছে, সে ব্যাপারটি আমার আগ্রহের জায়গা নয়।  বোধ হয় তার গানের কণ্ঠ ভালই ছিল।  আমার আগ্রহ অন্য, যে কারণে এই বিবরণীটি এখানে দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না।  সেটি হল, এই ঘটনায় আমাদের পূর্বধারণাই প্রবল হয়েছে।  জামায়াত শিবির যদি রবীন্দ্রবিরোধী হয়েই থাকে, তা রাজনৈতিক নহে।  সাম্প্রদায়িকও নয়।  সাংস্কৃতিক অনভ্যস্ততা মাত্র, যা রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্রবলয়ের ফাঁসির কারাগারে বসেও তাকে মধুর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বাঁধা দেয় না।  রবীন্দ্র-ভাবালুতা বা সাম্প্রদায়িক আক্রোশ নয়, রাজনৈতিক বোধ-বুদ্ধি থেকে রবীন্দ্র-পাঠ হলে খুব কাজের হতো বলে মনে করি।

 

বলছিলাম, রাষ্ট্র নেই।  আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।  যেমন ‘আমার সোনার বাংলা’।  মানে রাষ্ট্র-কল্পনা।  কমিউনিস্টদেরও একটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় কল্পনা আছে, রাষ্ট্র নেই, ‘রাষ্ট্র শোষক শ্রেণীর বল প্রয়োগের হাতিয়ার’ ইত্যাদি।  কল্পনা বলছি, কারণ এই রাষ্ট্র থাকা না থাকার শর্তগুলো, তার ‘বলপ্রয়োগ’ ইত্যাদি বচনে অভিমান আছে, রাষ্ট্র নিয়ে বোঝাপড়া নেই।  এই রাষ্ট্র কখন থাকে, তার ভিত্তিও কল্পনা।  যেমন ধরুন, জাসদের নেতা কর্মী মরেছে একাত্তর পরবর্তীতে, সেজন্য রাষ্ট্র নেই।  রাষ্ট্র খারাপ।  রাষ্ট্র নিপীড়ক।  দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবু রাষ্ট্র নেই।  মূলত, এইসবও বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মতই কল্পনা বিলাস।  এই রাষ্ট্র নেই তত্ত্ব কম্যুনিস্টদের মনোজগত একটি রোমান্টিক ভাবালুতায় ভরে রাখে।  এই কল্পনা কতটা ভাবালু তা টের পাওয়া যায় দুটি ঘটনায়।  এক. বাংলাদেশ বিপ্লবের পরে শেখ মুজিবুর রহমানের গণবিরোধী বাকশাল গঠনের ঘটনায় কম্যুনিস্টদের একটি গোষ্ঠীর সরাসরি অংশগ্রহণ এবং মুজিবুরের সব রকম রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের সহায়ক ভূমিকা পালন করা।  আবার, বর্তমান সময়ে এসে শেখ মুজিবুর রহমান কন্যা শেখ হাসিনার সরকারে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন বিপর্যয় মুহূর্ত তৈরিতে সেই সময়কার নির্যাতিত কম্যুনিস্টদের বর্তমান ভূমিকা।  মানে, জাসদের নেতা কর্মী মরেছে, সেজন্য রাষ্ট্র খারাপ।  প্রগতিশীল মরলে রাষ্ট্র খারাপ।  আর মৌলবাদী মরলে? তাদের কোন কোন বুদ্ধিজীবী বলছেন, প্রয়োজনে লাখ লাখ লোক মেরে ফেলতে হবে, দেশ মৌলবাদমুক্ত করার জন্য।  এইজন্য দেখা যায়, সাতক্ষিরায় বুলডোজার দিয়ে, বাড়ি-ঘর ভেঙে আসামি ধরতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী।  মতিঝিলে প্রকাশ্য জনসমাবেশের উপর সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তার জবাব দিতে হয় না।  রাষ্ট্র ঠিক থাকে, কম্যুনিস্টদের কল্পনায়।  মূলত রাষ্ট্র কোন কালেই ছিল না।  তখনও না, এখনও নয়।

 

৩.

 

শুরুতে রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্রের কথা বলছিলাম।  যার উপরে রবীন্দ্রসঙ্গীত।  কিন্তু বগলে? এই রাষ্ট্রের সাথে আমাদের জান্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।  নাগরিক হিশেবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং অপর নাগরিক হিশেবে (বুদ্ধিজীবীগণ যারে রোমান্টিক অর্থে প্রতিবেশি কহেন) সীমান্তে।  সেই অভিজ্ঞতা কেমন?

 

২০০৮ সালের কোন এক দিন বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর খুনোখুনির প্রতিবাদে একটি লেখা লিখেছিলাম: রবীন্দ্রনাথ ও বিএসএফ এর খুনোখুনি।  সেই সময় আমাকে আন্দোলিত করেছে দুটি তাৎপর্যময় ছবি।  একটি হল ১৮ জুলাই ২০০৮ তারিখে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হান্নান সরকার আর কৃষ্ণপদ দাস এর লাশ।  প্রথম আলো পত্রিকায় তার বিবরণে লেখা ছিল: ‘হান্নানের চাকরীর বয়স ছিল আর চার বছর।  অবসরের পর হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার’।  অন্য ছবিটি হল, বাংলাদেশের সেই সময়কার আলোচিত সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের একটি ছবি, তাঁর স্ত্রী নাজনীন মঈনের সাথে কমলাটে শান্তিনিকেতনী উত্তরীয় পরে শান্তিনিকেতনের গেইটে সাংবাদিকদের সামনে পোজ দিচ্ছেন।  চোখে কালো সানগ্লাস।  প্রথম আলো পত্রিকায় তারও একটি ক্যাপশন দেওয়া হয়েছিল: ‘ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল শান্তিনিকেতন দেখার।  আমার শৈশবের সেই স্বপ্ন পুরণ হলো আজ’।  আপনি চমকে উঠবেন পড়তে পড়তে।  কারণ দুই প্রান্তে দুজনের স্বপ্ন।  পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে, একজনের আশৈশব স্বপ্ন পুরণ হলো অন্যজনের রক্তের দাগের উপরে দাঁড়িয়ে।  আর হান্নান সরকারদেরকে স্বপ্ন দেখার মূল্যই দিতে হয় কয়েকশতবার করে।  একবার সীমান্তে বিএসএফর কাছে জীবন দিয়ে, আর বহুবার দেশীয় শাসক শ্রেণীর কাছে আসামি হয়ে।  কথাটি আমার মনে পড়ে প্রায়ই।

 

এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিডিআরের সতীদাহ ঘটে যায়।  বিডিআর এর নাম বদলে বিজিবি হয়।  বিএসএফ এর সাথে সীমান্তে যৌথ টহল দেয়, চা চক্র করে সেই খুন হয়ে যাওয়া বিডিআর জোয়ানরা।  এবং সর্বসাম্প্রতিক: বিজিবির গুলিতে ‘চোরাকারবারি’ নিহত হওয়ার শিরোনাম।  এইটা ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ এর খুনোখুনির অফিসিয়াল ভাষা, আমরা অতীতে দেখেছি।  র্যাব এর বিনা বিচার হত্যাকাণ্ড ও বিএসএফ এর খুনোখুনির ঘটনাগুলোর সাথে ৬ তারিখের মতিঝিল হত্যাকাণ্ডের অভিজ্ঞতায় এই ফোর্সটিও শেষমেশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগ দিল, বলা যায়।  এইভাবে, হান্নান সরকার আর কৃষ্ণপদ দাসদের কোন ইতিহাস থাকে না আর।  তারা মরে যায় বারবার, রবীন্দ্রনাথ ও বিএসএফ এর খুনোখুনিতে।  আসামি হয়ে।

 

২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর তথ্যমতে, স্রেফ এক দশকেই বিএসএফ এর হাতে নয় শতাধিক বাংলাদেশী খুন হয়।  কোন যুদ্ধপরিস্হিতি নয়, এমনকি পাল্টা-পাল্টি হামলার ঘটনা নয়, স্রেফ গুলি করে খুন।  অনুপ্রবেশ হলে গ্রেফতার করা যায়।  কিন্তু খুন? আন্তর্জাতিক আইন-কাস্টম কোন কিছুই সীমান্ত অনুপ্রবেশে খুনের, গুলির অনুমতি দেয় না।  সভ্য সমাজের কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ এর এই অনায্য খুনোখনি চলে।  এই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোর কোন প্রতিবাদ হয় না, এমন কি তদন্তও হয় না বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।  বরং কোন এক সময়ে বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী নামে এক বাংলাদেশী কিশোরীর একটি লাশ খুন করে বীভৎস অবস্হায় কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার ছবি বিশ্বমিডিয়াসহ বাংলাদেশের সাধারণ্যে আলোড়ণ তুললে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর একটির সাধারণ সম্পাদক ও সেই সময়কার বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারক তাচ্ছিল্যের সাথে সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্ত হত্যা খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।  সীমান্তে এরকম দু চারটি হত্যার ঘটনা ঘটেই।  ফেলানীর ঘটনা নিয়ে মিডিয়া অনর্থক অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে।

 

এতো গেল সরকার এর কথা।  লক্ষ্য করার মতো, উদাসীন বা পরোক্ষ অর্থে হত্যায় সহযোগী সরকার এর অবস্হানের মতোই, বাংলাদেশের পপুলার মিডিয়ায় বিএসএফ এর খুনোখুনির খবর গুম হয়ে যায়।  বাংলাদেশী মিডিয়াতে এইসব খবর এর ধরণ হলো, প্রথমত চেপে যাওয়া, দ্বিতীয়ত, নিতান্তই যদি আসে, তাহলে ‘অভিযোগ পাওয়া গেছে’ ধরণের খবর।  খবরের বিবরণীতে কখনোই আসে না, ‘বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিক খুন’, বরং খবর হলো, ‘খুনের অভিযোগ করা হয়েছে’।  কেউ হয়তো ভেবে মরছে, বাংলাদেশে মিডিয়া সংবাদ প্রকাশের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণের তাগিদেই এমন লিখছে।  কথাটা সঠিক নয়।  সঠিক হলো, বাকি সব বিষয়েই এরা ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কোন প্রাথমিক খোঁজ ছাড়াই কোন এক পক্ষকে আসামি বানিয়ে রায় ঘোষণায় ব্যস্ত থাকে, সংবাদের আড়ালে।

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মতই, আমি এদের রবীন্দ্রমুগ্ধ মিডিয়া বলি।  যারা বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনায় অস্হির।  যেন মনে হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর খুনোখুনিতে বাংলাদেশের আধিপত্যশীল প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াগুলো গুরুতর অংশীদার এবং সে প্রেক্ষিতে যৌথ খুনিও।  এমনকি আপনার মনে হবে যেন এরা বিএসএফ এর মিডিয়া সেলের কাজও করে।

 

৪.

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রবীন্দ্রগ্রহণের আর এক নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা উপমহাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক ও জাত-পাত-বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।  যার সাথে ইনসাফ ও হকের প্রশ্নে এ ভূখণ্ডের মানুষের দীর্ঘকালের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের সম্পর্ক।  হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহ, তিতুমিরের সংগ্রাম, ফরায়েজী ও কৃষক আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, এমন কি বাংলাদেশ আন্দোলনেও এর প্রকাশ আছে।  কিন্তু, হঠকারি শাসকদের ছত্রছায়ায়, ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ হিশেবে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্দরমহলেই আবার এর উত্থান এবং প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।  যার সাথে, আমরা মনে করি, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও সমপ্রসারণবাদের গভীর সখ্য তৈরি হয়ে আছে সাংস্কৃতিকভাবেই।  আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর সাথে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনা তথা ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোতে ইন্ডিয়ান আধিপত্য সম্প্রসারণ ও বজায় রাখার জন্য কৌশলগত রাজনীতির সম্পর্ক ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত।  এই সম্পর্ক ও সখ্যতার রাজনৈতিক পাঠ জরুরি।

 

আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসে এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বাসনায়, হিন্দুত্ব ও বাঙালিত্ব দুটি চরম কর্তৃত্বপরায়ন ডিসকোর্স হিশেবে হাজির আছে।  যেমন আত্মপরিচয় নামের প্রবন্ধে, হিন্দুত্বকেই ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  রবীন্দ্রনাথের এই যে বাসনা, যা একটি সমপ্রদায়ের আত্মপরিচয়, এর দূরতর ফলাফলসহ আরো গভীর ভাবে বলতে গেলে সংস্কৃতি ও রাজনীতির নির্ণায়ক হয়ে ওঠার দাবিদার।  মূলত এই বাসনাতেই ইন্ডিয়ায় হিন্দুত্ব অহিন্দুদেরকে হিন্দু হইতে আকাঙক্ষা প্রকাশ করে।  যখন বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ খুনোখুনি করে, তখন একা বিএসএফ নয়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যার শেষ পরিণতি হিন্দুত্ব, সেই হিন্দুত্ব এসে খুনোখুনি করে।  অপরদিকে, খেয়াল করে দেখুন, বাংলাদেশে বাঙালিত্ব অবাঙালিদেরকে বাঙালি হতে বলে ও সমান অধিকার বঞ্চিত করে।  যেমন বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদী হৈহুল্লোড় ও অবাঙ্গালী পাহাড়ীদের প্রতি রাষ্ট্রের স্হপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি হয়ে যাওয়ার আহ্বান দ্রষ্টব্য, যার ফলে পাহাড়ে অনৈক্যের শুরু।  এই মুহূর্তে এই উভয় শয়তানের ঘোটপাকানি গভীর রাজনৈতিক পাঠের দাবি রাখে।

 

আমরা মনে করি, ইতিহাসে আমাদের সব মুক্তি আন্দোলনে, এবং সর্বশেষ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে গণ-মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপরারপর গন্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম গন্তব্য ছিল এই ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরাজিত করা।  কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতার কারণে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই, আমরা আবার এই ব্রাহ্মণ্যবাদের খাঁচায় ঢুকে পড়েছি।  সীমান্তে খুনোখুনি, নদীর পানি অবরোধ, ভূমি দখল, অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে দাদাগিরি, এইসবের মাধ্যমে মহাভারতের এই নতুন রবীন্দ্রনাথ আবার আমাদের উপরে বর্ণবাদী জমিদার হয়েই বোঝার মতো দাঁড়িয়ে আছেন।  লাঠি দিয়ে শাসন করছেন।  এবং আমাদেরকে এখন, একই সাথে, এই দুই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে।  একজন সীমান্তে খুনোখুনি করে, একজন রাষ্ট্রে জমিদারী করে।

 

৫.

 

কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্ববাদ, যার শিকার এপার বাংলার গরিব হিন্দু-মুসলমান-চাষা-ভূষা সম্প্রদায়ের লোকজন, এবং খোদ ভারতের জনসাধারণ, উভয় কি এক? বা বাংলাদেশের হিন্দু জনসাধারণ, বাংলাদেশের এনজিওমার্কা সুশীল সমাজ যাদেরে সংখ্যালঘু বলে নাগরিক, নাগরিকতা ও অধিকার বিষয়ক আলাপে পদ্ধতিগতভাবে গর-হাজির রেখে বিশেষ দলবাজিতা ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় আধিপত্যবিস্তারের তরফে সুবিধা তৈরি করতে চায়, তাদেরও কি এক করে দেখা হবে? এই বিষয়টা খেয়ালে রাখা জরুরি যে, ভারত তার হিন্দুত্ব নিয়ে বাংলাদেশসহ দুর্বল ও ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের উপর যে আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী ভূমিকায় হাজির, তার সাথে ভারতের জনগণ বা এপার বাংলার হিন্দুদের তরফে কোন প্রাণের যোগ নেই।  ফলত এই আলাপে হিন্দুত্ব এবং ভারত মানে সেই আধিপত্যকামি ভারত রাষ্ট্র, তার সহযোগী এবং নির্মিত আইকনসমূহ।  আর কেহ নহে।

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, এই মুহূর্তে সংখ্যালঘু প্রশ্নকে ঢাল হিশেবে এনে নাগরিক অধিকার প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি করা হচ্ছে।  গত বেশ কিছু দিন ধরে আমরা বাংলাদেশে নাগরিক নিগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের চিত্র দেখেছি, একই সাথে এইটারে স্রেফ সংখ্যালঘু নিগ্রহতে ঢেকে দিতে বাংলাদেশের সুশীল মিডিয়া ও দালাল বুদ্ধিজীবী মহল এর তৎপরতা দেখেছি।  আমরা জানি, এইসব মূলত রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়, রাষ্ট্রের পেটোয়া কর্তৃক নাগরিক অধিকার হরণ ও দলন ছাড়া কিছুই নয়।  সংখ্যালঘু প্রত্যয়ে আমাদের প্রবল আপত্তি আছে।  আমরা বরং এই জায়গায় রাষ্ট্রের এবং নাগরিক সমাজের একটা ক্রিটিক দাঁড় করাতে পারি।  দেশের হিন্দু সমপ্রদায় যে সংখ্যালঘু বই কিছু নহেন, নাগরিক সমাজ বলে ‍তারা যে কল্প কাহিনী রচেন, উহাতে যে ‘শিক্ষিত’ এলিট শ্রেণী ছাড়া গাঁও গেরামের গরিব হিন্দু-মুসলিম কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর কোন স্হানই উনারা দিতে রাজী নহেন, সকলকেই সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়ে গায়েব করে দিতে চান, আমাদের এই জানা কথাটিই সেই সুশীল সমাজ সামপ্রদায়িক মাল-মশলা দিয়া এখানে পরিষ্কার করেন।  এইভাবে রাষ্ট্রের নাগরিক নিগ্রহকে স্রেফ সংখ্যালঘু নিগ্রহতে ভুলিয়ে দিতে চান, আর সরকারের প্রেসনোট প্রচার করে সামপ্রদায়িক রাজনীতিতে বুদ্ধি বিকান তারা, যাহাতে তাদের ভাসুর, মানে শাসক শ্রেণী বেঁচে যায়।  এখানে গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীদের এই সামপ্রদায়িক রাজনীতির শুদ্ধ পরিণাম ‘বড়ই বিভীষণ’।

 

মূলত রাষ্ট্রে কোন সংখ্যালঘু থাকেন না, নাগরিক থাকেন।  একই সাথে পরিষ্কার থাকা জরুরি, সামপ্রদায়িকতার সাথে সংখ্যালঘুত্ব ও সংখ্যাগুরুত্বেরও কোন সম্পর্ক নেই।  সংখ্যাগুরু যেমন, সংখ্যালঘুর ভেতরেও সামপ্রায়িক চিন্তা, তৎপরতা জিইয়ে থাকতে পারে।  এইটার সমাধান সমপ্রদায়ের চিহ্ন মুছে দেওয়া নয়।  কেন, কোন অবস্হার কারণে কোন সমপ্রদায় নিজেদের কম নাগরিক মনে করেন, তা যদি কেবল সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু প্রশ্নে সমাধান করতে চান, তাইলে সামপ্রদায়িক পরিমণ্ডলেই ঘুরপাক খাবেন আপনি।  কারণ, যে কারণে কোন সমপ্রদায় কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে সংখ্যাগুরু, তাদেরকে কোনভাবে সংখ্যালঘু বা অন্তত সমানসংখ্যা বানিয়ে ফেলা সমভব না।  এটুক সাধারণ জ্ঞান।  কেন, কোন অবস্হার কারণে কোন সমপ্রদায় নিজেদের কম নাগরিক মনে করেন, তা মূলত নাগরিক অধিকার প্রশ্নই।  এখানে সমাধান করতে চান না, বিষয়টারে সামপ্রদায়িক ইস্যু হিশেবে জারি রাখতে চান, সেজন্যেই বিশেষ দলবাজ বুদ্ধিজীবী ও গোষ্ঠীর সংখ্যালঘু প্রশ্ন।

 

৮.

 

‘Frankly, our job is to win the war. Part of that is information warfare. So we are going to attempt to dominate the information environment.’

Lt. Col. Rick Long, of the U.S. Marine Corps. He was asked why the military decided to embed journalists with the troops. Postmortem: Iraq war media coverage dazzled but it also obscured, Jeffery Kahn, NewsCenter, 18 March 2004

 

ক্রসফায়ারেরও একটি গল্প থাকে।  কিন্তু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী হত্যার জন্য কোন গল্পের প্রয়োজন নেই।  সব আলো বন্ধ করে একটি ব্লাকআউট হোক।  কোন প্রেসনোট নয়।  মিডিয়া নিজের মত গল্প ও অভিনন্দন বানিয়ে নেবে।  ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়ে এমন কিছু সাংবাদিকের জন্ম ঘটে, যারা এই গল্প বানাবে মার্কিন বাহিনীর হয়ে, এবং মার্কিন বাহিনীর গোপন তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেবে এবং সাথে থাকবে।  পরে কোন এক সময়ে এই ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন মার্কিন সেনা বাহিনীর একজন অফিসার এভাবে, ‘স্পষ্টভাবে, আমাদের কাজ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।  যুদ্ধের অংশ হল তথ্যযুদ্ধ।  তাই, আমরা চেয়েছি তথ্যপ্রবাহে আমাদেরআধিপত্য বজায় রাখতে। ’ বলা বাহুল্য, বিশ্বজুড়ে এই গৃহপালিত সাংবাদিকতা সমালোচিত হয়েছে এবং একই সাথে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়েছে তথ্যপ্রবাহে আধিপত্য কায়েমের উসিলা হিশেবে।

 

বাংলাদেশে মিডিয়া কর্মীরা সংবাদ বলিতে যে বস্তুকে আমাদের সামনে হাজির করেন, আমরা বিভিন্ন লেখায়, এইটাকে গৃহপালিত সাংবাদিকতা বলেছি।  এর বহু উদাহরণ আছে।  আপাতত উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের রিপোর্টিং বা হেফাজত-জঙ্গি কানেকশন সংক্রান্ত রিপোর্ট লক্ষ্য করতে পারেন।  ধরুন, আব্দুল আলিম, বা সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী বা আব্দুল কাদের মোল্লা বা মাওলানা সাঈদীর রায় ঘোষিত হলো।  মিডিয়া কর্মীগণ তৎক্ষণাৎ ছুটে যাবেন আসামির নিজেদের লোকালয়ে।  খুব সহজেই আপনি অনুমান করতে পারবেন, তারা কী দেখাবেন।  যদি রায় হয় ফাঁসির, রিপোর্ট হবে, মিস্টি বিতরণ, উল্লাস, কলঙ্ক মোচন হওয়ায় স্বস্হি, ইত্যাদি।  বেশ কিছু সাক্ষাৎকার থাকবে।  কোন বিপরীত চিত্র নেই।  যদি রায় হয় অন্যকিছু, তাহলে রিপোর্ট হবে, এলাকাবাসির ক্ষোভ।  ফাঁসির দাবি।  কোন বিপরীত চিত্র পাবেন না।  অভিযুক্তদের একজন আব্দুল আলিমের রায়ের পর একটি পপুলার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নিউজ দেখছিলাম।  আলিমের এলাকায় কোন এক প্রতিবেদক গিয়েছেন।  তো, সংবাদ পাঠক বেশ কিছুক্ষণ ঢাকার বর্ণনা দেওয়ার পর, সেই রিপোর্টারের কাছে ফোন করলেন।  জিজ্ঞেস করলেন, এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া কী।  রিপোর্টার আমতা আমতা করতে লাগলেন।  বিরক্ত হয়ে সংবাদ পাঠক ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, বলছিলাম, এলাকাবাসী রায় মেনে নিয়েছে? বিপরীত পাশ থেকে ফোনে শুধু একটি বাক্য বলা হল: না।  এলাকাবাসী ফাঁসি চায়।  এই পাশে তারপর আবার বর্ণনা শুরু হল, হাঁ, যা বলছিলাম, আলিমের নিজ এলাকার মানুষজনও এ রায় মেনে নিতে পারে নাই।  তারা আলিমের ফাঁসি চেয়েছে।  আপিলে হলেও যাতে ফাঁসি হয়, এইজন্য সরকারের কাছে ওরা জোর দাবি জানিয়েছে।  এখন, কথা হলো, সমাজে বা দেশে কি এদের সমর্থক একজনও নেই? ওদের কণ্ঠস্বর মিডিয়ায় না আসলে, এইটা কীভাবে এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া হতে পারে? অথবা এরকম কোন কণ্ঠস্বর না থাকলে, বাংলাদেশে তো নির্বিঘ্নে এই বিচার সম্পন্ন হতে পারতো।  সাঈদির রায়ের পর এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে এতগুলো মানুষ মরত না।  এইবার দেখুন আর একটি চিত্র।  সর্বসমপ্রতি চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় একটি বিস্ফোরণ ঘটে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, এটি আইপিএস ও বিদ্যুৎঘটিত বিস্ফোরণ।  একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আমাদের জানাচ্ছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদলও নিশ্চিত করেছে, বিস্ফোরণে আহত ছাত্রদের একজনের শরীরেও গ্রেনেড বা বোমায় ব্যবহার করা কোন উপাদান মেলেনি।  সব পপুলার মিডিয়া কিন্তু এই তথ্যটি এড়িয়ে গেছে।  প্রকাশ করেছে স্রেফ বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণ বা বিস্ফোরক উদ্ধার ইত্যাদি সরকারি প্রেসনোট।  যাই হোক, এর ফলশ্রুতিতে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক গ্রেফতার হন।  একটি পপুলার নিউজ পোর্টাল শিরোনাম করল, ‘সাকার ‘সহযোগীর’ আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিলেন মুফতি হারুন’।  নিউজের ভেতরে পড়ুন: ‘ইছাপুর গ্রামের জানালী চৌধুরী বাড়ি হারুনের শ্বশুরবাড়ি।  যে ঘর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা তার শ্বশুর মুফতি হাবিবুর রহমানের।  মুফতি হাবিব হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং চট্টগ্রামের নাজিরহাট মাদ্রাসার শিক্ষক।  ওসি মহিউদ্দিন বলেন, ‘মুফতি হাবিব বাড়িতে ছিলেন না।  আসলে জ্যাঠাশ্বশুর আবদুর রহমানের আশ্রয়েই ছিলেন হারুন। ’ তারপরে সালাহউদ্দিন চৌধুরী বৃত্তান্ত।  রিপোর্টের ভেতরে আবার সাব হেডিং: ‘শ্বশুর বাড়িতে আত্মগোপনে। ’ হারুনের আত্মসমর্পনের বিবরণ এরকম: ওসি মহিউদ্দিন বলেন, ‘ঘরের ভেতর ফ্যান চলছিল।  অবস্হান নিশ্চিত হওয়ায় আমরা প্রায় ৪৫ মিনিট বাইরে অপেক্ষা করি।  তারপর একসময় মুফতি হারুন নিজেই দরজা খুলে দেন। ’ দরজা খোলার পর জিজ্ঞাসা করলে মুফতি হারুন নিরুত্তাপভাবেই নিজের পরিচয় দেন বলে পুলিশ জানায়।  মিডিয়াতে এই পুরো রিপোর্টের শিরোনাম হল, সাকা সহযোগীর আশ্রয়ে ছিলেন হারুন এজহার।  এই রিপোর্ট বের করার জন্য মিডিয়াটিকে বহুত ইতিহাস ঘেঁটে, যুক্তিবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে, হারুন এর শ্বশুর বাড়িতে থাকা মানে, সাকার সহযোগীর আশ্রয়ে থাকা।  এই যুক্তিবিদ্যার নামই এমবেডেড জার্নালিজম, মানে গৃহপালিত সাংবাদিকতা।  বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দমন এবং দলবাজিতাকে বৈধতা দানের হাতিয়ার হিশেবে ব্যবüত হয় এইসব সাংবাদিকতা।

 

সচেতন মহল মনে করেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে যে অসহিষ্ণুতা ও ফ্যাসিজম গেঁড়ে বসেছে, তারও উসকানিদাতা এই গৃহপালিত সাংবাদিকতা।  মিডিয়া কীভাবে ফ্যাসিজম এর বিস্তার ঘটাতে পারে, এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ শাহবাগ ও তার প্রতিক্রিয়া।  ২০১৩ সালের এক করুণ সময়ে মিডিয়া ‘ধরে ধরে জবাই’ শ্লোগান প্রচার করেছে, শাহবাগ থেকে, লাইভ, প্রায় ২৪ ঘণ্টাই।  এর কয়েক দিনের মধ্যেই নাগরিকদের ভেতরে যে ফ্যাসিজমের বিস্তার ঘটেছে, তার বলি হয়েছেন অনেক শাহবাগের পক্ষের এবং বিপক্ষের লোক।  যেমন ব্লগার রাজিব।  ফাঁসি চাই ও ধরে ধরে জবাই এর প্রচার যদি ফ্যাসিজম এর প্রসার ঘটায়, তাহলে শাহবাগ এর পক্ষের রাজীবই কেন এর প্রথম ‘শহীদ’ হল? ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো বাদ দিলে, সহজ উত্তর হলো, ফ্যাসিবাদের চর্চা পাল্টা ফ্যাসিবাদ তৈরী করে।  যখন পাল্টা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে, তখন এই উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।  তারা কারো না কারো পক্ষ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে।  রাজীব এই যুদ্ধের অসংখ্য অতীত ও ভবিষ্যৎ কোরবানীর একটি উদাহরণ মাত্র।  অনবরত উসকানি ও জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে এমন একটি না ফেরার পরিস্হিতি তৈরি করে দেওয়ার জন্য ইতিহাসের আসামি হয়ে থাকবে এই গৃহপালিত সাংবাদিকতা।

 

৯.

 

রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তপনার সাথে মিডিয়ার যোগসাজসের কথা বলেছি।  এই ঘটনার সুদূরপ্রসারি ফলাফল কেমন, একটু ভেবে দেখা জরুরি।  সাম্প্রতিক সময়ের একটা পপুলার প্রপঞ্চ নিয়ে আলাপ করলে বিষয়টি বোঝা যাবে।  পুলিশ হেফাজতে জবানবন্দী, বিবৃতি, মুচলেকা- এইসব এখন আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অনিবার্য ও সাধারণ ঘটনা।  এক-এগারর কুশিলবগণ আমাদের রাজনীতিতে যেসব প্রপঞ্চকে স্বাভাবিক ভাব দিয়ে হাজির করেছেন, তার মধ্যে রিমাণ্ডে অমানুষিক নির্যাতন যেমন, এটিও একটি।  কিছুদিন আগে যেমন জোনায়েদ বাবুনগরী, এক-এগারর সময় দেখা যেত মরহুম জলিল, ওবায়দুল কাদের বা এরকম আরো নানান জবানবন্দী রীতিমত প্রতিদিন ফলাও করে প্রচার হত মিডিয়ায়।  মনে আছে, স্রেফ একটা পত্রিকা, এইসব রগরগে কাহিনী প্রচার থেকে বিরত থাকত সেই সময়।  ঘোষণা দিয়ে বিরত ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক নিজেই।  তবে, এক-এগারতেই এইসবের শুরু নয়, এর আগেই আমাদের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটে গেছে চরম আকারে।  যার কারণে এক-এগার আসে, বা বাকশাল আসে স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষের এমন একটি যুদ্ধের পরপর।  পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর নামে একটি বই পড়ছিলাম।  বইটিতে আইয়ুব খানের সময়ে একটি গ্রেফতার ও কারাগারে এমন একটি বিবৃতি বা জবানবন্দীর কাহিনী বলেছেন তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা দৈনিক ইত্তিফাক পত্রিকার মালিক সম্পাদক মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।  কারা কর্তৃপক্ষ একটি লিখিত বিবৃতি এনে দেয় মানিক মিয়ার হাতে, তিনি যাতে বিবৃতিতে সই করেন।  মানিক মিয়ার ভাষায়: ‘আমি এক নিঃশ্বাসে বিবৃতিটি পড়িয়া লইলাম।  আলোচ্য বিবৃতির ভাষায় কিছুটা নম্রতা থাকিলেও ইহা একটি বণ্ড বা মুচলেকা।  আমি ইহা সই করিতে অস্বীকৃতি জানাইলাম। ’ পরদিন আর একটি বিবৃতি আনা হয় তার সম্মুখে।  তিনি সেটিও সই করতে অস্বীকার করেন।  আরো কয়েকদিন পরে তিনি মুক্তি পান।  এইটা হল, সেই সময়ে মানসিক টর্চারের সর্বোচ্চ নমুনা।  কোন শারীরিক টর্চার বা অবমাননামূলক আচরণের কথা মানিক মিয়া উল্লেখ করেন নাই।  তবে তাঁর গ্রেফতারের ঘটনার একটি কাহিনী বলেছেন মানিক মিয়া।  গ্রেফতার করতে আসা অফিসারের নিকট তার সদ্য ব্যারিষ্টার পাশ পুত্র মঈনুল হোসেন হিরু গ্রেফতারী পরওয়ানা চেয়েছেন।  পুলিশ অফিসার তাকে দেশরক্ষা আইনের ৩২ ধারা মোতাবেক গ্রেফতারি পরওয়ানা দেখালেন।  ইতিহাসের এই ঘটনার বহুদিন পর, ২০০৮ সালে এই মঈনুল হোসেন এবং তার সতীর্থগণ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যে গণগ্রেফতার শুরু করলেন, তাতে না কোন পরওয়ানা ছিল, না ছিল কোন মর্যাদাকর আচরণ।  রিমাণ্ডে অমানুষিক নির্যাতনের যে রেওয়াজ শুরু করলেন, তাতে দুটি বিষয় বেরিয়ে পড়ল।  এক. রাজনীতিবিদগণের যে মারাত্মক দুবর্ৃত্তায়ন ঘটেছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল তাদের অনৈতিক, তোষামোদিপূর্ণ, সুবিধাবাদী ও মেনিমুখো আচরণে।  দুই. নির্যাতনের অপার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দুয়ার উন্মুক্ত হলো তাদের বরাতে।  সে আপনি রিমাণ্ডে বলুন, আর জন-সমাবেশে গুলি ও হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে বলুন, সকল প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা ও ভব্যতার রীতি লঙঘন।  এইসব এখন যে কোন ক্ষমতাসীন দলের জন্য সহজ ও স্বাভাবিক ঘটনা হিশেবে দাঁড়িয়েছে।  সেইদিন মতিঝিলে অপারেশন ফ্লাশ আউট এমনি এমনি ঘটে নাই।  এই লম্বা পর্যালোচনার কারণ হলো একটি সতর্কতা।  সেটি হলো, এখন যারা এই রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে সামনের সারিতে বসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও গ্যালারিতে বসে বাহবা দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে তারাও এইসবের শিকার হবেন।  তবে এইভাবে নয়, আরো নির্মম জিঘাংসায়, আরো ভয়াবহ অভিজ্ঞতায়।  যারা ইতিহাস খেয়াল রাখেন এবং এর পাঠ করেন, তারা এ ব্যাপারটি বুঝতে ভুল করবে না।  সেই সব নির্মমতা ও জিঘাংসার দায়ও আজকের এই হত্যা-রিমান্ড এর নায়কদেরই নিতে হবে তখন।  কেউ দায় এড়াতে পারবে না।  ইতিহাস তাদের আসামি করবে।

 

১০.

 

বাংলাদেশে এই মুহূর্তের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় যুদ্ধাপরাধ বিচার, অভিযুক্তদের ফাঁসি, শাহবাগ, হেফাজত, বিএনপির জামায়াত সংস্রব, জামায়াত নিষিদ্ধ, জঙ্গি ইসলাম এইসব।  আমরা সব সময়ই যুদ্ধাপরাধ বিচার ব্যবসাসহ এই সব বিষয়গুলোর ভোক্তা হওয়ারে প্রশ্ন করেছি।  আমরা বলি, এইসব উপরি ভণিতা মাত্র।  মূলত ধর্মীয়, পার্টিকুলার অর্থে ইসলামি রাজনীতির শক্তি ও  তাকে মোকাবেলার অক্ষমতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা হিশেবে দেখি এইসব প্রপঞ্চগুলোকে।  পাশাপাশি আছে, এইসবকে অবলম্বন করে দলবাজ রাজনীতি জারি রেখে ক্ষমতার দখল বজায় রাখা।  দেখুন, হাইকোর্টে জামায়াত রাজনীতির প্রসঙ্গে আলাপে আসে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সাথে রাষ্ট্রীয় বা জনগণের সার্বভৌমত্বর বিরোধ প্রশ্ন।  প্রশ্নটি থিওলজির।  এই থিওলজির বাদশাহ গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র।  স্বয়ং আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জেরা করেছেন উকিল সাহেবান, হাইকোর্টে।  আমি বলি, রাষ্ট্রের ধর্ম ও খোদা হয়ে ওঠা।  যদিও এইসবই বাংলাদেশ জামায়াত বহুদিন আগে সংশোধন করে নিবন্ধন শুদ্ধ করে নিয়েছিল কমিশনের ইচ্ছেমত, তানিয়া আমীর এর মতে, যে গঠনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলামিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল নিবন্ধনের অযোগ্য।  তাই নিবন্ধনের পর ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুযোগ নেই।  গুড।  তাহলে প্রশ্নটা কী? জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষের এডভোকেটদের একজন একটি প্রথম সারির পত্রিকায় লিখছেন, জামায়াতের মনে মনে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের প্রতি এই অবজ্ঞা আছে।  মওদূদীর লিটারেচার পাঠ করলে বোঝা যায়।  হাহ।  দারুণ এক ঘেরাটোপে বসে আমাদেরকে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পাঠের অপেক্ষা করতে হবে।  হাইকোর্ট নিশ্চয় আরো নিবিড় মনোপাঠ নেবে!

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনকালীন বিরোধিতার জন্য জামায়াতসহ অপরাপর দলগুলো নিষিদ্ধ হতে পারত।  এইসবের একটা মীমাংসা ৭১ পরবর্তী সময়ে করে ফেলা সমভব ছিল, ২০১৪ সাল পর্যন্ত এর ঘানি না টেনে।  কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের বিরোধিতা ও পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার যে অভিযোগ, তার ধারে কাছে না গিয়ে ধর্মভিত্তিক দল হিশেবে জামায়াতসহ চারটি দলকে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রি-কনস্টিটিউশনাল স্টেজে।  যার ইফেক্ট ছিল কনষ্টিটিউশন গঠনের আগ পর্যন্ত।  পরে ৭২ এর সংবিধানে ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক তৎপরতার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।  যার ফলে এই সংগঠনগুলো নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই যে কোন রকম রাজনৈতিক তৎপরতার অধিকার হারায়।  সেই সময়ে যদি সামপ্রদায়িক রাজনীতি নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অভিযোগে জামায়াতসহ অভিযুক্ত দলগুলোর বিরুদ্ধে কোন উদ্যোগ নেওয়া হত, সাংবিধানিক ভাবেই, জিয়াউর রহমান এর বহুদলীয় গণতন্ত্রে কখনোই জামায়াত নামে কোন রাজনৈতিক দলের ঠাঁই হতো না।  মূলত সেই সময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের সেরকম কোন আগ্রহ ছিল না, তারা এইটারে কেন্দ্র করে দীর্ঘ মেয়াদী দলবাজ রাজনীতির ফায়দা লুটায় তৎপর ছিল।  জামায়াত যেমন জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্র ও ধর্মীয় রাজনীতির উপর বিধি নিষেধ তুলে দেওয়ার সুযোগে বাংলাদেশে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে, সেই একই কথা আওয়ামী লীগের ব্যাপারেও সত্য।  শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল অপরাপর সব রাজনৈতিক দল এর মত আওয়ামী লীগেরও বিলুপ্তি ও নিষিদ্ধ করেছিল।  জিয়ার বহু দলীয় গণতন্ত্র বা পঞ্চম সংশোধনী শেখ মুজিবুর রহমানের কবরগাহ থেকে সেই আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জ্বীবিত করেছে, এইটা ভুলে গেলে চলবে না।

 

এইটাতে একটা বিষয় স্পষ্ট।  ৭১ সালের পর জামাতের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে রাজনৈতিক নেতা বুদ্ধিজীবী কারো ন্যূনতম মাথা ব্যাথা ছিল না।  বরং মাথা ব্যাথা ছিল, কীভাবে বাংলাদেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামগন্ধি রাজনৈতিক তৎপরতা তাড়ানো যায়।  সেই কারণেই তাড়াহুড়ো করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও সুনির্দিষ্টভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এই দলটির বিষয়ে কোন অভিযোগ বা সিদ্ধান্ত আসে নাই।  বরং সেই একই বিষয়কে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি- সবাই।

 

এই মুহূর্তে জামায়াত নিষিদ্ধ প্রশ্নটি আইনের দৃষ্টিতে বেশ জটিল।  কারণ, ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে তাদের রাজনীতির যে ভিত্তিমূল তৈরী হয়েছে বাংলাদেশে, তাকে স্রেফ কোলাবরেশন বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা দিয়ে বিচার করে শেষ করা যাবে না।  যে কোন অপরাধ অপরাধই।  তার বিচারের প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি এটাও সত্যি, কর্মীদের কোন অপরাধের জন্য দল নিষিদ্ধের নজির নেই ইতিহাসে।  আবার, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতার প্রশ্ন যদি আনা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা তাদের দলীয় এজেন্ডা হিশেবে হাজির নেই এখন এবং কখনোই ছিল না।  বরং তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বলে অপরাপর সব রাজনৈতিক দলের মত, অন্তরে যাই থাক।

 

মূলত ইতিহাসের যাবতীয় অমীমাংসা, রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও গণতন্ত্র প্রশ্নে পার্টিজান বুদ্ধিজীবীতা বাদ দিয়ে জরুরি রাজনৈতিক-দার্শনিক আলাপকে এগিয়ে নেওয়া দরকার।  যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি অবজেক্টিভ পর্যালোচনা দাঁড় করানো যায়।  এর নৈতিক হিম্মতের জন্য দরকার বাংলাদেশ বিপ্লবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো।  আওয়ামীলীগ-বিএনপির লুটপাটের রাজনীতি, এমনকি যে কোন রকম যুদ্ধাপরাধ বিচার রঙ্গেরও বিরুদ্ধে থাকতে হবে আপনাকে।

 

যে কোন বিচারের জন্য একটি নৈতিক অথরিটি দরকার।  সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ এর পূর্ণ প্রতিষ্ঠাই একমাত্র পারে বাংলাদেশে রাষ্ট্রগঠনকালীন যাবতীয় অমীমাংসার বিচার করতে।

 

১১.

 

উপরে যেইসব আলাপ করলাম, সেই আলাপগুলো এই বইতে বারবার আসবে, যখন আপনি পড়তে থাকবেন, প্রায় সব লেখাতেই।  কারণ এই লেখাগুলো ইতিহাসের ভেতরে বসে, ইতিহাসের নামতা গুণতে গুণতে, সেই ভ্রমণের অংশ হিশেবেই লিখিত হয়েছে।  ফলত এইসব লেখা ইতিহাসের সাথে লেখকের ডায়লগ ও বোঝাপড়ার অংশ, যা বেশির ভাগই কোন বড় রকমের সম্পাদনা বা মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই এই বইতে প্রকাশিত।  যদ্দুর সমভব হয়েছে, আমি লেখাগুলোতে রচনার তারিখ উল্লেখ করেছি, আমার বোঝাপড়ার ক্রমধারা ধরতে পারার জন্য।  এর বেশির ভাগই সামহোয়ারইনব্লগ, ফেসবুক এবং কোন কোনটা বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের অপিনিয়ন পাতায় পূর্ব প্রকাশিত।

 

এই লেখাগুলো সংকলন এবং সম্পাদনার কাজে আমাকে মূল্যবান পরামর্শ ও সময় দিয়ে সহযোগিতা করে ঋণী করেছেন অনুজ বন্ধু মেহেদি হাসান।  হারুন আল নাসিফ, অগ্রজ হিশেবে আমার বইয়ের বানান ও বাক্য-বিভ্রাট দেখে দিয়েছেন।  তারঁ ঋণ শুধবার নয়।  এই বই একই সাথে আমার বেড়ে ওঠা এবং বন্ধুদের সাথে আমার সম্পৃক্ততা, সংলাপ ও ঝগড়ার বয়ানও।  তাদের কাছেও আমার ঋণ অপরিসীম।

 

সর্বশেষ শফিক শাহীন, প্রকাশক, তিনি এই বইটি প্রকাশের ঝুঁকি নিয়েছেন।  তার জন্য অপরিসীম শুভ কামনা।  তিনি না হলে বইটি এ মুহূর্তে প্রকাশের সমভাবনা ছিল খুব কম।  এ বই প্রকাশের শতভাগ কৃতিত্ব শফিক শাহীনের।

 

 

বিনীত। রিফাত হাসান, চট্টগ্রাম। ফেব্রুয়ারি ২০১৪

 

ফুটনোটস:১. ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রণিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও এই প্রশ্ন ও অভিমুখের শরণ নেওয়া হয়েছে। দ্রষ্টব্য: ‘আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থ, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ রূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম।..’২. ‘হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম। ইহা মানুষের শরীর মন হৃদয়ের নানা বিচিত্র ব্যাপারকে বহু সুদূর শতাব্দী হইতে এক আকাশ, এক আলোক, এক ভৌগোলিক নদনদী অরণ্য পর্বতের মধ্য দিয়া, অন্তর ও বাহিরের বহুবিধ ঘাতপ্রতিঘাতপরম্পরার একই ইতিহাসের ধারা দিয়া আজ আমাদের মধ্যে আসিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছে’। আত্মপরিচয়: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩১৯। এই জাতিগত পরিণাম ও হিন্দুত্বের রূপ কেমন, তা বুঝতে আবুল মনসুর আহমদের আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর থেকে উদ্ধৃতি দিই: ‘ঐক্যবাদী মুসলিম নেতৃত্ব ও ঐক্যবাদী হিন্দু-নেতৃত্বের মধ্যে একটা মৌলিক বিরোধ ছিল। মুসলিম নেতৃত্ব চাহিয়াছিলেন দুই স্বতন্ত্র সত্তার মধ্যে রাজনৈতিক মিলন বা ফেডারেশন। পক্ষান্তরে হিন্দু-নেতৃত্ব চাহিয়াছিলেন সার্বিক মিশ্রণ বা ফিউশন।… অধিকাংশ হিন্দু নেতা চাহিতেন.. মাইনরিটি মুসলমান সমাজ বিপুল বেগবান হিন্দু সম্প্রদায়ে ‘হইবে লীন’। যেমন ক্ষুদ্র জলাশয়ের জল মহাসমুদ্রে লীন হয়। এটাকে তাঁরা অন্যায় বা অস¤ভব মনে করিতেন না। ধর্মে পৃথক হইয়াও যখন ব্রাক্ষ্ম-খৃষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন-পার্শি-গুর্গা-শিখেরা মহান হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকিতে বাধে নাই, তখন মুসলমানের বাধিবে কেন? … ‘আর্য্য-অনার্য্য শক-হুন’ যে ভাবে ‘মহাভারতের সাগরতীরে’ ‘লীন’ হইয়াছিল, মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দু সমাজে লীন হইয়া যাউক। তাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, ‘হিন্দু-মুসলমান’ হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দু-সভার জনতার মত ছিল না, বিশ্ব-কবি রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল।’ (কালতামামি, এগারই অধ্যায়, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ।)

এবার আসা যাক, রাজনৈতিক অধিকার প্রশ্নে ভারতীয় কাম হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই ‘লীন’ সম্প্রদায়কে কীভাবে জায়গা দিতে চান? ‘মুসলমানদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে নেতাদের বিভিন্ন যুক্তির উত্তরে ডাঃ বিধান রায় তাঁর স্বাভাবিক কাট-খোট্টা ভাষায় বলিলেন: তা হলে মুসলমানদের কথা এই, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে যাব না, কিন্তু চাকরিতে অংশ দাও।’ পাল্টা জবাবে উস্তাদ স্যার আবদুর রহিম সংগে-সংগে উত্তর দিলেন: তা হলে হিন্দুদের কথা এই, ‘চাকরিতে অংশ দিব না, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে আস।’ সবাই হাসিয়া উঠিলেন। অতঃপর সার আবদুর রহিম সিরিয়াস হইয়া বলিলেন: ‘লুক হিয়ার ডাঃ রায়। ইউ ফরগেট দ্যাট ইউ হিন্দুয হ্যাভ গট অনলি ওয়ান এনিমি দি বৃটিশার্স টু ফাইট, হোয়ারআয উই মুসলিমস হ্যাভ গট টু ফাইট থ্রি এনিমিয: দি বৃটিশার্স অনদি ফ্রন্ট, দি হিন্দুয অন দি রাইট এন্ড দি মোল্লায অনদি লেফট।’ কথাটা আমি জীবনে ভুলিতে পারি নাই।’- (প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা, চৌথা অধ্যায়, প্রাগুক্ত)

 

Leave the first comment